ওয়ালেস স্টিভেন্সের চারটি কবিতা

মুনযির-এর অনুবাদে আমেরিকার অগ্রগণ্য কিন্তু কম আলোচিত কবির কবিতা

মুনযির মুনযিরমুনযির মুনযির
Published : 6 Dec 2022, 04:05 PM
Updated : 6 Dec 2022, 04:05 PM

ওয়ালেস স্টিভেন্স (১৮৭৯-১৯৫৫) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রধান কবিদের একজন—আধুনিকতাবাদী মার্কিন কবি। জন্মের হিশেবে টি এস এলিয়টের অগ্রজ হলেও কবিরূপে আত্মপ্রকাশের হিশেবে স্টিভেন্স ছিলেন কিছুটা হলেও তাঁর অনুজ। সমসাময়িক অন্যান্য আধুনিকতাবাদী কবির তুলনায় তিনি যে স্বল্পপরিচিত ও কম জনপ্রিয়, তার জন্যে দায়ী হয়তো তাঁর প্রচারবিমুখ চরিত্র এবং তাঁর কবিতার প্রাকরণিক, ভাষাশৈলীজনিত, এমনকি ভাবনাগত স্বাতন্ত্র্য, জটিলতা ও দুরূহতা; কবিতার গুণে-মানে-অভিঘাতে তিনি অন্য তারকা-কবিদের চাইতে হীন, তা কিন্তু মোটেই নয়। প্রায় ত্রিশ বছরের কবিজীবনে তিনি প্রকাশ করেছেন সাতটি স্বতন্ত্র কবিতার বই, আর সবশেষে নিজের কবিতা-সংগ্রহ , যাতে পূর্বপ্রকাশিত সব কবিতাসহ সংকলিত হয়েছিলো পঁচিশটি নতুন কবিতা।

নিচের চারটি কবিতাই তাঁর প্রথম কাব্য হারমোনিয়াম (১৯২৩) থেকে নেওয়া।

একটি কালোপাখির দিকে তাকাবার তেরোটি তরিকা

 ১

বিশটি পর্বতের মাঝে,

একটিমাত্র সচল বস্তু ছিলো

কালো পাখিটির চোখ।

আমি তিনমনা হয়ে ছিলাম,

ওই গাছটির মতো

যেই গাছে কালোপাখি ছিলো তিনটি।

 ৩

হেমন্ত হাওয়ায় হাওয়ায় কালোপাখি ঘুরপাক খেলো।

এটি ছিলো মূকনাট্যের ছোট একটি অংশ।

একটি পুরুষ আর একজন নারী

হলো অভিন্ন।

একটি পুরুষ আর একজন নারী ও একটি কালোপাখি

হলো অভিন্ন।

জানি না কোনটি বেছে নিতে হয়,

স্বরবিভেদের সৌন্দর্য

না সৌকর্য বক্রোক্তির,

শিসরত কালোপাখি

নাকি তার পরে যা-ই রয় তা-ই।

দীর্ঘ জানালাগুলোকে বরফশলাকা

ভরিয়ে তুললো বিজাতীয় কাচ দিয়ে।

কালোপাখিটির ছায়া পারাপার

করলো সেটিকে ইতিউতি।

আবহ যা ছিলো

সে-ছায়ায় পেলো

একটি অবোধগম্য কারণ।

ওহে হ্যাডামের শীর্ণ লোকেরা,

সোনালি পাখির কল্পনা কেন করো?

দ্যাখো না তোমরা যে, কালোপাখিরা

তোমাদের আশেপাশে থাকা নারীদের

পায়ে পায়ে চারিদিকেই কেমন হেঁটে বেড়ায়?

মহৎ বাচনভঙ্গি এবং

সাবলীল, অবধারিত ছন্দ আমি জানি;

তবে, এ-ও জানি যে,

যতোটুকু জানি তাতে

কালোপাখি আছে জড়িত।

যখন দৃষ্টিসীমার বাইরে কালোপাখি চ'লে গেলো উড়ে,

সেটি চিহ্নিত ক'রে দিয়ে গেলো

বহু বৃত্তের একটির সীমানা।

১০

সবুজ আলোয় উড়তে থাকা

কালোপাখিদের দেখে,

শ্রুতিসুখকর বেশ্যারানিরাও

তীক্ষ্ণ গলায় চিৎকার ক'রে উঠতো।

১১

একটি কাচের বাহনে চ'ড়ে

লোকটি কানেক্টিকাট পেরিয়ে গেলো।

একবার, তাকে এফোঁড়ওফোঁড় ক'রে গিয়েছিলো ভয়,

কেননা সে তার জুড়িগাড়িটির ছায়া দেখে

মনে করেছিলো এক ঝাঁক কালোপাখি।

১২

নদীটি প্রবহমান।

কালোপাখি নিশ্চয় উড্ডীন।

১৩

সারাটা বিকেল সন্ধ্যাই হয়ে ছিলো।

তখন তুষারপাত হচ্ছিলো

এবং সম্ভাবনা ছিলো আরও তুষারপাতের।

কালোপাখি ব'সে ছিলো

সিডার গাছের শাখা-প্রশাখার মাঝে গিয়ে।

তুষার-মানব

শীতমনা হতে হয় যে-কারোই

হিম পানে আর তুষারছাওয়া পাইন গাছের

ডাল ও পালার পানে স্থির চেয়ে থাকতে গেলেই;

যে-গাছ শীতল হয়ে ছিলো বহু দিন ধ'রে

বরফশ্রান্ত জুনিপারগুলো, জানুয়ারি সূর্যের দূর

ঝিলিকে দাঁড়ানো রুক্ষ বৃক্ষগুলোকে অবলোকন

করতে গেলেই; এ-কথা ভাবতে না চাইলেই যে,

কোনও হাহাকার আছে হাওয়ার আওয়াজে,

ক'খানি পাতার মর্মরে,

যা কিনা সেই ভূমির আওয়াজ

যে-ভূমিতে সেই একই হাওয়ার ছড়াছড়ি যেটি ব'য়ে

চলে সেই একই বিরান স্থানেই

তার জন্যে, যে তুষারের মাঝে নিজেই অনস্তিত্বশীল

হয়ে এমন কিছুই শোনে-দ্যাখে না যা নেই,

বরং যে শোনে, দ্যাখে যা আছে না থাকার মতোই।

উলকি

আলো হলো এক মাকড়শা যেরকম।

গুড়ি মেরে চলে জলের ওপরে।

গুড়ি মেরে চলে তুষার কিনারে।

গুড়ি মেরে চ'লে যায় তোমাদের চোখের পাতার তলায়

এবং সেখানে বিস্তার করে তার জাল---

তার দু'টি জাল।

তোমাদের দু'চোখের জাল

বাঁধা আছে ঠিকই

তোমাদের হাড়মাংসের সাথে

যেমন রয়েছে বাঁধা কড়িকাঠ বা ঘাসের সাথে।

জলের উপরিতলে

আর তুষারের কিনারে কিনারে

দু'চোখের কতো তন্তু ছড়িয়ে আছে তোমাদের।

বহিরঙ্গ প্রসঙ্গে

ঘরের ভেতরে থাকলে জগৎ আমার বোধের অতীত;

কিন্তু যখন হাঁটতে বেরোই, দেখি যে, তিনটি-চারটি পাহাড় আর

টুকরোখানিক মেঘ দিয়ে সেটি তৈরি।

ঝুলবারান্দা থেকে আমি দেখি হলুদ হাওয়া,

পাঠ করি আমি সেখানেই যেখানে লিখেছিলাম,

"বসন্ত হলো এক রূপসীর মতো যে কিনা নগ্ন হচ্ছে।"

স্বর্ণবৃক্ষ নীল হয়ে আছে।

মাথার ওপরে তার আলখাল্লা নিয়েছে টেনে গায়কটি।

সেই আলখাল্লার ভাঁজে রয়েছে চাঁদ।