নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় 'মিশি সালজং'কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করে তারা।
Published : 06 Dec 2024, 04:29 PM
পূজা-অর্চনা, নাচ-গান এবং শুভেচ্ছা বিনিময়ে গারো সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক উৎসব 'ওয়ানগালা' উদযাপিত হল রাজধানীতে।
শুক্রবার ঐতিহ্যবাহী এই উৎসব হয়েছে লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে। গারোদের বাইরেও বাঙালিসহ আরো অনেক জাতিগোষ্ঠীর মানুষ শামিল হন এই অনুষ্ঠানে।
উৎসবে আসা গারো নারীদের পরনে দেখা গেছে ঐতিহ্যবাহী দকমান্দা ও টি-শার্ট। উৎসব প্রাঙ্গণে ছিল ঐতিহ্যবাহী নানা পণ্যের স্টল।
সকালে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা ও পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে উৎসবের সূচনা হয়। পরে শোভাযাত্রা বের করা হয়। থক্কা ও শস্য উৎসর্গের মধ্যদিয়ে শুরু হয় উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা।
এছাড়া ছিল বর্তমান ও সাবেক নকমা-নকমামিচিকদের (ওয়ানগালা উদযাপন কমিটির প্রধান) ওয়ানগালার শুভেচ্ছা বিনিময় পর্ব।
উৎসব সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এবারের আয়োজনে জুম চাষ, চিগিং দক্কা দিগিং সিক্কা, ট্রক্কা-মেসাসহ নানা ঐতিহ্যবাহী আয়োজনের পাশাপাশি উৎসব স্মরণিকা ও ক্যালেন্ডারের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
উৎসব প্রাঙ্গণে প্রবেশের পরই দেখা মেলে সাহিত্য পত্রিকা 'থকবিরিম’র সম্পাদক কবি মিঠুন রাকসামের সঙ্গে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "গারোদের জাতিস্ত্তার যে আত্মপরিচয়, তা হল ওয়ানগালা। এই উৎসবের সাথে আমাদের শেকড়ের সম্পর্ক। এই উৎসব আমাদের আত্মপরিচয়ের পাশাপাশি সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐক্যেরও ভিত্তি রচনা করে।"
উৎসবে দেখা মেলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীর। তারা মূলত 'বাংলার গীতরঙ্গ' বিষয়ক পাঠের অংশ হিসেবে উৎসবে আসেন বলে জানিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক কামালউদ্দিন কবির।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "আমাদের বিভাগের একটি কোর্স আছে 'বাংলার গীতরঙ্গ'। এটি পাঠের অংশ হিসেবে সারা দেশে কী কী গীতরঙ্গ আছে তা অনুসন্ধান করি। এই কোর্স পাঠের অংশ হিসেবেই আমরা এই উৎসবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এসেছি। তারা এই উৎসবে এসে আমাদের বিচিত্র গীতরঙ্গ, বাদ্য, নাট্যের সঙ্গে পরিচিত হবে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হবে। এমনটা আমাদের প্রত্যাশা।"
উৎসব আয়োজকরা বলেছেন, প্রতি বছর দশ হাজারের বেশি মানুষের অংশগ্রহণে উৎসবটি বার্ষিক মিলনমেলায় রূপ নেয়। নিজেদের সংস্কৃতির অতি পরিচিত গানের তালে তালে নাচতে থাকে তারা। বছরে একদিন নিজেদের পোশাক পরার এবং সকলের সঙ্গে নিজেদের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান উপভোগের সুযোগ পায় অংশগ্রহণকারীরা।
গারোরা বিশ্বাস করে, শস্য দেবতা 'মিশি সালজং' পৃথিবীতে প্রথম ফসল দিয়েছিলেন এবং তিনি সারাবছর পরিমাণ মতো আলো-বাতাস, রোদ-বৃষ্টি দিয়ে ' ভালো শস্য ফলাতে সহায়তা করেন। তাই নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় 'মিশি সালজং'কে ধন্যবাদ জানাতে উৎসবের আয়োজন করে তারা।
'ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪' এর নকমা বা প্রধান অন্ত ঘাগ্রা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "এটি মূলত আমাদের দেবতাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানানোর উৎসব। হাজার বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই উৎসবটি করে আসছে।"
১৯৯৪ সাল থেকে ঢাকায় এই উৎসবটি প্রতীকী রূপে আয়োজন করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
অন্ত ঘাগ্রা বলেন, "অতীতে গারোদের জীবন ও জীবিকা ছিল মূলত কৃষিনির্ভর, যা ছিল জুমচাষ ভিত্তিক। তারা তাদের কৃষি বর্ষের শেষের দিকে ক্ষেতের ফসল ঘরে তোলার সময় নকমা (গ্রাম প্রধান) এর নেতৃত্বে গ্রামের সবাইকে নিয়ে 'ওয়ানগালা' উৎসব উদযাপন করত। ওয়ানগালা ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশের উৎসব।"
"ঢাকা ওয়ানগালা শুধু একটি উৎসব নয়, এটি আমাদের গারো সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের প্রতীক। পূর্বপুরুষদের সংগ্রাম এবং ঐতিহ্যের ধারাকে নতুন প্রজন্যের কাছে তুলে ধরাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এই উৎসব আমাদের শেকড়ের প্রতি ভালোবাসা এবং একতার প্রতীক। খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেও গারোরা আদি ফসল উৎসব ওয়ানগালার স্মৃতি এবং ঐতিহ্য আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন।"
ঢাকা ওয়ানগালা-২০২৪ উদযাপন কমিটির সেক্রেটারী অটুট আরেং বলেন, "এই উৎসবে 'আমুয়া', 'রুগালা'র মত ধর্মীয় আচার পালন করা হয়। তারপর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং শুভেচ্ছা বিনিময়। এতে নিজস্ব ভাষায় গান গেয়ে শোনান গারো শিল্পীরা।"
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ গারোদের ঐতিহ্যবাহী জম নাচ জানিয়ে তিনি বলেছেন, শহুরে জীবনের কর্মব্যস্ততার ফাঁকে দিনভর গারো সম্প্রদায় এই উৎসবে নিজেদের মত করে আনন্দে মেতে থাকে।"