সুবিমল মিশ্র একটি গ্র্যান্ড সিঁড়ি

আমার জন্য প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ এসেছিল আন্টি-উপন্যাস "আসলে এটি রামাযান চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো" অনুবাদ করতে গিয়ে।

ভি রামস্বামীভি রামস্বামী
Published : 10 Feb 2023, 10:14 AM
Updated : 10 Feb 2023, 10:14 AM

২০০৫ এ, লেখক মৃণাল বসুর সাথে একটি অনলাইন সাক্ষাৎকারের ফলে আমি ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ লেখক সুবিমল মিশ্রের প্রথম দিকের গল্পগুলির অনুবাদের কাজ আরম্ভ করি, এবং তারপরে সুবিমলের আন্টি-গল্প ও আন্টি-উপন্যাস অনুবাদের একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্পে যাত্রা শুরু করি। এর আগে আমি কখনো লেখকের নাম শুনিনি, এবং যদিও আমি ইংরেজির মাধ্যমে সাহিত্যের একটি আগ্রহী পাঠক ছিলাম, আমি বাংলা ভাষায় বাংলা সাহিত্যের একটি রচনাও পড়িনি। কলকাতায় বসবাসের মাধ্যমে বাংলা ভাষার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিতি ছিল, এবং দুই দশক ধরে আমার শহরে তৃণমূল, সামাজিক ও জনসাধারণের এক্টিভিজমে নিয়োজিত ছিলাম।  আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা পড়তে শিখেছিলাম, কিন্তু সেটা তখন ছিল জং-ধরা।

 অনুবাদের প্রথম দিনগুলি আমার স্পষ্ট মনে আছে। এরকম 'গল্প' আমি কক্ষণোই পড়িনি, ফর্ম হোক, আর বিষয়বস্তুই হোক। তাই আমি গাছের দিকে তাকালাম, বনের দিকে নয়, এবং কেবল শব্দ আর বাক্যের ওপর নজর দিলাম। "বাগানের ঘোড়ানিমের গাছে দেখনচাচা থাকতেন" গল্পের একটি অশ্লীল ছন্দময় লোক ছড়া ও অনুবাদ করতে পেরেছিলাম: 'জননী জায়ার মাঝে ভেদাভেদ নাই/ একজন স্তন্যদাত্রী অন্যজন মাই'।  “দূরত্ববোধ” গল্প অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলাম যে সবকিছু একেবারে মাথার ওপর দিয়ে চলে গেলো। পরে, যখন 'বুঝতে' পারলাম, তখন গভীর তৃপ্তি অনুভব করলাম। সুবিমল মিশ্র আমাকে বলেছিলেন যে এই গল্পটি, যেটি ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকের সময়কে বলিষ্ঠভাবে উদ্ভাবন করে, এবং  যেটাতে আমার মনে হয়েছিল একটি ইউরোপীয় স্বাদ আছে, ওনার সবচে প্রিয় গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা তিনি ডিপ্রেশনের মধ্যে লিখেছিলেন।

 আমার নিজের ভেতরও গণ্ডগোল ছিল। যেমন আমার মনে হয়েছিল যে "আর্কিমিদিসের আবিষ্কার ও তারপর", বা "পরীজাতক", বা "মানুষ রতন"-এর মত গল্প আমার পক্ষে অনুবাদ করা উচিত না, কারণ পাঠকরা এগুলো ‘অরুচিকর’ মনে করবেন। সৌভাগ্যক্রমে আমি এরকম মানসিকতা ত্যাগ করতে পেরেছিলাম। আরেকটি সমস্যা ছিল লিটল ম্যাগাজিন জগতের কিছু লোকের মাথায়, যারা ভেবেছিলেন যে হার্পার পেরেননিয়াল থেকে The Golden Gandhi Statue from America বেরোনোয় সুবিমল অবশেষে 'বিক্রি হয়ে গেছেন'!

যখন দ্বিতীয় আন্টি-গল্প সংগ্রহের কাজ শুরু করি (Wild Animal Prohibited), তখনই আমি অনুবাদের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সুবিমল আমাকে বলেছিলেন যে যেহেতু তিনি আখ্যানের ফর্ম থেকে বিদায় নিয়েছেন, তাই ভাষার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। "নীল ফসফরাস" গল্পটি মনে আসে। আমার খসড়া পড়ে শোনানোর পর, তিনি আমাকে বলেছিলেন যে অনুবাদটি যৌক্তিক নয়, লোরকা এবং বোর্হেসের মতো স্বপ্নময় হওয়া উচিত। তিনি পরোক্ষ শব্দ চেয়েছিলেন, প্রত্যক্ষ নয়। তিনি চেয়েছিলেন আমি পাবলো নেরুদা এবং পল এলুয়ারকে গ্রাস করি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার পরামর্শে গল্পটি বাদ দেওয়া হয়। এর আগে, সুবিমল পাঠক, সৌভ চট্টোপাধ্যায়, আমাকে "নুয়ে গুয়ে দুই ভাই" The Canterbury Tales এর স্টাইলে অনুবাদ করতে বলেছিলেন। এটি আমার ক্ষমতার বাইরে ছিল, কিন্তু  তবুও আমি অনুবাদ করলাম, যেমন করলাম "ক্যালকাটা ডেটলাইন", সুবিমলের আরেকটি প্রিয় গল্প, যেটা অনুবাদককে পড়তে শুরু করার পর বেশ কিছু অংশ পর্যন্ত পড়ে যেতে হবে যাতে করে চরিত্রের লিঙ্গ চিহ্নিত করা যায়।

২০১৩ পর্যন্ত কোনো কোনো গল্প সম্পর্কে সুবিমল মিশ্রের সাথে পরামর্শ করতে পেরেছিলাম, কিন্তু এর পর থেকে আমি সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। যে কোন জিজ্ঞাসায় ওনার অভ্যাসগত প্রতিক্রিয়া, "যা তুমি ঠিক বোঝো"। কিন্তু আমার সাহায্যের জন্য প্রচেতা ঘোষ এবং নীলাঞ্জন ভট্টাচার্যের মত বন্ধু ছিল। সুবিমলের লেখা সম্মন্ধে নিজেকে শিক্ষিত করার জন্য আমি যথেষ্ট পরিমাণে পড়াশোনা এবং অধ্যয়নও করলাম। প্রকৃতপক্ষে, আমাকে  অনুবাদক ছাড়া একজন barefoot scholar-গবেষক এবং সাহিত্য সংকলকও হতে হয়েছে।

আমার জন্য প্রথম বড় চ্যালেঞ্জ এসেছিল আন্টি-উপন্যাস "আসলে এটি রামাযান চামারের গল্প হয়ে উঠতে পারতো" অনুবাদ করতে গিয়ে। উপন্যাসে কী হচ্ছে সে সম্পর্কে কোনও ধারণার অভাবেই আমি প্রথম খসড়া তৈরি করলাম। এই খসড়ার ওপর বার বার কাজ করতে করতে ধারণা স্বচ্ছ হতে থাকলো। ভারতে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পাদক, রাহুল সোনিকে সম্পাদক হিসেবে পাওয়ার সৌভাগ্য আমার ছিল। অনুবাদটি যে ভারতে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচকদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে তা আমার জন্য অত্যন্ত আনন্দ ও গৌরবের ব্যাপার।

সুবিমলের আন্টি-গল্পের চতুর্থ সংকলন (The Earth Quakes - প্রকাশের অপেক্ষায়) সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলো। "ত্বকের নিচে রহস্যের, ইনিই আসল গোয়েন্দা" গল্পে ‘আমি’ নামে একজন নায়ক আছেন, এবং The Brothers Karamazov-এর  কোনো কোনো চরিত্রের তির্যক উল্লেখ রয়েছে। একটি গল্পের শিরোনাম ছিল "কোকীরে লনাং করার মত" (“Jabberwocky” কবিতায় যেমন, বানানো-শব্দ ব্যবহার করে)। গল্পে একই সঙ্গে দুটি ন্যারাটিভ আছে, যার মধ্যে একটি বঙ্কিমী বাংলায়। আমি যখন এটি অনুবাদ করছিলাম, তখন আমি লেখকের পরাক্রমশালী প্রতিভা, তার সাহিত্য-সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রচেষ্টার প্রকৃত স্বভাবের একটি অবর্ণনীয় উপলব্ধি পেলাম। কী সেই উপলব্ধি? অনুবাদকের মৃত্যু। Death of the translator--অনুবাদের অযোগ্য হওয়ার অর্থেই এমন উপলব্ধি হয়েছিল। তার লেখায় ছিল: "হে যীশু, যীশু আমার – ঈশ্বরের মেষশাবক" এবং "মোমোরি গেম" এর মত গল্প, যেখানে গদ্য সত্যিই ঘন এবং অস্বচ্ছ। "রুক্ষ কঠিন শপথদীপ্ত হাত, নমনীয় হাত, মুষ্টিবদ্ধ হাত, সমর্পিত হাত, প্রতারিত হাত-ও", "নিকট প্রবিষ্ট সম্পর্কেও ধারণক্ষমতা", এবং "একচলার প্রতিমায় সবুজরঙের অসুর নিচেয়, বেশ দৃশ্যমান ভাবেই, কলাবৌ রাখা" মত শিরোনামের গল্প। এই (১৯৯০ এবং ২০০০ দশকে লেখা ) আন্টি-গল্পগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ, জটিল এবং সত্যিই কঠিন! সুতরাং অনুবাদও একটি দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া ছিল। প্রকল্পটি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো, বোঝা ঠিক কতটা ভারী হয়ে উঠলো তা বুঝতে পারলাম। বোঝা কমানোর জন্য একজন সহ-অনুবাদক নিয়েছিলাম, কিন্তু লোকডাউনের পর  কোনো সমস্যার কারণে সে কাজটি নিতে অক্ষম হল।  তবুও আমি নিছক অধ্যবসায়ের ফলে পাণ্ডুলিপিটি শেষ করতে পারলাম, এবং এখন copy-editing এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। আমার কাছে সুবিমল বাবুর মৃত্যু সংক্রান্ত সবচে দুখ্ঃজনক ব্যাপার এই যে উনি শেষ বইটি দেখে যেতে পারলেন না, এই একটি আফসোস রয়ে গেলো আমার মনে।

প্রতিটি বই আগের বইয়ের থেকে আলাদা এবং আরও কঠিন ছিল। The Golden Gandhi Statue from America-এর ভূমিকায় সুবিমল লিখেছিলেন যে ওনার লেখার শেষের পর্যায়গুলি বোঝার জন্য  পাঠকদের এই গল্পগুলিকে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মতো দেখা উচিত। সুবিমল মিশ্রের অনুবাদের প্রকল্পে এগিয়ে যাওয়ার জন্য, বাংলা ভাষার সাথে আমার লিপ্ততা থেকে শুরু করে – এবং সুবিমলের লেখা পড়ে – আমাকে নানাভাবে বেড়ে উঠতে হয়েছে। আর তাই আমি খুশি যে আমার শ্রমের মাধ্যমে আমি পাঠকদের উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে একটি গ্র্যান্ড সুবিমল মিশ্র সিঁড়ি দিতে পেরেছি!