“এই রায় যদিও ফাহিমকে ফিরিয়ে দেবে না, তবুও মর্মান্তিক এ ক্ষতিতে তার শোকার্ত পরিবারের জন্য সান্ত্বনা যোগাবে,” বলেন ম্যানহাটান ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি।
Published : 12 Sep 2024, 08:31 PM
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত তরুণ উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহকে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহটনের অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী টাইরিস ডেভন হসপিলকে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
মঙ্গলবার নিউ ইয়র্কের সুপ্রিম কোর্ট জুরি ২৫ বছর বয়সী হসপিলের এই সাজার আদেশ দেয় বলে ম্যানহটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস জানিয়েছে।
বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পাঠাওয়ের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম জোবাইক ও নাইজেরিয়া মোটরবাইক রাইড সেবা গোকাডারও প্রতিষ্ঠাতা। ২০২০ সালের ১৩ জুলাই ম্যানহটনের লোয়্যার ইস্ট সাইডে নিজের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হন তিনি। হত্যার পর তার লাশ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরা হয়।
ওই ঘটনায় তার সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী হসপিলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলার বিচারে নিজেকে নির্দোষ দাবি করলেও হসপিলকে গত ২৪ জুন দোষী সাব্যস্ত করে আদালত।
ম্যানহটন ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির অফিস বলছে, হসপিলকে ২০১৮ সালের মে মাসে সহকারী হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন ফাহিম। তার আর্থিক বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব পেয়েছিলেন হসপিল। আর্থিক নথিপত্রগুলো নিয়েও তিনি কাজ করছিলেন।
কিন্তু বান্ধবী ম্যারিন চ্যাভেজের বিলাসী জীবনযাপনের অর্থ যোগান দিতে ২০১৮ সালের পর ফাহিমের বড় দুটি প্রকল্প থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ চুরি করেন হসপিল। এরপর বিভিন্নভাবে আরও কিছু জালিয়াতির মাধ্যমে সব মিলিয়ে ফাহিমের ৪ লাখ ডলার সরিয়ে নেন।
২০১৯ সালের মে মাসে হসপিলকে চাকরি থেকে বাদ দেন ফাহিম। পরে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে চুরির একটি ঘটনা তিনি ধরে ফেলেন। তারপরও আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে হসপিলকে সেগুলো কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ দেন ফাহিম। কিন্তু অর্থ আত্মসাতের অন্য ঘটনাগুলোও ফাঁস হওয়ার ভয়ে ফাহিমকে হত্যার পরিকল্পনা করেন হসপিল।
ম্যানহটনের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি অ্যালভিন এল ব্র্যাগ বলেন, “একজন উদার, দয়ালু ও বিশ্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলা ফাহিম সালেহকে হত্যা ও মাথা বিচ্ছিন্ন করার মত নৃশংস ঘটনায় টাইরিস হসপিলকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয়েছে। অর্থ চুরির পরও ফাহিম তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছিলেন।
“এই রায় যদিও ফাহিমকে ফিরিয়ে দেবে না, তবুও মর্মান্তিক এই ক্ষতিতে তার শোকার্ত পরিবারের জন্য সান্ত্বনা যোগাবে বলে আশা করি।”
কী হয়েছিল সেদিন
ফাহিম সালেহর জন্ম ১৯৮৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সৌদি আরবে। সে সময় সেখানেই থাকতেন তার বাবা আহমেদ সালেহ। পরে তারা যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। নিউ ইয়র্ক সিটির অদূরে পোকিপসিতে থাকতে শুরু করেন।
তরুণ ফাহিম ২০১৮ সালে মোটর সাইকেলকে ট্যাক্সির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করতে নাইজেরিয়ায় ‘গোকাডা’, মালয়েশিয়ায় ‘জোবাইক’ এবং ঢাকায় ‘পাঠাও’ রাইড সার্ভিস চালু করেন। ম্যানহাটানভিত্তিক ভেঞ্চার ক্যাপিটল ফার্ম ‘অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটল’ এর প্রতিষ্ঠাতা-অংশীদার ছিলেন তিনি।
প্রতিভাবান এই তরুণ উদ্যোক্তা ২০১৯ সালে ২২ লাখ ডলারে ইস্ট হিউস্টন স্ট্রিটের ওই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট কেনেন। পরের বছরের ১৩ জুলাই সেই অ্যাপার্টমেন্টেই নৃশংসভাবে খুন হন। সেদিন তার খণ্ড-বিখণ্ড লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।
পুরো একদিন ফাহিমের কোনো সাড়া না পেয়ে সেদিন ওই অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিলেন তার বোন। ভেতরে ঢুকে তিনি ভয়ঙ্কর এক দৃশ্য দেখতে পান।
ফাহিমের মাথা ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিল কেটে টুকরো করা। কিছু টুকরো বড় আকারের আবর্জনা ফেলার ব্যাগেও ভরে রাখা হয়েছিল। পাশেই ছিল একটি বৈদ্যুতিক করাত, তখনও সেটির তার ছিল সকেটের সঙ্গে যুক্ত।
এর তিন দিন পর ফাহিমের সাবেক ব্যক্তিগত সহকারী হাসপিলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তদন্তকারীদের বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলোতে তখন বলা হয়, হসপিল মোটা অংকের ডলার চুরি করেছিলেন ফাহিমের কাছ থেকে। বিষয়টি ফাহিম জেনে যাওয়ায় তাকে হত্যা করা হয়। আদালতের রায়ে সেটিই প্রমাণিত হয়েছে।
যেদিন ফাহিমের লাশ পাওয়া গেল, তার আগের দিন ওই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। পরদিন খুনি ওই অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে যায় লাশ টুকরো টুকরো করে ব্যাগে ভরে সরিয়ে ফেলার পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য।
কিন্তু কাজ শেষ হওয়ার আগেই ফাহিমের বোন ওই ভবনে উপস্থিত হন এবং লবি থেকে কলিং বেল চাপেন। সে শব্দেই ঘাতক সবকিছু ফেলে ভবনের পেছনের দরজা ও সিঁড়ি ব্যবহার করে পালিয়ে যায় বলে সেসময় ধারণা দিয়েছিল পুলিশ।
আদালতের নথিতে বলা হয়, ফাহিমের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে একটি ইলেকট্রিক করাত, কাঁচি, ছুরি, গ্লাভস ও মুখোশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেইসঙ্গে একটি ব্যাগের ভেতরে ফাহিম সালেহর মাথা এবং শরীরের বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায়।