দ্বৈত ও অদ্বৈতের প্রসারিত যাত্রা

আবদুস সেলিমআবদুস সেলিম
Published : 6 Sept 2016, 02:14 PM
Updated : 6 Sept 2016, 02:14 PM

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. রশীদ হারুন তাঁর সেলিম আল দীনের নাট্য নির্দেশনা নন্দন ভাষ্য ও শিল্পরীতি গ্রন্থের ভূমিকায় বলছেন, 'দ্বৈতাদ্বৈত' শিল্পতত্ত্বভাষ্যকার নির্দেশক সেলিম আল দীন আমৃত্য ব্যাপৃত ছিলেন মঞ্চ দৃশ্যকলা, পাঠ ও শ্রবন শিল্পকলা প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি মঞ্চকাব্য সৃজনপূর্বক নিজস্ব নন্দনভাষ্য এবং শিল্পরীতির কাঠামো নির্মাণ কল্পে।' সেলিম আল দীনের এই প্রচেষ্টা তার শিক্ষার্থী ও সমর্থকদের মধ্যে সঞ্চারণ করতে পেরেছেন, তার অন্তত একটি সজীব উদাহরণ সম্প্রতি মঞ্চস্থ রুবাইয়াৎ আহমেদরচিত একক অভিনিত নাটক 'গহনযাত্রা'। নাটকটির শরীরে সেলিমের নন্দন-দর্শন খুবই স্পষ্ট দৃষ্টিগোচর হয়, বিশেষ করে এর অাখ্যায়িক চরিত্র ও দ্বৈতাদ্বৈতবাদ শিল্পচেতনার কারণে যার মধ্যে সমন্বিত হয়েছে ড. হারুণ উল্লিখিত 'দৃশ্যকলা', পাঠ ও শ্রবন শিল্পকলা'। স্পষ্টতই এই উপাদানগুলো 'ন্যারটিভ-এরই উপাদান।

নাট্যকার রুবাইয়াৎ আহমেদ এই নাটকের নামকরণ করেছেন 'দ্বৈত ও অদ্বৈতের আখ্যান, গহনযাত্রা'। বাংলাদেশের নাট্যামোদী মাত্রই জানেন, দ্বৈত-অদ্বৈতবাদের জনক সেলিম আল দীন, যাঁর সরাসরি ছাত্র রুবাইয়াৎ। কাঠামোগতভাবেও নাটকটি সেলিম-এর তাত্ত্বিক ধারায় অনুসৃত, যেমন প্রতিটি অপবর্তনের একটি করে শিরোনাম সংযোজন হয়েছে এবং নাটকের ভূমিকা হয়েছে 'যাত্রারম্ভ' নামকরনে। এই বিষয়টিও আমার কাছে প্রতিকী মনে হয়–প্রথমত যাত্রা অর্থে অন্তরের ভেতরে এক পরিশুদ্ধির অন্তহীন ভ্রমণ যার মূলমন্ত্র 'সবার মনে জাগ্রত হোক প্রেম, সবার সর্বান্তকরণ ভরে উঠুক শুভবোধে, সবাই সুন্দর আর নির্মল হোক।'

দ্বিতীয়ত, পুরো নাটকটির বর্ণনাধর্মী কাঠামোটি লোকজ যাত্রাপালার আদলে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে যদিও বর্ণনার ভাষাটি নয়। অপরাপর লোকজ উপাদান যথাক্রমে 'বন্দনা' ও 'প্রারম্ভ'। তবে একথা উল্লেখ করা সমুচিত হবে যে এই আদলটি নাটকের প্রথমাংশকে কিছুটা হলেও পীড়িত করেছে যেটি 'টেক্সট্' হিশেবে পাঠকদের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও দর্শকদের কাছে হয়নি।

'সালমার প্রত্যাবর্তন' অখ্যানে আমরা স্পষ্ট উল্লেখ পাই দ্বৈত-অদ্বৈতের তত্ত্ব, 'স্মৃতির সব কিছুর প্রতি প্রেমময় হয়ে ওঠো যদি, তবে জেনো, ভালবাসছো আসলে তাকেই, যিনি সবাইকে সৃজন করেছেন, যিনি সবার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক্ষায়। দ্বৈত সংজ্ঞায় তিনি বিরাজিত ব্রহ্মান্ডে, প্রবল আগ্রহ নিয়ে আছেন সবকিছু নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে হবেন অদ্বৈত।' নাটকের এই অংশটি দীর্ঘতম এবং সত্যি অর্থে মূল নাট্যধারাটি এখান থেকেই শুরু।

নাটকের প্লট আধুনিক এবং বিস্তৃত উপাদান হলো: উগ্রপন্থা এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত ধ্বংসযজ্ঞ এবং তারই উদ্ভূত পরিস্থিতি– বিশ্বজুড়ে রক্তগঙ্গা, হত্যা, ধর্ষণ। এরই বিপরীতে সালমা–নাটকের মূল চরিত্র–ঘোষণা করে পরমের সান্নিধ্য'। মঞ্চ নাটকের এই উপাদানগুলোর ভেতর পাশ্চাত্য প্রভাবও খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন সালমার মৃত লাশ সমাহিত করার কাঙ্খা এবং তার অগ্নিদগ্ধ হওয়া যথাক্রমে 'ইলেকট্রা' এবং 'জোয়ান অব আর্ক' নাটকদ্বয়ের কথা স্মরণে আনে।

এটি একটি একক চরিত্রের স্বগতোক্তি মূলক নাটক। এক ঘন্টার অধিক শামছি আরা সায়েকা নাটকের ক্রমোন্মোচিত ন্যারেটিভ অক্লান্তভাবে উপযুক্ত নান্দনিক প্রণয়কলার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছে নিঃসন্দেহে। তবে উচ্চারণ আরও পরিশুদ্ধ হলে সায়েকাকে অভিনেতা হিসাবে নিখুঁত বলা যেত কারণ নাটকের দীর্ঘ ব্যাপ্তি ও অপবর্তনের সাথে নিজেকে ধরে রাখা তার জন্য সহজ ছিল না।

তাছাড়া নাটকটি তো আসলে বর্ণনাশ্রয়ী। নাটকের নির্দেশক সুদীপ চক্রবর্তী নাটকটিকে যে চ্যালেঞ্জ হিসেবে মঞ্চে এনেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই কারণ আমার জানা মতে এটিই বাংলাদেশের দীর্ঘতম মনোড্রামা যেখানে বর্ণনাকেই সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। নাটকের ভেতর কোনো রসাত্মক বিনোদন বা স্বস্তি নেই এবং নাটকের মেজাজের কারণেই তা সংযোজন করার অবকাশ ছিলো না। তবে এমন উপাদান থাকতেই হবে তারও কোনো যুক্তি নেই। সুদীপ একটি কাজ ভাল করেছে, এবং সেটি হলো শেষ দৃশ্যের ঐক্ষিক এপিটাফ নির্মাণ যা দর্শকদের এক পরাচেতনাবাদের সংস্পর্শ দিয়েছে। এছাড়া পুরো নাটকে মুখোশের ব্যবহারও প্রশংসার্হ ও যথাযথ। যদিও বক্ষমান পর্যালোচনাটি (সমালোচনা নয়) নাটকের টেকনিক্যাল প্রদর্শনীর ভিত্তিতেই রচিত, বলতে বাধা নেই সংগীত সঞ্চালন ও আলোক সম্পাত নাটকের সাবলীল গতিকে একাধিকবার ক্ষুণ্ন করেছে।

পরবর্তী মঞ্চায়নগুলো আরও ঘনবিন্যস্ত হবে এই আশায় নাট্যকার, নির্দেশক এবং কলাকুশলীদের অভিনন্দন একটি শুদ্ধ নান্দনিক প্রচেষ্টার জন্য।