“যাহা আইনসঙ্গত, তাহাই যে ন্যায়সঙ্গত হবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নাই,” বলেন মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
Published : 23 Dec 2024, 02:48 PM
রাজনৈতিক পরিচয় বিবেচনায় উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের যে সংস্কৃতি রয়েছে তা দেশের ‘সর্বনাশের কারণ’ বলে মন্তব্য করেছেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল।
তিনি বলেছেন, “উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগ হচ্ছে বাংলাদেশের সর্বনাশের অন্যতম কারণ। আমরা সারাক্ষণ শুধু নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার কথা বলে চিৎকার করি। নিম্ন আদালতের স্বাধীনতার বলতে আমরা বুঝি যে- উচ্চ আদালতের কাছে তার জবাবদিহিতা থাকবে, এটাই তো?
“উচ্চ আদালতই যদি হয় রাজনৈতিক দলের প্রতি সবচেয়ে লয়াল, দলবাজ- তাহলে নিম্ন আদালতের স্বাধীনতা দিয়ে আপনি কী করবেন?”
দলবাজ বিচারক যে সুশাসনের অন্তরায় তা তুলে ধরতে গিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, “প্রথমে আপনাকে ফিক্সড করতে হবে উচ্চ আদালত, উচ্চ আদালতে নিয়োগটা ঠিক করতে হবে। নিয়োগের সঙ্গে যদি জয় বাংলা বা জিন্দাবাদ করা লোক আসবে- এটা যদি নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন তো আর উচ্চ আদালতে কাছে আপনি কিছু আশা করতে পারবেন না।”
সোমবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ আয়োজিত এক সংলাপে বক্তব্য রাখছিলেন আইনের শিক্ষক আসিফ।
তিনি বলেন, “বিচার বিভাগের সংস্কারে দাবি যেটা- এটা নতুন না; এটা বহু বছর ধরে কথা হচ্ছে। ২০-২৫ বছর ধরে বলা হচ্ছে উচ্চ আদালতে বিচারকের নিয়োগের জন্য আইন করতে হবে। নিম্ন আদালতে বিচার নিশ্চিত করতে হবে। নিম্ন আদালতের জন্য একটা সেক্রেটারিয়েট গঠন করতে হবে। প্রসিকিউশন সার্ভিস চালু করতে হবে, যাতে মামলা বিলম্বিত না হয়, এগুলো- অ্যাড্রেস করতে হবে। এগুলো আমরা জানি। আমাদের বিচার বিভাগ সংস্কার একটা কমিশন হয়েছে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা থেকে উপদেষ্টার দায়িত্বে আসা আসিফ নজরুল বলেন, “আমি যখন এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি, তখন আমি ভাবছি এখানে আমি আসলাম কেন? আমি তখন ভাবলাম, এটা শেষ হবে কবে। আমার তো আসার দরকার নাই। আমার খুব হতাশ লাগতো, কবে শেষ হবে, কবে রিপোর্ট দিবে, পলিটিক্যাল পার্টির সাথে বসতে হবে। ডায়ালগ হবে, পরে কি এত সময় থাকবে?
“আমি আমাদের সংস্কার কমিশনের সাথে কথা বলেছি, প্রধান উপদেষ্টার সাথে কথা বলেছি। উনি বলেছেন, ‘যেসব বিষয়ে ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্য আছে, তা করে ফেল’। তার পরেও সংস্কার কমিশন বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের অনুমতি নিয়ে আমরা কিছু সংস্কার করছি।”
তিনি বলেন, “উচ্চ আদালতে তিনটা বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিটি করে দিয়েছেন, যেখানে প্রধান বিচারপতি উনার অফিসের মাধ্যমে, আবার ১/১১ একটা ড্রাফট করে দিয়েছিল। এবং আমরা নিজেরা আইন মন্ত্রণালয়ের বড় কনসালটেন্সির মাধ্যমে একটা আইন করছি।
“এই শনিবার ইচ্ছা আছে যে বিভিন্ন আইনবিদ, রাজনৈতিক দলের মধ্যে আইনবিদ আছেন- আমরা একটা ব্রড বেইজ কনসালটেন্সি করব। আমরা এটা করে যদি ৩০-৪০ জন ভালো বিচারপতি নিয়োগ দিয়ে যাই উচ্চ আদালতে, অন্তত মানুষ তো ২০-২৫ বছর ভালো বিচারপতি পাবে।”
আইন উপদেষ্টা বলেন, “উচ্চ আদালতে ভালো একটা সেক্রেটারিয়েট দরকার। মানুষজন বলে- সচিবালয় নাম করা দরকার; নাকি আমাদেরকে প্রধান বিচারপতির অফিস থেকে একটা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। আরেকটা হচ্ছে স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিস।
“বাংলাদেশের এমন একটা অবস্থান যে- দলবাজ না হলে অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ সম্ভব না। আমরা এর জন্য একটা স্থায়ী প্রসিকিউশন সার্ভিস…এটা ছয় মাস লাগবে।”
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারবেন জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, “ইচ্ছা আছে, যদি বছর খানেক সময় পেলে এই কাজগুলো করে যাব। তার পরেও পলিটিক্যাল পার্টির ওনারশিপের একটা ব্যাপার আছে, পরের সরকার এসে এগুলো বাতিল করে দিতে পারে।
“আমার মনে হয় আমাদের ঐকমত্য যত শক্ত থাকবে, পরবর্তী সরকার সেটা বাতিল করতে তত কঠিন হবে, অসম্ভব হবে।”
উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, “আমি সব সময় বলতাম দেশে যদি সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে বিচার বিভাগ কখনও এত নির্মম, এত নিপীড়কে পরিণত হতে পারে না। আমার একটা থিউরি আছে, দেশে পাঁচ বছর পর পর নির্বাচন হলে এবং জনগণের রায় প্রকৃতভাবে প্রতিফলিত হলে বাংলাদেশে অত্যাচারী শাসক দলগুলো যারা আছে, তারা এতটা অত্যাচারী হতে পারে না।
“এটা আমরা ১৯৯১, ৯৬ এবং ২০০১ এ দেখেছি। দেশে যদি নির্বাচন বলতে কিছু না থাকে, তাহলে জবাবদিহি থাকে না। ইচ্ছামত নির্যাতন তন শুরু হয়। এটা আমি বলে রাখলাম, সব সংস্কারের মূলে যেন নির্বাচন ভাবনা থাকে। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ হস্তান্তর হতে হবে। এটা হচ্ছে সব থেকে বেস্ট ফান্ডামেন্টাল শর্ত। গণতন্ত্র বলেন, মানবাধিকার বলেন, আইনের শাসন বলেন। এটা হচ্ছে বেস্ট।”
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, “এখানে আলোচনার ইস্যু হচ্ছে রিফর্ম অব পলিটিকাল পার্টি; কেউ কেউ বলেছে- রিফর্ম অব জুডিসিয়ারি সিস্টেম করতে গিয়ে রিফর্ম অব পলিটিক্যাল পার্টি এসেছে। আসল কথাটা কেউ বলেন নাই।
“ফান্ডামেন্টাল রিফর্ম লাগবে, ইকোনোমিকাল সিস্টেম লাগবে। লুটপাটতন্ত্র যতদিন থাকবে, আমাদের আইনি কাঠামো বা আইনি ব্যবস্থার পরিবর্তন আনতে পারব না। একটা শ্রেণি বিভক্ত সমাজে প্রকৃত বিচার সম্ভব না “
তিনি বলেন, “সুতরাং কথা হলো যাহা আইনসঙ্গত, তাহাই যে ন্যায়সঙ্গত হবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নাই।
“আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে যাহা ন্যায়সঙ্গত, তাহার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে হবে।”
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) চেয়ারম্যান মুনিরা খান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।