সুন্দর তুমি এসেছিলে

নিশাত জাহান রানা
Published : 15 June 2022, 04:37 AM
Updated : 15 June 2022, 04:37 AM


সুন্দর তুমি এসেছিলে আজ প্রাতে
অরুণবরণ পারিজাত লয়ে হাতে –

হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল চেপে কন্ঠের মিজরাব স্বরের গায়ে লাগিয়ে এমন করে ছড় টেনে রবীন্দ্রনাথের কবিতাটি তিনি শুরু করলেন যে আমরা সবাই বেশ চমকিত-অভিভূত হয়ে গেলাম। একই কবিতা ভিন্ন ভিন্ন পর্দায় কেমন করে ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিয়ে ধরা দিতে পারে-তার একটা প্রদর্শন করলেন তিনি। হারমোনিয়ামের এ-মাথা থেকে ও-মাথা অবধি। মন্দ্রসপ্তক থেকে তারাসপ্তক। ব্যাপারটার অভিনবত্বে আমরা সবাই মুগ্ধ। এমন করেও তবে আবৃত্তির জন্য কন্ঠসাধনা হয়! উচ্চারণ সুরে লাগাবার জন্য, কন্ঠস্বরের প্রক্ষেপণের বিস্তার বৃদ্ধির জন্য- হারমোনিয়ামে গলা সেধেছি আমরা অনেকেই; কিন্তু কবিতাকেও যে হারমোনিয়াম বাজিয়ে, ভিন্ন সপ্তকে চলাচল করে- আবৃত্তির জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়- তা বুঝি সেই প্রথম অভিজ্ঞতা! ১৯৯২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আবৃত্তি সংগঠন স্বনন-এর আয়োজনে আবৃত্তি ও অভিনয় কর্মশালায় উপস্থিত হয়েছিলেন শাঁওলী মিত্র। স্বননে তখন আমরা প্রায়ই উচ্চারণ ও কন্ঠসাধনা বিষয়ে প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করতাম।

আজো মনে আছে সেদিন রক্তকরবী থেকেও তাঁর পাঠের নমুনাগুলি। দূর থেকে ডাকতে ডাকতে ছুটে আসা কিশোরের সংলাপ আর নন্দিনীর উত্তর।
– ন–ন্দি–নী–! নন্দিনী! নন্দিনী!!
– আমাকে তুই অমন করে ডাকিস কেন কিশোর? আমি কি শুনতে পাইনে?

সে আবৃত্তিতে হয়তো খানিকটা আহ্লাদ ছিল, আনুনাসিকতা ছিল, হয়তো খানিকটা অভিনয়-প্রবণতাও ছিল, কিন্তু সেটা পাঠে বৈচিত্র্যের আকর্ষণ যোগ করারই এক আবেগময় হৃদয়-সংযোগ ছিল যেন!

পিতা-মাতার ঘরানার শিল্পী তিনি। না হয়ে কোনো উপায় ছিল না তাঁর। তাঁদের হাত ধরেই তৈরি হয়েছিলেন তিনি। এতো আকর্ষণক্ষমতা সেই স্টাইলের, এতো শক্তি সেই ঘরানার যে তাকে অগ্রাহ্য করার প্রশ্নটিও অবান্তর। তবু শাঁওলী কি সেই ঘরানায় হারিয়ে গেছেন! নিশ্চিতভাবেই নয়। যেমন শম্ভু মিত্র এবং তৃপ্তি মিত্রের প্রবল আবেগ এবং সুচারু স্বর-প্রক্ষেপণ দক্ষতার বুননে নির্মিত শৈলীকে তিনি গ্রহণ করেছেন পরম্পরাগতভাবে; তেমনি নিজেও গড়ে নিয়েছিলেন একটি স্টাইল।

সেদিনের কথা ভুলিনি, তবে তখনো বাকি ছিল শাঁওলী মিত্রের অসাধারণ অভিনয় আর উচ্চারণের সমন্বয়ে বিন্যস্ত নাথবতী অনাথবৎ-এর কথন যাদুময়তায় আচ্ছন্ন হওয়া। দিনক্ষণ ভুলে গেছি। কিন্তু ভুলিনি তাঁর অসামান্য সৃষ্টি- নাথবতী অনাথবৎ-এর দুর্দান্ত পরিবেশনা। ঢাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে মঞ্চস্থ হয়েছিলো তাঁর একক অভিনয়। সংগঠনটি তখনও বর্তমান নতুন ভবনে আসেনি। পুরাতন অফিসেই স্থিত। দোতলা বাড়ির একতলায় ছোট ছোট ঘরে অফিস এবং কাজকর্ম। একটি মাঝারি আয়তনের সাদামাটা মিলনায়তন। সেইখানে অতি সাধারণ এক মঞ্চে একদিন অসাধারণভাবে উপস্থিত হলেন শাঁওলী মিত্র। রক্তবর্ণ শাড়িতে সুঠাম শরীরে দীর্ঘদেহী এক মেধা-উজ্জ্বল অপরূপা নারী। মুহূর্তে আলোকিত হয়ে উঠলো বিষন্ন চার দেয়ালের সাধারণ মিলনায়তনটি- নিরাভরণ দীনহীন মঞ্চটি। কী তাঁর উচ্চারণ, কী তাঁর কণ্ঠ প্রক্ষেপণ, কী তাঁর অভিনয়! আর সেই অসামান্য কথনের রচনাকারও তিনি নিজেই! সত্য যে- রামায়ণ-মহাভারত থেকে কাহিনী নিয়ে নানান নির্মাণমাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে অনেক অসাধারণ কাজ। মনে পড়ে আর এক অসামান্য প্রদর্শনী দেখেছিলাম তিজেন বাঈ-এর পান্ডবাণী উপস্থাপনায়। ছত্তিশগড়ের লোকরীতিতে মহাভারতের এক অনবদ্য মঞ্চায়ন। শাঁওলীর অভিনয় যারা দেখেছেন তারা যেমন মনে রেখেছেন, তেমনি যারা কেবল তাঁর কন্ঠের কাজ শুনেছেন তারাও ভুলবেন না। পরিবেশনা শেষ হওয়ার পরের রেশ তাদের শ্রুতিতে থেকে যাবে, বেজে যাবে রিন রিন রিন।

শাঁওলী মিত্রের আর কোনো মঞ্চ অভিনয় দেখার সুযোগ হয়নি আমার; কিন্তু আজও যখন তাঁর আবৃত্তি শুনি, কথন শুনি- এমন স্পষ্ট তাঁর উচ্চারণ- যেন প্রতিটি শব্দ তার পূর্ণ অর্থ নিয়ে শ্রুতিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বর্ণও যেন কোথাও হারায় না তার ভূমিকাটুকু। এমন ঝকঝকে পরিষ্কার কন্ঠস্বর! এমন সুনির্মিত স্বরযন্ত্র! স্বরযন্ত্রের সবগুলি অংশ যেন প্রতিটি বর্ণের ওজন ধারণ ও প্রক্ষেপণে যথোপযুক্ত প্রস্তুত। যেন প্রতিটি শব্দের অর্থ প্রচ্ছন্ন মাধুর্যে স্বয়ং শক্তিতে শ্রুতিতে অঞ্জলি তুলে দেয়। আর হৃদয়াবেগ এবং মেধাসৌকর্যের কি অপূর্ব বুনন। নাথবতী অনাথবৎ অথবা কথা অমৃতসমান শ্রবণ যেন এক আনন্দপরিভ্রমণ শাঁওলীর শিল্পসৃজন ভুবনে।

বিখ্যাত শিল্পী দম্পতি শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের কন্যা সেই শাঁওলী মিত্রের সঙ্গে আমার দেখা হলো বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফীর সূত্রে। ২০০৪ সালে কলকাতায় গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। প্রথম জীবনে বিশেষত গণনাট্য সংঘের উত্তাল কর্মমুখর চল্লিশের দশকের দিনগুলিতে কলিম শরাফী ছিলেন শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে একই বাড়িতে। শম্ভু মিত্রের কাছ থেকে কলিম শরাফীও পেয়েছিলেন কন্ঠ সাধনার পাঠ।

অসামান্য শিল্পী শম্ভু মিত্র আমাদের সমস্ত জীবনে আবৃত্তি শোনার আনন্দ বুনে দিয়েছেন তাঁর সুনিপুণ দক্ষতায়। আর কলকাতা বেতার আকাশবাণী থেকে ভেসে আসা তৃপ্তি মিত্রর নাট্যাভিনয় ছিল আমাদের ছোটবেলার এক আনন্দের উৎস। কলিম শরাফীর জীবন নিয়ে যখন প্রামাণ্যচিত্র পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া নির্মাণ করি, তখন সেই চলচ্চিত্রের সূত্রে একাধিকবার দেখা করতে যাই শাঁওলী মিত্রের সঙ্গে। শেষবার যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই, তিনি ব্যস্ত ছিলেন নাট্যমহড়ায়। তারমধ্যেই সময় করে দেখা হলো-কথা হলো। আর কখনো দেখা হবে না ঠিকই, তবে তাঁর স্বর, অভিব্যক্তি, দেহভঙ্গিমা, কথনশৈলী নিশ্চিত থেকে যাবে আমাদের শ্রুতিপটে, আমাদের দৃশ্যপটে বহু বহুকাল।