২০১১ সালের ২৩ মার্চ র্যাব সদস্যরা কলেজছাত্র লিমনের ‘পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে’ গুলি করে। ওই ঘটনা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক।
Published : 10 Sep 2024, 08:42 AM
র্যাবের গুলিতে কিশোর লিমন হোসেনের পা হারানোর খবরটা ১৩ বছর আগে সারা দেশে ব্যপক আলোড়ন তুলেছিল। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক হয়ে ওঠা লিমনের জীবনের ক্ষতটা এখনো তরতাজা।
কৃত্রিম পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে এর মধ্যেই জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছেন লিমন। আইনে স্নাতকোত্তর শেষ করে এখন তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
তখন র্যাবের পক্ষ থেকে লিমনকে ‘বিরাট সন্ত্রাসী’ হিসেবে উপস্থাপন করে দুটি মামলা তার বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছিল। দুটি মামলাই আদালত পরে খারিজ করে দেয়।
ছেলের পা হারানোর বিচার দাবি করে লিমনের মা যে মামলাটি করেছিলেন, তা এখনো চলছে। বিচার পেতে যুদ্ধ করে চলেছেন লিমন আর তার মা হেনোয়ারা বেগম।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর যখন রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন নিয়ে খোলামেলা সমালোচনা চলছে, তখন লিমনের প্রশ্ন, “এবার কী পাব পা হারানোর বিচার?”
২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে বরিশাল র্যাব-৮ এর সদস্যরা লিমনকে গুলি করে।
তখন র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, লিমন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী মোর্শেদ জমাদ্দারের সহযোগী। মোর্শেদকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানোর সময় কলেজছাত্র লিমন হোসেন গুলিবিদ্ধ হন। পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে (নিটোর) চিকিৎসা চলাকালে লিমনের বাঁ পা হাঁটু থেকে কেটে ফেলতে হয়।
পুরনো খবর
র্যাবের গুলিতে পা হারোনো সেই লিমনের বিয়ে
সব অভিযোগ থেকে মুক্ত হলেন লিমন
লিমনকে একটি মামলা থেকে অব্যাহতি
র্যাবের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের মামলা চলবে
ওই ঘটনায় লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির আদালতে একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। সেই মামলার তদন্তই এখনো শেষ হয়নি।
সে সময় বরিশাল র্যাব-৮ এর উপ-সহকারী পরিচালক-ডিএডি লুৎফর রহমান, কর্পোরাল মাজহারুল ইসলাম, কনস্টেবল মো. আব্দুল আজিজ, নায়েক মুক্তাদির হোসেন, সৈনিক প্রহ্লাদ চন্দ এবং কার্তিক কুমার বিশ্বাসসহ অজ্ঞাতনামা আরও ছয় র্যাব সদস্য ওই মামলার আসামি।
র্যাবের ভাষ্য ছিল, অভিযান চালানোর সময় কিশোর লিমন গুলিবিদ্ধ হন। তবে লিমন বলছেন, র্যাবের সদস্যরা তার হাঁটুতে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেছিলেন।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তখন (২০১১ সাল) ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। কলেজের ক্লাস শুরু হয়নি। ওইদিন ছিল ২৩ মার্চ। মায়ের সাথে গরু আনতে মাঠে যাচ্ছিলাম, বিকাল ৪টা- সাড়ে ৪টার মত বাজে।
“আমাদের বাড়ির কাছে একটা ব্রিজ ছিল। ব্রিজের এক পাড়ে তিনটা মোটরাসাইকেলে ছয়জন পোশাক পরা র্যাব সদস্য এসে ব্রিজের একপাশে দাঁড়ায়। আমি তখন মাকে পাঠিয়ে দিয়ে ব্রিজের মাঝখানে, আমার সাথে রসুল ও আবির নামে দুটো ছেলে ছিল। দুজনেরই বয়স ১১-১২ বছর।”
লিমন বলেন, “আমরা ব্রিজে বসে ছিলাম। র্যাব আসছে দেখে দাঁড়ালাম। এসেই একজন র্যাব সদস্য আমার কলার ধরল। তার নেমপ্লেটে লেখা ছিল ‘লুৎফর’। আমার শার্টের কলার ধরে বলতে থাকে, তুই সন্ত্রাসী। আমি বললাম, ‘স্যার আমি গরু আনতে বাইরাইছি।’
“পরে আমার সাথে যে দুটো ছেলে ছিল, ওদের চড় মারে র্যাব সদস্যরা। ওরা সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায়। কলার ধরে টেনে আমাকে একটু দূরে নেয় র্যাব সদস্যরা। তারপর একজন তার কোমরে গোজা পিস্তল আমার মাথায় ধরে আমাকে বলে, ‘তুই সন্ত্রাসী’। আমি তাদের পা ধরে বলি, ‘আমি সন্ত্রাসী না, আমি গরু নিতে আসছি।’”
ভয়ঙ্কর সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে লিমন বলেন, “তখন মাথায় গুলি না করে আমার বাম পায়ের হাঁটু বরাবর পিস্তল ধরে একটা গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে যাই। জ্ঞান ফেরার পর মনে হল সাদা পোশাকের একজন আমার গলা চেপে ধরেছে, এটুকু মনে আছে। এরপর যখন জ্ঞান ফেরে, তখন বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেলে নিজেকে পাই।”
র্যাব সদস্যরাই লিমনকে হাসপাতালে নেন। পরের ২৪ ঘণ্টাতেও তার পরিবারকে জানানো হয়নি, তাকে কোথায় নেওয়া হয়েছে।
২৫ এপ্রিল খুঁজেপেতে শেরেবাংলা মেডিকেলে হাজির হন লিমনের মাসহ পরিবারের সদস্যরা। তখন প্রচণ্ড ব্যাথায় কাতর তিনি।
লিমন জানান, ২৫ মার্চ র্যাব তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে দুটো মামলা দিয়ে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে চলে যায়। পুলিশের কাছে দেওয়ার পর পরিবার তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়ার উদ্যোগ নেয়। তখন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, লিমন মামলার আসামি, পুলিশ পাহারা ছাড়া তাকে কোথাও পাঠানো যাবে না।
এরপর লিমনের মা বিয়ের সময় পাওয়া নাকফুল বেচে সেই টাকা দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করেন। পুলিশসহ তারা ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যান। কিন্তু ডাক্তাররা তাকে পঙ্গু হাসপাতালে নিতে বলেন।
২৬ মার্চ তারা পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে দেখেন ছুটির আমেজ। কোনো ডাক্তার তাকে সেদিন দেখেননি। সারারাত তাকে হাসপাতালের বারান্দায় একটি ট্রলিতে ফেলে রাখা হয়।
২৭ মার্চ ডাক্তাররা এসে দেখে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। দুই দফায় দীর্ঘ সময় ধরে অস্ত্রোপচার করে তার বাঁ পা হাঁটু থেকে কেটে বাদ দেওয়া হয়। অপারেশন থিয়েটার থেকে বেডে দেওয়ার বেশ কয়েক ঘণ্টা পরে তার জ্ঞান ফেরে।
লিমন বলেন, “জ্ঞান ফিরে দেখি আামার বাম পাওডা নেই। এটা আসলে এখন যতোটা অবলীলায় বলছি, তখন যে কত তীব্র কষ্ট পেয়েছিলাম, তা এখন আর কাউকে বোঝাতে পারব না।
“আমি পঙ্গু হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলাম। তখন আত্মীয়দের সঙ্গেও দেখা করতে দেয়নি। পরে ২০১১ সালের ৬ এপ্রিল দৈনিক প্রথম আলোতে ‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে একটি সংবাদ আসার পর পরিস্থিতি কিছুটা পাল্টায়।”
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান পরদিন লিমনকে দেখতে যান। শুরু হয় রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর টানাটানি। লিমনকে নিয়ে তখনকার রাজনীতিকরাও কেউ কেউ নেতিবাচক কথা বলেন।
এরপর ওই মাসজুড়ে লিমনকে নিয়ে গণমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন আসতে থাকে। লিমনের ঘটনা হয়ে ওঠে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের প্রতীক।
পুরনো খবর
লিমনের ঘটনায় র্যাব 'নির্দোষ'
নিরাপত্তা চেয়ে থানায় আবেদন লিমনের
লিমনের বিষয়টি এখন আদালত দেখবে: সাহারা
লিমনের পায়ে গুলি নিছক দুর্ঘটনা: প্রতিমন্ত্রী
বিচার পেতে ১৩ বছরের যুদ্ধ
লিমনকে গুলি করে উল্টো তার বিরুদ্ধে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনের দুটি পৃথক মামলা দেয় র্যাব। মামলায় তার কাছ থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক উদ্ধারের অভিযোগ আনা হয়। মামলাগুলোতে লিমনের বয়স লেখা হয়েছিল ২৫ বছর। বিদ্যালয়ের সনদ অনুযায়ী তখন লিমনের বয়স ১৬ বছর তিন মাস।
লিমন বলছেন, পুলিশ দুই মামলাতেই তার বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলে মামলা বিচারের জন্য আদালতে যায়। এক পা নিয়ে লিমনকে ঘুরতে হয় আদালতে। ২০১৩ সালে আদালত মামলা দুটি খারিজ করে দেয়।
ওই সময় দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা লিমনের পাশে দাঁড়ান। বিচারের দাবি উঠতে থাকে সারা দেশে। ঢাকা, ঝালকাঠিসহ বিভিন্ন স্থানে লিমনের মুক্তি ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হয়।
জনসমর্থন পেয়ে ওই বছরের ১০ এপ্রিল ঝালকাঠির আদালতে র্যাবের বিরুদ্ধে মামলা করেন লিমনের মা হেনোয়ারা বেগম। আদালতের নির্দেশে সেটিকে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণ করে রাজাপুর থানা।
কিন্তু কিছুদিন তদন্ত করে ওই মামলায় ‘তথ্যগত ভুল’ থাকার কথা বলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে রাজাপুর থানা পুলিশ।
হেনোয়ারার আইনজীবী আক্কাস শিকদার বলেন, “থানার পুলিশ তখন যে প্রতিবেদন দিয়েছিল তার সারমর্ম দাঁড়ায়– লিমনের মা যে অভিযোগ করেছেন এরকম কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এরপর আমরা আদালতে নারাজি আবেদন দিই। সেই নারাজিও খারিজ হয়ে যায়।
“পরে জেলা ও দায়রা জজ আদালতে লিমনের মা আবার নারাজি দেন। সেখান থেকে নারাজি আবার খারিজ হয়ে যায়। এরপর আমরা অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশনের জন্য বলি। তখন পিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।”
তিন বছর ঝুলে থাকার পর পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কিন্তু লিমনকে কে গুলি করেছে, সেটা তিন বছর তদন্ত করেও বের করতে পারেনি পিবিআই। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, মামলার ঘটনা সত্য হলেও সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর বাদী আবারও নারাজি দিলে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদালত সিআইডিকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়।
এরপর জুলাই থেকে দেশে ব্যাপক অস্থিরতা শুরু হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পুলিশ অনেকটা নিস্ক্রিয় পয়ে পড়ে, বাহিনীতে ব্যপক রদবদলও হয়।
এখন মামলাটির তদন্তের কী হাল, তা জানেন না লিমন।
লিমন বলেন, “ওই মামলা উঠিয়ে নিতে আমাদের নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়। আমাদের আত্মীয়-স্বজনদেরও চাপ দিচ্ছিল র্যাব। তখন দেশের নানা পর্যায়ের মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক আমাদের পাশে দাঁড়ান। জাফরুল্লাহ স্যার (গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জাফরুল্লাহ চৌধুরী) আমার দায়িত্ব নেন। না হলে আমরা টিকতে পারতাম না।”
লিমনের ভাষ্য, “এক পর্যায়ে র্যাবের তৎকালীন এডিজি জিয়াউল আহসান তার অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে মামলা ওঠানোর কথা বলেন। আমরা উঠাইনি।”
সর্বশেষ ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান। হেফাজতে নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ ওঠায় সরকারপতনের পর তাকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। নিউ মার্কেট থানার একটি হত্যা মামলায় অগাস্টের মাঝামাঝি সময়ে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
গুলিতে পা কেটে ফেলার পর শারীরিক ধকল, মামলার হয়রানি, র্যাবের চাপ সবকিছু উপেক্ষা করে এক পায়েই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন লিমন।
২০১৩ সালে এইচএসসি, ২০১৮ সালে আইন বিষয়ে স্নাতক এবং ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর (এলএলএম) সম্পন্ন করেছেন। ২০২০ সালে তিনি জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠা করা গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। এখনো সেখানেই শিক্ষকতা করছেন।
বছর তিনেক আগে বিয়ে করেছেন লিমন, নিজের সংসার হয়েছে। তবে পা হারানোর বেদনা আর জীবনের ক্ষত তার এখনও শুকায়নি। বিচার পাওয়ার আশাও তিনি ছাড়েননি।
লিমন বলেন, “এই বিচার কী আমি দেখে যেতে পারব ভাইয়া?”
পুরনো খবর
পঙ্গু লিমন বিচার পেল না: এইচআরডব্লিউ
উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছেন লিমন
পুলিশের 'উপহারে' লিমনের ঈদ শেষ