আহমদ ছফার অগ্রন্থিত রচনাকর্ণফুলীর ধারে

admin
Published : 28 July 2010, 03:17 PM
Updated : 28 July 2010, 03:17 PM


আহমদ ছফা

ভূমিকা / নূরুল আনোয়ার

আহমদ ছফার লেখা কেউ ছাপতে চাইত না, সেই কষ্টের কথা আমরা কম বেশি জানি। তিনি পত্রপত্রিকায় কবিতা পাঠালে ছাপার অযোগ্য বিবেচনা করে সম্পাদক সাহেবেরা তা দলামোচড়া করে ময়লার ঝুঁড়িতে ফেলে দিতেন। কবিতা লিখেন অথচ কোন পত্রিকা ছাপে না এটা বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে প্রচার পেয়ে গিয়েছিল। ব্যাপারটি তাঁকে এক রকম লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পাবার আশায় তিনি একদিন সংবাদ পত্রিকার অফিসে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন। পত্রিকাটি সম্পাদনা করতেন সন্তোষ দাশগুপ্ত। আহমদ ছফা তাঁর লেখা কবিতা সন্তোষবাবুর হাতে তুলে দিয়েছিলেন পত্রিকায় ছাপার জন্য। সন্তোষবাবু কবিতায় আগাগোড়া চোখ বুলিয়ে প্রশ্ন তুললেন, বাবা আছে?

আহমদ ছফার জবাব, নাই।

ভাই আছে?

আহমদ ছফার জবাব, আছে।

আহমদ ছফা জানতে চাইলেন, এসব জানার কারণ কী।

সন্তোষবাবু বললেন, চিঠি দেব যেন সহসা তোমাকে বিয়ে করায়। কবিতার নামে যারা মিনি বিড়ালের মত সঙ্গী খোঁজে তাদের ওষুধ বিয়ে করা।

আহমদ ছফা এসমস্ত কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি সন্তোষবাবুর ওপর ক্ষেপে গিয়ে পুরো অফিসটা মাথায় তুলে ফেলেছিলেন। সন্তোষবাবু যা ইচ্ছে বলে যাবেন আর আহমদ ছফা ছেড়ে দেবেন তা কী করে হয়? যাহোক, অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঝগড়া তাঁদের মধ্যে চলছিল। এমন সময় পাশের ঘর থেকে রণেশ দাশগুপ্ত বেরিয়ে এসে তাঁদের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন এবং আহমদ ছফাকে টেনে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরে বসিয়েছিলেন। রণেশবাবুকে আহমদ ছফা চিনতেন না। রণেশবাবুও না। তিনি আহমদ ছফাকে সতর্ক করে দিলেন সন্তোষবাবু পাগল কিসিমের লোক। সুতরাং তাঁর কথায় যেন কিছু মনে না করেন। রণেশবাবুর কথা শুনছিলেন বটে, কিন্তু আহমদ ছফা মনে মনে ঠিক করেছিলেন সন্তোষবাবু বেরুলেই পিটাবেন। এজন তিনি একটা চায়ের দোকানে বসে অপেক্ষাও করছিলেন। যে কারণেই হোক সেদিন সন্তোষবাবুর গায়ে হাত তোলার মত অপকর্মটি তিনি করেননি। পরবর্তীতে আহমদ ছফা সন্তোষবাবুকে গুরু হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন।

যাহোক, রণেশবাবু কথা দিয়েছিলেন তাঁর কবিতা পত্রিকায় ছাপা হবে। তিনি তাঁর কথা রেখেছিলেন। 'সংবাদ' পত্রিকায় একনাগাড়ে আহমদ ছফার চার চারটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। তারপর রণেশবাবু তাঁকে বলে যেতে থাকলেন, তুমি তো কৃষক সমিতি নিয়ে কাজ করেছ, ওসবের ওপর গদ্যে কিছু লিখ না কেন?

আহমদ ছফার ধারণা হয়েছিল কবিতার নামে যে অখাদ্য তিনি লিখে চলেছেন তা ছাপতে রনেশবাবু রাজি নন। তিনি প্রশ্ন তুললেন, আমার কবিতা কি ছাপার অযোগ্য?

রণেশবাবু বললেন, তা হবে কেন? যারা কবিতা লিখে তারা তো গদ্যে লিখতে পারে না। তোমার অভিজ্ঞতা আছে, যদি লেখার হাত থাকে ইচ্ছে করলে কাজে লাগাতে পার।

রণেশবাবুর পরামর্শ আহমদ ছফার মনে ধরেছিল। তিনি কানুনগোপাড়া আশুতোষ কলেজে অধ্যয়নের সময় রেললাইন উপড়ে ফেলার কারণে পুলিশের নজরে এসেছিলেন। ফলে তাঁকে এলাকা ছেড়ে গহীন অরণ্য পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছিল। প্রায় দু' বছর তিনি ওসব এলাকায় ছিলেন। ওখানে থেকে তিনি কিছু দুর্লভ অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। চন্দ্রঘোনা কাগজের কলের জন্য একমাত্র কাঁচামাল ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঁশ। এই বাঁশ সংগ্রহ করা মোটেই সহজ ছিল না। পাহাড়ি দুর্গম পথ কেটে কেটে এসব বাঁশ সংগ্রহ করা হত। কিন্তু এই বাঁশ সংগ্রহের জন্য শ্রমিক যোগাড় করা ছিল কঠিন কাজ। ঠিকাদারদের দালালেরা বিভিন্ন জায়গা থেকে লোভ দেখিয়ে শ্রমিকদের ধরে আনত। কোন রকমে শ্রমিক নিয়ে আসতে পারলেই তারা তাদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন করে কাজ আদায় করত। তাদের তেমন একটা মজুরিও দেয়া হত না। এসব কা-কারখানা আহমদ ছফার কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি মনে মনে স্থির করেছিলেন এই শ্রমিক নির্যাতনের ওপর একটি লেখা লিখবেন। সে রাতেই তিনি লেখাটিতে হাত দিলেন। লেখাটির নাম দিয়েছিলেন 'কর্ণফুলীর ধারে'। লেখাটির প্রথম কিস্তি লিখে যখন রণেশ দাশগুপ্তের হাতে এনে দিলেন তিনি বললেন, বেশ তো হচ্ছে, লিখে যাও।

ওই সপ্তাহে লেখাটি সংবাদের উপসম্পাদকীয়তে ছাপা হয়ে গেল। তখন সংবাদের আর্থিক অবস্থা তত ভাল ছিল না। সাংবাদিক-কর্মচারীদের বেতনও ঠিকমত দেয়া যেত না। লেখাটি ছাপা হলে আহমদ ছফা রণেশবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তিনি লেখাটি পুরোটা শেষ করার জন্য তাগাদা দিলেন। এক পর্যায়ে তিনি তাঁকে চা খেতে দিয়ে ক্যাশিয়ার আইয়ুব সাহেবের কানে কানে কী যেন বললেন। আইয়ুব সাহেব আহমদ ছফাকে পঁচিশটি টাকা এনে দিলেন। রণেশবাবু তখনও সামনে বসা। তিনি হেসে বললেন, তোমার লেখার যৎসামান্য সম্মানী।

একটা লেখা লিখে এত টাকা পাবেন আহমদ ছফা ভাবতেই পারেননি। তাঁর মতে, ওই সময় ওই টাকা দিয়ে একটা বড়সড়ো খাসি কিনতে পাওয়া যেত।

আহমদ ছফা টাকার লোভে লোভে লেখাটি লিখে যেতে থাকলেন। প্রতিটি কিস্তি ছাপার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে পঁচিশ টাকা দিয়ে দেয়া হত। ঘাপলা বাঁধল তখনই যখন তিনি ষষ্ঠ কিস্তি শেষ করলেন। আইয়ুব সাহেব বলে বসলেন তাঁকে আর টাকা দেয়া যাবে না। আহমদ ছফা গেলেন ক্ষেপে। তিনি ধরে নিলেন অল্প বয়সী বলে আইয়ুব সাহেব তাঁর টাকাটা মেরে দিচ্ছেন। যখন তিনি টাকার জন্য চাপাচাপি আরম্ভ করলেন আইয়ুব সাহেব বললেন, আপনাকে টাকা দেব কোত্থেকে। রণেশদার বেতনের টাকাটা আপনাকে সম্মানী হিসেবে দিয়েছি। তিনি এক শ' পঁচিশ টাকা বেতন পান। পাঁচ কিস্তিতে সব টাকা আপনাকে দিয়ে দিয়েছি। এখন আর অবশিষ্ট নেই। কথাটা শোনার পর আহমদ ছফা লজ্জায় পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি লেখাটা আর লিখেননি। রণেশ দাশগুপ্তের এই উদারতার কথা তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রেখেছিলেন।

'কর্ণফুলীর ধারে' লেখাটির বিশেষত্ব হল এটি আহমদ ছফার প্রথম প্রবন্ধ। সংবাদ পত্রিকায় উনিশ শ' পঁয়ষট্টি সালের দশ জুন এটি ছাপা হয়েছিল। লেখাটি সম্প্রতি বাংলা একাডেমী পত্রিকা লাইব্রেরী থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। প্রথমে ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তুলে প্রিন্ট করে আবার মূল কপির সঙ্গে মিলিয়ে লেখাটি উদ্ধার করা হয়েছে। পত্রিকাগুলি অনেক পুরনো ও জীর্ণ হয়ে যাওয়ায় ফটোকপি করা যায় নি।

আমরা ধরে নিয়ে ছিলাম এ লেখা আর কোনদিন খুঁজে পাব না। ভাগ্য আমাদের নিরাশ করেনি। আশা করছি, আগামী একুশে বইমেলা উপলক্ষে প্রকাশিতব্য আহমদ ছফা রচনাবলির 'উত্তরখণ্ডে' তা অন্তর্ভুক্ত হবে। ২৮ জুলাই আহমদ ছফার নবম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর এই মৃত্যুবার্ষিকীকে সামনে রেখে লেখাটি পাঠকদের উৎসর্গ করা হল।

কর্ণফুলীর ধারে

কর্ণফুলীর আরেক নাম সোনাছড়ি। স্থানীয় লোকেরা বলে কর্ণফুলীর বুকে ফি বছর শুধু পলিমাটির সোনা নয়, বাঁশ, কাঠ, ছন, বেত, তরিতরকারি আরও রকমারি সোনা ভেসে ভেসে দূর-দূরান্তের দেশ হতে বিদেশে চলে যায়। বারবার হাত বদলের সঙ্গে সঙ্গে মালের যেমন কদর বাড়ে, তেমনি বাড়ে মুনাফার অঙ্ক। পার্বত্য চট্টগ্রামের সবটুকু ছোট-বড় পাহাড়ে পর্বতে ঘেরা। এসব পাহাড়ে মগ-চাকমা এবং অন্যান্য আদিবাসীরা 'জুম' চাষ করে। সমতল ভূমিতে রোপণ করে ধান, সর্ষে, কচু ইত্যাদি। এছাড়া সমগ্র-পার্বত্য অঞ্চল বাঁশ, গাছ, ছন, বেত আরও কত বনজ সম্পদে সমৃদ্ধ।

প্রায় এক যুগ হতে চলল সরকারি কর্তৃপক্ষ বনজ সম্পদের সদ্ব্যবহার করে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় করা এবং জনসাধারণের জীবিকার মান উন্নয়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার চন্দ্রঘোনায় কাগজের মিল স্থাপন করেন, যে কাগজের কলকে সরকারি নথিপত্রে এবং স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে এশিয়ার বৃহত্তম কাগজের কল বলা হয়ে থাকে। কাগজের কলে বাঁশ পেষাই করে নানারকমের যান্ত্রিক পদ্ধতির মধ্য দিয়ে নানা রকম কাগজ বানানো হয়। এখন কথা হল এশিয়ার বৃহত্তম পেপার মিলের উদরপূর্তির জন্য যে পদ্ধতিতে বাঁশ আমদানি করা হয়—তাই নিয়ে। পদ্ধতিটা রয়ে গিয়েছে অতীতের অন্ধকার গর্ভে। মিলের অন্তত তিরিশ চল্লিশ মাইলের মধ্যে কোন উল্লেখযোগ্য বাঁশের বন নেই। গভীর পার্বত্য অঞ্চল—পাহাড়ি পথে মিলের থেকে যে সব এলকার দূরত্ব এক শ' মাইলেরও বেশি অনেক সময় প্রতিবেশী দেশের বর্ডারের কাছাকাছি সেসব অঞ্চলেই নিবিড় বাঁশের বন। একেকটা বাঁশ ইয়া মোটা—আশি, এক শ' ফুট লম্বা। পাটের বনের চেয়েও বাঁশের বন ঘন। বাঁশের পাতার আড়াল দিয়ে রাতের কুয়াশা মাটিতে পড়ে না, সকাল নয়টা-দশটার আগে ঠিক মত সূর্য দেখা যায় না। পাহাড়িয়া জন্তু, হাতি, ভালুক এমনকি বানরও এসব বাঁশবনে বাস করতে পারে না। চারদিকে শুধু বাঁশ-বাঁশ আর বাঁশ।

মিল কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বাঁশের ঠিকাদারেরা কুলি দিয়ে বাঁশ কাটায়। বাঁশ কাটাবার সময় আগাগোড়া দুদিকে ফেলে দিয়ে শুধু মাঝের অংশটুকুই নিয়ে থাকে। এতে করে একটি বাঁশের তিন-ভাগের দুভাগ অপচয় হয়। একটা কাঁচা বাঁশের দুদিকে দুটো পুরনো বাঁশ না থাকলে ঝড়ের সময় সবগুলো বাঁশের আগা ভেঙে যায়। ঠিকাদার এবং মিলের কর্মচারীদের কর্তব্যের অবহেলার দরুন অনেক বাঁশের বন ইতোমধ্যেই আগা ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। সে যা হোক, কুলিরা বাঁশ কেটে আঁটি বেঁধে পাহাড়ের বিভিন্ন স্থানে হাজার হিসেবে জমা করে। এসব কাটা বাঁশকে নিকটবর্তী ছড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য পাহাড়ের ধার ঘেঁষে ঘেঁষে ছোট ছোট ছড়ার তীর পর্যন্ত রাস্তা কাটা হয়।

এ রাস্তা তৈরির কন্ট্রাক্টর যারা তারা প্রায় সকলেই স্থানীয় লোক নয়। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেসব অঞ্চলে পার্বত্য অধিবাসী মগ মুরংয়েরাও কোনদিন যায়নি ওসব জায়গায় মাটি কাটার জন্য কিভাবে কুলি সংগ্রহ করে এবং কুলিদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে তাই-ই আমার বলার বিষয়। তার আগে বাঁশ কিভাবে চন্দ্রঘোনায় গিয়ে পৌঁছে সে বিবরণটুকু দিচ্ছি।

একেকটা রাস্তার দূরত্ব ত্রিশ-চল্লিশ মাইল এবং সময়ে সময়ে আরও বেশি হয়ে থাকে। কন্ট্রাক্টারেরা এক মাইল আধ মাইল করে রাস্তার কন্ট্রাক্ট নেয় এবং কুলিদের দিয়ে রাত দিন অমানুষিক পরিশ্রম করিয়ে দু'তিন মাসের মধ্যে রাস্তা করে ফেলে। রাস্তা করার সময় মাঝে মাঝে বৃত্তাকার টার্নিংও কুলিদের দিয়ে তৈরি করায়। ওইসব টার্নিংয়ে লুপ লাইন বসিয়ে প্রায় আধ মাইল স্থানের কাটা বাঁশ এক জায়গায় জড়ো করা হয়। এভাবে সমস্ত টার্নিংগুলোতে কাটা বাঁশ জড়ো করা হলে পরে ছয় চাকা বিশিষ্ট ট্রাকগুলো কাটা রাস্তার উপর দিয়ে বাঁশ নিয়ে যায় নিকটবর্তী ছড়ির কাছাকাছি। ঠিকাদারের মাইনে করা মজুরেরা প্রতি বাঁশের আগায় দুটো ফুটো করে ফুটোর মধ্য দিয়ে একটি বাঁশের চাঁদা ফালি ঢুকিয়ে দিয়ে চালি বা ভেলা বাঁধে। তারপর এসব ভেলা ছড়ির জলে ভাসিয়ে ভাসিয়ে মজুরেরা কর্ণফুলীতে নিয়ে যায়। কর্ণফুলীর বুকে ভাসতে ভাসতে যখন কাপ্তাই বাঁধের কাছে ভেলাগুলো পৌঁছে তখন আবার ভেলা খুলে ফেলা হয়। আঁটি বেঁধে ট্রাকে তোলা হয়। ট্রাকে করে বাঁধ অতিক্রম করার পর নদীর জলে নামিয়ে আবার ভেলা বাধবার পালা। এই ভেলা ভেসে ভেসে চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের কাছে এলে ঠিকাদারেরা মিল কর্তৃপক্ষের কাছে অপেক্ষাকৃত বেশি লাভে বাঁশ বিক্রি করে দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে ঘরে চলে যায়। ভেলা খুলে আবার আঁটি বেঁধে দুটো লোহার হুক লাগিয়ে ঘূর্ণায়মান লুপ লাইনে আঁটি আঁটি বাঁশ তুলে দেওয়া হয়। চোখের পলকে বাঁশের আঁটিগুলো পেষণ-যন্ত্রের উদরে চলে যায়, তারপর এ-কল, সে-কল এমনি হাজারও মেশিন ঘুরে আরেক দিক দিয়ে বেরিয়ে আসছে গাঁইট গাঁইট তৈরি কাগজ।

এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন। সবসময় ঠিকাদারদের বাঁশের চালান চলছে এবং সে সঙ্গে রাস্তাও কাটা হচ্ছে। এ বছর একদিকে রাস্তা কাটলে পর বছর আরেকদিকে, যেদিকে বাঁশের বন আরও নিবিড়, সেদিকেই রাস্তা কাটা হয়, পাহাড়িয়া ভূমির উর্বরতা শক্তি খুবই বেশি, কাটা রাস্তা তিন মাসের মধ্যেই ঝোপ-ঝাড়-আগাছা ইত্যাদিতে ঢেকে যায়। দু'তিন বছর পর আগের পাহাড়ে বাঁশ কাটলেও আবার রাস্তা বানাতে হয়। ঠিকাদারেরা ছুটে আসে এবং ধাপ্পাবাজদের দিয়ে কি জঘন্য পদ্ধতিতে দূরদূরান্ত থেকে মজুরদের ভুলিয়ে এনে আধমরা করে ছেড়ে দেয়। এই মজুরদের অনেকে পরিবার পরিজনের মুখও দেখতে পায় না; পাহাড়িয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে কি নিদারুণ দুঃখে ওখানেই প্রাণ হারায় সেকথা এর পরে বলব।

ঠিকাদারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মাঝিরা কুলি সংগ্রহের জন্য কোন গ্রামে যায় না। কেন গ্রামে যায় না তা পরে বলব। তারা টাকা নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসে এবং মাদারবাড়ি, নালাপাড়া ইত্যাদি অঞ্চলের সস্তা আট-দশটা ঝুপড়ি ঘর ভাড়া করে রেখে দেয় এবং ওসব ঘরে সব সময় ঢালাও চাটাইয়ের বিছানা পেতে রাখে। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও থাকে। ওসব ঘরে দিনে এক আধবার ঠিকাদার বা ঠিকাদারের লোক এসে ঘরে খবর নিয়ে যায়, কতজন যোগাড় হল।

মাঝি বা আড়কাঠিরও আবার অনেক চর আছে। তারা সারাদিন সারা শহর চষে বেড়ায়। সুবিধা মত কোন মানুষ পেলেই এসব ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে আসে। চার-পাঁচজন অথবা আরও বেশি লোককে এক সঙ্গে তারা কখনও কাজের কথা বলে না। ওভাবে কুলি সংগ্রহ করতে গেলে বেশ একটু ঝুঁকি নিয়ে হয়। তাই তারা একলা মানুষকেই সব সময় প্রলুব্ধ করে বেশি।

চট্টগ্রাম শহর এদেশের শ্রেষ্ঠ বন্দর হওয়ায় কাজের আশায় আশেপাশের কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং আরও কিছু জেলার লোকেরা কাজ-কর্মের অনুসন্ধানে আসে। যারা কাজের অনুসন্ধানে একজন অথবা দুজন এমনিভাবে আসে তারা গাঁয়ের সরল মানুষ। অনেকে আগে কর্মব্যস্ত শহর কি জিনিস তা কোনদিন দেখেনি। সকলের তো আর চেনাজানা মানুষ শহরে থাকে না। গাড়ি থেকে কাঁথা বালিশ বগলে, জুড়ি কোদাল কাঁধে এসব মানুষ হঠাৎ যানবাহন, গাড়ি-ঘোড়া, লোক-লস্কর দেখে একদম হতবুদ্ধি হয়ে যায়। আগের অভ্যাস না থাকায় রাস্তায় ঠিকমত চলতে পারে না। মোটরকার ইত্যাদি যানবাহনের দুর্ঘটনার ভয়ে খুবই সন্তর্পণে রাস্তার একপাশ দিয়ে হাঁটে। আড়কাঠির চেলারা তখন এসব মানুষের অনুসরণ করে। তাদের সঙ্গে একেবারে দরদী বন্ধুর মত ব্যবহার করে। রাস্তা চিনিয়ে দেয়। পকেট থেকে বিড়ি বের করে খেতে দেয়। এমনকি চা-নাস্তাও খাওয়ায়। লোকগুলোর মন কৃতজ্ঞতায় যখন ভরে ওঠে তখনই সুযোগ বুঝে কন্ট্রাক্টরের গুণপনা বর্ণনা করে। অনুরোধ করে, "চলুন না আমাদের কন্ট্রাক্টর সাহেবের সঙ্গে। তিনি খুবই পরহেজগার মানুষ, পাঁচবেলা নিয়মিত নামাজ-পড়েন, কারও হকের পয়সা কখনও মাটি করেন না।" তাদের পরোপকার বৃত্তি এবং ঠিকাদারের মাহাত্ম্যে মোহিত হয়ে ঝুপড়ি ঘরগুলোতে উঠে আসে। আড়কাঠিরা তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বলে, আপনাদের কোনও চিন্তা নেই। এখানে খান আর ঘুমান, কন্ট্রাক্টর সাহেব খুবই দয়ালু লোক। তিনি আপনার গাঁট থেকে আপনাদের খাওয়া-পরার বন্দোবস্ত করেছেন।

শুধু গাঁয়ের লোক কেন অনেক শহর চেনা মানুষও দালালদের প্রলোভনে মুগ্ধ হয়ে এসব ঝুপড়ি ঘরে এসে ওঠে। কেমন করে ভাই বলছি। কোন ফ্যাক্টরি, মিল অথবা দোকানের কর্মচারীরা যখন চাকুরি হারায় অনেকের গাঁটে তখন দেশে ফিরে যাবার পয়সা থাকে না। অনেকে আবার শহরের চাকচিক্য ছেড়ে গ্রামে যাওয়াটা মনের দিক থেকে অনুমোদনও করতে পারে না। অথচ তাদের খাবার পয়সা নেই। এসব চাকুরিহারা লোকগুলোর প্রতি ওরা নজর রাখে। চাটগাঁ শহরের লালদীঘির পাড়, জিয়া পার্ক, স্টেডিয়াম, রেলওয়ে স্টেশন, সদরঘাট ইত্যাদি অঞ্চলে অন্নহীন-বস্ত্রহীন অনেক মানুষ দিনরাতে ক্ষুধিত কুকুরের মত ঘুরে বেড়ায়। দালালেরা অগ্রণী হয়ে এসব মানুষের সঙ্গে আলাপ জমায়। দুঃখে নানারকম সহানুভূতি, সান্ত্বনার বাণী উচ্চারণ করে, পানটা বিড়িটা খেতে দেয়। ওসব অভুক্তের মনের অবস্থা এমন তারা একবেলার ভাতের বিনিময়ে যে কোন কাজ করতে রাজি। এভাবে দিনে দিনে বর্ণিত স্থানগুলো হতে নতুন নতুন কাজের মানুষ ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে আসে। তবে তাদের একটা নিয়ম হল, পঞ্চাশের উপরে যাদের বয়স, যারা কঠোর পরিশ্রম করতে পারে না অথবা যারা খুবই দুর্বল তাদেরকে দালালেরা প্রলুব্ধ করে না।

এছাড়া আরও আছে, কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে এমনি অনেকে মা-বাপের ওপর রাগ করে টাকা-পয়সা চুরি করে শহরে চলে আসে। শহরে এসে অবিবেচকের মত দু'হাতে খরচ করে সব টাকা উড়িয়ে উপোষ করে থাকে। কি খাবে, ঘুমাবে কোথায় ইত্যাদি নানা সমস্যার জর্জরিত অবস্থায় দু'চোখে যখন অন্ধকার দেখে তখনই ওদের সামনে হাজির হয় দালালেরা। মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে আসে। এদের মধ্যে যথেষ্ট সংখ্যক হাইস্কুলেরর নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্রও আমি দেখেছি। স্কুলের নবম-দশম শ্রেণীর ছাত্ররা সাধারণত একটু কল্পনাপ্রবণ হয়ে থাকে। অ্যাডভেঞ্চার বা অভিযানের নেশা তাদের এমনভাবে পেয়ে বসে যে, কোন একটা ছুতো পেলেই শিক্ষক অথবা অভিভাবকের সঙ্গে ঝগড়া করে অথবা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে কিছু টাকা পয়সা নিয়ে শহরে চলে আসে। শহরে এসে তারা সে একই অবস্থার সম্মুখীন হয়। তখন দালালেরা তাদের কাছে এসে কেরানি, পিওন ইত্যাদি চাকুরির লোভ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে ঝুপড়িতে নিয়ে যায়। দিনের পর দিন মানুষ বাড়ে, মোটা চাল আর ডাটা জাতীয় তরকারি রান্না করা হয় দু'বেলা। অভুক্তেরা খেতে পেয়ে একটু তাজা হয়ে ওঠে। মজুরেরা কাজ পেয়েছে একথা ভেবে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

এতেই শেষ নয়। ওরা ছোট ছোট ছেলেদেরকেও ফাঁদে ফেলে। সুশ্রী, ফর্সা চেহারার ফুটফুটে সুন্দর ছেলেরা যখন অসহায়ভাবে চলমান পথের দিকে তাকিয়ে থাকে তখন দালালেরা এসে একান্ত আত্মীয়জনের মত পিঠে হাত বুলিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করে। অনেক গৃহপালানো ছেলে কেঁদে কেঁদে তাদের মা-বাপের কথা বর্ণনা করে। দালালেরা আশ্বাস দেয় তাদেরকে তাদের বাপ-মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে বলে। এটা সেটা কিনে দিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করে। তারপর তারা ছেলেদেরকে নির্জন ঘরে নিয়ে রাখে। সাধারণ কুলিরা তো তখনও কিছু জানতে পারে না।

কাপ্তাইয়েরও এক শ' দেড় শ' মাইল ওপরে যেখানে সত্যিকার অর্থে বাঘ-ভালুকও যায় না সেসব নারী-বিবর্জিত অঞ্চলে নিয়ে গিয়ে কিভাবে তাদের পাশবিক বৃতি চরিতার্থ করে সে কথা যথাসময়ে বলব।

মাস পনের দিনের মধ্যেই ঝুপড়িগুলো ভরে ওঠে মানুষে। যাওয়ার আগের দিন কুলিদের কার পেছনে কত খরচ হল তা আড়কাঠি এবং ঠিকাদারের লোকেরা গোপনে হিসেব করে লিখে রাখে।

তারপর এসব মানুষদেরকে ঠিকাদারের হাতে তুলে দেয় আড়কাঠিরা। ঠিকাদার সব কিছু বুঝে নিয়ে এক সকালে সকলকে নিয় লঞ্চে উঠে। কর্ণফুলীর জলে ঢেউ তুলে লঞ্চ উজানের দিকে ছুটে যায় সিটি বাজিয়ে।

লঞ্চ সেদিনই সন্ধ্যায় কাপ্তাই এসে পৌঁছে। কাপ্তাইঘাটে লঞ্চ থামলে পরে ঠিকাদারের মানুষেরা তাদের আনা মানুষের দিকে কড়া নজর রাখে, যাতে কেউ ফাঁকি দিয়ে নেমে যেতে না পারে। সব যাত্রী নামবার পর গুণে গুণে তারা এসব মানুষদের নামায়। কাজটি এত সতর্কতার সঙ্গে করে যে, কুলিদের কেউ টেরও পায় না। কাপ্তাইয়ের সস্তা কোন হোটেলে কিছু নাস্তা ইত্যাদি খাইয়ে তাদেরকে নিয়ে যায় সামনের পাহাড়ের উপরের পথ দিয়ে।

কেউ কেউ ঠিকাদারের মানুষদেরকে প্রশ্ন করে কাপ্তাই তো এসে গেলাম। এখন আবার কোথায় যেতে হবে? ওরা শুধু বলে, আরে মিয়ারা, চল – আসল কথা জানতে দেয় না। ওই দিনই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সকলে কাপ্তাইয়ের প্রায় দু'মাইল ওপরে রাইংখং বাজারে এসে পৌঁছে। টাউটেরা আসল কথা ভুলাবার জন্য তাদেরকে গান গাইতে বলে। নিজেরা নানা কেচ্ছা কাহিনীর অবতারণা করে। পাহাড় দেখেনি দলের অনেকে। একদিকে পাহাড় এবং অন্যদিকে যন্ত্রের কর্মব্যস্ততা ইত্যাদি দেখে অনেকেরই প্রাণ আপনা-আপনি আনন্দে নেচে ওঠে। গলা দিয়ে হঠাৎ নতুন কিছু দেখার আনন্দে গান বেরিয়ে আসে। যুবকেরা এই মগ-চাকমার আজব দেশের তরুণীদের গল্প করতে করতে মৌজ করে পথ চলে। রাইংখং রাজার থেকে যে হাঁটা দিয়েছে, একটু পরেই ক্ষুধায় তাদের পেট চিন চিন করে ওঠে। আর বিজলীবাতি নেই। পাহাড়গুলো উঁচু হতে উঁচুতর হচ্ছে। দু'পাশে নিবিড় বন। সরু পথে হাঁটতে তাদের গা ভয়ে ছম ছম করে, বুকে আশঙ্কা দোলা দিয়ে যায়, যাচ্ছি কোথায়? এরকম একটা ভয়ে সবাই আতঙ্কিত হয়ে ওঠে।

স্টেডিয়াম, সদরঘাটের সে দরদি বন্ধুদের ডেকে বলে, ও ভাই, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? ঠিকাদারের ভাড়াটে টাউটেরা নানারকম তালবাহানা করে আসল কথা এড়িয়ে যায়, এভাবে পাহাড়ের পাশ দিয়ে, সমতল ভূমির উপর দিয়ে, চাকমা পল্লীর ধার ঘেঁষে প্রায় ঘণ্টা তিনেক হেঁটে সকলে ধুল্যাছড়িতে এসে পৌঁছায়। ধুল্যাছড়ি হল রিজার্ভ ফরেস্টের যাত্রাপথের প্রথম বিরাম স্থল, ওখানে কতকগুলো হোটেল আছে। দোকানপাটও কিছু আছে। হোটেলগুলোও অনেকটা মাচানঘরের মত। এখানে এসে সকলে ভাত খায় এবং সে রাতের মত ঘুমায়।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ভীতি বিস্ফারিত চোখে সমতল ভূমির মানুষগুলো চেয়ে দেখে চারদিকে পাহাড় ঘেরা থমথমে পরিবেশ, কোন মানুষজন নেই তেমন। তাদের মুখের ভাষা মুখেই আটকে যায়। কেউ কেউ অস্ফূট চিৎকার করে ওঠে, 'আল্লাহ কোন দেশে আইলাম গো।'

ধুল্যাছড়ি থেকে যাত্রা শুরু করে পরের দিন। পাহাড়িয়া পথে প্রায় দশ মাইল হেঁটে বিলাইছড়ি বাজারে এসে পৌঁছে। মানুষদের চোখে মুখে তখন যে উদ্বেগ এবং বেদনা আমি দেখেছি – জীবনে তা কোনদিন ভুলব না। তবু তারা অনভ্যস্ত পায়ে পাহাড়িয়া বন্ধুর পথে হোঁচট খেতে খেতে সামনে এগিয়ে যায়।

বিলাইছড়ি বাজারটা অপেক্ষাকৃত জনবহুল স্থান। এখানে যে বাজার তা কাপ্তাই, চন্দ্রঘোনা এবং রাঙ্গামাটি বাদ দিলে পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্যকেন্দ্র। চাকমা, মগ এবং অন্যান্য আদিবাসীরা এ বাজারে কার্পাস, সর্ষে ইত্যাদি এবং আরও অনেক কিছু বিক্রয় করতে আনে। সেজন্য চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীদের ভীড় এই বাজারে।

বিলাইছড়ি খালে গোসল করে লোকগুলো হোটেলে এসে ভাত খায়, পেটে ক্ষুধা সকলের। তবু কারও মুখে ভাত রোচে না। সকলের চোখে আতঙ্কের আভাস। অচিন চাকমা তরুণীদের উদ্দেশ্যে হাসি-ঠাট্টা করা যুবকেরাও চিন্তার ভারে নুইয়ে পড়ে। ঠিকাদারের লোকেরা আর কতকগুলো লোকের সঙ্গে গলাগলি করে। এসব লোকদের ভাষা এরা বুঝতে পারে না। কারণ ওরা এ দেশের অধিবাসী নয়। এরা ঠিকাদারদের আগের লোকগুলোসহ চাকমা পাড়া থেকে বাংলা মদ আনিয়ে পান করে। সারারাতই মাতলামি করে।

সে রাতে প্রায় চারটের সময় সকলে যাত্রা শুরু করে। বুকের বল দমে গেছে মানুষদের। কোন অদৃশ্য শৃঙ্খল দিয়ে তাদেরকে বেঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছে যেন। এবারে জনমানুষের আনাগোনা একেবারে নেই। বিলাইছড়ির কাছাকাছি স্থানসমূহে মগ, মুরং, চাকমা, টিপরাদের বসতি শেষ।

বিলাইছড়ি, ধুল্যাছড়ি এসব জায়গায় বর্তমানে কাপ্তাই বাঁধ দেওয়ার ফলে পানির তলায় ডুবে গেছে; কিন্তু আমার যা বলবার বিষয়, মানে কুলিদের ওপর নির্যাতন এখনো সমানে চলছে।

রিজার্ভড এরিয়া শুরু হয়েছে। পাহাড়ের উচ্চতা ক্রমশ বাড়ছে। পথ চলার কষ্ট আগের চেয়ে দু'গুণ কি তিন গুণ বেড়ে গেছে। ঠিকাদারদের লোকদের সঙ্গে গলাগলি করা মানুষগুলো বন্দুক কাঁধে আগে পিছে চলেছে, কারও কারও হাতে চিকন পাহাড়িয়া বেতের ছড়ি। বয়সে যারা কচি সমান তালে হাঁটতে পারছে না ইতোমধ্যে শপাং শপাং তাদের পিঠে আঘাত করতে শুরু করেছে। দলের আর আর সকলে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে; হ্যাঁ সত্যি তারা ফাঁদে পড়েছে। সবকিছু দেখে, সব অনুভব করতে পেরে কারও কারও চোখ ফেটে ক'ফোটা পানি নিরবে দু'গ-ে গড়িয়ে পড়ে। কিছু বলে না। নিজেদেরকে ভাগ্যের হাতে সপে দিয়ে পথ চলে নিরবে।

একেকটা পাহাড় আধ মাইল এক মাইল উঁচু। সে সব উঁচু পাহাড়ের ধার দিয়ে বয়ে গেছে সরু পায়ে চলার পথ, ছড়ি থেকে ঝোপঝাড়, বাঁশের বন, কাঁটাবন ইত্যাদি ঠেলে চড়াইয়ে উঠতে উঠতে সকলের বুকের রক্ত পয়মাল হয়ে যায়। প্রতিবাদ করার উপায় নেই।

ছড়ির দেশ পার্বত্য চট্টগ্রাম। মৌসুমি বর্ষার শোষিত জল পাহাড় চুঁইয়ে চুঁইয়ে সারা বছরই নির্গত হয়। এই পাহাড় চোঁয়ানো জলে আরও পাহাড় চোঁয়ানো জল মিশে ক্ষীণ স্রোত বয়ে যায়। এমনি পাঁচ সাত, আট দশটা এমনকি আরও বেশি মিলিত হয়ে রচনা করে ছড়ি। এসব ছড়ি নিচের দিকে নেমে এসেছে এবং শেষ গতিতে কর্ণফুলীর বুকে মিশে গেছে।

এভাবে ছড়ির পর ছড়ি পেছনে পড়ে থাকে। তারা এগুতে থাকে সামনে। পিয়াসায় ছাতি ফেটে যায়। ছড়ির জলে তৃষ্ণা মেটায়, পুরোদিন চলার পর তারা আদি পথে এসে একটা বড় গাছের নিচে রাত্রি যাপন করে। পোটলা-পোটলি খুলে কিছু খেয়ে নেয়।

পরের দিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শরু হয় আবার পথ চলা। কত কষ্ঠ যে এ পথ চলায় তা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ জানে না। একেকটা উঁচু পাহাড়ে উঠতে গেলে আট দশবার প্রস্রাব করতে হয়। শরীরে ঘামও আর থাকে না বেরুবার। পাহাড়িয়া অঞ্চলে যাবার জন্যে কেউ পথ কেটে রাখেনি। এসব অঞ্চলে আদিবাসীরাও আসেনি আগে। পায়ে চলার পথও সে কারণে সৃষ্টি হয়নি। কোন কোন সময়ে পথের সামনে পড়ে দুর্ভেদ্য বন, তাও অতিক্রম করতে হয়। গা এবং গায়ের বিভিন্ন স্থান বন্য কাঁটার কামড়ে ছিঁড়ে যায়। দরদরিয়ে রক্ত ছোটে। সময় কই লক্ষ করবে। একটু গাফলতি দেখলেই পশাং শপাং কয়েক বেতের বাড়ি পিঠে পড়বে। আগের দরদি বন্ধুদের মুখের আদল তখন কসাইয়ের মুখের মত দেখায়। তাদের মুখের ক্রুর হাসি কেমন শানিত অথচ কত নিষ্ঠুর।

এভাবে শুক্কুরছড়ি, যমুনাছড়ি, ভাইবইন ছড়ি, চড়া চড়ির ওড়া ছড়ি, ফারোয়া ছড়ি ইত্যাদি শত শত ছড়ি পেরিয়ে সন্ধ্যা সাত-আটটার সময় বর্ডারের কাছাকাছি কর্মস্থলে এসে পৌঁছে—ঠিকাদারদের লোকেরা এসে সে সদরঘাটের মানুষদের সঙ্গে মোলাকাত করে। আর সব মানুষ পরস্পরের দিকে বোবা দৃষ্টি মেলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে নির্বাক নিস্পন্দ। চারদিকে পাহাড়ে বাঁশের বন।

বাঁশবনে পৌঁছে প্রথম রাতে কুলিরা কোন রকমে কাটায়। পরদিন সকালে ঠিকাদারের লোকদের চিৎকারে ঘুমভাঙা চোখ মেলে তারা চমকে ওঠে। একি দুঃস্বপ্ন দেখছে? কোথায় এল তারা? চারদিকে জঙ্গল। জঙ্গলের বাঁশের পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে না আকাশের উদারতা, বাঁশের ঘন বনের কোন ওপারে দিগন্তের রোদ ঝলসানো সোনালি রেখা, চারদিকে বিশাল নিবিড় ভয়ঙ্কর নিশ্চুপ আদিম অরণ্য। সৃষ্টির আদি থেকে প্রকৃতির আপন খেয়ালে বাড়ছে। দৃষ্টির অগম্য দূরে তারা ফেলে এসেছে ঘরবাড়ি পরিচিত পরিবেশ। চোখের সামনে সবকিছু ভেসে ওঠে। কিসে যেন কি হয়ে গেল। তখন চোখে পানিও নেই। আছে শুধু বনের নিশ্ছিদ্র আদিম ভয়াল পরিবেশ। সে পরিবেশের মাঝখানে তারা। সামনে যমদূতের মত দণ্ডায়মান ঠিকাদারের ভাড়াটে চেলাচামুণ্ডার দল।

সারা শরীর পুঁজে পুষ্ট ফোঁড়ার মত ব্যথাভারে জর্জরিত। এপাশ ওপাশ ফেরার শক্তি কারও নেই। তবু একটা জিজ্ঞাসা সকলের মুখে, এলাম কোথায়?

সেকথার উত্তর কেউ দেয় না। হুকুম করে কন্ট্রাক্টরের চেলারা, সকলে উঠে পড়। সমতল ভূমির মানুষ একে ত পাহাড়িয়া অঞ্চলের উঁচু-নিচু পথে হাঁটার অভ্যেস কারও নেই, তদুপরি এই যে দুর্গম পর্বতমালা, একে অতিক্রম করে অতীতে কদাচিৎ মগ-মুরংয়েরাও এসেছে কিনা সন্দেহ। হালের কাজে, মাঠের কাজে যারা অভিজ্ঞ তাদের কথা না হয় বাদ দেয়া যায়, কিন্তু যারা দোকানে কাজ করেছে, শহরে কাটিয়েছে অথবা যারা মা-বাপের সঙ্গে ঝগড়া করে স্কুলের পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বুকিয়ে এসেছে, তাদের অবস্থা?—সেকি বলা যায়, না কলম দিয়ে লেখা যায়?

তবু এসব প্রাণহীন মানুষকে উঠতে হয়। জঙ্গলের আড়ালে পায়খানা-প্রস্রাব করে জলের সন্ধান করে। কিন্তু জল কোথায়? পাহাড়ের গা চুঁইয়ে চুঁইয়ে জলের মত একজাতীয় রঙিন তরল পদার্থ বেরিয়ে আসছে। তাই দিয়ে চাল ধোয়া, কাপড় ধোয়া, পায়খানা-প্রস্রাবের জল শৌচ এবং পানীয় জল, এ অবস্থা দেখে কাউকে কাউকে হেসে উঠতে দেখেছি। কারণ কাঁদবার শক্তি তারা হারিয়ে ফেলেছে। প্রেতের হাসির মত সে হাসি। কত বিবর্ণ, কত করুণ, কত বেদনা মাখা মানব সন্তানের জীবনীরসের সে নিদারুণ অভিব্যক্তি।

রহস্যময়ী বনভূমি অনেক কিছুই আদি থেকে লোক চোখের আড়াল করে রেখেছে। রহস্যের পর রহস্য। লোকগুলোর চোখে ভাষা ফোটে না, কপালে বলিরেখা পড়ে না, চেতনা তাদের মরে গেছে। মৃত্যুর ওপারে দাঁড়িয়ে তারা যেন ঠিকাদারের মানুষদের হুকুম আদেশ নিরবে পালন করে যাচ্ছে।

এরপর তাদের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যে ঘরগুলোতে থাকতে হবে তা দেখিয়ে দেওয়া হয়। পাহাড়ের থলিতে এসব ঘর বেঁধে রাখা হয়েছে। বাঁশের মাচান ঘর। চারধারে বাঁশ দিয়ে ঢাকা ওপরে বাঁশপাতার ছাউনি, শীতের দিনে বনের হিমেল হাওয়া বর্শার ফলার মত সারা শরীরে এসে বিঁধে। বর্ষায় বৃষ্টির ছাঁট অবাধে ঘরে ঢুকে ঘরের মানুষদের আড়ষ্ট করে ফেলে। ফাগুনে বনভূমি আগুন। বঙ্গোপসাগরের অতল প্রশান্তিমাখা সুশীতল দখিনা হাওয়া এ বনের রাজ্যে প্রবেশ করে না। একেকটা ঘরে ত্রিশ থেকে চল্লিশ জন মানুষকে থাকতে হয় গাদাগাদি করে। এপাশ থেকে ওপাশে ফেরা যায় না। মানুষগুলো কিছু বলতে পারে না। বলার যে সাহস তা ফুরিয়ে গেছে। অনুভূতি তাদের গাছের মরা ডালের মত শুকিয়ে গেছে। বেঁচে থাকবার আশা-ভরসা, জীবনের স্বাদ-আহ্লাদ ঝুপড়ি ঘরের ক'বেলা ডাঁটার তরকারি দিয়ে মোটা চালের ভাতের বদলে সদরঘাটের দয়াল বন্ধুদের কাছে বিক্রি করেছে। এখন সামনে যা আসে, নির্বিবাদে তাই-ই মেনে নিতে হবে। বিরতি দিলে চলবে না।

থাকার ঘর দেখার পালা শেষ হয়। সে মাচান ঘরে নিজেদের কাঁথা-বালিশ রেখে দেয়, মৃতকল্প এসব মানুষ! বনের এ নিঃসীম রাজ্যেও নিজের একটু অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কি আকুল আগ্রহ! ঠিকাদারের মানুষেরা তাদেরকে তারপর রান্না-বান্নার সাজ সরঞ্জাম দেখিয়ে দেয়। দু'চারটে হাড়ি পাতিল, একজনের জন্য এক একটা মাটির সানকি ঠিকাদারের তরফ থেকে বরাদ্দ করা। ঠিকাদারের নিজস্ব স্টোর বা দোকান আছে। তাতে নৌকায় করে বিলাইছড়ি বা আরও দূরের রাঙ্গামাটি বাজার হতে চাল ডাল মরিচ ইত্যাদি নৌকা যোগে এনে জড়ো করে রাখে। স্টোর থেকে বাকিতে সব কিছু নিতে হয়। নতুন মানুষেরাও চাল, ডাল এনে মাটিতে গর্ত করে আগুন জ্বালিয়ে ভাত চড়িয়ে দেয়। ভাত পাক হয়ে গেলে মাড়-ফেনসহ ক্ষুধার তাড়নায় গোগ্রাসে খেয়ে নেয়। খাওয়ার পর মুখ-হাত ধুয়ে যেই একটু ঘুমাতে যাবে অমনি এসে হাজির ঠিকাদারের লোকেরা।

মিয়ারা চল সকলের কাজ দেখে আসবে। অবিশ্রান্তভাবে ত্রিশ চল্লিশ ঘণ্টা ধরে মানুষগুলো তাদের ছেড়ে যাওয়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোর দিকেও ভাল করে নজর রাখতে পারেনি। ওদের কথার জবাব দেবার ভাষা কারও মুখে যোগায় না। শুধু মরা মাছের চোখের মত দৃষ্টি হুকুম দাতাদের আজরাঈলের মত চোখ-মুখের দিকে নিঃশব্দে বাড়িয়ে ধরে। ব্যথা জর্জরিত শরীর নিয়েও ওদের উঠতে হয়। নিস্তেজ অনিচ্ছুক পাগুলো ছেঁচড়িয়ে ছেঁচড়িয়ে হুকুমদাতাদের অনুসরণ করে।

সাইট বা কর্মস্থলের দূরত্ব বাসা থেকে এক মাইল, আধ মাইল। সময় বিশেষে আরও বেশি হয়ে থাকে। কেউ মাটি কাটছে, কেউ বাঁশ কাটছে, কেউ কেউ বাঁশ গাছের গোড়া তুলছে, যারা শক্ত সবল তাদের কারও হাতে ছেনি মার্তুল, কারও হাতে শাবল গাঁইতি, পাহাড় যেখানে পাথুরে সেখানে আঘাতের পর আঘাত করছে। আঘাতের চোটে পাথর ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ফুলকিতে ফুলকিতে ঠিকরানো আগুন। ঘামে সারা শরীর ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। পিছে ফেরা তো দূরের কথা–একজনের সঙ্গে আরেকজন একটু কথা বলবে তার উপায়ও নেই। ঠিকাদারের এ-দেশীয় ও-দেশীয় চরদের হাতের চিকন কোরক বেত সশব্দে আঁছড়ে পড়ছে পিঠে। সূর্য ওঠার আগে ওরা কাজে গিয়েছে। বারোটার সময় এসে ডালের পানি আর সে ফেনশুদ্ধ ভাত খেয়ে একটার সময় আবার যেতে হয়েছে। সূর্য ঠিক ডুবে গেলে তাদের ছুটি হবে। রিজার্ভ ফরেস্টের কুলিদের কাজ করবার সময় হল। এদিকে সূর্য ওদিকে আকাশে তারা ওঠা এর মাঝখানে শুধু খাবার সময়টুকু ছাড়া সব সময় কাজ করতেই হবে।

নতুন মানুষদের দেখে পুরান মানুষেরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, কিছু বলে না তাদের কেবল নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে রিজার্ভ ফরেস্টে বল-বীর্য স্বাস্থ্য বলি দিতে এরাও এসেছে।

সাইট দেখান হল। সেদিনই ঠিকাদারের লোকেরা তাদেরকে গাঁইতি, কোদাল, শাবল, কুড়াল দেখিয়ে বলে যে যেটা চালাতে পারবে সেটা নিয়ে তাড়াতাড়ি হাতল লাগাও। ওরা ইতস্তত করে। তখন ঠিকাদারের লোকই বাঁটোয়ারা করে দেয়, যারা অপেক্ষাকৃত সবল তাদের হাতে শাবল অথবা ছেনি, মার্তুল, তার চেয়ে যারা দুর্বল তাদেরকে গাঁইতি, কুড়াল এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলদেরকে কোদাল দেয়া হয়।

যাদেরকে কেরানি, পিওন ইত্যাদির চাকুরি দেবে বলে এনেছে তারা যখন সে কথা বলে তখন মুখ ভ্যাংচিয়ে নানারকম টিপ্পনী কাটে যমদূতের মত লোকগুলো। স্কুল পালান ছেলেরা তাদের হাতে পায়ে ধরে বলে আমরা বাপের বাড়িতে শুধু লেখাপড়া করেছি। এসব কাজ কোনদিন করিনি। কে শোনে কার কথা।

কিশোরদের ঠিকাদারদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেন পাঠায় তা কারও অজানা নয়। তবু আমি এদের দৈনন্দিন জীবন বর্ণনা করার সময় এই নারী বিবর্জিত রিজার্ভড ফরেস্টের সে বীভৎস দিকটিও ইঙ্গিত বর্ণনা করব—শালীনতার মধ্য দিয়ে যত কম কথায় পারা যায়।

ওসব মানুষেরা কোদাল, কুড়াল, গাঁইতি, শাবলে হাতল লাগিয়ে নিয়ে সেদিন সন্ধ্যার মত রান্না করে খেয়ে ঘুমাতে যায়। সামনে যে জীবনের সংকেত তারা দেখতে পেয়েছে তারই তড়াসে অথবা যে ক্লান্তি তাদের শরীরের রোমে রোমে বাসা বেঁধেছে তারই চাপে, মোটা মুলি বাঁশের মাচানে খাঁচাবদ্ধ মুরগির মত ঘুমিয়ে পড়ে।

মশুর ডালের পানি আর ফেন-মাখা ভাত খেয়ে ওদেরকে সাইট-এ ছুটতে হয়। সেদিনকার মত কাজ শুরু হয়। পাহাড়ের পাথুরে অঙ্গ গাঁইতির আঘাতে আঘাতে মসৃণ করবার শিক্ষা তাদের কই? বিরাট বিরাট শত শত গাছের গোড়া উৎপাটন করার কাজও দেয়া হয়েছে তাদের। কাউকে কাউকে পাথরে সুড়ঙ্গ করে বারুদ দিয়ে পাথর ফাটানোর কাজ শিখাবার জন্য নেওয়া হয়েছে। স্কুলের যেসব ছাত্র কেরানি-পিওন বনবার আশায় এসেছে রিজার্ভড ফরেস্টে, তাদের প্রতি একটু করুণা করা হয়। তার মানে অপেক্ষাকৃত কম পরিশ্রমের কাজ তারা করে। একটা চটের বস্তার দু'দিকে দুটো ডাণ্ডা লাগিয়ে মাটিভর্তি বস্তাগুলো পাহাড়ের পাশে পাশে ঢেলে দেয়। দুপুর বারটা বাজলে তারা ডেরায় এসে সেই মশুর ডালের পানি আর ফেন মাখা ভাত খেয়ে আবার কাজে যায়। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা হলে তাদের ছুটি।

এভাবেই কাজ চলে প্রতিদিন। মানুষগুলো অতীষ্ট হয় ওঠে। পালাবার কথা তাদের মনে আসে, কিন্তু কেমন করে পালাবে? সারারাত বন্দুক নিয়ে কুলিদের বাসা পাহারা দেয় ঠিকাদারের লোক। আর তাছাড়া এ বিশাল দুরধিগম্য অরণ্যের ওপাশে মানুষের বাসভূমি কোথায় তা কেমন করে খুঁজে নেবে? মানুষগুলো তো এক একজন এক এক জায়গার, বাঙলায় কথা বললেও ভাষার বিভিন্নতার জন্য একজন আরেক জনের সঙ্গে মন খুলে আলাপ করতে পারে না। ঠিকাদারের লোকেরা সব সময় তাদের ভেতর এ বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখে। এসব ছাড়াও তাদের পালাতে হলে যে রাস্তা কাটছে সে রাস্তা বেয়েই ছড়িতে নামতে হবে। বিভিন্ন ঠিকাদারেরা এক আধমাইল ভাগাভাগী করে রাস্তার কন্ট্রাক্ট নেয়। রাতের বেলা রাস্তার উপরেও পাহারা বসায়। এক ঠিকাদারের লোক দুয়েকজন পাহারাদারকে ফাঁকি দিতে পারলেও একজন না একজনের হাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে। ধরা পড়লে আবার ঠিকাদারদের কাছে পাঠান হয়। কাজ করলে তবু ক'দিন বাঁচার আশা আছে। কিন্তু পালান মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। তবু মুক্তি পিয়াসী মানুষকে আমি পালিয়ে যেতে দেখেছি। ধরা তারা পড়েছে, শাস্তিও পেয়েছে।

দেখেছি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মজলিশপুর গ্রামের মফিজ উদ্দিনকে পালিয়ে যেতে। সে চারজন প্রহরীকে ফাঁকি দিতে পেরেছিল। কিন্তু পঞ্চম জনের হাতে ধরা পড়ে আবার তাকে ঠিকাদারের বাথানে আসতে হয়েছিল। কত যে মেরেছিল ওকে। জোয়ান মানুষের তাজা রক্ত পিচকারির মত ছুটেছিল বেতের ছড়ির আঘাতে। উঃ! গত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও আমি দেখিছি। এদের তুলনায় ওরা আরও নৃশংস। আরও পিশাচ, এতে শেষ নেই, ঠিকাদার বিচার করে রায় দিল, মফিজুদ্দিনকে একটি বিরাট তেরপাল দিয়ে বেঁধে বস্তার মত করে মাচান ঘরের তলায় রাখা হবে প্রতি রাতে। শুধু নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য নাক-মুখ খোলা রাখা হবে। তাই-ই তারা করেছিল মফিজুদ্দিনকে। রাতে তেরপাল জড়িয়ে মাচান ঘরের তলায় রাখত আর দিনের বেলায় কিছু খাইয়ে কাজে নিয়ে যেত। এভাবে একমাস কেটেছে মফিজুদ্দিনের। তারপর একদিন যখন মফিজুদ্দিনের সারা গায়ে বিষাক্ত ঘা হল তখনই তাকে মাচান ঘরে শুতে দেয়া হয়েছিল। সেই সংক্রামক ঘায়ে আক্রান্ত হয়েছিল আরও অনেকে। আমি শুনেছি, আরও আগে নাকি পালাবার অপরাধে একজনের হাত পা গাছের সঙ্গে বেঁধে সারা গায়ে পেরেক মেরে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাটা আমাকে যে লোকটি বলছিল সে ঠিকাদারের এক বিশ্বস্ত লোক।

রিজার্ভড ফরেস্টে ফেরারি আসামিদের আড্ডা পাহাড়িয়া দুর্গম পথে কাপ্তাই হতে প্রায় দেড় শ' দু'শ' মাইল ওপরে। পুলিশের কি সাধ্য ওদের নাগাল পায়। এদেরই কেউ কেউ ঠিকাদারদের দক্ষিণ হস্ত। বছরের পর বছর এরা রিজার্ভেই থাকে। ঠিকাদারের তরফ থেকে ওদের জন্য সব রকমের সুখ-সুবিধার ব্যবস্থাও করা হয় ঘিয়ে ভাজা রুটি খেতে দেওয়া হয়। সকাল-বিকেল দু'বেলা চা খেতে পায়। রাতের বেলা তুলার বালিশে, লেপের ওমের তলে ঘুমোয়। ভুলিয়ে আনা কিশোরদেরকে প্রতিরাতে পালা করে এদের সঙ্গে ঘুমাতে হয়। এসব ব্যাপার রিজার্ভে অহরহ ঘটছে। ছেলেদের করুণ আর্তচিৎকারে কুলিরাও ঘুমোতে পারে না। কিন্তু কি করবে তারা? করবার কি আছে তাদের? এসব বিকৃত রুচির মানুষদের বীভৎস আচরণে রাজি না হলে অরণ্যের হাড় কাঁপানো শীতে তাদেরকে হাত-পা বেঁধে উদোম গায়ে বসিয়ে রাখা হয়।

সব দেখে শুনে একবার আমি ঠিকাদারদের একজনকে বলেছিলাম, তোমরা এভাবে মানুষের উপর এবং বিশেষ করে তোমাদের নিজ সন্তানের মত ওই ছেলেদের ওপর এমনভাবে অত্যাচার কর কেন? এটা কি এমনি যাবে মনে কর? এর কি কোন প্রতিকার নেই? ঠিকাদার আমার কথা শুনে যে জবাব দিয়েছিল তার মানে—'আমরা জঙ্গলকে মঙ্গল বানাচ্ছি। তোমার বয়স অল্প সেজন্য বুঝবে না। আমরা জঙ্গলকে মঙ্গল বানাচ্ছি, তা করতে হলে জীবন যৌবনের কিছু অপচয় অবশ্যই হবে।'

এই-ই তো রিজার্ভড ফরেস্ট। দিনে দিনে মানুষগুলোর হাড়গুলো স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। মাসে একবারও গোসল করতে পারে না। গোসল করার পানি কই? পানির জন্য যেতে হয় বনপথে চার-পাঁচ মাইল। ঠিকাদারের জোরসে কাজ চলছে। সুতরাং তারা গোসল করবে কেন সময় নষ্ট করে? কাপড়ে চুলে একজাতীয় সাদা উকুন বাসা বাধে। রোদের তাতে ওসব উকুনের কামড় হয়ে ওঠে তীব্র। হাত পেছনে নিয়ে চুলকাবার সুযোগও পায় না। অমনি কয়েক বেত পিঠের ওপর সশব্দে আছড়ে পড়ে। ঠোঁটগুলো শীতের সময় কুষ্ঠরোগীর মত কেটে ফেটে ছিঁড়ে যায়। সারা শরীর পিচের মত নিকষ কাল হয়ে যায়। মুখম-লের মাংস চেপে বসে যায়, নরকঙ্কালের মত দেখায় ওসব মুখের আদল। মরণের ওপারের কোন প্রেতপুরীতে যেন হাওয়ার ঘায়ে এদিক থেকে ওদিকে হেলে যাচ্ছে। হাঁটতে পারে না। শরীরের রক্ত-মাংস-বল-বীর্য সব ঠিকাদারেরা শুষে নিয়েও তাদের নিষ্কৃতি দেয় না। সাইটের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত এ কঙ্কাল দিয়েই তারা মাটি কাটায়, পাথর কাটায়, গাছের গোড়া উপড়ায়, বারুদ দিয়ে বিরাট পাথুরে পাহাড় ফাটিয়ে মাঝখানে রাস্তা তৈরি করে। কিসের আশায়? কিসের নেশায়?

প্রতিদিন সকালে জীবিত কঙ্কালগুলো সার বেঁধে মাটি কাঁটতে যায়। পাহাড়ের ধারে ধারে রাস্তা বাঁধার কাজ এগিয়ে চলে। কুলিদের বুকের রক্তঝরা মেহনতে রাস্তার কাজ এগিয়ে যায় তরতরিয়ে। ঠিকাদারের মুখে ধূর্ত শেয়ালের মত কেচকে হাসি ফোটে। কুলিরা হিসেব করে আর কত বাকি মরণের। হাঁ, কুলিরা ওখানে মারা যায়। রাত্রিতে মশার কামড় খেয়ে কম্প দিয়ে জ্বর আসে গায়ে। বাদুড়ের মত বিরাট বিরাট মশার কামড় খেয়ে যে জ্বরে তারা পড়ে অনেক সময়, তাতেই হৃৎপি-ের ধুকধুক কাঁপুনিটুকু স্তব্ধ করে দিয়ে যায়। এমনি বেঘোরে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখেছি সন্দ্বীপের আউয়ালকে। উনিশ বছরের ডবকা ছেলে, কালীনাগের মত কাল গায়ের রং, এক মাথা কাল চুল। দাঁতগুলো ধুতরা ফুলের মত সাদা। শ্যামলা মুখের পেলব পেলব ভাবটুকু ছিল মায়াময়। মারা গেল। বেচারি একখানা কাফনও পায়নি। মাটির গর্ত করে তাকে সেখানে চিরদিনের মত শুইয়ে আবার উপরে মাটি চাপা দিয়েছে তার সাথীরা।

যারা মরে তারা বেঁচে যায়। অমানুষিক অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পায়। কিন্তু যারা বেচে থাকে? তাদের অবস্থা? সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যা দিন গড়ায়, আর এগিয়ে চলে রাস্তা বাঁধার কাজ। গতরের বলবীর্য শুষে নিয়ে পাহাড়ের কোল বেয়ে কাল নাগিনীর মত এঁকে-বেঁকে সামনের দিয়ে বয়ে যায়।

রাস্তা তৈরি হলে ঠিকাদারেরা লাখ লাখ টাকা পাবে। কিন্তু কুলিরা পাবে কি? আর কুলিরা কি খেয়েই বা এ রাস্তা বেঁধে যায়? আগেই তো বলেছি। ওরা ফেনমাখা ভাত খায়, আর খায় মশুর ডালের পানি। টমেটো, আলু ইত্যাদি তরি-তরকারিও ঠিকাদারেরা অনেক সময় বিলাইছড়ি বাজার থেকে কিনে নৌকায় করে এনে স্টোরে মজুদ করে রাখে। কুলিরা স্টোর থেকে বাকিতে চাল-ডালের সঙ্গে তরিতরকারিও খরিদ করে।

সে আরেক কথা। বিলাইছড়ি বাজারের কেনাদরের পাঁচগুণ দাম আদায় করে নেওয়া হয় তাদের কাছ থেকে। টমেটোর দাম নেয় কুলিদের কাছ থেকে এক টাকা চার আনা, কুলিরা কিছুই জানতে পায় না, ঠিকাদারের কেরানি খাতায় হিসেব করে রাখে। সব জিনিসের দাম এরকমই দ্বিগুণ, তিন গুণ, চার গুণ হয়ে থাকে। কুলিরা জানে না কিছু। যা লাগে দৈনিক স্টোর থেকে আনে। রান্না করে খেয়ে কোন রকমে হাড়সর্বস্ব শরীরগুলোকে সচল রাখে। পঁচিশ টাকা যে চালের মণ বিলাইছড়ি বাজারে, কুলিদের কাছে বাকি বিক্রি করার সময় তার দাম চল্লিশ টাকা, ছয় আনা সের আলুর দর এক টাকা দেড় টাকা, এমনি করে টাকার হিসেবে খাতা ভর্তি হয়।

রিজার্ভড্্ ফরেস্টের নির্বান্ধব অরণ্য। রাতে মশার কামড়। দিনে পোকা-মাকড়, অসহ্য হয়ে ওঠে দিন দিনে। একটু ধোঁয়া না হলে তাদের চলবে কেন? সেজন্য তারা স্টোর থেকে বিড়ি ম্যাচ খরিদ করে। চার আনা দামের বিড়ি প্যাকেটে নেট বার আনা লাভ করে। এক একজন মানুষের দৈনিক এক এক প্যাকেট বিড়ির প্রয়োজন হয়।

হাড়ভাঙা পরিশ্রম কোদালে পা কেটে যায়, আঙুল ছেঁচে যায়। বারুদের আগুনে ফাটানো পাথরের পাহাড়ে হরহামেশা পাগুলো গুরুতরভাবে জখম হয়, এভাবে জখম হয়ে পড়ে থাকলে কন্ট্রাক্টরের রাস্তা তৈরি হবে না। সেকথা তারা বেশ ভাল ভাবে জানে। এজন্য প্রত্যেক কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে একজন ইনজেকশন ফুঁরতে পারার মত হাতুড়ে ডাক্তার থাকে। আর থাকে নানাজাতীয় কিছু মিকশ্চার এবং ট্যাবলেট। এসব আহতদের প্রাথমিক শুশ্রুষার পরে আর বসে থাকতে দেয়া হয় না। দু'আনা দামের একটা ট্যাবলেট কেউ খেলে পরে ঠিকাদারের কেরানি তার নামে ডাক্তার খরচ লিখে রাখে এক টাকা। হরদম চোট লাগছে কুলিদের হাতে গায়ে আর ডাক্তার খরচও বেড়েই চলছে। এতেই শেষ নয়, যারা একটু সুস্থ সবল তাদেরকে কন্ট্রাক্টরের চেলারা তাস জুয়া ইত্যাদি শেখায়। নগদ টাকা ধার হাওলাত দেয়। খেলায় হারলে ক'বছর রিজার্ভে থাকবে তাই নিয়ে বাজি ধরে। নতুন লোকেরা খেলায় হেরে যায় এবং রিজার্ভে থাকতেও বাধ্য হয়।

যারা এভাবে কাজ করে তাদের দৈনিক দেড় সের পরিমাণ চালের ভাত না হলে পেট ভরে না। সে অনুপাতে তরকারিরও প্রয়োজন। সারাদিন পাহাড় পাথর কেটে বাসায় বাসায় এলে পরে তখন তাদের দু'একটা ট্যাবলেটেরও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কুলিরা কিছুই জানে না, শুধু ঠিকাদারের স্টোর হতে প্রয়োজনের সময় কেরানিকে দিয়ে লিখিয়ে যা লাগে তাই নেয়। ঠিকাদারের হাতুড়ে ডাক্তারকে রোগির শরীরে ইনজেকশনের বিনিময়ে ডিস্টিল ওয়াটার ইনজেক্ট করে দিতে দেখেছি। এক একটা পেনিসিলিন ইনজেকশন যেগুলোর দাম বড়জোর এক টাকা কিংবা বার আনা সে রকম একটা ইনজেকশনের খরচ লিখে রাখে রোগির নামে কমসে কম চার পাঁচ টাকা।

এমনি করে সুখে-দুঃখে সাইটের কাজ শেষ হয়ে আসে। ঠিকাদার কর্তৃপক্ষের কর্মচারীকে কাজ বুঝিয়ে দেয়। কুলিরা হাড় জিরজিরে শরীরখানা নিয়ে হলেও দেশে যেতে পারবে ভেবে মনে মনে চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

তারপর বলে হিসেব নিকেশের পালা। ঠিকাদার মিথ্যা কথা বলে না। ঝুপড়ি ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদেরকে যে হিসেবে রোজকার মাইনে দেওয়া কথা ছিল তাই দেয়। দিনে চার টাকা ধরে। সর্বমোট কোন কুলি যদি চারমাস কাজ করে সে ঠিকাদারের কাছে পাওনা হবে চারশ' আশি টাকা। এরপরে ঠিকাদার নিজের পাওনার হিসেব করে। চালের দাম কাটে প্রতি মণ চল্লিশ টাকা করে। ডালের দাম কাটে সের আড়াই টাকা। বিড়ির দাম এক টাকা প্যাকেট। এছাড়া তেল, হলুদ, তরিতরকারি সবগুলোতে ইচ্ছামত দাম ধরে। হিসেবের পরে দেখা যায়, ঠিকাদারের কাছেই প্রত্যেক বিশ পঁচিশ টাকার বাকিদার হয়ে পড়েছে। ঠিকাদার দুর্বল অক্ষমদের অনেক সময় পথ ভাড়া দিয়ে দেয় দয়া করে। কি বিচিত্র দয়া! তারপরে শক্ত সবলদেরকে নিয়ে নতুন সাইটে লাগিয়ে দেয় কাজে। কুলির আড়কাঠিদেরকে প্রতিরোজ মাথা কিছু চার আনা করে কমিশন বুঝিয়ে দেয় ঠিকাদার। ঠিকাদার লাখ টাকা পেলে আড়কাঠি পায় হাজার টাকা। আবার তারা শহরে এসে বসে। ভাই বন্ধু ডেকে মানুষকে ভুলিয়ে আবার ঝুপড়ি ঘরে তোলে। আবার চালান দেয় লঞ্চে করে কর্ণফুলীর উজানে—যেখানে বন্য জন্তুরা বাস করে না, মগ মুরংয়েরা যায় না সেই নিভৃতিতে। মানুষগুলো কি হারিয়ে আসে সেকথা পূর্বোক্ত অধ্যায়গুলোতে খুবই সংক্ষেপে বলতে চেষ্টা করেছি।

সর্বশেষে দেশের মানুষের চোখের সামনে আমরা শুধু একটি প্রশ্ন তুলে ধরতে চাই—তাহল আর কতকাল চলবে এ বীভৎস অত্যাচার? আর কতকাল?

সংবাদ ১০-৩০ জানুয়ারি ১৯৬৫