চেক প্রতারণার মামলা এগোয় না কেন?

কোনো কোনো মামলা শুনানির তারিখ পায় বছরে একটি। বিচারের পরিধি সংক্ষিপ্ত হলেও ভুক্তভোগীদের অপেক্ষায় থাকতে হয় বছরের পর বছর।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2022, 07:24 PM
Updated : 29 Sept 2022, 07:24 PM

লালবাগের কেমিকেল ব্যবসায়ী মো. আব্দুর রহিম পণ্য বিক্রি করে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকার চেক পেয়েছিলেন আরেক ব্যবসায়ী মো. আসাদুজ্জামানের কাছ থেকে। নির্ধারিত সময়ে ব্যাংক থেকে সেই টাকা তুলতে না পেরে তিনি চেক প্রতারণার মামলা করেন। এরপর আট বছর ধরে আইনজীবীর ফি গুনতে গুনতে আর দোকান বন্ধ রেখে হাজিরা দিতে দিতে তার পর্যুদস্ত দশা।  

চেক প্রতারণার মামলায় বিচারের পরিধি ছোট ও সংক্ষিপ্ত হলেও উজ্জ্বল বালোর মতো ভুক্তভোগীদের বিচার আর আটকে থাকা অর্থ পাওয়ার আশায় বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে।

এ ধরনের মামলায় সাক্ষী থাকে কম, কারাদণ্ডের পরিমাণও কম; কিন্তু অনেক মামলাতেই শুনানির তারিখ মেলে বছরে মাত্র একটি।

আইনজীবীরা বলছেন, কোনো জটিলতা না ঘটলে শুধু বাদীর সাক্ষ্য আর দুটি ধাপ পার করলেই এ ধরনের মামলা রায়ের পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব, যদি ‘সদিচ্ছা’ থাকে। কিন্তু দীর্ঘসূত্রতায় মামলার জটে আটকা পড়ছে ঢাকার নিম্ন আদালত।

ফৌজদাররি মামলার বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, “আসামি পক্ষে জেরা করার তেমন কিছু থাকে না। তারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে সময় ক্ষেপণের চেষ্টায় শুনানির জন্য সময় চান। অনেকে উচ্চ আদালতে যান, কিন্তু সফল না হয়ে ফিরে আসেন। এ ধরনের মামলার শুনানিতে এত সময় ক্ষেপণ করলে বাদীপক্ষ হতাশ হয়ে পড়ে।”

সেই হতাশাই ফুটে উঠল লালবাগের কেমিকেল ব্যবসায়ী মো. আব্দুর রহিমের কথায়। ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা উদ্ধারের জন্য ২০১৪ সালের ৪ ডিসেম্বর এন আই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় তিনি মামলা করেছিলেন। পরে মামলাটি ঢাকার ৪ নম্বর যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারের জন্য আসে।

বিচারের এক পর্যায়ে আপসে টাকা ফেরত দিতে রাজি হয় বিবাদী পক্ষ। আদালতের অনুমতি নিয়ে ছোট ছোট কিস্তিতে তারা পাওনা পরিশোধ শুরু করে।

কিন্তু বেশিরভাগ তারিখে কিস্তির চেক না দিয়ে বিবাদীরা সময় পেছানোর আবেদন করায় খালি হাতে ফিরতে হয় জানিয়ে আব্দুর রহিম বলেন, “আমার তো আইনজীবীকেও ফি দিতে হয়, পুরো টাকা কবে পাব এখনও জানি না। দোকান বন্ধ রেখে আদালতে আসতে যেতেই আমি ফতুর হয়ে গেলাম।” 

চেক ‘ডিজঅনার’ কী: ঋণ বা পণ্য কেনাবেচায় অর্থ পরিশোধের নিশ্চয়তা হিসাবে রাখা চেক ইস্যুর তারিখ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ব্যাংকে জমা দিলে অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে ব্যাংক তা ‘ডিজঅনার’ করে ফেরত দেয়। এক্ষেত্রে চেক কেন ডিজঅনার হল, সে ব্যাপারে ব্যাংক একটি নথি দেবে। এরপর ৩০ দিনের মধ্যে চেক দাতাকে লিগ্যাল নোটিস দিয়ে টাকা পরিশোধের আহ্বান জানানো হয়। ওই সময়ের মধ্যে টাকা পরিশোধ বা যথাযথ উত্তর না দিলে এক মাসের মধ্যে আইন অনুযায়ী মামলা করার সুযোগ রয়েছে।

এরকম মামলা কত?

২০২০ সালের ১৮ অক্টোবর হাই কোর্টের একটি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট (এনআই অ্যাক্ট) অনুযায়ী চেক প্রতারণার মামলার বিচার চলে যুগ্ম দায়রা জজ আদালতে।

ঢাকার মহানগর দায়রা জজ আদালতের অধীন সাতটি যুগ্ম জজ আদালতের কোনটিতে কত মামলা রয়েছে তার সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান কেউ জানাতে পারেননি। তবে মহানগর দায়রা জজ আদালতের সেরেস্তা সহকারী রিয়াজ হোসেনের ধারণা, চেক প্রতারণার যেসব মামলা বিচারে যাওয়ার পর নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে, সেগুলোর সংখ্যা ৭০ হাজারের কম হবে না।

যেসব মামলায় এখনও অভিযোগ গঠন হয়নি, সেগুলো ধরলে মোট মামলার সংখ্যা হবে কয়েক গুণ।  

চেক প্রতারণার মামলায় তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়।

  • নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে (চেক ইস্যুর ৬ মাসের মধ্যে) চেকটি ব্যাংকে নগদায়নের জন্য দেওয়া হলে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে কিনা।

  • নির্দিষ্ট সময়ে বিবাদীকে নোটিস দেওয়া হয়েছে কিনা।

  • সঠিক সময়ের মধ্যে মামলা করা হয়েছে কিনা।

অপেক্ষা ফুরায় না

বিচারপ্রার্থী আর আইনজীবীরা বলছেন, বিবাদীরা সময়ক্ষেপণ করার চেষ্টা করে নিজেদের স্বার্থে। কিন্তু আদালত যখন দীর্ঘ সময় পর পর শুনানির তারিখ ফেলে, ভুক্তভোগীর যাওয়ার জায়গা থাকে না।   

ব্যবসায়ী উজ্জ্বল বালোর কোম্পানি কুইকপাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডের কাছ থেকে ২০১৭ সালে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার কিনে ৫ লাখ টাকা করে এক্সিম ব্যাংকের দুটি চেক দিয়েছিলেন ফুজিৎসু বাংলাদেশ লিমিটেডের ইব্রাহীম খলিল। কিন্তু ২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি, ১৪ জানুয়ারি ও ১৬ জানুয়ারি তিন দফা চেক প্রত্যাখ্যান করে ব্যাংক। পরে চেক স্থগিতের তথ্য আসে।

নিয়ম অনুযায়ী ইব্রাহীমকে প্রথমে আইনি নোটিস পাঠান উজ্জ্বল। এর পরের ধাপে ২০১৮ সালের ১৮ মার্চ নিগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় মামলা করেন তিনি।

২০১৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় ইব্রাহীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয় ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে।

এরই মধ্যে মামলা বাতিল চেয়ে হাই কোর্টে যান ইব্রাহীম, কোনো আদেশ না পেয়ে ফিরে আসেন। অভিযোগ গঠনের বছরের ২০ মে বাদীর সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ পড়ে, এর তিন বছর পর এ বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি সেই সাক্ষ্য শেষ হয়, যদিও এখন পর্যন্ত মামলাটি রায়ের পর্যায়ে আনা যায়নি।

উজ্জ্বল বলেন, “টাকা আদায় করার জন্য চেক প্রতারণার মামলা করে আদালতে এসে এভাবে ঘুরতে হলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা থাকে না। একটি মামলা শুনানির জন্য বছরে একটি তারিখ দিলে মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।”

ঢাকার প্রথম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে এনার্জি পাওয়ার জেনারেল লিমিটেডের দায়ের করা ৯ লাখ ৯০ হাজার ২৩০ টাকার একটি চেক প্রতারণা মামলায় মো. আল মামুনের বিরুদ্ধে এনআই অ্যাক্টে বিচার চলছে।

২০১৮ সালে দায়ের করা এ মামলায় সবশেষ শুনানির তারিখ ছিল ১৪ জুলাই। বিচারক পরবর্তী শুনানির তারিখ রেখেছেন আগামী বছরের ১৫ মে।

ঢাকার পঞ্চম যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিদ্যুত সরকার নামে এক গ্রাহকের বিরুদ্ধে ওই একই কোম্পানির দায়ের করা চেক প্রতারণা মামলায় শুনানির তারিখ ছিল গত ২৬ জুলাই। পরবর্তী তারিখ পড়েছে ২০২৩ সালের ৬ জুন।

২০১৯ সালে শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের একটি বুটিক হাউজের শিশির কুমার হাজরা সাড়ে ৩ লাখ টাকার চেক প্রতারণার মামলা করেন মো. শফিকুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে।

এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারার ওই মামলার বিচার চলছে ঢাকার চতু্র্থ যুগ্ম মহানগর দায়রা জজ আদালতে। মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ছিল গত ২১ এপ্রিল। বিচারক পরের তারিখ রেখেছেন প্রায় ৭ মাস পরে, আগামী ১৪ নভেম্বর।

একই আদালতে ১০ মাস পরে তারিখ পড়েছে ৫ লাখ টাকার একটি চেক প্রতারণা মামলার। এ মামলার বাদী শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার ইলিয়াস আহমেদ। বিবাদী রামপুরা আফতাবনগরের মনীন্দ্র নাথ মণ্ডল।

এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারায় ইস্টার্ন ব্যাংকের দিলখুশা শাখার এই চেক প্রতারণা মামলায় অভিযোগ গঠনের তারিখ ছিল গত ১১ সেপ্টেম্বর। কিন্তু পরবর্তী তারিখ রাখা হয়েছে ২০২৩ সালের ৪ জুলাইয়ে।

এনআই অ্যাক্ট

  • ১৮৮১ সালের মূল আইন ১৯৯৪, ২০০০ ও সর্বশেষ ২০০৬ সালে সংশোধন হলেও আইনের মৌলিক কাঠামোয় পরিবর্তন আসেনি।

  • ২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এক রায়ে চেক ডিজঅনার মামলার বিচারে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসে।

  • ওই রায়ে বলা হয়, এনআই অ্যাক্টের ৪৩ ধারা অনুযায়ী যে ‘কনসিডারেশনে’ চেক দেওয়া হয়েছিল, সেই ‘কনসিডারেশন’ পূরণ না হলে বা কোনো ‘কনসিডারেশন’ না থাকলে চেক দাতার কোনো দায়বদ্ধতা নাই।

  • রায়ে এনআই অ্যাক্ট সংশোধন করা হয়, যাতে আগের ১৩৮ ধারায় সংযুক্ত ‘দেনা বা দায়দায়িত্ব পরিশোধের জন্য’ শব্দগুলো বাদ দেওয়া হয়।

  • ফলে নতুন আইনে এতদিন বাদী পক্ষে চেকদাতার কাছে তার পাওনা প্রমাণ করার দরকার হত না এবং সেই পাওনা পরিশোধের জন্যই যে চেক দিয়েছিল তা প্রমাণ করার দরকার ছিল না। কিন্তু আপিল বিভাগের রায়ের ফলে বাদীকে এখন প্রমাণ করতে হয়, কী কনসিডারেশনে চেক দাতা চেক ইস্যু করেছিলেন।

  • চেক প্রতারণার অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি হল ১ বছরের কারাদণ্ড, অথবা চেকে লিখিত অর্থের তিন গুণ অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড।

 আদালত বাড়ানোর পরামর্শ

চেক প্রতারণার মামলা নিষ্পত্তিতে কোর্ট সংখ্যা বাড়ানোর মত দিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের একজন কৌঁসুলি।

ঢাকা মহানগর জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আবদুল্লাহ আবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আগে বেশি কোর্টে এ ধরনের মামলা চলত। এখন শুধু যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ আদালতে চেক প্রতারণার মামলার বিচার হয়। মামলার সংখ্যাও এত বেশি যে নিষ্পত্তিতে সময় চলে যাচ্ছে।

“কোর্ট সংখ্যা বাড়ানোর আলোচনা চলছে। সরকার থেকে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসনের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।”

আবদুল্লাহ আবু বলেন, এ ধরনের মামলায় এত বিচারপ্রার্থী উপস্থিতি হন যে এজলাসে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। এ ধরনের মামলা যে আদালতে থাকবে, সেগুলোর এজলাসের জায়গা ও পরিধিও বাড়াতে হবে।

“শুধু কোর্ট বাড়ালেই হবে না। বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের বসার জন্য স্থান সঙ্কুলান করে তবেই কোর্ট বাড়াতে হবে।”

বেঁধে দিতে হবে সময়

ব্যাংক বীমাসহ ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইনজীবী শাহীনুল ইসলাম রিজভী এ ধরনের মামলা বিচারে সময় বেঁধে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমার কাছে অনেকগুলো মামলা রয়েছে যেগুলোতে বছরে একটি করে বিচারের তারিখ পড়ছে। অথচ হত্যা, মাদক, অন্যান্য ফৌজদারি মামলায় মাসে একটি করে তারিখ পড়ে। এ ধরনের মামলার বিচারে সংক্ষিপ্ত সময় বেঁধে দিয়ে আইন সংশোধন করা যেতে পারে।

আইনজীবী পারভেজ হাসেম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বছরে একটি তারিখ শুনানির জন্য ধার্য করলে বিচার বিলম্বিত হয়। বিলম্বিত বিচার ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।

“এ ধরনের মামলার বিচারে আদালত, বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে, যেগুলোতে গ্রাহকের ঋণ পুনঃতফসিল, অর্থাৎ ঋণ পরিশোধে নতুন শর্ত যোগ করা হয়েছে।

“যে কারণে সেগুলোতে গ্রাহকের বিরুদ্ধে পুরনো শর্তের অবসান হয়ে যায়, এক্ষেত্রে ওই আগের ঋণ জামানত চেকের আর মূল্য থাকে না। কিন্তু ব্যাংকের নিয়োজিত কতিপয় আইনজীবী মামলা প্রত্যাহার না করে নিজেদের স্বার্থে সেগুলো ঝুলিয়ে রাখেন, যে কারণে মামলার সংখ্যা আর কমে না।”