ভারতীয় শিখা আর পৃথিবীর প্রতিধ্বনি

আলোচ্য এই গ্রন্থে কেবল ভারতীয় তথা বাংলা ভাষার লেখকদের প্রতিই তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত নয়, আছেন আরও তিনটি মহাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন লেখক।

রাজু আলাউদ্দিনরাজু আলাউদ্দিন
Published : 28 March 2023, 10:56 AM
Updated : 28 March 2023, 10:56 AM

অবিশ্বাস্য শুনালেও, স্প্যানিশ ভাষার সাথে ভারতীয় সংস্কৃতির সংযোগ কম করে হলেও ৮ শ বছরের পুরোনো। সম্পর্কের সূচনা যদিও খানিকটা ঘুর পথে। স্পেনের কাস্তিয়্যার রাজা তৃতীয় ফের্নান্দোর ছেলে আলফনসো এল সাবিয়োর শাসনামলে (১২৫২-১২৮৪) তারই নির্দেশে calila e Dimna শীর্ষক একটি আরবি গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছিল স্প্যানিশ ভাষায়। বইটি আরবি ভাষায় রচিত হলেও গ্রন্থের গল্পগুলোর উৎস ছিল ভারতীয়। অনুবাদের অনুবাদ যদিও, তারপরও দুই মহাদেশের মধ্যে এই সম্পর্ক রচিত হয়েছিল। অনুবাদ ছাড়া আর কোন উপায়েই বা এক ভাষার সাথে আরেক ভাষার সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব? তবে সূচনা হলেও তার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়নি কয়েক শতাব্দী যাবৎ। উনিশ শতকের আগে থেকে ভারতীয় চিরায়ত সাহিত্য ও দর্শন বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অনুবাদ হলেও, মূলত রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারের ফলে ভারতের প্রতি স্প্যানিশভাষী লেখক-অনুবাদকদের মনোযোগ ঘনীভূত হতে শুরু করে। আর বিশেষভাবে সমসাময়িক ভারতীয় সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ও চর্চার ধারাবাহিকতায় লাতিন আমেরিকার সাড়া কেবল তাদের প্রতিই যারা হয় ইংরেজি ভাষায় লিখেছেন নয়তো ইংরেজির বদৌলতে স্প্যানিশ ভাষায় অনূদিত হয়েছেন। বাংলা ভাষার প্রায় কোনো লেখককেই এই তালিকায় পাওয়া যাবে না। এক্ষেত্রে একুয়াডরের মারিয়া এলেনা বাররেলা একমাত্র ব্যতিক্রম যার আগ্রহ ও চর্চার কেন্দ্রে ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার লেখক তো আছেনই, আছেন বাংলা ভাষার প্রধান দুই লেখকও: রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। এক অর্থে গোটা লাতিন আমেরিকায় তিনিই একমাত্র ভারতবিশেষজ্ঞ যিনি প্রাচীন ও সমসাময়িক ভারতীয় এবং বাংলা সাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিকহাল ও চর্চাকারী। মারিয়াকে আমরা নজরুল ইসলামের প্রথম স্প্যানিশভাষী অনুবাদক হিসেবে ইতিমধ্যে জেনেছি। কিন্তু তিনি যে এই অনুবাদ প্রকাশের আগেই La Flama y el Eco নামে স্প্যানিশ ভাষায় একটি প্রবন্ধের বই লিখেছিলেন তা আমাদের কাছে—মূলত ভাষিক দূরত্বের কারণে--এখনও অজানা।

এই গ্রন্থের প্রায় এক তৃতীয়াংশ ভারতীয় লেখকদের নিয়ে লেখা। আর গোটা বইটিকে বলা যায় সমকালীন বিশ্বসাহিত্যের দর্পণ কারণ এতে ইউরোপ, আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা এবং ভারতের বহু লেখককে নিয়ে আছে তার গভীর ও স্বচ্ছ এমন কিছু হৃদয়গ্রাহী প্রবন্ধ যেগুলো স্প্যানিশ ভাষায় প্রথমবারের মতো আবির্ভূত হয়েছে। ভারতীয় সাহিত্য ও লাতিন আমেরিকান কোন কোন লেখক সম্পর্কে তার অনুসন্ধানী গবেষণাগুলো আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। ভারতীয় সাহিত্যের ঐতিহ্য সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে Poetica India, Fiscinante Tradicion প্রবন্ধে তিনি ভারতীয় পুরাণ ও মহাবাক্যগুলোকেও আলোচনায় রেখেছেন ঐতিহ্যের ধারাবাহিক বিস্তারের একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরার জন্য। ভারতীয় সাহিত্যের অরবিন্দ আধিগা, কিরণ দেশাই, ভৈকম মুহাম্মদ বশীর, কুররাতুল আইন হায়দার, হরিবংশ রাই বচ্চন, আমীর খসরু, মহাদেবী ভর্মা, গালিব ও রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আছে স্বতন্ত্র কয়েকটি প্রবন্ধ। এদের প্রত্যেককে নিয়ে এই প্রবন্ধগুলোতে আছে লেখকের বিস্তৃত কিন্তু গভীর উপলব্ধি। আছে কখনো কখনো তুলনামূলক এমন সব উন্মোচন যা আলোচিত লেখকদেরকে পাঠের নতুন প্রসাদে একই সঙ্গে সমসাময়িক ও তাৎপর্যময় করে তোলে। ভারতীয় এই লেখকদের সম্পর্কে তার আলোচনাগুলোয় কেবল তার পাণ্ডিত্যই নয়, আছে অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে দেখার গভীরতা। ভারতীয় বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য নিয়ে তার অভিনিবেশ ও পাণ্ডিত্য লাতিন আমেরিকার সমসাময়িক অন্য কোনো লেখক বা সাহিত্য সমালোচকের আছে কিনা জানি না। লাতিন আমেরিকায় নিশ্চয়ই অনেক বড় বড় লেখক আছেন, আছেন ভারতবিশেষজ্ঞও। কিন্তু ভারতীয় এতগুলো ভাষার লেখক সম্পর্কে এমন বিস্তৃত ধারণা ও পাণ্ডিত্য আমি ওখানকার অন্য কোনো লেখকের মধ্যে অন্তত দেখিনি। এছাড়া বাংলা ভাষার রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল সম্পর্কে তার গভীর আলোচনাগুলো তো আছেই। তবে আলোচ্য এই গ্রন্থে কেবল ভারতীয় তথা বাংলা ভাষার লেখকদের প্রতিই তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত নয়, আছেন আরও তিনটি মহাদেশের শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন লেখক। আমাদের কাছে অল্পপরিচিত ব্রাজিলের লেখক সিরাল্দো আল্ভেস পিন্তোকে নিয়ে লেখাটিতে দেখিয়েছেন কীভাবে এই লেখক শিশুসাহিত্যের জগতে প্রথা ভেঙে তৈরি করছেন নতুন ধারা। এই লেখক যে গোটা লাতিন আমেরিকায় জনপ্রিয় লেখকদের একজন তা এই লেখাটি না পড়লে আমারও জানা হতো না। কিন্তু মারিয়া আমাদের কাছে পরিচিত লেখকদের নিয়েও যখন লিখছেন তখন তাদের সম্পর্কে অজানা আর নতুন তথ্যে আমাদের সামনে হাজির করছেন। যেমন ধরা যাক হোসে মার্তিকে নিয়ে তার Los pasos de Marti en Nueva York প্রবন্ধটি। নিউ ইয়র্কে তার সফর সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল নিতান্ত সামান্য। অথচ এই লেখাটি পড়লে বোঝা যায়, তার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রচনা লিখিত হয়েছে ওই নিউ ইয়র্কে। এবং মারিয়ার ভাষ্যমতে, মার্তির ওই সফর সংক্ষিপ্ত বা লোক-দেখানো (Breve o superficial) ছিল না। এই লেখককে নিয়ে মারিয়া পরবর্তীকালে আরও কিছু অনুসন্ধানী কাজ করেছেন যা তার অন্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ত্রিনিদাদের লেখক ভি এস নাইপল, ফরাসি লেখক লে ক্লেজিও, হুইটম্যানের Leaves of Grass-এর একুয়াদরিয় অনুবাদক ফ্রান্সিস্কো আলেকজান্ডার, ফরাসি লেখিকা রেজিনে পেরনাউ, বর্তমান ইউক্রেনের ঔপন্যাসিক ইরেনে নেমিওরভস্কি, ইতালিয় সাহিত্যের উমেবের্তো একো ও এমিলিও সালগারি, কলম্বিয়ার গার্সিয়া মার্কেস নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা তো আছেই।

এই গ্রন্থে ব্যতিক্রমধর্মী কয়েকটি আলোচনা হচ্ছে সাহিত্য ও টিভি-নাটক ( literature y telenovela), অভিধান নির্মাণ (Creando Diccionarios), নেরুদা ও পিনোচেত ( Neruda y Pinochet), প্রান্তের কণ্ঠস্বর (Voces en los margenes) আর আছে লেখিকার মাতামহ একুয়াডরের বিখ্যাত কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক পাবলো বালারেসো মোংকাইয়োকে ( Pablo Balarezo Moncayo en la memoria) নিয়ে। এই লেখাগুলো সাহিত্যগুণে এবং তথ্যমূল্যে কেবল উপভোগ্যই নয়, লেখিকার বিশ্লেষণী গুণে খুবই তাৎপর্যময়। পেত্রার্কার উত্তরাধিকার (El legado de Petrarca) কীভাবে পরবর্তীকালে, এমনকি আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে তার এক হৃদয়গ্রাহী আলোচনাও আমার দেখতে পাবো এই গ্রন্থে। এছাড়া, নিউ ইয়র্কে কবির নির্বাসন ( los Exilios de Poeta en Nueva York), এলমিরায় মার্ক টোয়েন ( Mark Twain en Elmira), ব্রোংসে পো(Poe en el Bronx), ব্রুকলিনে হুইটম্যান (Whitman en Brooklyn) শীর্ষক যে লেখাগুলো আছে, এগুলো মূলত নিউ ইয়র্ক শহরের চারটি এলাকায় চারজন লেখকের বসবাসের ঘটনা ও তাদের রচনার আলোকে তৈরি হলেও, এই লেখাগুলোয় মারিয়ার নতুন নতুন কিছু পর্যবেক্ষণও আমরা দেখতে পাবো। এগুলোর মধ্যে দীর্ঘ লেখাটি লোরকাকে নিয়ে। এছাড়া,হার্ভার্ডে বোর্হেসের অভিভাষণের সংকলন This craft of verse বইটি নিয়ে হার্ভার্ডে বোর্হেস (Borges en Harvard) শীর্ষক একটি ছোট্ট আলোচনা আছে যেখানে তিনি এই বইটির জন্মের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। বোর্হেস হার্ভার্ডে বেশ কিছু বক্তৃতা দিয়েছিলেন ১৯৬৭ সালের দিকে। ক্যাসেটে ধারণ করা সেই বক্তৃতাগুলো গ্রন্থাকারে বেরিয়েছিল অনেক পরে, ২০০০ সালে। মারিয়া এই বইটির অস্তিত্বহীনতা থেকে মূর্ত হওয়ার ঘটনাকে খুব সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন। রবীন্দ্র অনুবাদ (Traduciendo a Tagore) শিরোনামে এক ছোট্ট প্রবন্ধে মারিয়া স্প্যানিশ ভাষায় রবীন্দ্রনাথের অনুবাদের প্রাচুর্যের কথা জানালেও তিনি রবীন্দ্রনাথের গোটা রচনার তুলনায় তাকে আংশিক বলেই মনে করেন। তিনি আশা করেন ভবিষ্যতে রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ যেন মূল ভাষা থেকে হয় এবং তার আরও রচনার যেন অনুবাদ হয়।

আগেই বলেছি, এটি এমনই এক গ্রন্থ যার ১৭০ পৃষ্ঠার ছোট্ট পরিসরে পৃথিবীর বহু ভাষার লেখক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা লাতিন আমেরিকার উন্মুক্ত দৃষ্টিতে আবিষ্কারের নজির হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের মাধ্যমে মারিয়া পাণ্ডিত্য ও মননের এক স্তম্ভ তৈরি করেছেন। সমকালে লাতিন আমেরিকার নবীন লেখকদের মধ্যে মারিয়া বিশ্বসংস্কৃতিকে, আর বিশেষভাবে ভারতীয় সংস্কৃতিকে, যতটা নিবিড় ও সূক্ষ্ণ পাঠে আত্মস্থ করেছেন ততটা অন্য কারোর মধ্যে খুব কমই দেখা যায়।