প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ: শিক্ষকদের শিক্ষক

গোলাম ফারুক খানগোলাম ফারুক খান
Published : 9 March 2023, 04:09 PM
Updated : 9 March 2023, 04:09 PM

ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর মতে বাঙালির পাবলিক কালচারে স্মৃতি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বরেণ্য ব্যক্তিদের জীবন ও কাজ, বিভিন্ন পরিবারের গৌরব ইত্যাদি বিষয়ে মানুষের স্মৃতি কথা-উপকথার রূপে ছড়িয়ে থাকে। 'স্মৃতি ও বাঙালির পাবলিক কালচার' নামের প্রবন্ধে দীপেশ এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরেজি বিভাগের দৃষ্টান্ত দিয়েছেন। তাঁর কথায়ই ফিরে যাই: 'আমি মাঝেমাঝেই প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ানোর ধারার কথা ভাবি। বিশেষ গবেষণা হয়নি এ নিয়ে। ... অথচ ক্যাপটেন ডি. এল. রিচার্ডসন থেকে শুরু করে প্রফুল্ল ঘোষ, পার্সিভ্যাল সাহেব, তারক সেন, সুবোধ সেনগুপ্ত, অমল ভট্টাচার্য, মায় অরুণ দাশগুপ্ত পর্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে আছেন ছাত্র-মাস্টারদের বলা অজস্র খণ্ড কাহিনিতে।... প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক স্মৃতি তো অনেকটাই এইরকম গল্প।'

উপমহাদেশে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে, উচ্চতর শিক্ষার পাঠ্যক্রমে ইংরেজি সাহিত্য প্রচলনের বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন উঠেছে। মূলত প্রশ্ন তোলা হয়েছে এ ভূখণ্ডে এটি চালু করার পেছনে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তা নিয়ে। উত্তর-উপনিবেশবাদী সমালোচক গৌরী বিশ্বনাথন তাঁর বিখ্যাত বই 'Masks of Conquest'-এ বলতে চেয়েছেন, ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের পক্ষে সম্মতি আদায়ের উদ্দেশ্যেই ইংরেজি সাহিত্যের পাঠ চালু করা হয়েছিল। এই ঔপনিবেশিক ফাঁড়া তো ছিলই। তবে এ-ও তো সত্য যে, গত দু-আড়াই শতাব্দী ধরে ইংরেজি সাহিত্য আমাদের চিন্তা এবং কল্পনাকে পুষ্ট করেছে, দৃষ্টিকে প্রসারিত করেছে, নতুন ভাবনার বীজ ছড়িয়ে বাংলা সাহিত্যে অনেক উজ্জ্বল ফসল ফলিয়েছে। যাক, এ প্রসঙ্গ রেখে আপাতত প্রেসিডেন্সি কলেজে ফিরে যাই।

আমরা জানি, একসময়ের হিন্দু কলেজ বা পরের প্রেসিডেন্সি কলেজই ছিল বাংলা অঞ্চলে ইংরেজি সাহিত্য পড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। দীপেশ যে কয়েকজন শিক্ষকের নাম বলেছেন তাঁরা সবাই কীর্তিমান। প্রেসিডেন্সি কলেজের বাঙালি শিক্ষকদের মধ্যে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইংরেজি রোম্যান্টিক কাব্যান্দোলন বিষয়ক বই সেকালে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজের বিদ্বৎসমাজেও সমাদৃত ছিল। শেক্সপিয়ারের কমেডি বিষয়ে সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্তের বইও এরকম সমাদর পেয়েছিল। অনেক আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা ধরনের লেখায় আমরা তাঁদের সম্বন্ধে পড়ি। তবে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, এই শিক্ষকদের মধ্যে যাঁর প্রতিকৃতি সবচেয়ে উজ্জ্বল রঙে আঁকা, তিনি অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (১৮৮৩-১৯৪৮)। তাঁর খ্যাতি রীতিমতো প্রবাদতুল্য। বিশ শতকের প্রথম চার দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষা পেয়ে যাঁরা বাংলাদেশে জীবনের নানা ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেন, তাঁদের অনেকেই অকুণ্ঠভাবে অধ্যাপক ঘোষের কাছে নিজেদের ঋণ স্বীকার করেছেন। শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বসিত বর্ণনায় তাঁর ক্লাসে বসার অভিজ্ঞতা মাঝেমাঝে কিংবদন্তির মতো লাগে। তিনি নিজের হাতে ইংরেজি সাহিত্যের অনেক খ্যাতিমান শিক্ষককেও গড়ে তুলেছিলেন। সঙ্গতভাবেই তাঁকে শিক্ষকদের শিক্ষক বলা যায়।

দীপেশ যেমন বলেছেন, প্রেসিডেন্সির অন্য অনেক কৃতবিদ্য শিক্ষকের মতো অধ্যাপক ঘোষের জীবন এবং কাজ সম্পর্কেও কোনো রীতিবদ্ধ অনুসন্ধান হয়নি। তবে নানাজনের স্মৃতির টুকরো জোড়া দিলে এই মনীষীর মোটামুটি সম্পূর্ণ একটি অবয়ব ফুটে ওঠে। ১৯০৪ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। শুরুর দিকে দু-তিন বছরের জন্য বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে চলে গেলেও ১৯০৮-এ আবার শিক্ষকতায় ফিরে আসেন এবং ১৯৩৯-এ অবসরে যান।

যতদূর মনে পড়ে, প্রথম এই পরাক্রমী ব্যক্তিত্বের সন্ধান পাই বুদ্ধদেব বসুর বই 'আমার যৌবন'-এ। সেটি ক্লাস নেওয়ার সুবাদে নয়, পরীক্ষা নেওয়ার সুবাদে। ১৯৩০/৩১ সালে বুদ্ধদেব বসুদের অনার্স পরীক্ষায় বহিঃপরীক্ষক হিসাবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। বুদ্ধদেবের লিখিত পরীক্ষার খাতায় একটি বানান ভুল হয়েছিল। 'বক্রদৃষ্টি কঠোরদর্শন' অধ্যাপক ঘোষ লাল দাগ দেওয়া বানানে আঙুল রেখে ভ্রূকুটি করে বললেন: 'দেখতে পাচ্ছো বানান?' বুদ্ধদেব শান্তভাবে উত্তর দিলেন: 'ইটন-এর হেডমাস্টারমশাইও ভুল করেন শুনেছি।' তক্ষুনি চাবুক পড়ার মতো প্রত্যুত্তর এল: 'Yes, sir, but he does not fumble!' অর্থাৎ কিনা ইটনের মতো নামিদামি বিলেতি পাবলিক স্কুলের হেডমাস্টার কালেভদ্রে দুয়েকটা বানান ভুল করলেও তিনি তো আর তোমার মতো তালগোল পাকান না! বুদ্ধদেব খেয়াল করে দেখলেন, বানানটা তিনি একবার কেটে দিয়ে আবার ভুল লিখেছেন। মনে মনে মেনে নিলেন এই ভুল তিরস্কারের যোগ্য। এরকমই ছিল অধ্যাপক ঘোষের নিরিখ। যে শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণি পাবে, সে একটি বানানই বা ভুল করবে কেন!

প্রেসিডেন্সি কলেজের একজন কৃতী ছাত্র, লেখক ও রাজনীতিবিদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের মহাগ্রন্থ 'তরী হতে তীর'-এ অধ্যাপক ঘোষের আরো অন্তরঙ্গ চিত্র পাই। হীরেন্দ্রনাথ ইতিহাসে অনার্সের ছাত্র ছিলেন এবং ১৯২৪ সালে অধ্যাপক ঘোষকে পেয়েছিলেন একটি ইংরেজি কোর্সে। তিনি পড়িয়েছিলেন শেক্সপিয়ারের 'মার্চেন্ট অব ভেনিস।' হীরেন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা তাঁর নিজের ভাষায়ই বলি: 'অচিরে প্রফুল্লবাবুর ভক্ত হয়ে পড়লাম। আর তার প্রথম কারণ হল যে অমন ইংরিজী পড়ানো কোথাও দেখিনি। বিদেশী ভাষার স্বচ্ছ, স্পষ্ট নির্ভুল উচ্চারণ -- কিন্তু এ তো তুচ্ছ কথা, খাস "সাহেব" অধ্যাপকও তো বহু দেখেছি। যা দেখলাম তা হল ভিন্ন জাতের পড়ানো -- শেক্সপীয়ারের নাটকের ভিতর নিজে মশগুল হয়ে অন্যকে মশগুল করে তোলা; ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশেষ ক্লাস নেওয়া (রবিবারে পর্যন্ত), যেখানে উপস্থিত থেকে "পারসেন্টেজ" মেলে না অথচ সবাই আসে, ভালো, মন্দ, মাঝারি সব ছেলে আসে; একাধারে নাটকের বিশ্লেষণ এবং অভিনয় যেন আমরা দেখতে পাই। তাই মুখস্ত হয়ে গেল "Merchant of Venice"-এর অনেক অংশ -- আজও কিছু কিছু রয়েছে।' হীরেন্দ্রনাথ আরো অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁর আবেগোচ্ছ্বল উষ্ণ বিবরণ থেকে জানা যায়, শেক্সপিয়ার পড়াতে গিয়ে অধ্যাপক ঘোষ প্রতিটি চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পাঠ এবং অত্যন্ত মৌলিক ব্যাখ্যা করতেন। এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের চোখের সামনে প্রতিটি দৃশ্য, প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠত এবং সাহিত্যের গাঢ়তর বোধ তাদের হৃদয়ে সঞ্চারিত হতো।

সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত তাঁর 'তেহি নো দিবসাঃ' নামের আলোচিত স্মৃতিকথায় অধ্যাপক ঘোষের একটি একান্ত পরিচয় তুলে ধরেছেন। তিনিও ১৯২৪ সালে ইংরেজি অনার্স ক্লাসে অধ্যাপক ঘোষকে শিক্ষক হিসাবে পান। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর সহকর্মী হিসাবেও কাজ করেছেন। সুবোধ সেনগুপ্তের মতে মধ্যযুগীয় ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপক ঘোষের জ্ঞান ছিল অভাবনীয়। প্রতি বুধবার তিনি জেফ্রি চসারের 'ক্যান্টারবেরি টেলস' পড়াতেন। সুবোধ সেনগুপ্তের ভাষায়: '১৯২৪ সালের কলিকাতায় বসিয়া প্রতি বুধবার আমরা ঘণ্টাখানেকের জন্য চতুর্দশ শতাব্দীর ইংল্যান্ডে চলিয়া যাইতাম; তাহা যেন আমাদের কলিকাতার মতই সুপরিচিত এবং ওখানকার লোকগুলিও -- ক্লার্ক, ফ্রায়ার, মংক -- আমাদের রামবাবু, শ্যামবাবুর মতই চেনাজানা লোক...।' সুবোধ সেনগুপ্ত অধ্যাপক ঘোষের অনুপম শেক্সপিয়ার-অধ্যাপনার বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। অধ্যাপক ঘোষ প্রতিটি কোর্স শুরু করার আগে টেক্সটটি নতুন করে পড়ে নিতেন এবং খুব জানা বিষয়কেও সম্পূর্ণ নতুন আলোতে দারুণ জীবন্তভাবে উপস্থাপন করতেন। অধ্যাপক ঘোষের সাহস এবং স্পষ্টবাদিতা ছিল প্রবাদতুল্য। দোর্দণ্ডপ্রতাপ আশুতোষ মুখার্জির পুত্র শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তখন একদিন তাঁকে মুখের ওপর বলে দিয়েছিলেন: 'You have inherited all your father's vices.'

প্রেসিডেন্সি কলেজের আরেকজন দুর্দান্ত ছাত্র অশোক মিত্র আইসিএস ১৯৩৯-৪০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আত্মজীবনী 'তিন কুড়ি দশ'-এ তিনি লিখেছেন: 'আমাদের সময়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে এমন কয়েকজন ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন যাঁদের সমকক্ষ সে-সময়ে অক্সফোর্ডেও ছিলেন না।... তাছাড়া প্রেসিডেন্সি কলেজের লাইব্রেরিতে ইংরেজি সাহিত্যসংগ্রহ ছিল অবিশ্বাস্য রকমের মূল্যবান, পৃথিবীর খুব কম স্থানেই অত মূল্যবান ও বিস্তৃত সংগ্রহ আছে।... প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ যেরকম চসার বা শেক্সপিয়ার পড়াতেন ১৯৩৯-৪০ সালে অক্সফোর্ডে আমি সেরকম পড়ানো শুনিনি।'

কবি আবুল হোসেনেরও সৌভাগ্য হয়েছিল প্রফুল্ল ঘোষের কাছে শেক্সপিয়ার পড়ার। আবুল হোসেন তখন তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আর প্রফুল্ল ঘোষ নিয়মিত চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর এক বছরের জন্য প্রফেসর এমেরিটাস হিসাবে কাজ করছেন। তখন তিনি পড়িয়েছিলেন শেক্সপিয়ারের 'ওথেলো।' সেই আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আবুল হোসেনের মুখ থেকেই শুনি: 'তার আগেও আমরা ইংরেজি নাটক পড়েছি, অন্য দুজন অধ্যাপকের কাছে। কিন্তু পি সি ঘোষের পড়ানোর ধরন ছিল একেবারেই আলাদা। বক্তৃতা নয়, সারাটা সময় পড়ে গেলেন নাটকটা। পড়া বলা ঠিক হল না, অভিনয় করলেন। যখন যে চরিত্রের সংলাপ বলেন তার স্বর বদলে যায়। ডেসডিমোনার কথায় তার চোখ ছলছল করে, ওথেলোর সংলাপে এক রকমের দৃঢ়তা শুনি, আয়াগোর চাতুর্য শুধু তার কথায় নয়, চোখে-মুখে ভাসে। ৬০ বছরের এক বৃদ্ধ একই সঙ্গে নারী ও পুরুষের সংলাপ বলে যাচ্ছেন কী আশ্চর্য দক্ষতায়, মিহি ও মোটা গলায়, সেনাপতির শালীনতা এবং সৈনিকের ঈষৎ অমার্জিত স্বর কেমন সহজে বের হচ্ছে তাঁর কণ্ঠ থেকে, আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে শুনি। পড়ার গুণেই চরিত্রগুলো মূর্ত হয়ে উঠত চোখের সম্মুখে।...তাঁর পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে, ঘণ্টা পড়েছে, তাঁর খেয়াল নেই। তিনি বলে যাচ্ছেন, কলেজে কেউ তাঁকে বাধা দেওয়ার কথা ভাবতেও পারত না। তাঁর পরে যাঁর ক্লাস নেওয়ার কথা তিনি হয়তো দরজা থেকে উঁকি দিয়ে ফিরে গেলেন, সেটা পি সি ঘোষের চোখেও পড়ল না।... আমরা যাঁদের কাছে ইংরেজি পড়েছি, সেই অধ্যাপককুল, সুবোধ সেনগুপ্ত, তারাপদ মুখার্জি, সোমনাথ মৈত্র তাঁর কাছেই শেক্সপিয়ার পড়েছিলেন এবং তাঁরাও আমাদের মতো অভিভূত হয়েছিলেন। সে কথা তাঁদের মুখে শুনেছি।'

অন্য সবার মতোই অধ্যাপক ঘোষেরও কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি এইচ এম পার্সিভ্যালের শেক্সপিয়ার সংস্করণ ছাড়া অন্য কোনো সংস্করণ সহ্য করতে পারতেন না। পার্সিভ্যাল ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর গুরু। একদিন একজন শিক্ষার্থী হার্টফোর্ডের সংস্করণ নিয়ে ক্লাসে এলে সেটা অধ্যাপক ঘোষের চোখে পড়ে গেল। তিনি গর্জে উঠলেন: 'What's that novel you are reading?' ছেলেটি যতই কাচুমাচু হয়ে বলে যে, এটা নভেল নয় 'ওথেলো' তিনি ততই রেগে যান। শেষ পর্যন্ত ছেলেটির হাত থেকে বইটা নিয়ে উলটে-পালটে দেখে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিলেন। সঙ্গে দিলেন এক কড়া ধমক: 'Don't bring novels in my class.'

প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপক ঘোষের বিদায় সংবর্ধনার দিন একটি মনে রাখার মতো ঘটনা ঘটেছিল। সে অনুষ্ঠানে তাঁর অনেক কৃতী ছাত্র এসেছিলেন -- যাঁরা তখন রাজনীতি, শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রশাসন, বিচারবিভাগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে একেকজন দিকপাল। সভার শেষের দিকে সামনের সারি থেকে বাংলা সরকারের মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি উঠে বললেন: 'স্যার, আজ আপনাকে একটা প্রশ্ন করব, জবাব দিতে হবে। আপনি জীবনে এত ছাত্র পড়িয়েছেন, কাকে আপনার সেরা ছাত্র মনে করেন?' কিন্তু অধ্যাপক ঘোষ কিছুতেই এ প্রশ্নের জবাব দেবেন না। শুধু আঙুল দিয়ে সামনের দুই সারিকে দেখিয়ে বলেন: 'তোমরাই তো আমার সেরা ছাত্র। জীবনে তোমাদের মতো ছাত্র পেয়েছিলাম এর চেয়ে গর্বের আর কী আছে!' অনেকক্ষণ তিনি এভাবে পিছলে যাওয়ার পর তাঁর বিখ্যাত ছাত্ররা সবাই দাঁড়িয়ে পড়লেন: 'না স্যার, আজ আপনাকে বলতেই হবে।' নিরুপায় অধ্যাপক কিছুক্ষণ ভেবে সামনের দিকে ঝুঁকে অনেকটা যেন শ্যামাপ্রসাদের কানে কানে বললেন: 'হুমায়ুন কবির।' মুহূর্তেই সারা হল হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ল। কোথায় হুমায়ুন কবির? ফরিদপুরের ক্ষণজন্মা সন্তান হুমায়ুন কবির, মেধাবী হিসাবে দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক-অধ্যাপক-রাজনীতিবিদ হুমায়ুন কবির কোনো কারণে সেদিন এ সভায় আসতে পারেননি, তবে জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার তিনি সেদিনই পেলেন।প্রফুল্ল ঘোষের মতো সেকালের শিক্ষকরা যে আধুনিক শিক্ষাবিজ্ঞানের নতুন পদ্ধতিগুলোর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কিংবা শ্রেণিকক্ষে সেগুলো প্রয়োগ করতেন এরকম মনে হয় না। তাঁরা নিজেদের মতো করেই পড়াতেন -- অনেকটা একমুখি বক্তৃতার ধরনে। তবু শিক্ষার্থীরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত এবং তাঁদের সব কথা অন্তরে ধারণ করত। তাহলে কী এমন ছিল তাঁদের সেই প্রথাগত শিক্ষণপদ্ধতিতে? তুলনামূলক বিচারে আমাদের অবস্থান কোথায়? মনে হয় এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবা দরকার।