Published : 18 Nov 2022, 01:43 PM
বিনি সুতোর মালা
প্রেমে তো শর্ত থাকবেই
শর্ত তো ছিলই
তাই বলে ছেলেমানুষী শর্ত নয় ...
এই যেমন -
তুমি কিন্তু আর সিগারেট খাবে না,
শরীর খারাপ করবে।
রাত জাগবে না
চোখের নিচে কালি হবে।
আমার জন্মদিন মনে করে
ফুল নিয়ে আমার দরজায় দাঁড়াবে!
এই সব কিছুই শর্ত ছিল না।
শর্ত ছিল
তোমার লেখা কবিতাটা
প্রথম আমাকে শোনাবে!
শুনিয়েছো?
যদি মিছিলে যাও
আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখবে
হাতের মুঠোয়
রেখেছো?
বৃষ্টিতে এলোমেলো শহরময় ঘুড়তে ইচ্ছে হলে
আমায় ডেকে নেবে
নিয়েছো?
যদি চাঁদনী রাতে পদ্মায়
পঞ্চকবির গান শুনতে শুনতে ভাসো ...
ভাসবো দুজনে!
ভেসেছি?
কাগজ কলমের শর্তে
বাজারের ফর্দ থাকে
বাড়িওলার তাগাদা থাকে
অফিসের পদোন্নতি থাকে
আমাদের এসব শর্তের দস্তখত
কিছুই ছিল না তবুও
বিচ্ছেদ হলো!
আগুয়াস কালিয়েন্তেস
উন্মত্ত পানশালা থেকে বেরিয়ে
কিছু মানুষ একা হয়ে যায়
অজগরের মত সরু আঁকাবাঁকা রাস্তায়।
পাথরের পথে, পাথরের দেয়ালে
লেখা আছে ভুলে যাওয়া শহরের
নিজস্ব গোপন কান্নার গল্প।
তবু এইসব রাতজাগা প্রেত
ফিসফিস করে বলে যায়
মাতালের কানে কানে
Can you keep a secret?
Can you keep a secret?
পারে বৈকি,
সুরাসক্তের
প্রলাপে কারই বা আস্থা বলো!
পৃথিবীর নাভি থেকে উঠে আসা ইতিহাস
রাজাধিরাজের গল্প পিচ্ছিল সুড়ঙ্গ বেয়ে হারিয়ে যায়
সময়ের গহীন গহ্বরে।
সেই সাথে কিছু প্রেম,
কিছু হৃদয় ভাঙার নিঃস্ব নালিশ
কিছু তোমাতে আমাতে বড় মাখামাখি।
কিছু রুজি রোজগার, রান্না-বাটি
কিছু শুধুই সময়ের অপচয়,
কিছু নতুন বছরের হালখাতা।
এইসব আটপৌরে জীবনের গল্পে
আধিপত্য আর জয়ের নেশা
জলে স্থলে অন্তরীক্ষে
নিশান উড়ানোর রক্তাত্ত হাত,
বড় সেকেলে মনে হয়।
অরণ্যের রহস্য শুধু অরণ্যই জানে!
পাথরের মসৃণ দেহে জেগে ওঠে
শীতল অক্ষর,
কেচুয়ার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়
Can you keep a secret?
Can you keep a secret?
কতকাল আর গোপন অভিসারে
নিষিদ্ধ অরণ্যের হাহাকার?
তারচেয়ে বরং এই উরুবাম্বার গভীরে
বাস করা জলের সাথে
ভেসে যাক
শতাব্দীর ধুলো, কাদা, জল,
ঢেকে থাক কুয়াশা প্রদোষে নির্জন
আগুয়াস কালিয়েন্তেস।
শীতের হিম তুষার, বৃষ্টির অঝোর জলপ্রপাত
গ্রীষ্মের তাপদাহ, পলি জমে জমে
হোক সবুজ অরণ্য!
শীতের সকালে সেই অরণ্যে
টুপটাপ করে কান্নার মত জল ঝরে,
সেখানে
আজো প্রতিধ্বনিত হয়
আন্দিজ পর্বতমালার পাথরের কানে কানে
Can you keep a secret?
Can you keep a secret?
পাথরের হৃদয় চিরে
এক একটি দীর্ঘশ্বাসের গল্প আর
পতনের শব্দের সাথে মিশে থাক
কিছু কাম, প্রণয়, প্রলাপের মায়া
কিছু পবিত্রভূমির সূর্য প্রণাম
কিছু ক্ষমাহীন মৃত্যু, কিছু
স্বেচ্ছানির্বাসন...
জেট ল্যাগ
তোমার শহরে আজ সূর্যোদয়
দীর্ঘ দূরত্বের উড়ার ক্লান্তি নিয়ে
অন্ধকারে নিমজ্জিত শহরে একা জেগে আছি।
এই শহরে কুকুরগুলো আমার মতই অসহায়।
এই দেশ, এই জন্মভূমি,
এই মাতৃভুমি
তবুও নিজের কোন ঠিকানা নেই,
চেনা বিছানা নেই,
নিজস্ব কোন চাবি নাই।
তবু ফিরে ফিরে আসি।
জানলার মুখ রেখে বৃষ্টিজলে ভিজি।
বহুদিন পর ফিরে পাওয়া
বৃষ্টিকে প্রতি ফোটায় ফোটায়
দুহাতের দশ আঙুলে জড়িয়ে ধরি।
জলের ঝাপ্টায় স্মৃতিরা ফিরে আসে
তুমুল বিস্ময়ে,
হিথরো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে থাকা
অস্থির যাত্রীদের মতো,
সব স্মৃতি যেন কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার অপেক্ষা।
কাঁটাবন, পলাশী, হাতিরপুল,
আমাদের টি এস সির করিডোরে
ধুলোয় ভরা আড্ডায়
নিরবে ভালবাসা চেটেপুটে খাওয়া।
শিশু ফুলবালিকার হাতে ঝুলে থাকা
বকুল ফুলের মালার মত চেনা গন্ধ
তবুও বড় অচেনা।
এই শহরের সব বৃষ্টিজল কদম ফুল
দমচাপা ঘাম ক্রোধ
এই শহরের সব কোলাহল
একদিন দুজনেই ভাগাভাগি করে নিয়েছিলাম।
রিক্সার শহরেও পাখিরা ঘরে ফিরে।
আমাদের সূর্যাস্ত ছিল
আর একটুক্ষণ থাকার অনুনয়।
আজ এই শহরে তোমার
প্রশান্ত ঘুমের সূর্যোদয়ে
আমার শহরে অস্তাচল
ঘরে ফেরার পালা
আমার অন্য এক ফ্লাইট ধরার অপেক্ষা।
বট ও পাকুড়
অনন্তকালের দরজায়
যে মুহূর্তে তুমি এসে দাঁড়ালে
সেই মুহূর্ত থেকে
পৃথিবীর পথ চলা।
মহাবিশ্বের সকল রহস্য
সেইদিন থেকে আমার কাছে
জলের মত স্বচ্ছ, তরল,
সকল অপনয়ন, আড়গুণনের জটিল সমাধান
আটকে ছিল এই কাঠের দরজার ছিটকিনিতে।
তুমি এলে-
আকাশে সেই সময়ে সহস্র উল্কাপতন,
তবু আমি তোমাকেই দেখছিলাম।
সঙ্গত কারণেই
সেই একটি রাতের জন্য
বৈশ্বিক মহামারী, সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসন,
মুদ্রাস্ফীতি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি,
জলবায়ু পরিবর্তন
সবকিছু
পেপারওয়েটের নীচে চাপা পড়ে রইলো।
শীতের কুয়াশা-আদরে মোড়া সকাল
কাঠের দরজার বাইরে পা বাড়ালেই
সবুজ ঘাসে রাতের শুভ্র শিশিরের স্পর্শ।
দূরে পাহাড়ের ওপারে পাহাড়,
তারপরে অজানা মানুষের বাস
তারও ওপারে গভীর সমুদ্র
সেখানেও রাতজাগা জাহাজে বাতি জ্বলে
শঙ্কায় কী বিহ্বলতায় সে কথা
এপারে অজানাই থেকে যায়।
এপারে শহরতলীর নিরালা ঘরে
পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম রাতের শেষে
অন্য এক সকাল।
দুটো প্রাণের শত সহস্ত্র অনুনয় বিনয় উপেক্ষা করে
সূর্যের মৃদু আলো স্পর্শ করে
মাথা নত করে থাকা উইলো, হাইড্রেঞ্জা,
ক্রিনাম লিলি থেকে অতঃপর পার্সিয়ান জেসমিন।
সেই সকালে পৃথিবী বদলে গেছে অযুত নিযুত
সেই সকালে তুমি বট আমি পাকুড়।
ইরাবতী জল
আমাদের দেখা হয়েছিল এক পরিত্যক্ত শহরে
তাম্রযুগের ধ্বংসাবশেষ সাক্ষী হয়ে সেই শহরের
পাশ দিয়ে বয়ে যায় রাবী নদী।
সেখান থেকে শোনা যায় হরপ্পার ট্রেন স্টেশনের হুইসেল।
হিম সন্ধ্যায় প্রদীপ হাতে কেউ যেন অপেক্ষায় আছে,
কোথায় যেন পৌঁছনোর তাড়া ।
তোমার চোখে আমি আবিষ্কার করেছি মৃতের স্তুপ
বেহায়া মেয়ের নৃত্য।
তোমার নাম দিয়েছি ইরাবতী।
কত সহস্র প্রাচীন শব্দ জোড়া দিয়ে বলেছি ভালবাসি।
বলেছি এমনি করেই দিন রাতের কাহিনী
ভুলে যাক কক্ষপথের ঠিকানা
তবু আমরা অন্ধকারে জোনাক পোকার আলোয়
দেখবো জীবন।
খুঁটে খুঁটে খাব দ্রাবিড় সভ্যতা ,
হারিয়ে যাওয়া শবের পাশে আমরা
আবার জেগে উঠবো কোলাহলে
নিজ হাতে গড়বো ঘর ঠিক মৃত শহরের আদলে।
তুমি আমার কথায় হ্যাঁ বা না কিছুই না বলে
মিলিয়ে গেছ সিন্ধু নদ অববাহিকায়।
সহস্র বছরের তৃষ্ণা নিয়ে আজো আমি
ভেসে বেড়াই বুধীল, নেই, মণিমহেশ হ্রদের জলে-
জল কথা কয়, জল কথা কয়,
জল টলমল ভরা চোখের জলে
কথা কয়,
মুছে যায় আর এক জন্মের ইতিহাস।
চিঠি
আজ তোমায় কিছু লিখব বলে
সারাদিন হাতে কোন কাজ রাখিনি।
দূরালাপনী নিঃশব্দ করে রেখেছি,
সকল সামাজিক মাধ্যমগুলোতে
নিখোঁজ সংবাদ এর মত আজ আমি অধরা মুখ।
সদর দরজার বাইরে
সংবাদপত্র পড়ে আছে অবহেলায়
দূরদর্শনের আজ কোন
সংবাদ আমাকে বিচলিত করবে না।
সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর
অস্ত্র বেচাকেনায়
বলির পাঁঠা হয়ে থাকুক ইয়েমেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত লু হাওয়ায়
জ্বলে যাক মরূদ্যান।
পৃথিবীজুড়ে মোদি, ট্রাম্প
আর বরিস জনসনের বাড়বাড়ন্ত হোক,
তবুও আমি অন্ধ উটের মতো
আজ বালিতে মুখ গুঁজে থাকবো,
রাতকানা প্যাঁচার মতো ঝুলে থাকবো
নিঃসঙ্গ পাইন গাছে।
তোমায় লিখব বলে।
চায়ের কাপে ছলকে পড়ে শীতল নিঃশ্বাস
জানালার ফাঁক দিয়ে গলে পড়া
আততায়ী রোদ
কাঠের মেঝেতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়
তবুও আমার কলম স্থবির অনড়।
কী লিখব বলো!
তোমার এক পলক দেখা মানেই
আমার সর্বস্ব হারানোর অস্থিরতা।
সেই তোমাকে
কত কী যে লিখতে ইচ্ছে করে
যার সকলি জানা তোমার,
তবু সকলই অজানা।
অন্তর বাড়ি যেখানে ফিরে যাওয়া যায়না
আমার বিদায়ের দিনে
আমি একদম কাঁদিনি
নির্বাসন বলে কথা!
আমার সব ভালোলাগা ভালবাসার সকল চিহ্ন
আমি জড়ো করেছি সাথে নেয়ার দুই সুটকেসে!
বাবা মা আমার প্রিয় ছোট বোন
সকলে মিলে এগিয়ে দিচ্ছে কত কি—
বাবা ছোট্ট বোতলে সরিষার তেল
যত্ন করে খবরের কাগজ মুড়িয়ে দিয়ে বল্লেন
“চাটনি খেতে চাইলে একটু সরিষার তেল না হলে হয় না!
এটা সাথে নে মা!
ছোট বোন জীবনানন্দ দাশ সমগ্র,
মৈয়েত্রী দেবী ন হন্যতে, বুদ্ধদেব গুহের সবিনয় নিবেদন,
হলুদ বসন্ত,
পূর্ণেন্দু পত্রীর কথোপকথন, জয় গোস্বামী
রবীন্দ্রনাথে - আহা! সূর্যবর্ত্
সব জড়ো করেছে সুটকেসের পাশে।
আমি এক এক করে
মনে করে করে সাথে নিচ্ছি
গানের সংগ্রহ- অতুল প্রসাদ, রজনীকান্ত,
হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশি,
রবিশঙ্করের সেতার
রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান
আরও কত কি!
নিচ্ছি প্রিয় কিছু শাড়ী!
কিছু জামদানি, তাঁত, কপালের টিপ, পায়ের আলতা।
কাঁদব? সময় কই?
যেতে হবে
কবে ফিরে আসবো জানি না তো!
সাথে নিতে হবে আমার যা কিছু প্রিয়
যা কিছু ভালবাসার
যা না হলেই নয়!
এর মধ্যে ঝুম বৃষ্টি নামল আমাদের
"বন্ধুনিবাস” পাড়ার মাঠ ঘাট চত্বর জুড়ে।
বাবা ফিস ফিস করে বলেন
“মেয়েটা চলে যাচ্ছে আহা আকাশও আজ কাঁদছে “
বাইরে তাকিয়ে দূরের জলাশয়ে বৃষ্টি
কী মনোমুগ্ধকর বৃষ্টি!
বুকটা এক মুহূর্তের জন্য হুহু করে উঠলো
দেখতে পাবো তো এমন বৃষ্টি আবার!
কান্নার যে দলা গলার কাছে আটকে আছে
তা সহসা গিলে ফেললাম!
"বৃষ্টি? বৃষ্টি মানেই আরো জ্যাম, ট্রাফিক
তার মানে আরো আগে বেরুতে হবে!
চোখের কোনে যে অশ্রু অচকিতে জমে গেছে তা
দুহাতে উড়িয়ে দিলাম।
কাঁদিনি একদম।
আমার প্রিয় বন্ধু হুমাযূন আহমেদের কয়েকটা বই
হাতে দিয়ে বলল, প্লেন পড়বি, মন ভাল করা বই,
হাসবি, একদম মন খারাপ করবি না কিন্তু।
দুপুরে তাড়াহুড়ো করে মচমচে ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে
মায়ের হাতের খিচুরি খেলাম।
তারপর
আমার প্রিয় বারান্দা, প্রিয় ঘর, অসমাপ্ত বাড়ির ছাদ,
ছাদের অমীমাংসিত রডগুলো ছেড়ে
সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলাম
আমার বাবার ছোট্ট দোতালা বাড়ির নিরাপদ সিঁড়ি বেয়ে
অজানা পৃথিবীতে।
এভাবেই আমার যা কিছু সব নিয়ে
উঠে গেলাম দেশান্তরের জাহাজে, অজ্ঞাতবাসে।
কী সাথে নিয়ে আসবো
তাই ভাবতে ভাবতে
ফেলে এসেছি
আমার একলা বারান্দা
যেখান থেকে দেখা দূরের জলাশয়ে
ছোট্ট অর্ধ-ডুবন্ত নৌকা
তাতে ঝঝমঝম বৃষ্টি।
ফেলে এসেছি
কবিতার সুখ দুঃখ কান্না
জীবনের যুক্তাক্ষর
আর বিরহের দীর্ঘশ্বাস।
তবু কাঁদিনি আমি।
মেয়েদের একদম কাঁদতে নেই।