জন্মবার্ষিকীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে স্মরণ

নানা কর্মসূচিতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখতে শহীদ জননীর জীবন থেকে প্রেরণা নেওয়ার আহ্বান জানান হয়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 May 2023, 01:22 PM
Updated : 3 May 2023, 01:22 PM

জন্মবার্ষিকীতে নানা কর্মসূচিতে স্মরণ করা হল শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে, যার নেতৃত্বে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে ও হচ্ছে।

বুধবার এসব কর্মসূচি থেকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন জারি রাখতে শহীদ জননীর জীবন থেকে প্রেরণা নেওয়ার আহ্বান জানান হয়।

দিনের অনুষ্ঠানসূচি শুরু হয় সকালে মিরপুরে জাহানারা ইমামের কবরে ফুল দেওয়ার মধ্য দিয়ে। পরে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে হয় আলোচনা অনুষ্ঠান।

লেখক জাহানারা ইমামের জন্ম ১৯২৯ সালের ৩ মে। ১৯৭১ সালে নিজের বড় ছেলে শফী ইমাম রুমিকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন তিনি। ঢাকায় গেরিলা হামলা পরিচালনাকারী ‘ক্র্যাক প্লাটুনের’ সদস্য রুমিকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যাওয়ার পর আর তার সন্ধান মেলেনি। তখন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার রুমির বাবাও একাত্তরে মারা যান।

স্বামী-সন্তান হারানোর বেদনা চেপে রেখে জাহানারা ইমাম একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নেমেছিলেন আন্দোলনে।

স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে ১৯৯২ সালে দলের আমির পদে বসালে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত হয় একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি। যুদ্ধাপরাধের বিচারে তার নেতৃত্বে বসেছিল গণআদালত।

এজন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল জাহানারা ইমামকে। সেই অভিযোগ মাথায় নিয়েই ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মারা যান তিনি।

তার সেই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় এক দশক আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হয়। সেই বিচারে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে ২০১৩ সালে যে শাহবাগ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার প্রেরণাও ছিলেন শহীদ জননী।

মঙ্গলবার জাহানারা ইমামের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকায় জাতীয় জাদুঘরের কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত আলোচনায় যে কোনো অপশক্তি মোকাবেলায় তরুণদের সক্রিয় থাকার আহ্বান জানান হয়।

‘জাহানারা ইমামের আন্দোলন : তরুণদের করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভায় ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, কমিটিরি সদস্য অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কমিটির সহ সাধারণ সম্পাদক শহীদসন্তান অধ্যাপক নুজহাত চৌধুরী বক্তব্য রাখেন। আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক মারুফ রসূল, সঞ্চালনা করেন কমিটির আইটি সেলের সভাপতি শহীদসন্তান আসিফ মুনীর।

মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “তিনি (জাহানারা ইমাম) একাধারে শহীদ জননী, লেখিকা, শিক্ষাবিদ, কথাসাহিত্যিক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের নেত্রী। সংসার জীবন এবং লেখক জীবনের পাশাপাশি সাংবাদিকতার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশের নাগরিক আন্দোলনেও তার অবদান অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনে তরুণদের সম্পৃক্ততা ছিল। আগামী দিনের বাংলাদেশ বিনির্মানেও তরুণদের ভূমিকা অনেক। তারাই দেশ ও জাতিকে পথ দেখাবে।”

শাহরিয়ার কবির বলেন, “৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলেও আমাদের আরও দীর্ঘ, কঠিন ও বিপদসঙ্কুল পথ অতিক্রম করতে হবে। মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অন্ধকার যেভাবে সমাজ ও রাজনীতিকে গ্রাস করেছে, সেখান থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে এগিয়ে আসতে হবে তরুণ প্রজন্মকে।”

তিনি বলেন, “১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ জামায়াত সমর্থিত খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকারের যাবতীয় হুমকি ও বাধা অগ্রাহ্য করে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের জন্য আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে যে গণআদালত করেছিলাম, সেখানে অংশগ্রহণকারী ৯০ ভাগ ছিল তরুণ। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে শাহবাগে তরুণদের নেতৃত্বেই যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে ঘটেছিল ছাত্র-জনতার মহাঅভ্যুত্থান। এখনও তরুণরাই এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি।”

“সমাজ ও রাজনীতির মৌলবাদীকরণ ও সাম্প্রদায়িকীকরণ যেভাবে ঘটেছে, যেভাবে মানুষের মনোজগতে এর আধিপত্য বিস্তৃত হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে লড়তে হলে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে সূচিত নাগরিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই,” বলেন শাহরিয়ার কবির।

মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, “তরুণদের নিয়ে আমি অনেক আশাবাদী। তারা একদিন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।”

নুজহাত চৌধুরী বলেন, “তরুণদের প্রতি জাহানারা ইমামের ভরসা ছিল। ১৯৯২ সালে তরুণদের যেমন অংশগ্রহণ ছিল, তেমনি ২০১৩ সালেও আমরা দেখি তরুণদেরকে। তাদেরকে মা এবং মাটির কাছে নিয়ে যেতে হবে। অনলাইনেও একদল তরুণকে যুদ্ধ করতে হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের হয়ে। কারণ প্রতিক্রিয়াশীলরা সংগঠিত।”

বাংলা একাডেমিতে আলোচনা

শহীদ জননী জাহানার ইমামের লেখা গ্রন্থ ও তার জীবন নতুন প্রজন্মের মাঝে আলোর যে দীক্ষা দিয়ে চলেছে, সেই পথ ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন গবেষক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক।

বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে একাডেমির উদ্যোগে আয়োজিত ‘জাহানারা ইমামের প্রবহমান লড়াই : যুদ্ধস্মৃতির উদ্ভাসন ও গণহত্যাকারীদের বিচার’ শীর্ষক একক বক্তৃতা দেন তিনি।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

মফিদুল হক বলেন, “জাহানারা ইমামের জীবন-কর্ম বহুভাবে বিচার করা যায়। তার শিক্ষকতা জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে অনেক কথা বলার থাকে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সাহসি ভূমিকা পালন করেছেন, নিজ পুত্রকে এগিয়ে দিয়েছেন যুদ্ধের পথে মৃত্যুর ঝুঁকিময় অভিযাত্রায়, যুদ্ধে শহীদ পুত্রের হারিয়ে যাওয়ার বেদনা বহন করে লিখেছেন যুদ্ধদিনের অভিজ্ঞতার অসাধারণ বয়ান একাত্তরের দিনগুলি, যে-গ্রন্থ তাকে এমন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে যা একান্ত তুলনাহীন।”

কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, “জাহানারা ইমাম বাংলা সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট লেখক ও অনুবাদক। জাতির ঐতিহাসিক এক মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধবিরোধী গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।”

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, “শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বাংলাদেশের ইতিহাসে তার ঐতিহাসিক যুদ্ধাপরাধবিরোধী আন্দোলনের জন্য যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।”

আলোচনায় আরও অংশ নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও আবৃত্তিশিল্পী রূপা চক্রবর্তী, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব নাফরিজা শ্যামা, বাংলা একাডেমির উপপরিচালক সাহেদ মন্তাজ।