ন্যানো সাহিত্যতত্ত্ব: একটি ইশতেহার

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 25 Nov 2013, 09:00 AM
Updated : 25 Nov 2013, 09:00 AM


তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীদের বহু দিনের স্বপ্ন বস্তুজগতের তাবৎ রহস্যকে–প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলকে এক করে–একটি মাত্র তত্ত্বের সংকেতে (Grand Unification theory) প্রকাশ করা। স্বভাবসুলভ উচ্চাশায় ভর করে, বোর্হেস স্বপ্ন দেখতে গিয়ে বলেছিলেন, "কেমন হয় যদি সকল ভাষা, সকল অভিব্যক্তি, সমগ্র কবিতা কেবল একটি পংক্তিতে, বা এমনকি একটি মাত্র শব্দে সংকুচিত করা যায়?"

বিজ্ঞানী ও কবিরা এতদিন যার স্বপ্ন দেখেছেন এবং এখনও দেখছেন তা বাস্তবায়িত করার সময় এসেছে। জীবন ছোট, তাই সময় এতো মূল্যবান। এই মূল্যবান সময়কে অতিকথন, অপ্রয়োজনীয় শব্দ আর অনাবশ্যক বৃহত্বে অপচয় করা যাবে না। সাহিত্যের সকল শাখাকে তাই এসব লক্ষণ থেকে মুক্ত করে ন্যানো আয়তনে যেতে হবে। প্রকরণের সকল বৈশিষ্ট্য নিয়েই সাহিত্যের প্রতিটি শাখা– হোক সে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নাটক–নিজেকে প্রকাশ করবে। কিন্তু যথাযথতা আর মিতব্যয়িতা হবে এর মূলমন্ত্র। 'দূর ব্রহ্মান্ডকে তিলে টেনে' আনতে চাই আমরা। চাই তিলের মধ্যে তালকে দেখতে। তিলকে তাল বানাবার অাতিশয্য ত্যাগ করে বিন্দুর সিন্ধুতে প্রবেশ করতে চাই। আর তাই ন্যানো উপন্যাসকে আমরা সর্বোচ্চ ১৫০০ শব্দের পরিসরে নিয়ে আসতে চাই। সবচেয়ে দীর্ঘ ন্যানো গল্পটি হবে সর্বোচ্চ ৩০০ শব্দের। একটি ন্যানো প্রবন্ধও ৩০০ শব্দের সীমাকে অতিক্রম করতে পারবে না কোনভাবেই। ন্যানো নাটককেও ৩০০ শব্দের পরিসরে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একটি ন্যানো ম্যুভি কোন মতেই ১০ মিনিটের বেশি হতে পারবে না। সবচেয়ে দীর্ঘতম ন্যানো কবিতাটি হবে সর্বোচ্চ ৩০ শব্দের।

ন্যানো কবিতার বৈশিষ্ট্য
১.ভাবালুতাকে পুরোপুরি বর্জন করতে হবে।
২. উপমার প্রচলিত ধরণকে বর্জন করে এর সারাৎসারকে প্রকাশ করতে হবে কবিতায়।
৩. কবিতায় অর্থহীন বিশেষণ পুরোপুরি বর্জনীয়।

ন্যানো কাব্যতত্ত্ব অনুসারে আমরা যে ধরনের কবিতার জন্ম সম্ভব করে তুলতে চাই তার বীজ ইতিপূর্বে–অসচেতন-প্রসূত ভ্রুণাবস্থায়–ছড়িয়ে আছে অবশ্যই। আমরা চাই সজ্ঞানে একে সংঘটিত এবং বিকশিত করতে। কখনো কখনো ইদানীং ফেসবুকেও এধনের ভ্রুণের জন্ম হচ্ছে। আমরা চাই এর সজ্ঞান ও সচেতন পরিস্ফুটন। ন্যানো কবিতার একটি উদাহরণঃ
ওই দূরে দেখা যায় দিবসের রক্তিম ভ্রুণ,
এইখানে ট্রেনে-কাটা মানুষের দেহখণ্ড, খুন ।

জীবনের উদায়াস্তকে আমরা এই কাব্যোত্তীর্ণ মিতব্যায়িতায় প্রকাশ করতে চাই। একই সঙ্গে চাই অর্থহীন প্রলাপের শাব্দিক অপচয় থেকে কবিতাকে মুক্ত করতে। ইঙ্গিতময়তা ও সাংকেতিকতা হবে ন্যানো কাব্যের মূলমন্ত্র।

ন্যানো গল্প
গল্পের ধারণা থেকে ঝেড়ে ফেরতে হবে 'নিটোল কাহিনী বয়ানের' খাসলত। বর্ণনা নয়, বয়ানের ইঙ্গিতময়তা ও সাংকেতিকতার গুণেই গল্প হয়ে উঠবে তীব্র ও তীক্ষ্ণ। চরিত্রদের শরীরি বর্ণনা বর্জন করে– সম্ভব হলে– সংলাপ দিয়ে তাদেরকে স্পষ্ট করতে হবে। ন্যানো গল্পকে হয়ে উঠতে হবে স্মৃতিকাতর একটি ছবির প্রকাশের মতো। কিংবা একটি চকিত দৃশ্যের মাধ্যমে বিপুল ঘটনা ও কালপুঞ্জের ইশারাকে বাঙ্ময় করে তুলতে হবে, যেমনটা করেছিলেন গুয়াতেমালার কবি আউগুস্তো মোন্তেররোসো তার এক বাক্যের একটি গল্পেঃ "যখন সে জেগে উঠলো, ডাইনোসরটা তখনও সেখানেই ছিলো(cuando desperto, el dinosaurio todavia estaba alli)। গল্পকে হয়ে উঠতে হবে নির্ভার, ক্ষিপ্র গতিসম্পন্ন, বহুস্তরী, যথাযথ এবং স্বচ্ছ।

ন্যানো উপন্যাস
ন্যানো উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য হবে এই যে তার কোনো কেন্দ্রীয় চরিত্র থাকবে না। একই চরিত্র বিভিন্ন চরিত্রে প্রবেশ করে ইচ্ছে করলে নিজেদের মধ্যে শলাপরামর্শ করে কাহিনীকে সংক্ষিপ্ত করে নিতে পারবে। তবে এই সংক্ষিপ্তকরণের কাজটির মধ্য দিয়েই কৌশলে কাহিনীকে এগিয়ে নেবে স্বভাবপ্রসূত বিস্তারের পরিবর্তে।
ন্যানো উপন্যাসের একটি উদাহরণ :
"তুমি", বললো সে, "প্রতি ২৮ দিনে একবার তুমি তোমার ত্বককে পুরোপুরি বদলাও; আর আমি দিনে তা তিন চারবার করি ।" কালা শোনে না, অন্ধ দেখতে পায় না। সে পৃথিবীকে স্পর্শ করা বাদ দিয়েছিলো ।

ন্যানো প্রবন্ধ
আলোচ্য গ্রন্থের পুনর্কথন, চুম্বক অংশ উপস্থাপন ও প্রগলভতা বর্জন করে মর্মোক্তিকে প্রকাশ করতে হবে।

সব শেষে আমি একটি উদাহরণ হাজির করবো যা কবিতা এবং গল্প–উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হতে পারে । এটি কবিতার একটি অংশ, অলোকরঞ্জন থেকে, কিন্তু তিনি কবিতাটি সেখানেই শেষ করেননি বলে একে ন্যানো কবিতা বলা যাবে না। উদাহরণটা :

ধানখেতে এসেছিল বেড়াতে দু'জন
ধানখেতে শিশু রেখে পালাচ্ছে দু'জন

প্রেম এবং বিবাহবহির্ভুত যৌন সম্পর্কের সূত্রে সদ্যজাতকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সময়, সমাজ ও নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি সদ্যজাতের প্রতি আমাদের বেদনাবোধকে তুলে ধরার জন্য এই দুটি পংক্তিই যথেষ্ঠ।

এই ইশতেহারে উদ্বুদ্ধ হয়ে যারা ন্যানো সাহিত্য রচনা করবেন তাদেরকে অনুরোধ করবো নিচের ইমেইল ঠিকানায় আপনার লেখাটি বা লেখাগুলো পাঠাতে । আমরা পরে এগুলো সংকলন আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেবো । লেখার সঙ্গে লেখকের ছবি ও পরিচিতিমূলক তথ্য আবশ্যক।

এই ইশতেহারে যে-কেউ যুক্তি দিয়ে নতুন কিছু যুক্ত করার মাধ্যমে একে আরও সমৃদ্ধ করতে পারেন। আমরা পরে তা গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় ইশতেহারের 'সংযোজনা' অংশে অন্তর্ভুক্ত করে নেবো।
ইমেইল ঠিকানা: razualauddin@gmail.com