তিন বছর পর ভাষার মাসের প্রথম দিনই পর্দা উঠল বইপ্রেমী মানুষের প্রাণের মেলার; আর মেলার মাঠের প্রথম দিনের ভিড় বার্তা দিল, মহামারীর দুঃসময় পেরিয়ে এবারের বইমেলা হয়ত ভালোই জমবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার বিকালে 'অমর একুশে বইমেলা ২০২৩' এর উদ্বোধনের আনুষ্ঠানিকতা সারেন। তিন বছর পর সশরীরে মেলায় এসে তিনিও ছিলেন দারুণ উচ্ছ্বসিত।
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রায় সাড়ে ১১ লাখ বর্গফুট জায়গায় মেলা হচ্ছে এবার; অংশ নিচ্ছে ৬০১টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। মাসব্যাপী এ মেলার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ।’
সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত আর একুশের অমর গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর ভাষা শহীদদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানাও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে। বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাপরিচালক মোহাম্মদ নুরুল হুদা। এছাড়া সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, সংস্কৃতি সচিব মো. আবুল মনসুর এবং বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটনও বক্তব্য দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অমর একুশে বইমেলা আমাদের প্রাণের মেলা।… বইপড়ার অভ্যাস বৃদ্ধির জন্য সারাদেশে আঞ্চলিক সাহিত্যমেলা চালিয়ে যেতে হবে।"
পরিবর্তিত বই-বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অডিও বই প্রকাশের তাগিদ দিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, “একই সঙ্গে বাংলা ভাষায় রচিত গুরুত্বপূর্ণ বইপত্র ইংরেজিসহ উল্লেখযোগ্য বিদেশি ভাষায় অনুবাদের ব্যবস্থা করতে হবে।"
উদ্বোধনী স্মারকে স্বাক্ষর করে প্রধানমন্ত্রী বইমেলা উদ্বোধন করার পর বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন। তিনি চলে যাওয়ার পর বইমেলার দ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
প্রথম দিনই মেলায় দেখা যায় দর্শনার্থীদের ভিড়, তবে সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের প্রস্তুতি পুরোপুরি সমন্ন হয়নি। বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দেখা যায় এখনও স্টল গোছাতে ব্যস্ত।
মেলার মাঠে কথা হয় অনলাইন বই বিপণন প্রতিষ্ঠান জলপড়ে ডটকমের স্বত্ত্বাধিকারী মাহবুব সেতুর সঙ্গে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, "মেলার প্রথম দিন কোনো বছরই পুরোপুরি মেলা চালু হয় না। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর সবাইকে মেলায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয়, এরপর সাধারণত ৩ ঘণ্টার মত খোলা থাকে। এই সময়টাতে মূলত স্টল সাজাতে ব্যস্ত থাকেন প্রকাশকরা। কারো কারো স্টল নির্মাণ কাজও শেষ হয় না। প্রথম দু-তিন দিন যাওয়ার পর মূলত মেলার আমেজ তৈরি হয়।"
রাষ্ট্রপতির আত্মজীবনীসহ ৭ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সাতটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
বইগুলো হলো- তার নিজের সম্পাদিত ‘শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলি প্রথম খণ্ড’, রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের আত্মজীবনী ‘আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি’, মুহম্মদ নূরুল হুদা সম্পাদিত চারটি বই- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী: পাঠ-বিশ্লেষণ’, ‘কারাগারের রোজনামচা: পাঠ-বিশ্লেষণ’, ‘আমার দেখা নয়াচীন: পাঠ-বিশ্লেষণ’, ‘জেলা সাহিত্য মেলা ২০২২ (১ম খণ্ড)’ এবং প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সাবিত্রী উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ ‘দি ম্যাটার অব সাবিত্রী’।
বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ১৫ জন কবি, লেখক ও গবেষকের হাতে ২০২২ সালের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী।
এ বছর কবিতায় ফারুক মাহমুদ ও তারিক সুজাত, কথাসাহিত্যে তাপস মজুমদার ও পারভেজ হোসেন, প্রবন্ধ/গবেষণায় মাসুদুজ্জামান, অনুবাদে আলম খোরশেদ, নাটকে মিলন কান্তি দে ও ফরিদ আহমদ দুলাল, শিশুসাহিত্যে ধ্রুব এষ, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় মুহাম্মদ শামসুল হক, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় সুভাষ সিংহ রায়, বিজ্ঞান/কল্পবিজ্ঞান/পরিবেশ বিজ্ঞানে মোকারম হোসেন, আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনীতে ইকতিয়ার চৌধুরী, ফোকলোরে আবদুল খালেক ও মুহম্মদ আবদুল জলিল এ পুরস্কার পেয়েছেন।
এক নজরে বইমেলা
বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০১টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবার। এর মধ্যে একাডেমি প্রাঙ্গণে ১১২টি প্রতিষ্ঠানকে ১৬৫টি এবং সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ৪৮৯টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৩৬টি ইউনিট দেওয়া হয়েছে; থাকছে ৩৮টি প্যাভিলিয়ন।
এবার ১৫৩টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে লিটলম্যাগ চত্বরে। মেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের টিএসসি গেইট দিয়ে প্রবেশ করলে মাঠের উত্তর-পশ্চিম পাশে পাওয়া যাবে এই চত্বর।
বইমেলায় শিশুচত্বরটি এবার বাংলা একাডেমির মন্দিরের পাশের গেইট দিয়ে প্রবেশের ঠিক ডান দিকে বড় পরিসরে রাখা হয়েছে।
বাংলা একাডেমি ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য প্রকাশনা সংস্থা ২৫ শতাংশ কমিশনে বই বিক্রি করবে। বাংলা একাডেমির ৩টি প্যাভিলিয়ন ও শিশুকিশোর উপযোগী প্রকাশনার বিপণনের জন্য একটি স্টল রয়েছে।
২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলা চলবে। ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন বেলা ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। রাত সাড়ে ৮টার পর নতুন করে কেউ মেলা প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারবেন না। ছুটির দিনে মেলা সকাল ১১টা থেকে শুরু হবে।
২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকাল ৮টায় খুলবে মেলার দুয়ার, খোলা থাকবে রাত ৯টা পর্যন্ত।
প্রতি শুক্র ও শনিবার মেলায় সকাল ১১টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত ‘শিশুপ্রহর’ থাকবে। প্রতিদিন বিকাল ৪টায় বইমেলার মূল মঞ্চে সেমিনার এবং সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান থাকবে।
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে শিশুকিশোর চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার আয়োজন থাকবে। এছাড়া নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা থাকবে।