ঈদ ও বিয়েতে গায়ে চড়ছে ভারত ও পাকিস্তান আর মাথায় সৌদি আরব। ছেলেরা এমন কিম্ভূত আচকান পরে কোমরে তলোয়ার লট্কে বিয়ের আসরে আসছে যেন বিয়ে তো নয়, যুদ্ধে এসেছে নারী জয় করতে।
Published : 14 Apr 2025, 01:54 AM
সে সময় আমরা শাড়ি বানান দীর্ঘ ইকার দিয়ে লিখতাম| বাড়ি বানানও! এই ‘শাড়ি’র সঙ্গে আমার পরিচয় হবার এবং শাড়িটাই বাড়ি হবার উপলব্ধির দিনটির কথা এখনো সুস্পষ্ট মনে আছে। ১৯৬৩ সাল, জামালপুরের গার্লস স্কুলে সাত ক্লাশে পড়ি, বয়স বারো কিংবা তেরো; হঠাৎ করেই দেখি গা থেকে এক থোকা রক্ত জবা মাটিতে পড়ে গেছে। আমি হতভম্ব। গার্হস্থ বিজ্ঞান গ্রন্থের ‘হায়েজ নেফাস’ বাংলা ভাষা না। তো কি বুঝবো? আসলে আমি ঋতুমতী হলাম। আম্মা বল্লেন,“তুই আইজ আর স্কুলো যাইস না, শামীম”। বড়বোন বুজান কিছু পুরানো নরম কাপড় ন্যাপির মত করে দেখিয়ে, বাতলে দিলো বর্জ্যরক্ত আটকানোর বিধি। কিন্তু ছোট মানুষ আমি নতুন ন্যাপি, স্কুল ড্রেসের সালোয়ার কামিজ মাথার স্কার্ফ একসংগে সামলাতে পারছিলাম না। এসব আবার নাকি গোপনে ভালো সাবানে ধুয়ে শুকিয়ে রিসাইকেল করতে হবে! শুনে,ব্যাপক কান্না শুরু করে দিলাম। আম্মা তখন তাঁর ঘরে পরার একটা বেগুনীশাড়ি এনে পরিয়ে দিলেন। আমার ব্যবহারিক জীবন সহজ হয়ে গেল। আমি নারী হলাম! তারপর থেকেই জানি শাড়ি আমাদের একান্ত পরিধেয়।
এসএসসি’র ফেয়ার ওয়েলে বড় আপা রাবেয়া আহমদ বল্লেন,“মেয়েরা সবাই শাড়ি পরে এসো কিন্তু। শাড়িপরা আমাদের দেশের সংস্কৃতি”। মন্টি পড়লো মাসিমার জামদানী, আমি পরলাম বুজানের লাল কালো চেক ঢাকাই বিটি, মাজু পরলো বড় বড় সাদাকালো, চেক ঢাকাই। আমাদের বয়স ষোল কিন্তু ততদিনে, ভালই শাড়ি পরি। বুলবুলি তো মাও হয়ে গেছে। সেও এসেছে ছেলে কাঁখে, শাড়ি পরে। তারপর এলো কলেজ পর্ব। দানবীর আরপি সাহা স্থাপিত কুমুদিনী কলেজ টাঙাইলে পড়তে গেলাম। কুমুদিনী কলেজে সুতির সাদা শাড়ী ও যে কোনো রঙ পাড় শাড়িই ছিলো ইউনিফর্ম। এমন কি আমাদের অবাঙ্গালী প্রিন্সিপালও কলেজে শাড়ি পরে আসতেন। সেখান থেকে পাশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গেলে শাড়িই ছিল প্রধান পোশাক। রোকেয়া হলেও তাই। বাসুদা শাড়ি ধুয়ে দিতেন। নিউমার্কেটে ‘রূপায়নে’ কাইয়ুম চৌধুরীর ব্লক ডিজাইনে করাতাম শারীর অর্ডার। তখন নাইটি পরারও চল তেমন ছিলো না বলে ঐ শাড়িই ছিলো আমাদের বাড়ি। আবহাওয়া, অঙ্গসজ্জা, অন্ন-আহার, চলাফেরা সব বুঝেই সেই বাড়িটির নির্মাণ।
আমাদের হাজার বছর আগে যে শাড়ির প্রচলন ছিল তার প্রমাণ আছে পাহাড়পুর-ময়নামতির পোড়ামাটির ফলকে। কিন্তু মাত্র কয়েক দশকেই কর্মজীবী নারীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশেষ করে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ হওয়ার পর এখন বৈশাখী উৎসব, বসন্তগান, রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী এবং একুশের অনুষ্ঠান ছাড়া শাড়ি খুব কম দেখা যায়। মেয়েরা যেন শাড়ি পরতেও ভুলে গেছেন। কেউ কেউ এখন বিউটি পার্লারে গিয়ে অন্যের হাতে শাড়ি পরে তবে অনুষ্ঠানে যান। সেখানে তাদের শাড়ি পরিয়ে দেন পাহাড়ি পার্লার কর্মী! কী একটা অবস্থা!
আমাদের লিংগুয়াফ্রাঙ্কা বাংলাভাষা হলেও দেশের প্রতিটি স্থানে নিজস্ব উপভাষার বা ডায়লেক্টের একটা রূপ আছে। হস্তশিল্প দেশের লোক সংস্কৃতির কথা বলে, বুননশিল্পের প্রতিটির আছে আলাদা ইতিহাস, মোটিফ ও মূল্য। শাড়ির বেলাও তাই। মসলিনের যুগ পেরিয়ে আজকের জামদানি যে অবস্থানে এসেছে তা লোকশিল্পেরই অবদান। এ থেকে শিল্পীর মনের প্রতিটি দশক চিহ্নায়ন সম্ভব এবং সেটাই হবার কথা। বাবুর হাটের তাঁতের শাড়ির সঙ্গে টাঙাইলের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। সিলেটের মনিপুরী কিংবা সিদ্ধিরগঞ্জের জামদানী ঠিক অন্য জায়গায় পাবেন না। রাজশাহী সিল্কের রেশমি পেলবতারও নেই জুড়ি। আর এর সব মিলিয়েই বাংলাদেশের ফ্যাশন শাড়ি। এ বাংলাদেশের মেয়েদের বাড়ি। আমাদের দেহের গড়নটাই এমন যে বাংলাদেশের নারীকে ভিন্ন পোশাকে দেখলে মনে হয় আনাড়ি।
সংস্কৃতির বিনাশ হয় কূপমন্ডুকতায়, স্বার্থচিন্তায়, রাজনৈতিক লিপ্সায়। আচ্ছা, না হয় ধরে নিলাম বৈশ্বায়নের কারণে আমাদের সংস্কৃতির এ পরিবর্তন ও বিবর্তন না হলে এগুনো ব্যাহত হয়। তখন লক্ষ্য রাখতে হবে এগুনো শব্দটির দিকে। লক্ষ্য রাখতে হবে দেশের আবহাওয়ার দিকে। লক্ষ্য রাখতে হবে উপলক্ষ্যের দিকে। এসব বুঝেই পোশাক নির্ধারন সমীচীন। এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের ছায়া আলাদা করে দেখবার দরকার আছে। কিন্তু তা পুরাতন মুছে নতুন নির্মাণে নয়। জীববৈচিত্র্য যেমন জীবের টিকে থাকার জন্য জরুরী, তেমনি নিজস্ব সংস্কৃতি-সাহিত্য মানুষের মনের স্থিতিশীলতার জন্য সমান জরুরী। ধারাবাহিকতা আরো জরুরী। পৃথিবীর সব জাতি সব গোষ্ঠীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিরই বিবর্তন ঘটে। বাঙালি সংস্কৃতিও সেই পথ ধরে চলছে। শত বছর আগের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের বাঙালি সংস্কৃতির পুরো মিল থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবে ধারাবাহিকতা না থাকলে সেটাই এক সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। অযাচিত পরিবর্তনে বিবর্তনের স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত হয়। সে শব্দ বা বাণী বা বিগ্রহ যাই হোক।
আমার অভিজ্ঞতা তেতুলিয়া থেকে টেকনাফ না হলেও নেহায়েত নগণ্য না। সিলেট, সন্দ্বীপ, চাটগাঁ, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টাঙাইল, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, জামালপুর, নোয়াখালী, বরিশাল এবং আরো দু’একটা জায়গা- কিন্তু কথা হল বাংলাদেশের সেই হারিয়ে যাওয়া সময়ের কাহিনী বলার জন্য এ পরিসরও পর্যাপ্ত না। আবার বলি সংস্কৃতির বিনাশ হয় কূপমন্ডুকতায়, স্বার্থচিন্তায়, আত্মপ্রেমের অন্ধতায়, রাজনৈতিক লিপ্সায়। হে সরকার, একটা কথা মনে রাখা দরকার। নিটোল বর্তমান বলে কিছু নেই। মুহূর্তে মুহূর্তে সবই অতীত হয়ে যাচ্ছে। তাই শুধু বর্তমান নিয়ে ভাবলে জাতি হিসেবে আমাদের আত্ম-পরিচয় একদিন লুপ্তও হয়ে যেতে পারে। এখন সেটাও যে কেউ কেউ আশংকা করছেন না, তাও কিন্ত নয়।
এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের ছায়া আলাদা করে দেখবার দরকার আছে। তা নতুন নির্মাণে হবে কিন্তু। পুরাতন মুছে নয়। বৈচিত্র্য যেমন জীবের টিকে থাকার জন্য জরুরী, তেমনি মানুষের নৈতিকতা সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বৈচিত্র্যও তাদের মনের স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত জরুরী। পৃথিবীর সব জাতি, সব গোষ্ঠীর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিরই বিবর্তন ঘটে। বাঙালি সংস্কৃতিও সেই পথ ধরে চলছে। শত বছর আগের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে আজকের বাঙালি সংস্কৃতির পুরো মিল থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। তবে ধারাবাহিকতা না থাকলে সেটাই এক সময় বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়টা আশির দশক। তখন আমি অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক বিচিত্রার কিংবদন্তী সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত চৌধুরীর প্রণোদনায় প্রায় বদ্ধ পাগলের মত বিচিত্রার দেশী পোশাক নিয়ে কাজ করে কাটিয়েছি। হাতে নিয়েছিলাম ‘ফ্যাশন’-এর নামে দেশ থেকে বিদেশী ফ্যাশন তুলে দেবার পরিকল্পনা। রাতদিন মহানন্দে এই “দেশী পোশাকই এখন ফ্যশান” স্লোগানে আমাদের কাজ চিত্রে, চরিত্রে, টিভি অনুষ্ঠানে ধ্বনি প্রতিধ্বনি তুলেছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। আমরা পুরো বিচিত্রার ফ্যাশন -টিম আরিফ রহমান শিবলী, জসিম মল্লিক, এমদাদ হক, করভি মিজান, ইস্তাম্বুল হক, মশিউর রহমান, সাবেরই মোস্তফাসহ আরো অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁতী, নির্মাতা, ভোক্তা, ডিজাইনার সবার মধ্যে কি এক জোয়ার নিয়ে এসেছিলাম। ফ্যাশন জগতের মৌল ধাতুর পুরোটাই 'দেশী' হয়ে গেছিল।
কিন্তু এখন? ঈদ ও বিয়েতে গায়ে চড়ছে ভারত ও পাকিস্তান আর মাথায় সৌদি আরব। ছেলেরা এমন কিম্ভূত আচকান পরে কোমরে তলোয়ার লট্কে বিয়ের আসরে আসছে যেনো বিয়ে তো নয় যুদ্ধে এসেছে নারী জয় করতে। আমাদের দেশের শাড়িওলারা ও ব্যবসায়ীরা তা বুঝে কৃত্রিম তন্তুর কাপড়ে ছেয়ে ফেলেছেন বাজার। ভারত ও পাকিস্তান থেকে আনা জরি চুমকি পাথর, আমদানীকৃত রকমারী স্টাইলিশ কাটে দোকান ঝকঝক করছে। অন্যদিকে আমাদের জামদানী, মিরপুর, টাঙাইল কেঁদে ফিরছে। বিশ্বরঙের স্নেহভাজন বিপ্লব সাহা বলেন, আপা চেষ্টা করছি প্রাণপণ, তবু আপা শাড়িই উঠে যাচ্ছে!
এবার আবার নিজের গল্পে ফিরে যাই। কন্যা ঈশিতার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। মধ্যসত্তুর দশক। ছোটদের শাড়ি পাওয়া যেতো না। গ্রামে ছোট ছোট মেয়েরাও হাতে বোনা শাড়ি পড়ে। হাঁটের দিনে তা বাজারে ওঠে। শ্বশুরবাড়ি সন্দ্বীপের খন্তার হাট থেকে ছোটদের ডুরে শাড়ি কিনে এনেছিলাম। ঢাকায় এসে খেলার সময় নিজেই পেঁচিয়ে না পেঁচিয়ে নানান ভাবে শাড়ি পরা শিখে গিয়েছিলো। পরে মেয়েটি বিলেতে বড় হয়ে বাংলাদেশে ফিরে দীর্ঘ সাত আট বছর শাড়ি পরেই ঘর-বার সবই করেছে। শুনেছি ব্রিটিশ কাউন্সিল ঢাকায় হেড অব আর্টস হিসেবে কাজ করার সময় লন্ডনে পড়াশোনা করে বড় হওয়া ঈশিতার নিত্যদিন শাড়িপরা দেখে কেউ কেউ ছেড়ে যাওয়া শাড়ি আবার ধরেছেন! সঙ্গগুণে কি না হয়? এখন যেমন ভিন দেশের পোশাক।
ঈশিতার কন্যা আনাহিতা। বর্তমানে সে স্কটল্যান্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। সেদিন ইন্সট্রাগ্রামে ওর পাঠানো কি এক অনুষ্ঠানের ছবিতে দেখি ওমা শাড়ি পরে আছে! কপালে আবার লাল সবুজের টিপ!!হা বাঙালী ললনা, শাড়ী পরা কঠিন এ কথা তুমি আর বলো না।