সাগর-রুনি খুন: ‘না পারলে তারা বলুক, সরি’

র‌্যাব চাইলে পারে, এই বিশ্বাস রুনির ভাইয়ের; প্রশ্ন, পারছে না কেন?

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Feb 2023, 06:34 AM
Updated : 11 Feb 2023, 06:34 AM

এগার বছর হয়ে গেল, সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের কিনারা হয়নি। তদন্তভার পেয়ে ১০ বছর ধরে চেষ্টাই করে যাচ্ছে র‌্যাব, কিন্তু সেই চেষ্টায় যে কোনো অগ্রগতি হচ্ছে, তারও কোনো লক্ষণ নেই।

এক এক করে ৯৫তম বার আদালতে গিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য সময় নিয়েছে র‌্যাব। যা দেখে ক্ষুব্ধ রুনির ভাই মামলার বাদী নওশের রোমান। তিনি বলেন, না পারলে ব্যর্থতার দায় আদালতের কাছে স্বীকার করে সরে দাঁড়াক র‌্যাব।

তবে র‌্যাব কর্মকর্তারা এরপরই বলছেন, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকার রাজাবাজারে নিজেদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটে খুন হন মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক সাগর এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি।

সেই রাতে সেই ফ্ল্যাটে তারা দুজন ছাড়া ছিলেন তাদের একমাত্র সন্তান পাঁচ বছর বয়সী মাহিন সরওয়ার মেঘ। তাকে উদ্ধৃত করে পুলিশ তখন জানিয়েছিল, খুনি ছিল দুজন।

আলোড়ন তোলা এই হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর বছরের পর বছর গড়ালেও খুনিরা অধরাই থেকে গেছে।

থানা পুলিশ, গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে ঘটনার দুই মাস পর মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। তারা ডিএনএসহ অন্যান্য বায়োমেট্রিক আলামত সংগ্রহের জন্য ঘটনাস্থল থেকে বটি, নিহতদের পরিধেয় কাপড়সহ বেশ কিছু বস্তু পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ল্যাবেও পাঠায়। তবে কিছুতেই কিছু হয়নি।

বিচারের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে গত বছর মারা গেছেন মেহেরুন রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা। সাগরের বয়ঃবৃদ্ধ মা সালেহা মুনির এখনও ছেলের বিচারের অপেক্ষায় দিন গুণছেন।

মামলার সর্বশেষ হাল জানতে চাইলে বাদী রোমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আলামতের পরীক্ষায় কী পাওয়া গেছে, সে বিষয়ে তাদের কিছু জানায়নি র‌্যাব।

তদন্ত আসলে হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সংশয়ী তিনি। রোমান বলেন, “ওরাই (র‌্যাবের কর্মকর্তারা) আমাদের ইনসিস্ট করত কোর্টে আবেদন দিতে, যাতে তদন্তটা অন্য সংস্থার কাছে যায়। আগের একজন তদন্ত কর্মকর্তা ২০১৪-১৫ সালের দিকে খুবই বলতেন। তবে এখন অনেকদিন তারা এরকম কিছু বলে না।”

তবে র‌্যাবের পরিবর্তে অন্য সংস্থার হাতে তদন্তভার পড়লেও পরিস্থিতি বদলাবে বলে আশাবাদী হতে পারছেন না রুনির ভাই।

তিনি বলেন, “আমাদের কাছে মনে হয়, চাইলে এরাই পারবে। তারা ব্যর্থ হলে বলুক যে আমরা পারছি না, উই আর স্যরি। তখন যদি আদালত অন্য কাউকে দেয়।”

তবে হত্যাকাণ্ডের দুই মাস পর যখন তদন্তভার র‌্যাব পেল, তখন যতটা আশাবাদী হয়েছিলেন রোমান, এখন তার তার কিছুই নেই।

“তখন আমরা বলেছি ‘ভালো হয়েছে’। এখন ঘুরলাম তো অনেক বছর। এমন যদি হত যে র‌্যাবকে সরিয়ে অন্য কাউকে দিলে লাভ হবে … আমরা আসলে বুঝে গেছি কিছু হবে না। এখন এফবিআই এলেও আমাদের কোনো কিছু যায় আসে না।”

তদন্তে ঘাটতির জায়গাটা কোথায়- সক্ষমতার অভাব, র‌্যাবের সদিচ্ছার অভাব, না কি রাষ্ট্রের নীতিগত জায়গার সমস্যা? জানতে চাইলে রোমান বলছেন, “পরের দুটোই মনে হয়। সরকার চায় না বলেই হয়ত র‌্যাব করছে না।

“আজকে যদি সাগর-রুনির মামলাটা উদ্ঘাটিত হত, তাহলে সেটা হত বিরাট কৃতিত্বের বিষয়, সেটা তো র‌্যাবই পেত।”

রোমান বলেন, “মার্ডারের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসে বলে গেলেন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বের হবে, তার পরেরদিন আইজিপি বললেন প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি আছে। এগুলো কথা তো হাওয়ার ওপর বলেননি।”

হত্যাকাণ্ডের ১০ মাস পর ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে এসে এই খুনে জড়িত আটজনকে শনাক্তের দাবি করেছিলেন সাহারার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে আসা মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

ওই আটজনেরে অধিকাংশই মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত নিতাই খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হন। তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজনকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

সাগর-রুনি ও ডা. নিতাই হত্যাকাণ্ডের ধরন এক বলে তখন বলা হয়েছিল। কিন্তু সেদিকেও তদন্তের কোনো অগ্রগতি আর হয়নি।

চুরি করতে এসে খুনের যে ধারণা তখন দেওয়া হয়েছিল, সেই বিষয়ে কোনো মতামত ছিল কি না- প্রশ্নে রোমান বলেন, “আমরা বলছি যেই হোক, আপনারা প্রুফ দেন। মামুলি বিষয় হইতেই পারে, চোর করতেই পারে।

“সেই চোর আপুর দামি ফোনটা নিল না, সাগর ভাইয়ের কমদামি ফোনটা নিল! ল্যাপটপ নিল, দামি ক্যামেরাটাও নিল না! আর কোনো রুম টাচ করল না! শুধু একটা রুমে এরকম করে চলে গেল? এটা কেমনে সম্ভব! চোর, ডাকাত হলে তো পুরো বাড়ি তছনছ করত। তখন ডিএসএলআর ক্যামেরাটা অনেক দামি ছিল। আর বাঁধছে (সাগরের হাত ছিল রশিতে বাঁধা) এমনভাবে, যেভাবে খুবই ট্রেইনড লোকজন বাঁধে।”

এত কিছুর পরও হতাশ নন জানিয়ে নওশের বলছেন, “আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাব। আমার মনের শান্তি এই যে আমি ট্রাই করে যাচ্ছি।”

সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘ এখন অনেক বড়। সামনেই ১৭ বছরে পা দেবে। ক্রিকেট খেলছে, পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই বয়সেই ওকে পুলিশ-সংবাদ মাধ্যম-আদালতের হ্যাপা কম পোহাতে হয়নি।

এই হত্যাকাণ্ডের যে বিচার হচ্ছে না তা কি মেঘ টের পায়- জানতে চাইলে রোমান বলেন, “হ্যাঁ, আমার ধারণা মাঝে মাঝে এটা নিয়ে ওর পেইন হয়।”

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর বিচার দাবিতে নানা কর্মসূচি ছিল সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর। ১১ বছরেও খুনের রহস্য ভেদ না হওয়ায়গত বৃহস্পতিবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে আসেন এই দম্পতির সহকর্মী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নেতারা।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, “ডিআরইউর স্মারকলিপি আমি র‌্যাবের ডিজিকে এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি একটা কিছু যেন তারা জানান, সেই নির্দেশনা তাদের দেওয়া হবে।”

এরপর র‌্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, তারা ‘পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে’ তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন।

তবে অগ্রগতির কোনো খবর তার কাছ থেকেও মেলেনি।

“এখনও তদন্ত প্রতিবেদন বা চার্জশিট দেওয়ার মতো কোন তথ্য-উপাত্ত আমরা পাইনি। আমরা আদালতে নিয়মিত প্রতিবেদন দিয়ে বিষয়টি অবগত করছি,” বলেন তিনি।

তদন্তের প্রয়োজনে বিভিন্ন আলামত দেশের বাইরে পাঠানো হয়েছে জানিয়ে র‌্যাবের মুখপাত্র বলেন, “সর্বোচ্চ গুরুত্ব এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তদন্তের কাজ চলছে।”