খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা ভাষার সেরা সেই অল্প কয়েকজন অনুবাদকদের একজন যিনি বিশ্বসাহিত্যের বিরল সব রত্নকে আমাদের রক্তের অলংকার করে তুলেছেন। আমাদের জীবিত অনুবাদকদের মধ্যে তাঁর সাথে তুলনীয় একজনও নেই। তিনি বাংলাদেশের অনুবাদের জগতে আইফেল টাওয়ার।
Published : 20 Apr 2025, 02:36 AM
অনুবাদক খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের প্রথম যে-বইটির সাথে আমার পরিচয় সেটি ছিল রিউনোসুকে আকুতাগাওয়ার ৮টি গল্পের এক সংকলন, বাংলায় সেটির নাম ছিল রাসোমন শীর্ষক গল্পটির নামে। বইটি বেরিয়েছিল দ্রাবিড় প্রকাশনী থেকে ১৯৮২ সালে। বইটি আমি কিনেছিলাম নিউ মার্কেটের ভেতরে যে-সব বইয়ের দোকান ছিল (ছিল বলছি এই কারণে যে সেগুলোর বেশ কয়েকটি এখন উঠে গেছে।), সেখানে নলেজহোম বলে একটা বইয়ের দোকানে ছোট আকৃতির এই রাসোমন বইটি চোখে পড়তেই আমি কিনে ফেলি। পেঙ্গুইন পকেট সাইজের মতোই ছোট্ট ও সুন্দর একটি বই নিউজ প্রিন্ট কাগজে মুদ্রিত, দামেও ছিল বেশ সস্তা। খালিকুজ্জামান ইলিয়াসকে আমি তখনও চোখে দেখিনি, কিন্তু তাঁর নাম শুনেছি। এবং এও জানতাম তিনি বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস-এর ছোট ভাই। বড় ভাই কথাসাহিত্যে আর অনুজ অনুবাদের জগতে সমাদৃত এক ব্যক্তিত্ব। বইটি বোধহয় প্রকাশের দুএক বছরের মধ্যেই কিনেছিলাম। ইলিয়াস ভাইয়ের অনুবাদের সঙ্গে ওই প্রথম আমার পরিচয়। বইটিতে ১৩/১৪ পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ ভূমিকা ছিল যা আকুতাগাওয়ার সাহিত্যকর্মকে বুঝবার জন্য যেমন জরুরী, তেমনি সুপাঠ্য। তাঁর অনুবাদ তখনও মূলের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ ও বিচার করার মতো বুদ্ধি ও খেয়াল কোনটাই মাথায় ছিল না। কিন্তু অনুবাদের প্রসাদগুণ তখনই অনুভব করেছি পড়তে গিয়ে। ভূমিকায় তাঁর গদ্যভঙ্গিও ছিল চিত্তাকর্ষক। অনুবাদ কিংবা ভূমিকার গদ্যে, কোথাও বাক্যের সামান্যতম শৈথিল্য নেই, আগাগোড়া আঁটসাঁট বন্ধনে বাক্যের গতি প্রবহমান। তাঁর ভাষার লালিত্য, মাধুর্য্য ও স্বচ্ছতা জানিয়ে দেয় তিনি লক্ষ্য ভাষাটি শুধু ভালোভাবে জানেনই না, এই ভাষাটি তাঁর সৃষ্টিশীল সত্তার সবগুলো বর্ণে প্রয়োজনমতো রাঙিয়ে নিতে জানেন। এই রাসোমন ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ, এবং এই প্রথম গ্রন্থে তিনি পাঠকের আস্থা অর্জন করে নিয়েছিলেন অনুবাদক হিসেবে তাঁর অসামান্য গুণের কারণে।
এই বইটি পাঠের পরপরই দ্বিতীয় যে অনুবাদটি কেবল আমাকেই নয়, বলা যায় আমাদের গোটা প্রজন্মকেই অভিভূত করেছিল, সেটা ছিল কলোম্বিয় সাংবাদিক প্লিনিও আপুলেইয়ো মোন্দোসার সাথে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের একটি পুস্তকদীর্ঘ সাক্ষাতকার: পেয়ারা সুবাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল উত্তরাধিকার পত্রিকায় ১৯৮৫ সালে। গার্সিয়া মার্কেস তখন সাহিত্য জগতে নক্ষত্রের মতো, কিন্তু তাঁর সামগ্রিক জীবন ও কর্মভিত্তিক এরকম দীর্ঘ আর সুস্বাদু সংলাপের খোঁজ আমাদের জানা ছিল না, কিংবা থাকলেও তা ইংরেজি অনুবাদে আমাদের হাতে এসে পৌঁছায়নি তখনও। ইলিয়াস ভাই সম্ভবত মার্কিন মুল্লুক থেকে নিয়ে এসেছিলেন বা ওখান থেকেই অনুবাদ করে উত্তরাধিকারে পাঠিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাতকারটির অনুবাদ পড়ে মার্কেসের ব্যক্তিজীবন, তাঁর রুচি, তার রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক অভিমুখ ও প্রবণতাগুলো অনেক বেশি স্পষ্টভাবে জানার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। যদি বলি মার্কেসকে তিনি এই সাক্ষাতকারের মাধ্যমে অনেক বেশি ব্যাপকভাবে বাংলাদেশে পরিচিত করে দিয়েছিলেন, তাহলে মোটেই বাড়িয়ে বলা হয় না। এবং একইসাথে তিনি নিজেও এই কাজের মাধ্যমে বলতে গেলে এক লাফে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন অনেক বেশি। কিন্তু অত্যন্ত জনপ্রিয় এই সাক্ষাতকারটি বই আকারে বেরিয়েছিল অনেক পরে, ২০০৫ সালে মাওলা ব্রাদার্স থেকে। তবে এর আগেই ইলিয়াস ভাইয়ের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ গ্রন্থ বেরিয়ে গেছে। যেমন ১৯৮৪ সালে জোনাথন সুইফটের গালিভার্স ট্রাভেলস ( বাংলা একাডেমি), ১৯৮৬ শলোকভের প্রথম জীবনের গল্প (মুক্তধারা), ১৯৯৫ সালে বের হলো জোসেফ ক্যাম্পবেল-এর মিথের শক্তি ( বাংলা একাডেমি), ১৯৯৯ সালে রিচার্ড রাইট-এর কালো ছেলে ( বাংলা একাডেমি)। মাঝখানে কয়েক বছরের বিরতির পর ২০১৬ সালে ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউ ( বিপিএল) , ২০২২ সালে নিকোস কাজানজাকিসের রিপোর্ট টু গ্রেকো (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র), ২০১৩ সালে চিনুয়া আচেবের দেবতার ধনুর্বাণ ( প্রথমা), ২০১৮ সালে মেয়েদের যুদ্ধ ও অন্যান্য গল্প ( বাতিঘর) এবং ২০২০ সালে জননেতা ( বাতিঘর), ২০২২ সালে নিকোস কাজানজাকিসের জোরবা দ্য গ্রিক (কথাপ্রকাশ) এবং ২০২৪ সালে জাঁ জ্যাক রুশোর স্বীকারোক্তি ( বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র)। পেয়ারার সুবাস-এর পর তাঁর দ্বিতীয় যে অনুবাদটি আমাদের মধ্যে সাড়া ফেলেছিল সেটা মিথের শক্তি। তখন আমাদের তরুণ প্রজন্মের হাতে হাতে এই বই ঘুরছে। ইলিয়াস ভাইয়ের গালিভার্স ট্রাভেলস ছিল বাংলাদেশে ( সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেও) প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ। সুপাঠ্য এই অনুবাদে পাণ্ডিতপূর্ণ এক দীর্ঘ ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও আমাদের সারস্বত সমাজে অন্য দুটো অনুবাদের মতো এটি কেন সাড়া জাগায়নি সেটা বুঝতে পারছি না। সেটা কি এই জন্য যে ওটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য এবং তা আড়াই শ বছর আগের এক চিরায়ত সাহিত্য বলে? আমরা এতদিনে এর প্রতি কৌতূহল হারিয়ে ফেলেছি বলে? কিন্তু গালিভার্স ট্রাভেলস তো বিষয়গুণে আজও আমাদের কাছে কেবল সমসাময়িকই নয়, এটি অনুবাদের গুণেও তো বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে সাড়া জাগাবার কথা ছিল। আমরা অনেক সময়ই পুরোনো বলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইকেও অবহেলা করি। এই অনুবাদটি নিয়ে পত্রপত্রিকায় আলোচনাও যে খুব একটা হয়েছে তাও নয়।
ইলিয়াস ভাইয়ের আরেকটি টাইটানিক কাজ হচ্ছে জেমস জর্জ ফ্রেজারের গোল্ডেন বাউ। দুই বাংলাতেই এখনও পর্যন্ত এটি একমাত্র অনুবাদ। এই কাজটি যে কত দুরূহ তা অনুবাদকরা খুব ভালো করেই জানেন। আর জানেন বলেই বোধহয় বইটি প্রকাশের ১৩০ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও এটি কেউ অনুবাদের সাহস করেননি। অনুবাদের দুরূহতার পাশাপাশি এর বিপুলতাও অনাগ্রহের আরেক কারণ। কিন্তু ইলিয়াস ভাই হচ্ছেন সেই অনুবাদক যিনি দুরূহতা ও বিপুলতাকে অসামান্য মেধা ও দানবীয় পরিশ্রমে জয় করে নেন। গোল্ডেন বাউ ইলিয়াস ভাইকে, বলা যায়, অনুবাদক হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে গেছে। কিন্তু ইলিয়াস ভাই খ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকার মানুষ নন। অনুবাদের ক্ষুধা তাঁকে বারবার চিরায়ত সাহিত্যের মনিমুক্তোর দিকে নিয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় তিনি যেমন চিনুয়া আচেবের প্রথম অনুবাদক, সম্ভবত তিনি আচেবের সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থেরও অনুবাদক। আচেবের প্রতি তাঁর পক্ষপাতের একটা বড় কারণ হয়তো এই যে তিনি বিদেশের মাটিতে নাইজেরিয় এই লেখকের উপর পিএইচডি করেছিলেন। আমি মনে করি বাংলা ভাষায় তিনি আচেবের শ্রেষ্ঠতম অনুবাদক। অনেকেই আচেবের অনুবাদ করেছেন, কবীর চৌধুরী থেকে শুরু করে আজকের কোনো কোনো তরুণরাও আছেন অনুবাদকের দীর্ঘ কাফেলায়, কিন্তু খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের ইর্ষণীয় সাফল্যের ধারেকাছে কেউ পৌঁছুতে পারেননি।
আরেক লেখকের প্রতিও তাঁর সুবর্ণ পক্ষপাত আমরা লক্ষ্য করবো, তিন গ্রিক কথাসাহিত্যিক ও কবি নিকোস কাজানজাকিস। কাজানজাকিসের কোনো গ্রন্থ অনুবাদের আগে, বলা যায়, বহু বছর আগে সত্তরের দশকে কোনো এক লিটল ম্যাগাজিনে তিনি এই লেখককে নিয়ে লিখেছিলেন এক দীর্ঘ প্রবন্ধ। সম্ভবত সেটিই ছিল গ্রীক এই লেখক নিয়ে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম কোনো প্রবন্ধ। কিন্তু কাজানজাকিস অনুবাদে তিনি হাত দিয়েছেন অনেক পরে, রিপোর্ট টু গ্রেকো এবং জোরবা দ্য গ্রিক—দুটোই গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো ২০২২ সালে। এই অনুবাদ দুটিও বাংলা ভাষায় সেরা দুই রত্ন। বই দুটো যারা ইংরেজিতে পড়েছেন তারা জানেন কাজানজাকিস-এর গদ্য ছন্দোময়, লালিত্যমধুর আর অভিনব অভিব্যক্তিতে পূর্ণ। এরকম গদ্য অনুবাদকদের জন্য যথেষ্ট ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইলিয়াস ভাই আশ্চর্য জাদুবলে বাংলাভাষায় তা বশীভূত করে নেন অবলীলায়। তিনি আচেবের উপন্যাস ও গল্প অনুবাদে যে-দক্ষতা দেখিয়েছেন তা তুলনাহীন। কোনো গল্প বা উপন্যাসে যখন নানা পেশা ও শ্রেণির বিভিন্ন চরিত্রের সমাবেশ ঘটে, আর তাদের ভাষাভঙ্গি যদি হয় ভিন্ন ভিন্ন, তিনি তখন তাদের সংলাপে ভাষিক পার্থক্য দিয়ে আলাদা করে ফেলতে পারেন সহজেই। চরিত্রদের শ্রেণি, পেশা ও সাংস্কৃতিক আবহ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন ভাষিক চরিত্র ফুটিয়ে তোলার দক্ষতা তাঁর বিস্ময়কর। কোনো কোনো চরিত্রের সংলাপে প্রয়োজন অনুসারে আঞ্চলিক বুলিও যুক্ত করে দেন বাস্তবতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত করার স্বার্থে। অন্য সব অনুবাদকরা যখন মূল রচনার চরিত্রদের ভাষিক বৈচিত্রকে অক্ষমতার বুলডোজার দিয়ে সমান করে ফেলেন, ইলিয়াস ভাই সেখানে নিপুণ দক্ষতায় প্রতিটি চরিত্রকে লক্ষ্য ভাষায় মূলের বৈশিষ্ট্যকে অটুট রাখার জন্য সর্বোচ্চ পরিশ্রম ও মেধার বিনিয়োগ ঘটান। তাঁর অনুবাদগুলো যদি কেউ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতেন এবং মূলের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই তাঁর অনুবাদের অসাধারণত্ব টের পেতেন। একদম আক্ষরিক অনুবাদ বলতে যা বুঝায় তা তিনি কখনোই করেননি, আবার নিজের মতো মনগড়া সৃষ্টিছাড়া অনুবাদও করেননি। অনেক সময় মূলে এমন কোনো বাগধারা হয়তো থাকে যা বাংলা ভাষায় খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাগধারার কথাগুলো হয়তো অনুবাদ করা যায় কিন্তু বাগধারার ভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য যদি লক্ষ্য ভাষায় না থাকে তাহলে অনুবাদকের জন্য কাজটি হয়ে পড়ে দুরূহ। ইলিয়াস ভাই সবসময়ই চেষ্টা করেন মূলের বাগধারাটি রক্ষা করতে। ইংরেজি ভাষার সুক্ষ্ণ অনেক বৈশিষ্ট্য, সুর ও চলনগুলো তাঁর এত ভালোভাবে জানা যে বাংলাভাষায় সেগুলো তিনি জীবন্ত করে তুলতে পারেন। কাজটা যে সহজ নয় তা সমঝদার মাত্রই জানেন। কারণ প্রতিটি ভাষা অন্য ভাষা থেকে চলনে, গড়নে, ছন্দে ও সুরে আলাদা। অনুবাদের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে জটিল গড়নের ও জটিল ভাষার কোনো বিদেশি রচনার অনুবাদ যদি লক্ষ্য ভাষায় সুপাঠ্য হয়, আমরা অনেক সময় যেটাকে রদ্দি ভাষায় ‘ঝরেঝরে’ বলে প্রশংসা করি, সেই ধরনের অনুবাদ সম্পর্কে আমার সবসময়ই সন্দেহ হয়। এমনকি আমি এও বিশ্বাস করি যে অনুবাদকে খানিকটা যদি অনুবাদের মতোই শুনায় তা অনুবাদের জন্য দোষনীয় নয়, কারণ অনুবাদ যদি বিশ্বস্ততা বজায় রাখতে চায় তাহলে ভাষিক ভিন্নতার কারণে তা অনুবাদের মতো শোনানোটাই হবে যথাযথ। কিন্তু ইলিয়াস ভাই এই জায়গাটিতে আমাদের প্রচলিত ধারণাকে লঙ্ঘন করে এক আশ্চর্য সমঝোতা তৈরি করেন। এত সন্তর্পনে, এত সুক্ষ্ণভাবে এবং এতই সংবেদনশীলতার সাথে ভাষিক বৈষম্যকে তিনি ঘুচিয়ে দেন যে তা একই সঙ্গে বিশ্বস্ততাকে যেমন ক্ষু্ন্ন করে না, আবার ভাষিক স্বচ্ছতা ও সাবলীলতাকেও পুরোপুরি বজায় রাখে। অথচ মূলের বাক্যার্থ তো বটেই, এমনকি শব্দার্থও তিনি এড়িয়ে যান না। কিন্তু বাংলা ভাষার চলনের যথাসম্ভব নিকটবর্তী করে তোলেন।
অনুবাদের নিষ্ঠায়, প্রাচুর্যে ও সাফল্যে তিনি পশ্চিমবঙ্গের মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তুলনীয়। মানবেন্দ্রর মতোই তিনি প্রচুর অনুবাদ করেছেন, করেছেন দুরূহ সব রচনাসম্ভার, কিন্তু দুজনের অনুবাদের আদর্শ অনেকটাই আলাদা। মানবেন্দ্রর অনুবাদ পড়লে আমাদের মনে হবে এটি অনুবাদই; ভাষিক ভিন্নতাকে তিনি বিশ্বস্ততার সাথে অনুসরণ করতে গিয়ে মূলের বাক্যরীতিকে অক্ষুন্ন রাখার পক্ষপাতী। এর ফলে অনুবাদ প্রচলিত ভাষায় ঝরঝরে মনে হবে না বটে, কিন্তু তাই বলে অবোধগম্য নয়। বাংলা ভাষার স্বভাব ও রীতির সাথে তার ইষৎ দূরত্ব আমরা অনুভব করি সবসময়ই। কিন্তু ইলিয়াস ভাই বাংলা ভাষার স্বভাব ও রীতির অনুগত করে তোলার মধ্যেই অনুবাদের সাফল্যকে নিশ্চিত করার পক্ষপাতী। মূলের প্রতি সর্বোচ্চ বিশ্বস্ততা বজায় রেখে আশ্চর্য সাফল্যের সাথে তিনি সেটা করে দেখানও।
এই সাফল্য আমরা দেখতে পাবো তাঁর সর্বশেষ অনুবাদকর্ম জাঁ জ্যাক রুশোর ৭ শ পৃষ্ঠার স্বীকারোক্তিতে (বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, ২০২৪ সাল)। রুশোর এই মহাগ্রন্থ যারা ইংরেজিতে পড়েছেন তারা জানেন, এটি অনুবাদ করা মোটেই সহজ নয়। কিন্তু ইলিয়াস ভাই এই বিপুল যজ্ঞটিও সম্পাদন করেছেন তাঁর নিজস্ব অনুবাদ শৈলীর বৈশিষ্ট্যকে অনাহত রেখে। অনুবাদে তাঁর অসামান্য কৃতি কেবল দুটি ভাষায় অলঙ্ঘ্য অধিকারের ফলেই নয়, বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে তাঁর গভীর জ্ঞানও পরোক্ষে ভূমিকা পালন করেছে।
অনেকেই হয়তো জানেন না তিনি মাঝেমধ্যে কিছু কবিতাও অনুবাদ করেছেন। কবিতার অনুবাদে তাঁর সামর্থ্য মুগ্ধ করার মতো। ভাষার নিজস্ব ছন্দতো থাকেই, উপরন্তু যদি তা অন্তানুপ্রাসযুক্ত হয়, তাহলে সেরকম কবিতাও একেবারে মূলের অনুরূপ করে তুলতে তাঁর জুড়ি নেই।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস বাংলা ভাষার সেরা সেই অল্প কয়েকজন অনুবাদকদের একজন যিনি বিশ্বসাহিত্যের বিরল সব রত্নকে আমাদের রক্তের অলংকার করে তুলেছেন। আমাদের জীবিত অনুবাদকদের মধ্যে তাঁর সাথে তুলনীয় একজনও নেই। তিনি বাংলাদেশের অনুবাদের জগতে আইফেল টাওয়ার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা তাঁর অনুবাদকর্মের দ্বারা যতটা উপকৃত ও ঋদ্ধ হয়েছি, তাঁর প্রতি রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারী অবহেলা তার চেয়ে বেশি দেখিয়েছি। তিনি একটিমাত্র রাষ্ট্রীয় যে পুরস্কারটি পেয়েছেন তা ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার। উল্লেখ যে এই পুরস্কারটি তিনি পেয়েছেন বিলম্বে, তাঁর অসাধারণ বহু অনুবাদকর্ম প্রকাশের অনেক পরে। ইতিমধ্যে তাঁর চেয়ে কম যোগ্য কেউ কেউ এই পুরস্কার পেয়ে কুলীন হয়েছেন। এই পোড়া দেশে, দুর্নীতি যেখানে দুর্বাঘাসের মতো বিস্তৃত, যেখানে কৃতি ও প্রতিভা উপেক্ষিত, সেখানে তিনি একুশে পদক বা স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হন না। আর বেসরকারি যে-সব পুরস্কার ও পদক রয়েছে সেখানেও তিনি উপেক্ষিত। তৃতীয় শ্রেণির তথাকথিত সৃষ্টিশীল উপন্যাস বা গল্পের জন্য অর্ধশিক্ষিত লেখকরা পুরস্কৃত হলেও, খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের মতো প্রথম শ্রেণির, আমি বলবো একেবারে বিশ্বমানের অনুবাদক আজও উপেক্ষিত। তাঁকে উপেক্ষার মাধ্যমে আমাদের তথাকথিত সৃষ্টিশীল ও মৌলিক সাহিত্যের দীনতাকেই কেবল প্রকাশ করছে, কারণ বিশ্বমানের মৌলিক একটি রচনার সফল অনুবাদ তৃতীয় শ্রেণির মৌলিক সাহিত্যের চেয়ে অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি স্মরণে রাখি যে সহস্র এক আরব্য রজনী ফরাসি ভাষায় যখন প্রথমবারের মতো অনূদিত হলো তখন সেটি কেবল অনুবাদই ছিল না, সেটি ইউরোপে রোমান্টিসিজমের জন্মদাত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল, হয়ে উঠেছিল অসংখ্য মৌলিক রচনার জননী।
খালিকুজ্জামান ইলিয়াস আজ ৭৬ বছরে পা ফেলেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীল কর্মময় জীবনের মূল্যায়ন আমরা বলতে গেলে কিছুই করিনি। অথচ তাঁর কাছে আমাদের সাহিত্যিক ঋণ বিপুল। তাঁর কাজের মূল্যায়ন কবে হবে সেই আশায় না থেকে জন্মদিনে তাঁর কাছে আমাদের ঋণটুকু অন্তত স্বীকার করে তাঁকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাই।