ঢাকার মহাখালীতে ব্র্যাক সেন্টারে পা রাখতেই দেখা গেল এক ঝাঁক শিশু ঘিরে রেখেছে কার্টুনিস্ট সাইয়েদ রাশাদ ইমাম তন্ময়কে। তাদের দাবি, তন্ময়কে একটা বেডরুম এঁকে দেখাতে হবে।
বাচ্চাদের এ দাবি রাখতে মার্কার নিয়ে হোয়াইটবোর্ডে একটা বেডরুমের ছবি আঁকতে শুরু করলেন তন্ময়। এদিকে বাচ্চারা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে তার মার্কারের গতিবিধি দেখছে।
তন্ময় প্রথমে এক ঝটকায় একটা লম্বা আয়তক্ষেত্র আঁকলেন। তারপর তার মাঝে আড়াআড়িভাবে আরও একটা ছোট আয়তক্ষেত্র এঁকে বাচ্চাদের উদ্দেশে বললেন, “এটা কীইইইই?”
বাচ্চারা তার প্রশ্নে সাড়া দিয়ে হাত-পা নাচাতে নাচাতে সমস্বরে জানালো, “বালিইইইইইশ…”
তন্ময়কে আবার বলতে শোনা গেলো, “এটা তবে কী?” এবং আবারও ধ্বনিত হলো, “লাইইইইইটটট…”
এদিন এভাবেই এক ঝাঁক শিশুর বর্ণিল উপস্থিতিতে মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টারের প্রাঙ্গণ। তাদের কেউ কেউ লাফিয়ে লাফিয়ে সংখ্যা শিখছে। কেউ কেউ দুলছে দোলনায়। কেউ ধ্যানমগ্ন হয়ে রঙ তুলির আঁচড়ে ছবি আঁকছে। কেউ আবার কাঁদা-মাটি দিয়ে হাতি, ঘোড়া বানাতে ব্যস্ত।
অনেকে আবার তন্ময় হয়ে দেখছে জাদুকর আসিফ আসগরের ম্যাজিক-শো।
‘খেলার জগৎ গড়ি’ শীর্ষক একটি ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট (ব্র্যাক আইইডি) তাদের ‘প্লে-ল্যাব’ মডেলটিকে ঘিরে এই অনুষ্ঠান হয়; সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিভিন্ন বয়সী শিশুদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবক ও পরিচর্যাকারীরাও এতে অংশ নেন।
খেলার মধ্য দিয়ে শিশুদের শেখানোর উদ্দেশে ব্র্যাকের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং প্রাক-শৈশব উন্নয়ন (আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট) প্রোগ্রামের অন্যতম প্রধান অংশীদার ডেনমার্কভিত্তিক লেগো ফাউন্ডেশনের ৯০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে এর আয়োজন করা হয়।
উৎসবে কার্টুনিস্ট সাইয়েদ রাশাদ ইমাম তন্ময় এবং জাদুকর আসিফ আসগর ছাড়াও শিশুদের সঙ্গে নানা ধরনের খেলায় তরুণ কার্টুনিস্ট ও শিল্পী মোর্শেদ মিশু এবং ‘মাসু আঁকে’ খ্যাত মাসুদা খান অংশ নেন।
মোর্শেদ মিশুর সঙ্গে কথা হলে জানান, তিনি বর্ণের মাধ্যমে ছবি আঁকবেন।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “বাচ্চাদের তো পিএইচডি লেভেলের পড়াশুনা করার দরকার নাই। বরং ওদের এমনভাবে শেখানো উচিত যার সাথে ওরা কানেক্ট করতে পারবে। কারণ মুখস্থ জিনিস মনে থাকে না। যেটা মানুষ আনন্দ নিয়ে শেখে তা সে কখনও ভুলে না।”
তিনি মনে করেন যে এরকম ‘ইন্টারঅ্যাকটিভ ও কমিউনিকেটিভ’ ধারায় যদি বাচ্চাদের শৈশবটা গড়ে তোলা যায়, তাহলে সেই বাচ্চারা বড় হয়ে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে আর হিমশিম খাবে না।
ঢাকার বনশ্রীর ৪টি প্লে-ল্যাবের প্রোগ্রাম অর্গানাইজার ইসরাত জাহান বলেন, “আমরা লক্ষ্য করেছি যে যদি একটা শিশুকে জীবনের প্রথম ধাপেই খেলার মধ্য দিয়ে না শেখানো হয়, তবে বড় হয়ে তার মাঝে জড়তা বেশি দেখা যায়। কিন্তু খেলতে খেলতে শিখলে তা আর হয় না।”
বাংলাদেশে ব্র্যাকের নিজস্ব প্লে-ল্যাব কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে এ পর্যন্ত ৯টি জেলার ৩২টি উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪০০টি প্লে-ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে; ২৫ হাজারের বেশি প্রাক-প্রাথমিক শিশু খেলার মাধ্যমে শেখার সুযোগ পাচ্ছে।
এসব প্লে-ল্যাব স্থাপনে ব্র্যাকের কারিগরি সহায়তায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করছে। বাংলাদেশে উদ্ভাবিত এই মডেলের আন্তর্জাতিক প্রসারেও কাজ করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে ব্র্যাকের নিজস্ব পরিচালনায় বাংলাদেশ, উগান্ডা ও তানজানিয়ায় ৬৫৬টি প্লে-ল্যাবে মোট সাড়ে ১১ হাজার শিশু অংশ নিয়েছে।
এগুলোতে মূলত এক থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের খেলতে খেলতে শেখানো হয়। তাদের সহায়তা করেন প্রশিক্ষিত ‘প্লে-লিডার’ অর্থাৎ শিক্ষকরা।
বুধবরের অনুষ্ঠানে শিশুরা মাটি দিয়ে পুতুল তৈরি, ছবি আঁকা, ছবিতে শেখা, মাপেট খেলা (কাপড়ের পুতুলের সঙ্গে কথা বলা), শব্দ ও সংখ্যা তৈরি প্রভৃতি নানা ধরনের খেলায় অংশ নেয়। পাশাপাশি তাদের জন্য মোরগ লড়াই, বৌ ধরা, লুকোচুরিসহ আবহমান বাঙালি এবং বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির বিভিন্ন খেলার একটি গবেষণামূলক প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হয়।
অনুষ্ঠানে ব্র্যাক আইইডি এর নির্বাহী পরিচালক এরাম মারিয়াম এবং লেগো ফাউন্ডেশন সিনিয়র প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ক্রিস্টিন মর্শ উপস্থিত ছিলেন।