দুর্দানা খানের চিঠি: বাস্তবের এক সমান্তরাল কল্পলোক

লেখা আমার কাছে সৃজনশীলতা নয়—বরং আপনাদের কাছে সসংকোচে স্বীকার করি, লেখালেখি আমার জন্য এক ধরনের চিকিৎসা যা আমার sanity restore করে।

মাহীন হকমাহীন হক
Published : 8 Nov 2023, 09:55 AM
Updated : 8 Nov 2023, 09:55 AM

পত্রোপন্যাসের ধারণাটা বেশ সহজ। চিঠির আদান-প্রদানের মাধ্যমে যে উপন্যাসের ঘটনাক্রম এগিয়ে যায় সেটাই পত্রোপন্যাস। পত্রোপন্যাসের ইতিহাস বেশ দীর্ঘই বলা চলে। ধারণা করা হয় ১৪৮৫ সালে দিয়েগো দে সান পেদ্রো'র লেখা Carcel de Amor বা প্রেমের কারাগার বইটিই ইতিহাসের প্রথম পত্রোপন্যাস বা এপিস্টোলারি নভেল। সে হিসেবে উপন্যাসের এ জঁরার বয়স পাঁচশ বছরেরও বেশি। পরবর্তীতে গ্যেটে, দস্তয়েভস্কি, ব্রাম স্টোকারের মত ঔপন্যাসিকদের হাতে এ ধারা আরো পোক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে ব্রাম স্টোকার তার বিখ্যাত উপন্যাস 'ড্রাকুলায়' চিঠির পাশাপাশি ডায়েরি ও খবরের কাগজও গল্পে ব্যবহার করেছেন। বাংলা ভাষায়ও বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, তরুণকুমার ভাদুড়ী ও আহমদ ছফার মত লেখকেরা এই ঘরানার উপন্যাস লিখেছেন।

তবে যদি কথাসাহিত্যের কোনো ধারার লেখকদের নাম এইভাবে হাতে গুণে বলে দেয়া যায়, তাহলে সে ধারা যে বহুলচর্চিত নয় তা সহজেই অনুমেয়। অথচ এমন একটি বিরল ধাঁচের উপন্যাসই লিখলেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। কবুতর দেখিবামাত্র তাকে খাঁচায় বন্দি করবার প্রবৃত্তি আমাদের বাধ্য করে দুর্দানা খানের চিঠি উপন্যাসটিকে পত্রোপন্যাস বলে আখ্যায়িত করতে। কিন্তু বাস্তবে একটি কবুতরকে আপনি তার খাঁচার মাধ্যমে একদমই চিনতে পারবেন না।

উপন্যাসটির সময়কাল ২০২৫ সাল। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন বাংলাদেশি লেখক হুমায়ূন আহমেদ খান। সেই উপলক্ষে বিবাহবিচ্ছেদের প্রায় দুই যুগ পরে তাকে চিঠি লেখেন প্রথম স্ত্রী দুর্দানা খান। যোগাযোগ হয় দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিনের সাথেও। এভাবেই একের পর এক চিঠির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকে গল্প, একটির পর একটি পর্দা সরে যেতে থাকে।

পত্রোপন্যাসের একটি সমস্যা হলো, কথাসাহিত্যের সবচেয়ে কার্যকর কিছু কৌশল এখানে খাটে না। স্বাভাবিক সংলাপ, পারিপার্শ্বিক বর্ণনা, মনস্তাত্ত্বিক বিবরণ, এরকম অনেককিছুই হয়তো এ ধরণের উপন্যাসে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় না। যেহেতু কাহিনী এগিয়ে যায় চিঠির উপর ভর করে, কথকের স্বাধীনতার দিগন্তও সংকুচিত হয়ে আসে। এইটুকু জাল টেনে নিয়েই এই ব্যাডমিন্টন খেলা খেলতে হয়। তা মেনে নিয়েই লেখক লিখতে বসেন। কিন্তু এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও উপন্যাসটিতে কোনোকিছুর কমতি মনে হয়নি। আপাত নির্লিপ্ত, স্বাভাবিক ভাষায় লেখা চিঠিপত্রের অন্তরালে যে লুকিয়ে আছে বহু বছরের অভিমান, রাগ ও ভালোবাসা তা বুঝতে বেগ পেতে হয় না। একদিক দিয়ে, পাঠককে কোনো উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সবচেয়ে কাছাকাছি নিয়ে আসে পত্রোপন্যাসই। কারণ অন্যান্য উপন্যাসে চরিত্ররা একটা বাস্তব ঘটনা বা পরিস্থিতিতে স্বয়ং উপস্থিত, আমরা কেবল তা পাঠ করি। কিন্তু পত্রোপন্যাসের ক্ষেত্রে পাঠক ও চরিত্রেরা উভয়ই একই অবস্থার মুখোমুখি। উভয়েই একটা কালিকুলিমাখা কাগজের সামনে বসে তা পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় মশগুল। মুখের ভাষার কতখানি লিখিত রূপে হারিয়ে যায়, কত স্বর, কত ন্যুয়ান্স চোখ এড়িয়ে যেতে পারে, সেই দ্বিধা-দ্বন্দ্বে চরিত্ররাও জড়িয়ে পড়ে। আমি অন্তত এইটুকু ভেবে স্বস্তি পেয়েছি যে গল্পের চরিত্রেরাও আমারই মত "ইন বিটুইন দ্য লাইন্স" পড়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। রেবেকা যখন বারবার বান্ধবী শারমিনকে বলছে স্বামীর অপকর্মের কথা, আবার একইসাথে জানাচ্ছে সে সব মানিয়ে নিচ্ছে, তখন আমরা জানি সে মিথ্যা বলছে, এবং শারমিনও জানে। তার জন্য আমাদের কোনো "ইন্ট্রুসিভ ন্যারেটরের" প্রয়োজন হয়নি, কিংবা দরকার হয়নি রেবেকার কোনো দীর্ঘ নাটকীয় অভ্যন্তরীণ স্বগতোক্তি। এইটুকু আমরা লেখকের যা বলা হয়নি তাও বুঝিয়ে দেয়ার সহজ দক্ষতার কারণেই বুঝতে পারি।

একজন লেখকের জন্য সৎ সমালোচক অত্যন্ত জরুরি। একজন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান সমালোচক লেখকের বিভিন্ন আঙ্গিক, বৈশিষ্ট্য পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। এক অর্থে, সমালোচক লেখককে নতুন করে আবিষ্কারও করেন কখনো কখনো। দস্তয়েভস্কির জন্য এরকম এক সমালোচক ছিলেন মিখাইল বাখতিন। বাখতিন দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে লক্ষ্য করেছিলেন বহু স্বরের উপস্থিতি। বাখতিনের মতে এই বহু স্বরের উপস্থিতিই উপন্যাসের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য এবং সেজন্যই উপন্যাস সাহিত্যের আধুনিকতম রূপ। কোনো লেখায় কেবল একটি স্বরেরই আধিপত্য থাকলে তা নিছক সাংবাদিকতায় পরিণত হয়। দুর্দানা খানের চিঠি উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রেরই অত্যন্ত স্বকীয় স্বর রয়েছে। এতটাই যে, প্রায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতি চিঠির শেষে প্রেরকের নাম না দেখেও বলে দেয়া যায় সে চিঠি কে লিখেছে। কোনো ধারাবাহিক সংলাপের সুযোগ না থাকা সত্ত্বেও এরকম স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করতে পারা এক অসামান্য কাজ। এবং তার মানে এই না যে একজন চরিত্রের উপর একটিমাত্র স্বর চাপিয়ে দেয়া হলো। বরং বাস্তব জীবনে যেমন সকল পরিস্থিতিতে আমরা একটি স্বর বজায় রাখি না, যেরকম অফিসের বসের সামনে আমাদের যে রূপ ও পরিবারের কারো সাথে যে রূপ, তা এক হয় না, এই উপন্যাসেও ব্যাপারটা সেরকমই। শারমিন একটি চরিত্র। কিন্তু বান্ধবী রেবেকাকে পাঠানো চিঠিতে তার যেমন ফটকা, চটুল স্বর, পুত্র অরিত্রকে পাঠানো চিঠিতে ঠিক তার বিপরীত, মায়ের মমতা ও আদরমাখা স্বর:

"আমার কলিজার টুকরা অরিত্র, তোমার চিঠি পেয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। তোমার লেখাপড়ার খরচ দিতে পারছি না—তোমাকে রেস্টুরেন্টে কাজ করে টিউশন ফি জোগাড় করতে হচ্ছে। এ কষ্ট আমি রাখব কোথায়?"

প্রাক্তন স্ত্রী দুর্দানা খানকে লেখা চিঠি ও হারুকি মুরাকামিকে লেখা চিঠিতেও হুমায়ূন আহমেদ খান একই ব্যক্তি নন। এরকমই তো ঘটে, আমাদের ভিতরে বিরাজ করে বহু সত্তা ও বহু স্বর। আমাদের যিনি মা, তিনি কারো কারো বান্ধবীও বটে। প্রতিটি চরিত্রের সম্ভাব্য সবকটা সত্তা ও স্বরকে যথোচিত স্থানে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে টেনে বের করে এনেছেন লেখক।

উপন্যাসটি শুরু হয় একটি নোবেলপ্রাপ্তির সংবাদের মাধ্যমে। কিন্তু গল্প যত এগুতে থাকে, আমরা বুঝতে পারি এই নোবেল বিজয়কে কেন্দ্র করে বোনা হচ্ছে অন্য একটি কাহিনী। লেখক হুমায়ূন আহমেদ খানের বহু বছরের দীর্ঘ পারিবারিক দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, দূরত্ব — এসবই হয়ে উঠছে মুখ্য। এইসব জটিলতা ধীরে ধীরে একটি নিষ্পত্তির দিকে এগোতে থাকে, এবং তা শেষ পর্যন্ত ঘটে নোবেল পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানে। অর্থাৎ, পুরো নোবেলের ঘটনাটি পরিণত একটি পরিবারকে আবার মিলিত করার উছিলায়। না, হুমায়ূন আহমেদ খানের নিজের পরিবার আর মেরামতের মত অবস্থায় থাকে না। কিন্তু এই ভাঙা পরিবারের সদস্যরা মিলে একটি নতুন সম্পর্ক জোড়া লাগিয়ে দেন, বিয়ে দিয়ে দেন অরিত্র আহমেদের সাথে তার বান্ধবীর। সেই বিয়ে পড়ান সুইডেনের রাজা স্বয়ং। অর্থাৎ, শেষমেষ এই গল্পে নোবেল পুরস্কার, সুইডেনের রয়্যাল লাইব্রেরি ও এমনকি স্বয়ং রাজাও হয়ে পড়েন কেবল একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার অনুঘটক।

কিন্তু ঘরের হস্তীটির দিকে এবার মনোযোগ ফেরানো দরকার। এই উপন্যাসের কেন্দ্রবিন্দু যিনি, নোবেলবিজয়ী লেখক হুমায়ূন আহমেদ খান, তার জীবনের সাথে আমাদের চেনা একজন লেখক হুমায়ূন আহমেদের জীবনের ঘটনা হুবহু মিলে যায়। কিন্তু আমাদের পরিচিত হুমায়ূন আহমেদ ক্যান্সারে মারা যান ২০১২ সালে। আর এই উপন্যাসের হুমায়ূন আহমেদ খান সেই দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে বেঁচে ফিরে ২০২৫ সালে নোবেল জেতেন, এবং তার মৃত্যু হয় ২০২৭ সালে। দার্শনিক প্লেটোর দাবি ছিল শিল্প কেবল বাস্তবতার একটি দুর্বল অনুকরণ করে, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন মিমেসিস। তার শিষ্য অ্যারিস্টোটল বললেন, শিল্প শুধু বাস্তবের অনুকরণ করে না, সমান্তরাল একটি বাস্তবতা নির্মাণও করে থাকে। সাহিত্যে ইতিহাসের এরকম কাল্পনিক পুনর্গঠন পুরোপুরি নতুন না। এমনকি সিনেমাতেও যখন কুয়েন্টিন টারান্টিনো তার 'ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডসে' হিটলারকে একজন সিনেমাহলের মালকিনের হাতে মেরে ফেলেন, কিংবা 'ওয়ান্স আপোন আ টাইম ইন হলিউডে' যখন তিনি হলিউডের অভিনেত্রী শ্যারোন টেটকে বাঁচিয়ে দেন, তখন তাও ইতিহাসের এরকমই এক ফিকশনাল রি-ইম্যাজিনেশন। কিন্তু এ ধরণের শিল্প মানুষ কেন সৃষ্টি করে? কারণ বাস্তবতা আমাদের তুষ্ট করতে পারে না। কোনো এক প্রাচীন প্রবৃত্তি থেকে আমাদের মনে বারবার বুদ্বুদের মত ফুটে ওঠে এক প্রশ্ন: "কী হতো যদি..."

কী হতো যদি আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি পুড়ে না গিয়ে থাকতো? কী হতো যদি পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর বিশ্বাসঘাতকতা না করতো? কী হতো যদি জীবনানন্দ দাশ ট্রামের তলে না পড়তেন? শুধু এসবই না, বরং নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের ক্ষেত্রেও এ প্রশ্ন মানুষ বারবার করে থাকে। মার্কিন লেখক কার্ট ভনেগাট বলেছিলেন জীবনে চলার পথে একজন মানুষের নিয়তির সাথে আরেকজনের নিয়তির গিঁট বেঁধে যায়। আমরা শূন্যে ভাসতে থাকা কতগুলো মার্বেলের মত, ভাসতে ভাসতে অন্য মার্বেলের সাথে ঠোকা খেয়ে আমাদের জীবনের গতিপথ পালটে যায়। কিন্তু এই যাত্রায় কোনো একটি মার্বেল যদি অনুপস্থিত থাকতো, নিয়তির একটি গিঁট যদি আলগা হয়ে যেতো, তাহলে কী হতো? শিল্পীদের এরকম ভাবনা থেকেই কল্পনার ডালপালা ছড়াতে ছড়াতে জন্ম নেয় এ ধরণের সৃষ্টি। উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ খান নোবেল পাওয়ার পর সুইডিশ একাডেমিতে তার ভাষণে এক জায়গায় বলেন:

"কেন লিখি। বস্তুত অধিকাংশ ক্ষেত্রে আমি লিখি নিজের আনন্দের জন্য। লেখার সময় পাঠকদের কথা আমার মাথায় থাকে না। আমি লিখি কারণ লিখে আনন্দ পাই । লিখতে লিখতে কখনো আমার চোখ দিয়ে অশ্রুপাত হতে থাকে। আবার কখনো অসম্ভব আনন্দে হৃদয়পাত্র পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। লেখা আমার কাছে সৃজনশীলতা নয়—বরং আপনাদের কাছে সসংকোচে স্বীকার করি, লেখালেখি আমার জন্য এক ধরনের চিকিৎসা যা আমার sanity restore করে। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপন আমাদের sanity ক্ষতবিক্ষত করে, আমাদের মানসিক স্থৈর্যের বিনাশ করে, আমাদের সুস্থতা কেড়ে নেয়, ক্ষয় করে আমাদের চিন্তার ভারসাম্য। আমি যখন লিখি প্রতিটি অধ্যায় আমার ক্ষতিগ্রস্ত সত্তা মেরামত করে সারিয়ে তোলে, দূর করে আহৃত বিকার।"

এভাবেই, আমরা বাস্তবের বাইরে এমন এক সমান্তরাল জগতের কথা ভাবি, যেখানে লেখক হুমায়ূন আহমেদ আরো কিছুদিন বেঁচে ছিলেন ও সর্বোচ্চ সম্মাননা পেয়েছিলেন। এমন এক জগৎ, যেখানে আমাদের প্রশ্নেরা জবাব পায়, যেখানে সকল সম্ভাবনার বীজ পরিণতির বৃক্ষ হয়ে বেড়ে ওঠে।