স্বপ্ন
দোজখ-কন্দরে যখন ধোঁয়াশাময় পুষ্প ফোটে,
-কিংবা আমরা প্রবেশ করি মৃত্যুলোকের ধুপের ধোঁয়ায়,
স্বর্গচ্যুত সে-মহাপ্রহরে, নিস্বনিত সে-সন্ধ্যাবেলায়,
সমস্ত ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ একযোগে ব'লে ওঠে,
“কারা তোমরা হানা দিচ্ছো এই গহীনতম কবরে,
যখন আকাশে জ'মে উঠছে ভূতগ্রস্ত কুয়াশা,
উপরন্তু ক্রূর হাওয়ায়
অনাদি আলো নেভার পরে
ঘণ্টার শব্দের তালে তালে ঘনাচ্ছে অমানিশা?
বুড়ি বাম্বারা বেশ্যারা, আজকের এ-অমারাত্রে
ওঠো সে-মত্ত জাহাজে, যা ভাসছে মহাসাগরে,
অন্তহীন অসীম অন্ধকারে লক্ষ্যহীন যাত্রায়
তোমরা নিশ্চয়ই পৌঁছে যাবে পরাবাস্তবের দরোজায়।“
ভ্লাদের রক্ততৃষ্ণা
নক্ষত্রখচিত অনন্ত আকাশ যখনই ঢাকা প'ড়ে যায়
জাহান্নাম থেকে পালানো বন্দির ভীতিপ্রদ ডানায়,
তখনই দাতা শয়তানের আতুর ও মায়াবী হৃদয়
নিজেরই আত্মার রক্ত ঝরায় অঝোরধারায়।
আজ সে-নিরন্তর রক্তবৃষ্টিতে কৃমির দল সাড়া দিচ্ছে
সমগ্র ট্রানসেলভানিয়ায়,
ঝাঁক ঝাঁক প্লেগের ইঁদুড় অজ্ঞাত ভয়ে ঘুরপাক খাচ্ছে
দর্পণের গোলকধাঁধায়।
গোলাপ, গোলাপ, আমি তোমাকে চেয়েছি গোলাপ,
অন্ধকারে প্রজ্জ্বলিত তুমি, দীপ্র বা ধূসর,
আকাশে গোলাপ এবং ভূমিতে গোলাপ,
গোলাপই কবরে অথবা হৃদয়ে গোলাপ।
কার দিব্য স্মৃতির প্রতিচ্ছবি নড়ে নাইলে বা নির্ঝরে?
আত্মরক্তপায়ী পুষ্প, তুমি? যার কণ্ঠ থেকে নিরন্তর সঙ্গীত ঝরে?
হয়তো তুমি দরোজাতে কড়া নাড়বে কোনো এক বিষণ্ণ প্রদোষে,
এবং অজস্র শূলবিদ্ধ দেহ থেকে
চুঁইয়ে পড়া রক্তের বন্যায়
সিক্ত পৃথিবী সুর ছড়াবে মায়াবী আকাশে।
গোলাপ, হে গোলাপ, মরমী কবির আধ্যাত্মিক গোলাপ,
তোমার রক্তলাল পাপড়ি থেকে কিছু সুর আকাশে ঝরুক,
উদ্ভাসিত হও হৈমন্তিক রাত্রির মায়াবী জ্যোৎস্নায়,
নরকে জন্মানো হে দুঃখভারাক্রান্ত পরম গোলাপ।
নর্তক ঈশ্বর
হিংস্র এবং ধর্ষকামী ভালোবাসায় পরিপূর্ণ আমার হৃদয়
নিজেকেই খুঁজে পায় ক্লাউনদের দৃপ্ত সার্কাসে,
যেখানে মহীয়ান শিল্পকলা দুর্জয়, অক্ষয়,
ধ্বংসবাদী রূপ পায় এক বামন বেশ্যার নাচে।
এই মহাজগতের নীতিগুলো ক্রমেই বদলায়
তাঁর প্রতিটি নতুন নতুন নাচের মুদ্রায়,
যেনো আগুন অগ্নিগিরি থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে
ছড়িয়ে পড়ে সবখানে আর সঙ্গীত ছড়ায়।
বেশ্যার প্রতি প্রেম
ফ্যাকাশে বেশ্যা, আজ সার্কাসে দেখেছি যাকে,
দড়ির ওপর যে নৃত্য করে রাত্রিদিন,
যার দর্শকরা কামনা প্রকাশে লজ্জাহীন,
মুখ চেপে ধ'রে পরম ছন্দ শোনাবো তাকে,
“শস্তা বেশ্যা, সার্কাসের নটী, আমাকে তুই
গোপনে দেখাবি বেবেলের মিনারে ওঠার ধাপ,
যার ছাদ থেকে স্বপ্নে বারবার দিয়েছি ঝাঁপ,
জানি সে-পতনে হাড়গোড় ভেঙে চূর্ণ হয়।
মৃত্যুর আকাঙ্খায় আমি তো কাতর, লক্ষ্যহীন
কতো শতো রাত কাটিয়ে দিয়েছি নিদ্রাহীন,
নোট লিখে যাই কবরে কবরে স্বপ্নময়:
নর্তকী বেশ্যা, তোর প্রতি প্রেম অন্তহীন।”
মাতা কবি
আমার হৃদয় যেনো কোনো এক বিকলাঙ্গ শয়তানের দূত,
প্রস্ফুটিত করে রক্তপায়ী ফুল আর যা কিছু অদ্ভুত
এমন সব ছন্দে-গন্ধে নফসকে ঠেলে দেয় অতলান্ত আঁধার গহ্বরে।
ক্রমেই স'রে যাই ভগবান থেকে দূরে রক্ততৃষ্ণার তেপান্তরে।
একে একে সবগুলো গর্ভজাত শিশুকে বালিশচাপা দিয়ে হত্যার পরে
কোটর থেকে ছিঁড়ে নিই ভয়ার্ত চোখের তারা, যা থেকে খৃষ্টের করুণাময়
অশ্রু মোমের ফোঁটার মতো ঝরে নিরন্তর।
বিমর্ষ ছানি পড়া চোখে মাকড়দল বুনে চলে জাল,
আর হৃদয়ের গোরস্থানে ফোটে উদ্বেগের কম্প্র শতদল,
সবখানেই আমি দেখি জাহান্নামের অসীম বিস্তার
এবং আমার শ্বাসযন্ত্র ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে বীভৎস চিৎকার।
আলেফ
প্রতিহিংসা ও স্বপ্নবিনাশী সর্বনাশা
রক্তক্ষরণে আমার স্নায়ু আন্দোলিত,
মগজের কোষ জাহান্নামি শব্দে প্রকম্পিত
ও রক্তনালিতে হেরোইনের অতল নেশা।
সে দেয় আমাকে শুভ্র স্বপ্নের স্বর্গসুখ,
গভীর আকাশে, আলেফে আলেফে ধ্বনিত স্বর,
আমার স্নায়ুর সকল বিকার, বমন ও জ্বর
রক্তে ভেজালো পূত আত্মার দিব্য মুখ।
তবুও আমি শুনি মহা শয়তানের পায়ের ধ্বনি,
যেহেতু তা ছিলো নিখিল নাস্তির অঙ্গীকার,
নফসের সাথে দ্বন্দযুদ্ধে হারার পর
আমার আত্মা বিধ্বস্ত-নরকগামী
হারালো স্বপ্ন, ঘনীভূত হলো অন্ধকার।
পিতৃহত্যা
কীইবা আমি দেখে চলেছি ওই আবলুশ কাঠের ঘড়িতে?
ছক কষি জ্বরাক্রান্ত পিতাকে হত্যার ঘুমে-জাগরণে,
রাত তিনটার ঘণ্টা বাজলেই যাকে ফেলে দেবো হন্তারক ফাঁদে,
আগ্রাসী শূলগুলো যেনো জাহান্নামের বার্তা ব'য়ে আনে।
কতো যন্ত্রণার আর আতঙ্কের নিষ্ঠুর এই যন্ত্র সুমহান,
কোনো অনুরোধে বা আর্তনাদে সাড়া দিতে দেয় না শয়তান,
আমরা যেনো এক নিয়ন্ত্রিত জীব, ক্রূর শয়তানের হাতের পুতুল,
কিছুতেই তৃপ্তি পায় না আমাদের হৃদয়ের রক্তপায়ী ফুল।
অবশেষে ফাঁসিকাষ্ঠে গণ্ডদেশে এঁটে আসা দড়ির দাপটে
যখন আমাদের প্রত্যেকের শ্বাস রূদ্ধ হয়ে আসে
সফল একটি হত্যাকাণ্ডের উল্লাস ছড়িয়ে থাকে গুমোট বাতাসে।
আমাদের আত্মায় লুকিয়ে থাকা শয়তান
কিম্ভূত দেবদূত ঝরালো রক্ত,
ছিঁড়লো চোখের তারা : ঝলকিত মুক্তো,
মধ্যরাত্রির চিরায়ু নদীতে
বা গভীর এ-আকাশে ছড়ালো ডানা তার।
“রূদ্ধ করো সব বাতায়ন, লৌহদ্বার,”
রাত্রির বারান্দায় হন্তাটি গর্জালো
ও তার ভ্রষ্ট ছায়া প্রদীপ নেভালো,
অতলান্ত আকাশে সে ছড়ালো ডানা তার।
সে এক রাজহাঁস, দোজখ ও স্বর্গে সমাগত,
আমাদের কদাকার আত্মার অন্তর্গত
স্বপ্নে যে হানা দেয় ভোরে কিংবা সন্ধ্যায়,
অথবা রজনীতে যখন মোম নিভে যায়।
নির্জন কবরখানায় ঘুরছে তার অন্তর,
অথবা আকাশে সে ছড়াচ্ছে ডানা তার।
সে এক দেবদূত, বিকৃতিতে লিপ্ত,
সমস্ত নক্ষত্র ও-নয়নে প্রক্ষিপ্ত
তারই ভজনাতে ফুরোয় ধুপ, অম্বর ,
গভীর এ-আকাশে সে ছড়ালো ডানা তার।