Published : 10 Jan 2024, 11:15 PM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নের তালিকা থেকেই বাদ পড়েছিলেন প্রায় এক চতুর্থাংশ এমপি। নির্বাচনের তিন দিনের মাথায় শেখ হাসিনার ৩৭ সদস্যের যে নতুন সরকারের যে ঘোষণা এল, তাতে বাদ পড়লেন অর্থ, পরিকল্পনা, বাণিজ্য, কৃষি, বস্ত্র ও পাট, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, টেলিযোগাযোগের মত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর সামলে আসা মন্ত্রীরা।
পুরনো-নতুন মিলিয়ে ৩৭ সদস্যের এই নতুন মন্ত্রিসভার সামনে দেশের অর্থনীতি সামাল দেওয়াকেই মূল চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির।
সাবেক রাষ্ট্রদূত বলেন, “আমার কাছে মনে হয়, অর্থনীতির দিকটিই প্রধান হিসেবে আসবে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রেমিটেন্স, দেশের বাইরে আমাদের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। আর অভ্যন্তরীণভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সরকারের।
“তারা কোন পথে যাবেন, বিএনপির সাথে বোঝাপড়া করবেন, নাকি এখন যেভাবে আছেন, এভাবেই থাকবেন, সেটা তাদের বিষয়। কারণ অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যদি না থাকে, অনেক কাজ করা কঠিন হতে পারে।”
একজন উপমন্ত্রী এবং একজন প্রতিমন্ত্রী এবার পদোন্নতি পেয়ে মন্ত্রী হয়েছেন। এছাড়া আগে কোনো সময় মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করেছেন এমন পাঁচজনকে শেখ হাসিনা ফিরিয়ে এনেছেন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে।
আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ মেয়াদের সরকারে প্রবীণ ও বয়োজ্যেষ্ঠ অনেকের জায়গা হয়নি। ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রীর মধ্যে সাতজনই প্রথমবার এই দায়িত্বে আসছেন। আর ১১ জন প্রতিমন্ত্রীর মধ্যে সাতজন আগে কখনো সরকারের দায়িত্বে ছিলেন না।
সার্বিক বিচারে এই নতুন-পুরনো মিশেল সরকারের গতি বাড়াতে সহায়ক হবে বলেই হুমায়ুন কবিরের বিশ্বাস।
তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে যেহেতু মন্ত্রিসভা, তার গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা মন্ত্রিসভার জন্য বড় সম্পদ হয়ে দাঁড়াবে। পুরনো যারা আছেন, তাদের অভিজ্ঞতাও গুরুত্বপূর্ণ। নতুনরা তাদের সাথে কাজ করে নিজেদের অভিজ্ঞতা বাড়াতে পারবেন।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান বলছেন, নতুন সরকারের সামনে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফেরানো। তার মতে, অর্থনীতির বতর্মান ‘দুর্বলতার’ জন্য পুরনোদের কিছু দায় ‘অবশ্যই আছে’।
সেই দুর্বলতা কাটাতে কী করতে হবে নতুন সরকারকে? নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, “গত তিন মাসে আর্থিক খাতের চ্যালেঞ্জ ও এজেন্ডাগুলো সব মহলেই আলোচিত হওয়ায় অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। সম্ভাব্য উত্তোরণের পথগুলো নিয়েও আলোচনা হয়েছে অর্থনীতিবিদদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। উপায় সকলের জানা।”
অর্থনীতির হাল ধরতে নতুন সরকারে যাকেই বিবেচনা করা না কেন, দেশে যোগ্য লোক আছে বলে মনে করেন এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, “এটা এখন জাতীয় বিষয় হিসেবে দেখতে হবে। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন উন্নয়ন, পুঁজিবাজারের ফ্লোর প্রাইসের যৌক্তিকতা দেখা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্প চালিয়ে নেওয়া হবে কি না তা দেখার সময় হয়েছে।
“প্রকৃত অর্থেই আমরা একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। কিছুটা দুর্বল হলেও আমাদের পেছনে নয়, সামনের দিকে তাকাতে হবে। যা হয়েছে তা ভাবার চেয়ে উন্নয়ন কীভাবে করা যায় সেটি অগ্রাধিকার দিতে হবে মনে করি।’’
রাজনীতির বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ মন্ত্রিসভার নামের তালিকা দেখে অবাক হননি। নতুন সরকারের জন্য তিনটি চ্যালেঞ্জ দেখছেন তিনি।
“পররাষ্ট্র, অর্থনীতি ও সুশাসন- এই তিন খাতে বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে। আমাদের প্রত্যাশা, নতুন মন্ত্রিসভা ঠাণ্ডা মাথায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ইস্যুগুলো প্রত্যাশিতভাবে ভাববে এবং যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। অর্থনীতির সমস্যা নিরসন ও সুশাসন নিশ্চিতে কথা ও কাজের মিল রাখতে হবে।”
সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার বলেন, গত ১৫ বছরে দেশে দৃশ্যমান অনেক উন্নতি যেমন হয়েছে, তেমনি মানুষের মধ্যে আয় বৈষম্য বেড়েছে। এ জায়গাগুলো কীভাবে সমন্বয় করা হবে- তার ওপর নির্ভর করবে নতুন সরকারের সাফল্য।
“আওয়ামী লীগের শরিকদের নির্বাচনে বড় ধরনের পরাজয় হয়েছে। জাতীয় পার্টি আগের নির্বাচনের চেয়ে অনেক কম আসন পেয়েছে। এগুলো নিয়েও এক ধরনের আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট আছে। আবার যারা পরাজিত হয়েছে, তারা নিজেরা বলছে, তাদের হারিয়ে দেওয়া হয়েছে।
“বিএনপি তো নির্বাচনে নাই। কিন্তু যারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করছে, তারাই তো বলছে, নির্বাচনটা প্রশ্নবিদ্ধ। এ বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান করা হবে- তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করছে।”
নতুন মন্ত্রীদের নিয়ে আশাবাদী হতে চান নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ। তিনি বলেন, এই মন্ত্রিসভাকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি যেমন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তেমনি দুর্নীতিও রোধ করতে হবে।
“এই দুটি বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে নতুন মন্ত্রী পরিষদের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। যারা ইমেজ মঙ্কটে পড়েছেন, তাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। যাদেরকে আনা হয়েছে তারা যথেষ্ট ভালো এবং আশা করছি তারা তাদের অতীতের ভালো কাজগুলোই চালিয়ে যাবেন “
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইনস্টিটিউশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বৈশ্বিক মন্দার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সমস্যা কোথায় এটা সরকারও জানে।
“এর মধ্যে প্রধান সমস্যা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট এবং আর্থিক খাতে অনিয়ম। এই তিন ক্ষেত্রে সংস্কারের এখনই সময়। কারণ এসব সংস্কার অনেক ক্ষেত্রে বেদনাদায়ক হয়। তাই কোনো সরকারই নির্বাচনের আগে এই অর্থনৈতিক সংস্কার করতে চায় না।”
সরকার খোলা মনে এসব সংস্কার করতে পারলে দেশের অর্থনীতি দীর্ঘ দিনের জন্য ইতিবাচক পথে থাকবে বলে মনে করেন গবেষক আব্দুর রাজ্জাক ।