‘‘ নিজেদের মনে করিয়ে দেই—সেনাবাহিনীকে দিয়ে, পুলিশকে দিয়ে, র্যাব দিয়ে আনন্দ, উৎসব করার আয়োজন করতে যাওয়াটা আমাদের ব্যর্থতা। এটা স্বাভাবিক না”, বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
Published : 12 Oct 2024, 08:21 PM
নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে পূজার মতো উৎসব পালন করতে চান না প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি এমন রাষ্ট্রের ‘স্বপ্ন’ দেখছেন যেখানে আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরকেও এমন উৎসবে ছুটিতে পাঠানো যাবে।
বাঙালি হিন্দুদের প্রধান উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার মহানবমীতে শনিবার বিকেলে ঢাকার ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির পরিদর্শনে গিয়ে এ কথা বলেন তিনি।
গত ৫ অগাস্ট প্রবল গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর নানা শঙ্কার মধ্যে এবারের দুর্গোৎসবে সরকারের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
তবে ইউনূস বলেন, ’’ আমরা বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব- ইত্যাদির সাহায্য নিয়ে দুর্গাপূজা করছি। তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমরা এমন একটি রাষ্ট্র গঠন করতে পারি খুব শিগগিরই যেখানে তারাও ছুটি উপভোগ করবে। আমরাও ছুটি উপভোগ করব।
“তাদের (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) ছুটি বিসর্জন দিয়ে আমাদের আনন্দ করতে হবে না। এ ‘অপরাধবোধ’ থেকে আমরা মুক্ত হয়ে যাব। দেশের নাগরিক হিসেবে উৎসব পালন করব। কেউ আমাদের বাধা দিতে পারবে না।
“এ রকম রাষ্ট্র আমরা গঠন করব। আমরা সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গঠন করতে পারি, যেটা দিয়ে দেশের মানুষ দুনিয়ার সামনে গর্ব করতে পারি। ’’
প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় মন্দিরে পৌঁছলে তাকে পূজা উৎসব পরিষদের পক্ষ থেকে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেওয়া হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির সভাপতি জয়ন্ত কুমার দেব, সাধারণ সম্পাদক তাপস চন্দ্র পাল, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর ও সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ শর্মা।
ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
‘এটা আমাদের ব্যর্থতা’
ইউনূস বলেন, ’’নিজেদের মনে করিয়ে দেই—সেনাবাহিনীকে দিয়ে, পুলিশকে দিয়ে, র্যাবকে দিয়ে আনন্দ, উৎসব করার আয়োজন করতে যাওয়াটা আমাদের ব্যর্থতা। এটা স্বাভাবিক না।
“এই ব্যর্থতাটাকে আমরা এবারের জন্য গ্রহণ করেছি। আমরা সমাজটাকে যে আমরা সমাজটাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে পারি নাই যেখানে কোনো জায়গায় একটা অংশ আনন্দ-উৎসব করবে… কাউকে বাদ দিয়ে নয়, সবাইকে নিয়ে আনন্দ উৎসব করব।
“তাও সম্ভব হচ্ছে না, আমাদের দিয়ে। এ রকম সমাজকে নিয়ে আমরা কী করবো। এ রকম সমাজ কি আমরা চাই? আমরা এ রকম সমাজ চাই না।”
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ’’এই যে আমরা আপনাদের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে আপনাদের পূজা উৎসবের সুযোগ করে দিলাম। এটা যেন ভবিষ্যতে আর কখনও করতে না হয়, সে জন্য আমরা একযোগে কাজ করব।
“আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করতে চাই, যে বাংলাদেশে যারা এই দেশের নাগরিক তাদের ‘সকলেরই সমান অধিকার’, এটা যেন আমরা নিশ্চিত করি।”
শুধু কিতাবে লিখে দিলে হবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এরপর কাটাকাটি মারামারি এগুলো করলাম, অধিকার কেড়ে নিয়ে বাহবা পেলাম, এ রকম বাংলাদেশ আমরা চাই না।
“এ রকম সমাজ চায় না বলেই ছাত্র-জনতা তাদের জীবন দিয়েছে। নতুন বাংলাদেশ সৃষ্টি করার স্বপ্ন নিয়ে এ যাত্রা শুরু করেছি। আমরা এ স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে চাই। এটা শুধু কথার কথার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। ’’
সংস্কার কমিশন প্রসঙ্গে
রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে যে ছয়টি কমিশন গঠন হয়েছে, সে বিষয়েও বক্তব্য রাখেন ইউনূস। তিনি বলেন, ’’নতুন বাংলাদেশে আমাদের কী কী নতুন দরকার, তা বের করে আনতে হবে, সেটি প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
“আমরা কতগুলো কমিশন বানিয়ে দিয়েছি। তারা তো দেশ পাল্টিয়ে ফেলতে পারবে না। তাদের সেই সাধ্য তো নেই। কমিশন করেছি এই জন্য যে, তারা আমাদের স্বপ্নগুলোকে একত্র করবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কারণে মহা স্বপ্নে আমরা চলে এসেছি, এ স্বপ্নের একটা রূপরেখা থাকবে। আমরা বলছি সংবিধান সংশোধন করব, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন প্রথা সংশোধন করব, অনেক কিছু। ’’
সংস্কার কমিশন তিন মাসের মধ্যে প্রতিটি বিষয়ে রূপরেখা দেবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “যেগুলো আপনারা চান সেগুলো বাস্তবায়ন করার নামই হল সংস্কার।”
দেশকে ‘পাল্টে ফেলার’ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “এটা যেন আমাদের হাতছাড়া না হয়ে যায়। কারণ, একবার হাতছাড়া হয়ে গেলে এটা আর কোনো দিন ফিরে আসবে না।
“অপূর্ব এক সুযোগ ছাত্র-জনতা আমাদের হাতে দিয়েছে। আমাদের হাতে আলাদিনের প্রদীপ দিয়ে দিয়েছে, আমরা যা চাই, তাই করতে পারি। স্বপ্নগুলোকে একত্র করেন। ছোটখাটো বিষয়ের মধ্যে থাইকেন না। বড় বিষয়ের দিকে আসেন। কাঠামো তৈরি করে দিলে, তারপরে কে কী পেল বা পেল না, সে হিসেবই নেই, পাব বলেই তো সব কিছু করছি। ’’
অতীতে অত্যাচারিত হওয়ার অভিযোগ এনে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এমন একটা সমাজ থেকে আমরা বেরিয়ে আসছি, যেখানে সমস্ত অধিকার ছিল ছোট্ট একটি গোষ্ঠীর কাছে, বাকি মানুষের কোন অধিকার ছিল না। আমরা সব অধিকার বঞ্চিত ছিলাম।
“এই অভ্যুত্থান হঠাৎ করে সেটা পাল্টে ফেলল। যারা মানুষের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়েছিল তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করেছিল ছাত্র-জনতা। এখন এ অধিকার আমাদের সবার কাছে আসতে হবে।”
রাষ্ট্র যদি কারও অধিকার নিশ্চিত করতে পারে তা হলে সেই রাষ্ট্রের কী দরকার- এই প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে প্রত্যেকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা। যে অধিকার কেড়ে নেবে, তাকে যেন সঙ্গে সঙ্গে শাস্তি দেওয়া। এটিই স্বপ্ন। ’’
আরও পড়ুন:
তাঁতীবাজার মণ্ডপে 'পেট্রোল বোমা' নিক্ষেপ, পুলিশ বলছে 'ছিনতাইকারী'