সুফি দরবেশ ও কবি আবদুর রহমানকে তার দেশের মানুষ ভালোবেসে বাবা উপাধিতে সম্মানিত করেছে। পেশোয়ারে আনুমানিক ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মোগল আমল ছিল তখন। তার সমসাময়িক বিখ্যাত কবি ছিলেন খুশল খান খটক। তারা দুজনেই পশতু ভাষায় সর্বকালের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি। বাবা রহমানের কবিতা ইসলামের মরমিধারা সুফিবাদী ভাববস্তুতে সমৃদ্ধ।
বাবা রহমানের পরিবার গোত্রপতি ছিল বলে কোনো-কোনো বিবরণে পাওয়া যায়। কিন্তু তিনি শান্তিপূর্ণ সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন। তার ভাষায়, 'যদিও সোনার পেয়ালার পানি ঐশ্বর্যময়, আমি নিজের জন্য মাটির পাত্রই বেছে নিই।' তার কালে সংঘটিত বিভিন্ন উপজাতীয় দ্বন্দ্ব-বিবাদে তিনি অংশ নিতেন না। তিনি বিদ্বান হিসাবে সম্মানিত ছিলেন।
বাবা রহমান আনুমানিক ১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে লোকান্তরিত হন। পেশোয়ারে তার মাজার শরিফ বিশালকায় গম্বুজে শোভিত। তার মাজারে কবি ও ভক্ত-আশেক-মরমিগণ দর্শন করতে আসেন। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের চার তারিখে তার মাজারে ওরস অনুষ্ঠানে বিপুল মানুষের আগমন ঘটে।
রহমান বাবার কবিতাসংগ্রহ 'দিওয়ানে রহমান বাবা' নামে পরিচিত। পশতু ভাষায় লেখা ৩৪৩ টি কবিতা আছে এতে। গ্রন্থটির হাতে লেখা অনেকগুলো পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন নামী-দামী গ্রন্থাগারে এসব পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে। তার কবিতার প্রথম মুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে। তার কবিতা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
রহমান বাবা প্রশংসিত কবি ছিলেন। অনেক পশতুনের কাছে তার রচনা কবিতার চাইতেও উচ্চতর কিছু হিসাবে বিবেচিত হয়। সেখানে কোরান শরিফের পরই তার কালামের অবস্থান। তার কবিতা শান্তি, প্রীতি, প্রেম, মানবিকতা ও সহজ-সরল জীবনের কথা বলে। পশতুন জনমণ্ডলির সংস্কৃতি ও প্রজ্ঞার প্রতিফলন রয়েছে তার কবিতায়। তার কবিতা যেমন বিপুল জনপ্রিয় ছিল, তেমনি তরুণ কবিদের জন্য অনুকরণ-অনুসরণের মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। তার শিক্ষা ও নির্দেশনা অনুধাবন ও মান্য হতে শুরু করে। তার সম্মানে তার নামে একটি কবিতার স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে লোকে শিক্ষা নিতে আসত। এখনও পাকিস্তান-আফগানিস্তানের পশতুভাষী জনগণের কাছে বাবা রহমান প্রিয় ও সম্মানিত।
গত চারশ বছর ধরে ভক্ত-আশেক, কবি, গায়ক ও অন্যান্য আগ্রহীগণ সারাবছরই তার মাজার শরিফে আগমণ করে। ওরসের সময় তো বিশাল সমাবেশ ঘটে। ধর্মীয় উগ্রবাদীরা এইসব প্রেমাত্মক ধারা সহ্য করতে পারে না। হিংসাপ্রবণ ও নির্মম লোকেরা ২০০৯ সালের মার্চে শক্তিশালী বোমা নিক্ষেপ করে মাজার শরিফের বড় রকমের ক্ষতি সাধন করে। তবু মানুষ ভালোবাসে উচ্চভাবের মানুষকে। সব বাধা ও ভয় উপেক্ষা করে তার নিকটে যায়। বাবা রহমান অমনই একজন মানুষ রতন।
নিপাত কর ধর্মকে
আর যত দুনিয়াবি স্বার্থ রয়েছে --
তারপর কর আলিঙ্গন আসল প্রেমের সাথে।
তোমার অহম আর অনর্থক যা কিছু আছে
ওসব আঁকড়ে ধরে রেখে
তাঁকেও ধরতে গেলে পাবে না তো।
চড়কির মতো ঘুরছেই দুনিয়া,
তোমার মুঠো থেকে বের করে দাও একে।
ইন্দ্রিয়াতুর স্বপ্ন-কামনা সব ছাড়,
প্রিয় তোমার সাথেই আছেন এইখানে ও এখন।
প্রেমের যে পানীয় তিনি ধরে আছেন তা পান কর,
তাকে তোমার শুধু একটিবার ডাকলেই যথেষ্ট।
★
দুনিয়ার আলো তারা : যারা জানে;
মানবজাতির পথনির্দেশক তারা : যারা জানে;
আল্লা-নবির পথ খুঁজছ যখন, শোনো তাদের নিকটে : যারা জানে;
গবেষক মিল পায় তাদের ভাবনায় : যারা জানে;
মরুর পাথর সোনা হয়ে ওঠে পরশে তাদের : যারা জানে;
অজ্ঞেরা মৃততুল্য; যিশুর মতন তারা : যারা জানে;
যেহেতু যিশুর ফুঁয়ে মৃত পেত প্রাণ,
সেরকম দিব্য ফুঁ রয়েছে তাদের : যারা জানে;
রহমান তাদের গোলামি করে, যতটাই পারে : যারা জানে।
★
ফুলগাছ বোনো, চারপাশে হবে বাগান,
কাঁটাঝোপ পুতে আঘাতে আহত হবে;
যদি ছোঁড়ো তীর অন্যজনের দিকে,
তোমার দিকেই ফিরে ওটা আসবে।
যদি লোভাতুর চোখে চেয়ে দেখ কিছু,
জেনো একদিন মাটিতে মিলতে হবে;
নিজেই পড়বে বেখেয়ালে হেঁটে গিয়ে
কুয়ো খোঁড়ো যদি অন্যে পড়ুক ভেবে।
একে অপরের সঙ্গে সন্নিহিত,
সকল মানুষ মিলে একটাই দেহ;
অন্যকে দিলে আঘাত, করলে ক্ষতি,
নিজের দিকে তা ফেরে -- নাই সন্দেহ।
দিনের আলোয় চেয়ে দেখ চারদিক,
নিজের পথকে সহজ-সরল কর;
হঠাৎ জাঁকিয়ে আসবে সে কালরাত
ঢেকে দেবে সব, তার আগেই নেমে পড়।
★
যারা সবাই তোমার কাছে আত্মনিবেদন করতে পারে,
তারা কেউই সব কিছু দিয়ে দিতে পারবে না, যা আমি পারব।
সারা দুনিয়ায় ভালোবাসার মতো আর কেউ নাই তোমার মতন।
আমার জগত, আমার ঘরবাড়ি, আমার দুঃখ-বেদনা সবই তোমার মুখের দিকে চেয়ে।
যখন আমি আমার জান দিয়ে দিতে পারব
কেবল তখনই তোমার কাছ থেকে বিচ্ছেদ মানতে পারব।
ততক্ষণ পর্যন্ত এবাদতের কাতারে ভীড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইব।
রাজা ও ভিখারিরা যোগ দিচ্ছে আমার সাথে;
সারা জগত তোমার প্রেমে পড়ে জেগে উঠছে;
কিন্তু আমি নিজের ইচ্ছায় প্রেমে পড়ি নাই :
তুমিই ডেকে এনেছ আমাকে।
★
তোমার বাগানের প্রতিটা ফুল
প্রদীপের চেয়েও উজ্জ্বল।
তোমার বাগানের কালো কাকও
ফিনিক্সের মতো আমার কাছে।
রহমানের কাছে আর কোনো সন্তোষ নাই
সৌন্দর্যময় ছাড়া।
★
আমি রহমান, হৃদয় আমার
হয়ে গেছে দ্রবীভূত,
ওই মেয়েটির জন্যই, যার
কোমর চুলের মতো।
★
যারা নিশ্চিন্ত তাদের জন্যই ঘুম আর হাসি,
কিন্তু যখন প্রিয়তমের জন্য তুমি ব্যাকুল থাকো
তখন ঘুমাও কীভাবে? কেমন করে হাসতে পার?
খোদা আগুন থেকে প্রেম বানিয়েছেন,
শিখার মধ্যে ঘুম থাকতে পারে না।
হাজার রাত্রি নিদ্রাহীনভাবে কেটেছে,
কাল হয়তো প্রিয়তমের সাথে বিচ্ছেদ ঘটতে পারে।
★
চোখ নিচে নামিয়েছি
কিন্তু মাথা নত করতে পারি নাই,
মনে হয় প্রেমের বেলাতেও
আমি আফগানই রয়ে গেলাম।
সূর্যের পাল্লা আসমানে উঠে গেল,
যখন তোমার রূপের সাথে তাকে মাপতে গেলাম।
ওরা এটাকে দোজখের ভাষা বলে,
কিন্তু আমি পশতু ভাষা নিয়েই বেহেশতে যাব।
পুখতুনখোয়া'র দিগন্তে এখনও দেখা যায় নাই আমাকে,
আমি সেই সর্বজনীন সূর্য, এখনও যার উদয় ঘটে নাই।
গভীর রাতে যখন নিস্তব্ধতার রাজত্ব শুরু হয়
তখন আমার হৃদয়ে এক উচ্চ নিনাদ জেগে ওঠে;
আলো যখন পৃথিবী ছেড়ে যায় আর অন্ধকার নামে,
কবির অন্তরে তখন জেগে ওঠে আলো।
ভেবেছিলাম আমার আহ্বানে জাগিয়ে তুলব এই ঘুমন্ত জাতিকে,
দেখতে পেলাম যে ঘুমকাতুরে জাতিকে আমি খোয়াবের মধ্যে ডাকছি।
তোমার ভাবনা ছাড়া আর কোনো কিছু কীভাবে আসতে পারে আমার মনে!
যেহেতু আয়নায় কেবল তার প্রতিবিম্বই দেখা যায় যে আছে উপস্থিত সেখানে।
এ জীবন কঠিন কি না তা আমি সত্যিই জানি না;
তবে আরামের চাহিদাই একে জটিল করে তোলে।
অপর জগতের কাহিনি বলি আমি সেই গ্রন্থ হতে,
যা নেমে এসেছে ভিন্ন আকাশ থেকে।
আমার কাছ থেকে উত্তেজনা নিয়ে দুনিয়াকে দাও,
পৃথিবী ও আকাশকে বর্ণিল কর নতুন করে,
আমার কর্দম হতে নতুন আদম সৃষ্টি কর,
লাভ-লোকসানের এই ক্রীতদাসকে হত্যা কর।
★
মেঘের সাথে মাথা ছুঁয়ে বেঁচে থেকো না,
জন্মসূত্রে তুমি মৃত্তিকার সন্তান।
বাধ পেরিয়ে যে স্রোতধারা চলে যায় সে আর ফিরতে পারে না,
যেমন পারে না ফিরতে বয়ে যাওয়া সময়।
ভালো আর খারাপ কর্মগুলোকে অভিনিবেশে বিবেচনা কর,
কোনটায় লাভ তোমার : এটায় না ওটায়?