খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: ফুটবলের শিল্প হতে বাধা কই?

প্রায় ছুটে এসে পলিটিক্যাল সায়েন্স-এর ছেলেটিকে থামাতে তার জামার কলার চেপে ধরলেন।

চিন্তামন তুষারচিন্তামন তুষার
Published : 4 Dec 2022, 09:53 AM
Updated : 4 Dec 2022, 09:53 AM

ফুটবল বিশ্বকাপ উপলক্ষে ফুটবল-জ্বরে কাঁপছে পুরো বিশ্ব। সে জ্বরের প্রকোপ এসে পড়েছে বাংলাদেশেও। দেশের অলি-কানাগলি, পাড়া-মহল্লার আনাচে-কানাচে আপামর জনসাধারণ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে নানা মাপের ডিজিটাল পর্দার সামনে। প্রিয় খেলোয়াড়, প্রিয় দলের খেলা দেখে উত্তেজনা স্তিমিত করার প্রয়াস নিচ্ছেন সকলে। শিল্পী-সাহিত্যিকরাও এ থেকে বাদ যাবেন কেন? বিডিআর্টস আজ থাকছে বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত অনুবাদক, প্রাবন্ধিক এবং শিক্ষক ড. খালিকুজ্জামান ইলিয়াস-এর সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন চিন্তামন তুষার।--বি. স

চিন্তামন তুষার: আপনি কি নিয়মিত ফুটবল খেলা দেখেন?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: দেখি, মাঝে মাঝে। ইউরোপ, লাতিন আমেরিকার দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে দেখি।

চিন্তামন তুষার: এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলা দেখছেন?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: দেখছি, তবে খুব একটা নিয়মিত নয়।

চিন্তামন তুষার: ফুটবল খেলায় কোন বিশেষ দল সমর্থন করেন?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: না, বিশেষ কোনও দলের প্রতি সমর্থন নেই, তবে তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশ প্রথম বিশ্বের কোনও দেশের বিপক্ষে খেললে তাকেই সমর্থন দিতে চাই। এটা বোধহয় আন্ডারডগের প্রতি মানুষের সহজাত সহানুভূতি।

চিন্তামন তুষার: ফুটবল খেলা কেন পছন্দ করেন?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: ফুটবলে কদাচিৎ দর্শকের জন্য একঘেঁয়েমি আসে। নব্বই মিনিটের খেলাটি দর্শক খেলোয়াড় সবাইকে টানটান উত্তেজনায় রাখে। দর্শকদের অবিরাম চিৎকার, কোচদের অস্থির পায়চারী, মাঝেমাঝে খেলোয়াড়দের ফাউল, মারামারি—পরিবেশটাই অন্যরকম। মানুষ উত্তেজনা পছন্দ করে।

চিন্তামন তুষার: আপনি কি কখনো ফুটবল খেলেছেন?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: খেলেছি বহুবার। বগুড়া জেলা স্কুলে শেষের দু তিন বছর মনে হয় খেলার মাঠেই সময় কাটতো বেশি। বিশ্ববিদ্যালয়ে মহসিন হলের এবং ইংরেজি বিভাগের দলে কয়েকবার খেলেছি। অন্য হল এবং বিভাগের সঙ্গে হতো প্রতিযোগিতা।

চিন্তামন তুষার: কোন অবস্থানে খেলতেন বা কি ভূমিকায় খেলতেন?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: খেলতাম ব্যাকে। এখন একে কি বলে জানি না; পজিশনগুলোর নাম পাল্টে গেছে।

চিন্তামন তুষার: ফুটবল খেলা নিয়ে বা বিশ্বকাপ খেলা নিয়ে কোন অম্ল বা মধুর স্মৃতি আছে?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: স্বাভাবিকভাবেই জেতার স্মৃতিগুলো মধুর আর হারেরগুলো অম্ল। তবে একটা করুণ স্মৃতি মনে পড়ে। একবার পলিটিকাল সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট-এর সঙ্গে খেলা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক রাশিদুল হাসান স্যারও (একাত্তরের ১৪ই ডিসেম্বরে আল বদরের হাতে শহিদ) খেলা দেখছিলেন। আমাদের একজন খেলোয়াড়কে ওদের একজন বাজেভাবে ফাউল করলে একটু বিতণ্ডা এবং তা থেকে হাতাহাতি শুরু হয়। রাশিদ স্যার যেহেতু খেলাধূলায় খুব উৎসাহী ছিলেন, তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। প্রায় ছুটে এসে পলিটিক্যাল সায়েন্স-এর ছেলেটিকে থামাতে তার জামার কলার চেপে ধরলেন। ছেলেটিও সম্ভবত স্যারকে চিনতে না পেরে আঘাত করে বসে। ব্যস, খেলা বন্ধ হয়ে যায়। ছেলেটার কি একটা শাস্তি হয়েছিল, মনে নেই। তবে এরপর থেকে রাশিদ স্যার বেশ চুপসে যান। ইংরেজির চেয়ারম্যান ড. সাজ্জাদ হোসেন তাঁকে সম্ভবত খুব ভর্ৎসনা করেছিলেন। এরপর তাঁকে আর খেলার মাঠে উৎসাহী দর্শকের আসনে দেখিনি। তবে ফুটবলে আগ্রহ তিনি হারাননি। একবার আমরা হেরে গেলে পরদিন টিউটোরিয়াল ক্লাসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ডিড ইউ নট প্লে? বুঝলাম আমার ওপর তিনি ভরসা করতেন। যা হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ফুটবল খেলার ওই একটি স্মৃতিই প্রায় বাহান্ন বছর পর আজো আমার কাছ বেদনা হয়ে জেগে আছে।

চিন্তামন তুষার: ফুটবল খেলা নিয়ে কোন সাহিত্য বা শিল্পকর্ম আছে কী?

খালিকুজ্জামান ইলিয়াস: ফুটবল নিয়ে বাংলা ভাষায় অল্প হলেও সাহিত্যকর্ম আছে, যেমন মতি নন্দীর কথাই মনে পড়বে। বিদেশি ভাষায় এদুয়ার্দো গালেয়ানোর এবং হুয়ান বেইয়্যোরোর বই আছে। ফুটবল নিয়ে চিত্রশিল্প, আলোকচিত্র শিল্প, স্থাপত্যশিল্প তো নিশ্চয় আছে। সাহিত্যে ফুটবল অমর হয়ে থাকতে পারে নামী খেলোয়াড়দের জীবনী কি আত্মজীবনী হিসেবে, বায়ো ফিকশান হিসেবে। পেলে, মারাদোনা, মেসি—এদের জীবনী আছে। পেলে কিম্বা মারাদোনার তো আছেই। আমাদের দেশের একজন সামাদের কথা ছেলেবেলায় কোনও একটা লেখায় পড়েছিলাম। ইংরেজ আমলের এই খেলোয়াড় সম্ভবত লেফট আউট পজিশনে খেলতেন। তিনি খালিপায়েই খেলতেন এবং মাঠের বাম কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতেন। দর্শকরা টিটকিরি দিত। কিন্তু একবার বল পেলে তিনি সেই যে ছুটতেন তখন তাঁকে থামায় কে? একে এড়িয়ে, ওকে মাড়িয়ে, তাকে টপকিয়ে, নিজের দলের কাউকে পাস না দিয়ে, পায়ে বল সেঁটে তিনি ছুটতেন এবং থামতেন একেবারে গোলপোস্টের ভেতরে গিয়ে। হয়তো একটু অতিরঞ্জিত হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাঁর খেলার ধরন নাকি ছিলো ওরকমই। সায়েবরা নাকি তাঁর পায়ের আঙ্গুল টিপে টিপে দেখতো কী আছে ওখানে। জানি না এসব কতোটুকু মিথ আর কতোটুকু সত্যি। তবে ফুটবল খেলা নিয়ে সাহিত্য যথেষ্ট পরিমাণে থাক বা না থাক, খেলাটি স্বয়ং কিন্তু শিল্প হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য সেটা নির্ভর করে খেলোয়াড়ের দক্ষতা ও মানসিকতার ওপর। সামাদ, পেলে, মারাদোনা, মেসি, নেইমার—এঁরা তো ফুটবল-শিল্পীই। ফ্যান আর ফ্যানাটিক দর্শক, উৎকণ্ঠিত কোচ, এমনকি খেলার ফাউলগুলোও এই শিল্পের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। শরীরের যে ছন্দ, দোলায়িত অঙ্গভঙ্গি, বল নিয়ে চতুরালি ইত্যাদি এই শিল্পেরই অংশ, হয়তো এটা নৃত্যশিল্পেরই আরেক সংস্করণ, আরেকটি পারফরমিং আর্ট। অতএব ফুটবলের শিল্প হতে বাধা কই?