দিবসের সন্তানেরা: মানব-ইতিহাসের দিনপঞ্জী

উরুগুয়ের বিখ্যাত লেখক এদুয়ার্দো গালেয়ানোর জনপ্রিয় গ্রন্থ থেকে কয়েকটি ভুক্তি অনুবাদ করেছেন আসাদ মিরণ

আসাদ মিরণআসাদ মিরণ
Published : 6 March 2023, 04:09 PM
Updated : 6 March 2023, 04:09 PM

এদুয়ার্দো গালেয়ানোর অন্যতম আলোচিত বই, “চিলড্রেন অফ দ্য ডেজ: এ ক্যালেন্ডার অফ হিউম্যান হিস্ট্রি” তাদের জন্য যারা মনে করেন, বহন করার জন্য ইতিহাস বেশী ভারী হয়ে উঠেছে। ক্যালেন্ডারে লিপইয়ার বছর হয় ৩৬৬ দিনে, সেই প্রতিটি দিনের জন্য গালেয়ানো পাঠকদের একটি করে উপাখ্যান উপহার দিয়েছেন। ইতিহাসকে পুনরায় উপস্থাপন করেছেন। তিনি বাস্তব, সম্ভবত ভুলে যাওয়া গল্প বলেছেন। তার লিখনিতে ব্যাপক হত্যালীলার মাঝেও সাহস, প্রান্তিক কণ্ঠস্বর, তুচ্ছ বিষয় এবং সৌন্দর্যের স্মৃতিকে তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন। তার উপাখ্যানে ইতিহাসের সুপরিচিত বিভীষিকাময় ঘটনাগুলির পাশে স্বল্প-পরিচিত ঘটনাগুলি জায়গা করে নেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে মানুষের এক মহাকাব্য। নিচে বইটির কয়েকটি উপাখ্যান অনুবাদ করা হয়েছে। বইটি ২০১২ সালে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে।-আসাদ মিরণ

পায়ের স্মৃতি (৩ জানুয়ারি)

খ্রিষ্টপূর্ব ৪৭ সালের তৃতীয় দিনে, প্রাচীনকালের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থাগারটি পুড়িয়ে ধূলোয় মিশিয়ে দেয়া হয়। ক্লিওপেট্রার ভাইয়ের বিরুদ্ধে জুলিয়াস সিজারের যুদ্ধাভিযানের সময়, রোমান সৈন্যরা মিশর আক্রমণ করে। আগুন আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির হাজার হাজার প্যাপিরাস স্ক্রোলের* বেশিরভাগই গ্রাস করে। দুই সহস্রাব্দ পরে, আমেরিকান সৈন্যরা ইরাক আক্রমণ করে। জর্জ ডব্লিউ বুশের এক কাল্পনিক শত্রুর বিরুদ্ধে ক্রুসেডের সময়, বাগদাদের লাইব্রেরির হাজার হাজার বইয়ের প্রায় সবটাই ছাই হয়ে যায়। মানবতার ইতিহাস জুড়ে, মাত্র একটি আশ্রয় বইকে যুদ্ধ এবং দাবানলের সংহার থেকে আগলে রাখে: একটি ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি। দশম শতাব্দীর শেষের দিকে পারস্যের এক মহান উজির আব্দুল কাসেম ইসমাইলের মাথায় এই ধারণাটি এসেছিল। বিচক্ষণ ও অক্লান্ত এই পরিব্রাজক, লাইব্রেরিটি নিজের সাথে রেখেছিলেন। এক লাখ সতেরো হাজার বই, চারশত উটে চড়ে এক মাইল লম্বা কাফেলা সৃষ্টি করে চলে। উটগুলি ছিল ক্যাটালগ স্বরূপ তাদেরকে বহন করা বইয়ের শিরোনাম অনুসারে সাজানো হয়েছিল। ফারসি বর্ণমালার বত্রিশটি অক্ষরের প্রতিটির জন্য এক একটি উটের ঝাঁক।

* মিশরীয় সভ্যতায় নীল নদের তীরে নলখাগড়া জাতীয় গাছ পাওয়া যেত।সেই গাছ কেটে প্রাপ্ত খোলকে পাথর চাপা দিয়ে রোদে শুকানো হতো। ফলে খোলগুলো শুকিয়ে যেত এবং পাথরের চাপে সোজা হয়ে লেখার উপযোগী হতো। পরবর্তীতে আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে রোল আকারে সংরক্ষণ করা হতো। প্যাপিরাসের এক একটি রোল লম্বায় ১০ থেকে ২০ ফুটের মতো হতো। এভাবে তৈরি প্রাচীন লেখার উপযোগী মাধ্যমকে প্যাপিরাস বলা হয়।

সভ্য মা (জানুয়ারি ২৩)

১৯০১ সালে রানী ভিক্টোরিয়া শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পরদিন, লন্ডনে একটি গুরুগম্ভীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়। এটি আয়োজন করা সহজসাধ্য ছিল না। একটি যুগ যার নামে চলেছিল এবং যিনি তার মৃত স্বামীর স্মরণে চল্লিশ বছর ধরে কালো বস্ত্র পরিধান করে নারীদের ত্যাগের একটি মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার এমন জাঁকজমকপূর্ণ বিদায়-পর্ব ন্যায্য পাওনা ছিল। ‘ভিক্টোরিয়া’ ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, লেডি এবং উপপত্নীর প্রতীক। তিনি চীনের উপর আফিমের অভিশাপ এবং নিজের দেশের উপর পুণ্য আরোপ করেছিলেন। তার শাসনামলে ভালো আচরণ শেখানো কাজগুলি আমাদের অধ্যয়ন করার প্রয়োজন। ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত লেডি গগ-এর বুক অব এটিকেট (শিষ্টাচারের বই)’ বইটি সময়ের কিছু সামাজিক বিধি প্রতিষ্ঠা করেছে: উদাহরণস্বরূপ, লাইব্রেরির তাকগুলিতে নারী ও পুরুষ লেখকদের সহ্যের সীমা ছাড়ানো সান্নিধ্য অবশ্যই পরিহার করতে হবে।লেখকদ্বয় যদি বিবাহিত হয়, তবেই তাদের বই একসাথে রাখা যেতে পারে, যেমন রবার্ট ব্রাউনিং এবং এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিংয়ের ক্ষেত্রে।

পৃথিবী সংকুচিত হচ্ছে (ফেব্রুয়ারি ২১)

আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। প্রতি দুই সপ্তাহে, একটি ভাষা মারা যায়। পৃথিবী যখন তার মানুষের ভাষা হারিয়ে ফেলে, তখন সে সংকুচিত হয়; ঠিক যেমনটি গাছপালা এবং পশুদের বৈচিত্র্য হারিয়ে ফেললে জগতের পরিণতি হয়। ১৯৭৪ সালে অ্যাঞ্জেলা লোইজ মারা যান। এই নারী ছিলেন তিয়েররা দেল ফুয়েগোর শেষ ওনা ইন্ডিয়ানদের একজন, বিশ্বের প্রান্তিক জন। তিনিই ছিলেন শেষ ব্যক্তি যিনি তাদের ভাষায় কথা বলেছিলেন। অ্যাঞ্জেলা নিজের জন্য গেয়েছিলেন, অন্য কারো জন্য না, সেই ভাষায় তাকে ছাড়া আর কেউ স্মরণ করে না: “যারা চলে গেছে তাদের পদে পদে আমি হাঁটছি। আমিও কি হারিয়েছি?” অতীতে, ওনা জাতিরা বেশ কয়েকটি দেবতার পূজা করতো। তাদের পরম ঈশ্বরের নাম ছিল পেমাউলক। পেমাউলক মানে হলো ‘শব্দ’।

বাজে কথার খ্যাতি (এপ্রিল ২৩)

আজ, বিশ্ব বই দিবস। সাহিত্যের ইতিহাস যে একটি নিরবচ্ছিন্ন প্যারাডক্স, সেটি মনে করতে কষ্ট হওয়ার কথা না। বাইবেলের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৃশ্য কি? আদম আর ইভ আপেল কামড়াচ্ছে। এটা কিন্তু সেখানে নেই। প্লেটো কখনই তার সবচেয়ে বিখ্যাত বাক্যটি লেখেননি: “শুধু মৃতরাই যুদ্ধের সমাপ্তি দেখেছে ।’’ ডন কিহোতে তার দে লা মাঞ্চা বইতে কখনো বলেননি: “কুকুর ঘেউ ঘেউ করুক, সানচো। আমরা যে ঠিক পথে আছি, এটা তারই সংকেত।’’ ভলতেয়ারের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাক্যটি যা তিনি কখনো বলেননি কিংবা লেখেননি : “আপনি যা বলবেন আমি তার সাথে একমত নই, তবে আপনার কথা বলার অধিকারটি আমি আমৃত্যু রক্ষা করব।’’ জর্জ উইলহেম ফ্রেডরিখ হেগেল কখনও লেখেননি : “বন্ধু, সমস্ত তত্ত্ব ধূসর, শুধু জীবন বৃক্ষ সবুজ।’’ শার্লক হোমস কখনও বলেননি : “এটা সরল, প্রিয় ওয়াটসন।’’ লেনিন তার কোন বই বা পুস্তিকাতে লেখেননি : “পরিসমাপ্তি উপায়ের ন্যায্যতা দেয়।’’ বের্টোল্ট ব্রেখট তার সর্বাধিক উদ্ধৃত কবিতার লেখক ছিলেন না: “যখন ওরা প্রথমে কমিউনিস্টদের ধরে নিয়ে যেতে এলো/ আমি কোন কথা বলিনি, কেননা আমি কমিউনিস্ট ছিলাম না...’’ এমনকি হোর্হে লুইস বোর্হেসও তার সবচেয়ে পরিচিত কবিতার লেখক ছিলেন না: “যদি আমি জীবনের চেয়েও বেশী বাঁচি/আমি আরও ভুল করার চেষ্টা করব...’’

প্রকাশনার বিপদ (২৪ এপ্রিল)

২০০৪ সালে, গুয়াতেমালার সরকার একবারের জন্য দায়মুক্তির ঐতিহ্য ভেঙে দেয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে যে রাষ্ট্রপতির আদেশেই মিরনা ম্যাককে হত্যা করা হয়েছিল। মিরনা নিষিদ্ধ গবেষণা করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। হুমকি পাওয়া সত্ত্বেও, এই নারী সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া, নিজ দেশের নির্বাসিত আদিবাসীদের খুঁজে বের করতে জঙ্গল ও পাহাড়ের গভীরে চষে বেড়িয়েছিলেন। তিনি তাদের ভাষা সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে, সমাজবিজ্ঞানীদের একটি সম্মেলনে, আমেরিকা থেকে আগত একজন নৃবিজ্ঞানী অভিযোগ করেছিলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেবলই প্রকাশনার জন্য চাপ দেয়: “আমার দেশে আপনি যদি প্রকাশ না করেন, তাহলে আপনার ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাবে।’’ এবং মিরনা উত্তরে বলেছিলেন: “আমার দেশে আপনি যদি প্রকাশ করেন, তবে আপনি নিজেই ধ্বংস হয়ে যাবেন।’’ মিরনা তার গবেষণা প্রকাশ করেছিলেন। তাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

প্রকৃতি বোবা নয় (৫ জুন)

বাস্তবতা নিশ্চল-জীবনের ছবি আঁকে। দুর্যোগকে প্রাকৃতিক বলে সঙ্গায়িত করা হয়, যেন প্রকৃতি জল্লাদ, শিকার নয়। এদিকে জলবায়ু বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, আমরাও হই। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস। একুয়াদরের নতুন সংবিধান উদ্‌যাপনের জন্য একটি শুভ দিন। ২০০৮ সালের এই দিনে, বিশ্ব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো “প্রকৃতিরও অধিকার আছে’’ বিষয়টিকে তারা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়। বিষয়টিকে একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়, যেন প্রকৃতি কোন মানুষ, যার অধিকার থাকতে হবে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই ধারণাটি পুরোপুরি স্বাভাবিক বলে বিবেচিত হয়। কেননা, তাদের বড় বড় কোম্পানিগুলির মানবাধিকার আছে। ১৮৮৬ সালে, সুপ্রিম কোর্টের এক নির্দেশনা বা সিদ্ধান্তের পর থেকে তারা কোম্পানির মানবাধিকারের বিষয়টি রক্ষা করে চলে। যদি প্রকৃতি একটি ব্যাংক হত, তাহলে সেটির স্বার্থ রক্ষার জন্য ইতোমধ্যেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়তো।

পরিষ্কার বিবেক (১৩ মার্চ)

২০০৭ সালের এই দিনে, ইউনাইটেড ফ্রুটের উত্তরসূরি, চিকিতা ব্রান্ডস-এর ব্যানানা কোম্পানি, বিগত সাত বছর ধরে কলম্বিয়ার আধাসামরিক গ্যাং-কে অর্থায়ন করার কথা স্বীকার করে এবং সে জন্য জরিমানা দিতে সম্মত হয়।এই গ্যাং দলগুলি শ্রমিক সংগঠনের ধর্মঘট এবং তাদের বাকিসব অপ্রত্যাশিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সুরক্ষা প্রদান করেছিল। ঐ বছরগুলিতে কলা উৎপাদন অঞ্চলে ১৭৩ জন ইউনিয়ন কর্মী খুন হয়। জরিমানার পরিমাণ ছিল পঁচিশ মিলিয়ন ডলার। নিহতদের পরিবারের কাছে এক পয়সাও পৌঁছেনি।