নিকারাগুয়ার অনিবার্য কবি রুবেন দারিও

রুবেন দারিও একসময় বুয়েনোস আইরেসে কলম্বিয়ান কনসাল হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র ‘লা নাসিওন’-এর সংবাদদাতা হিসেবেও।

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 8 August 2023, 03:41 PM
Updated : 8 August 2023, 03:41 PM

নিকারাগুয়াকে বলা হয় ‘কবিতার দেশ’। ক্যারিবিয় সাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের তীরবর্তী এ দেশটির প্রত্যেক নাগরিকের ঠোঁটে ও হৃদয়ে কবিতা আছে বলে মনে হবে। কারণ একটাই, শতবর্ষ ধরে হীরের টুকরোর মতো তারা আগলে রেখেছে এক কবিকে, দিয়েছে মহানায়কের সম্মান।

তার নাম রুবেন দারিও (১৮ জানুয়ারি ১৮৬৭ - ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬); একাধারে কবি, সাংবাদিক, কূটনীতিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। দারিওর চেহারা যদি কেউ চেনে তাহলে তাকে দেখতে পাবে নিকারাগুয়ার সর্বত্র--মুদ্রা, ডাকটিকিট, চুরুট, রাষ্ট্রপতি ভবন, মানাগুয়ার বিমানবন্দর, চিনানদেগার কফিশপ, জাদুঘর, পাঠাগার, পার্ক, হোটেলের প্রবেশপথ, জাতীয় থিয়েটার, এমনকি মানাগুয়ায় একটি সাঁজোয়া ট্রাকেও তার প্রতিকৃতি, ম্যুরাল বা ভাস্কর্য দেখা যেতে পারে। তার প্রতিকৃতি ঝোলানো অবস্থায় দেখা যায় গ্রানাদার অনেক রেস্তোরাঁয়ও।

রুবেন দারিওর পুরো নাম ফেলিক্স রুবেন গার্সিয়া সারমিয়েন্তো। জন্ম ১৮৬৭ সালের ১৮ জানুয়ারি, নিকারাগুয়ার মেটাপায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন, পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘বালক কবি’ হিসেবে। তার উল্লেখযোগ্য বইগুলো হল- ‘আজুল’, ‘পয়েটিক অ্যান্থলজি’, ‘সংস অফ লাইফ অ্যান্ড হোপ’ ও ‘মার্গারিটা’ ইত্যাদি। ভাষা রক্ষায় নিকারাগুয়ার সরকার তাকে ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদা দিয়েছে। হিস্পানিক ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার নায়ক’ হিসেবে পরিচিত এ কবির জন্মদিন প্রতিবছর রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করে দেশটি।

রুবেন দারিও একসময় বুয়েনোস আইরেসে কলম্বিয়ান কনসাল হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র ‘লা নাসিওন’-এর সংবাদদাতা হিসেবেও। ভ্রমণ করেছেন বহু দেশ। তার কবিতার বিষয়বস্তু হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে প্রেম, বিচ্ছিন্নতা, সাহস ও আবিষ্কারের উদ্দেশ। কবিতায় রয়েছে মানুষের প্রতি বিনীত সংহতি, চিন্তার ভেতর-কাঠামোর স্থায়িত্ব, ঐশ্বর্যবান ও আধুনিকতার উদ্ভবের চিহ্নে ভরপুর। ‘ফ্যাটালিটি’ (১৯০৪) কবিতায় দারিও লিখেন, “গাছটি সুখি, কেননা এটি সামান্যই সংবেদনশীল/ কঠিন শিলা এখনও সুখি, কেননা তা কিছুই অনুভব করে না/ বেঁচে থাকার মতো বড় কোন ব্যথা নেই, সচেতন জীবনের চেয়ে ভারি কোন বোঝা নেই।”

স্প্যানিশ-ভাষী বিশ্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সংঘটিত হয়েছিল ‘Modernismo’ বা ‘আধুনিকতাবাদ’ নামে সাহিত্য আন্দোলন। আর এ আন্দোলন উদ্ভাবনে ছিলেন রুবেন দারিও, তাকে বলা হয় ‘স্প্যানিশ আধুনিকতার জনক’, বলা হয় ‘দ্য ডিভাইন পোয়েট’। তার ‘Modernismo’ ভাষার অন্তর্গত অর্থ এবং সংস্কৃতিতে কবিতার প্রভাবকে সামনে আনে। Modernismo শুরু হয়েছিল মূলত কবিতায়, ১৮৮৮ সালে রুবেন দারিওর ‘আজুল’ প্রকাশের পর। ক্রমশ তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো স্পেনে। এ আন্দোলন আধুনিকতাকে নতুন অর্থ দিয়েছে। রুবেন দারিওর মৃত্যুর চার বছর পরও ১৯২০ সালের দিকে আন্দোলনটি গতিশীল ছিল।

১৯৬৭ সালের মে মাসে মেক্সিকোতে ল্যাটিন আমেরিকান লেখক সম্মেলনে আর্জেন্টাইন সাহিত্যিক হোর্হে লুইস বোর্হেস (১৮৯৯-১৯৮৬) বলেন, “দারিও সবকিছু নতুন করে দিয়েছেন- ভাষার উপাদান, শব্দভাণ্ডার, ছন্দ-মাত্রা, নির্দিষ্ট শব্দের অদ্ভুত জাদু, কবি এবং তার পাঠকদের সংবেদনশীলতা। তার কাজ থেমে যায়নি এবং থামবেও না। আমরা যারা একসময় লড়াই করেছি, আজ বুঝতে পারছি যে আমরা এটি এখনও চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা তাকে (রুবেন দারিও) ‘ভাষার মুক্তিদাতা’ বলতে পারি।” ‘টু রুজভেল্ট’ (১৯০৩) কবিতায় দারিও লিখেন, “বাইবেলের স্বর কিংবা ওয়াল্ট হুইটম্যানের কবিতার মতো/ যে কণ্ঠ পৌঁছবে তোমার কাছে, শিকারি!/ আদিম ও আধুনিক, সরল ও জটিল তুমি/ তুমি কিছুটা জর্জ ওয়াশিংটন, আর কিছুটা নমরুদ...।”

বোর্হেস বলেন, “আমরা সবাই রুবেন দারিওর সন্তান, সবকিছুই আধুনিকতা থেকে এসেছে।...দারিওর মতো কবি সাহিত্যে এলে সবকিছুই বদলে যায়। আমাদের ব্যক্তিগত রায় কোন ব্যাপার নয়, অপছন্দ বা পছন্দে কিছু যায় আসে না, আমরা তাকে পড়েছি এটাই বড় ঘটনা।...দারিও এমন একটি সঙ্গীতের অধিকারী ছিলেন যা আমার পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়, আমি পাওয়ার চেষ্টাও করছি না।...যখন কেউ রুবেন দারিওর ভাষার মধ্য দিয়ে যায় তখন সবকিছু বদলে যায়...।”

ভাষার স্বরে পরিবর্তন আনা, শব্দসঙ্গীতে নতুন সুর আরোপ করা সম্ভবত কবির মূল কাজ। দারিওর আধুনিকতা স্প্যানিশ কবিতায় যেন সেই নতুনত্ব নিয়ে এসেছিল, তিনি একটি স্রোতের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যা ভাষার বিপ্লব ঘটিয়েছে এবং শব্দের প্রাণে এনেছে নতুন নিঃশ্বাস। দারিওর প্রভাব রয়েছে পরবর্তী কবিদের মধ্যেও, যেমন- তার শিষ্য নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি হুয়ান রামোন হিমেনেস (১৮৮১-১৯৫৮), কবি সেসার ভাইয়েহো (১৮৯২-১৯৩৮) এবং কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩)। দারিওকে বলা হয় ‘কাস্তিলীয় অক্ষরের রাজপুত্র’। ‘সংস অফ লাইফ অ্যান্ড হোপ’ কবিতাবইটিকে তার মাস্টারপিস হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ এটিতে কবি হিসেবে তার সম্পূর্ণ পরিপক্কতা প্রতিফলিত হয়েছে।

দারিও মাত্র তিন বছর বয়সেই পড়তে শিখেছিলেন এবং তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল কিশোর বয়সে। তিনি যখন চিলি ভ্রমণ করেছিলেন তখন তার বয়স মাত্র ১৭। আত্মজীবনীতে তিনি উল্লেখ করেছেন লেওনে সেই বাড়িটির কথা, যেখানে তিনি বড় হয়েছেন। তার সঙ্গে থাকতো মিগেল দে সের্বান্তেসের (১৫৪৭-১৬১৬) উপন্যাস ‘দন কিহোতে’ আর নির্বিঘ্নে সেটা পড়ার জন্য কীভাবে তিনি সিকারো গাছের ডালে চড়তেন। স্পেনের জাতীয় গ্রন্থাগারে কাজ করার জন্য দারিও যখন মানাগুয়ায় চলে আসেন, তখন তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্প্যানিশ ক্লাসিক পড়ে কাটাতেন। সেই সময়টা ছিল তাৎপর্যপূর্ণ; স্পেনে তখন দারিদ্র, বছরের পর বছর গৃহযুদ্ধ এবং মহামারীতে বিধ্বস্ত।

১৯৩৩ সালে বুয়েনোস আইরেস পেন ক্লাবে দারিওকে নিবেদিত একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে একটি যুগল সংলাপ শুনিয়েছিলেন কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩) এবং কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)। স্প্যানিশ-ভাষী দুই কবি কৌতুকপূর্ণ এ সংলাপটি পড়েন রাতের খাবার টেবিলের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে। সংলাপে তারা দারিওকে স্মরণ করেন এবং ‘মাস্টার পোয়েট’ বলে অভিহিত করেন। তার কাজ সম্পর্কে মেক্সিকান কবি অক্তাবিও পাস (১৯১৪-১৯৯৮) লিখেছেন, “আধুনিকতাবাদী কবিদের মধ্যে রুবেন দারিও শুধু সবচেয়ে সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত নন, তিনি মহান আধুনিক কবিদের একজন। কখনও তিনি আমাদের এডগার অ্যালান পো-এর কথা মনে করিয়ে দেন, কখনও ওয়াল্ট হুইটম্যানের কথা।”

১৯১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নিকারাগুয়ায় মারা যান কবি রুবেন দারিও। পুরো আমেরিকাজুড়ে স্প্যানিশ-ভাষীরা দারিওকে মনে রেখেছে পরম শ্রদ্ধায়। মাদ্রিদে রুবেন দারিওর নামে মেট্রো স্টেশন রয়েছে। মেক্সিকো সিটি, পানামা সিটি, সান সালভাদোর এবং হন্ডুরাসের তেগুসিগালপা শহরে আছে রুবেন দারিওর নামে রাস্তা। যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামিতে রুবেন দারিও পার্কের পাশেই রয়েছে রুবেন দারিও মিডল স্কুল। এছাড়া লস অ্যাঞ্জেলেসের মেউডে রয়েছে রুবেন দারিওর স্মৃতিস্তম্ভ।

বরেণ্য এই কবি, কূটনীতিক এবং মহানায়ক ১০৭ বছর পরও শতভাগ বেঁচে আছেন নিকারাগুয়ার জনগণের হৃদয়ে; যেখানে তিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন এবং মৃত্যুর পর শায়িত আছেন। ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রুবেন দারিওর মৃত্যুশতবর্ষে নিকারাগুয়ার জাতীয় সংসদ তাকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ঘোষণায় বলা হয়, “...তিনি তার কলম, বুদ্ধি ও বাহু দিয়ে নিকারাগুয়ার জাতীয় ভাষার সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা রক্ষা করেছেন। সেইসঙ্গে বিশেষ করে স্পেনসহ আমেরিকা মহাদেশের সমস্ত স্প্যানিশভাষী দেশ ও ফ্রান্সের ভাষা তিনি তার গদ্য ও কবিতা দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।”

তথ্যসূত্র

. নিকারাগুয়া, ল্যান্ড অফ ভার্স, রিভার্সেস ‘ডিভাইন’ পোয়েট, নিউ ইয়র্ক টাইমস

. রুবেন দারিও অ্যান্ড দ্য রোমান্টিক সার্চ ফর ইউনিটি, দ্য মর্ডানিস্ট রিকোর্স টু এসোটেরিক ট্র্যাডিশন, ক্যাথি লগিন জুরেইদ

. দ্য এনেসক্যাপাবল পোয়েট অফ নিকারাগুয়া, নিউ ইয়র্ক টাইমস

. ট্রান্সলেটিং রুবেন দারিও আজুল, অ্যাডাম মাইকেল কার