একজন শুদ্ধতম বিরল মানুষের কথা

আখতার হুসেনআখতার হুসেন
Published : 5 Dec 2022, 07:26 AM
Updated : 5 Dec 2022, 07:26 AM

কবি, লেখক ও ভাষাসৈনিক তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে আমার বিচ্ছিন্নভাবে পরিচয় ১৯৬৭ সালের মধ্যভাগ থেকে হলেও আনুষ্ঠানিক পরিচয়ের পালা ঘটে ১৯৬৮ সাল থেকে। ঢাকার বাংলাবাজারে প্যারীদাস রোডের মাঝামাঝি অবস্থানে প্রকাশনী সংস্থা খান ব্রাদার্সের বিপরীত দিকের যে রাস্তা, তার এক পাশে ছিল ভাষাসৈনিক মোহাম্মদ সুলতান ভাইয়ের স্বল্পপরিসরের বইয়ের দোকান ‘পুঁথিপত্র’। তার দশ কদম পরেই ছিল পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তর দশকের উঠতি তরুণ লেখক-কবি ও শিল্পীদের আড্ডার অন্যতম পীঠস্থান ‘বিউটি বোর্ডিং’। সেখানেই সেদিন বিকেলের দিকে আমি সুলতান ভাইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম।

তাঁর বইয়ের দোকানের ভেতরে তেমন জায়গা ছিল না। সুলতান ভাইয়ের কাছে আসার প্রধানতম কারণ, ক’দিন আগেই তাঁর ‘পুঁথিপত্র’ প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্মরণে প্রকাশিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের তৃতীয় সংস্করণ। প্রথম সংস্করণ বেরিয়েছিল ১৯৫৩ সালে। বের হওয়ার কিছুকালের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পরপরই সংকলনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। আর তৃতীয় সংস্করণ বের হলো ১৯৬৮ সালের মে মাসে।

মোহাম্মদ সুলতান ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকার চামেলীবাগে, খেলাঘরের শাখা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। সে-ও ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ের কথা। তাঁর দো কি চারচালা টিনের ভাড়া বাসার সামনে ছিল একটুকরো খেলার মাঠ। সেই মাঠেই খেলাঘর প্রতিষ্ঠার জন্য চামেলীবাগের কিশোর-কিশোরীদের সমাবেশ করার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ‘চামেলীবাগ খেলাঘর আসর’। সম্ভবত তাঁর ছেলে-মেয়েদের কেউ কেউ এই সংগঠনের সঙ্গে তখন জড়িত হয়েছিল। আমরা একবার তাঁর বাসার সামনের ওই মাঠে ‘খেলাঘরের পুতুলগুলো’ নামে আমার লেখা একটা নাটক মঞ্চস্থ করি। নাটক শুরু হওয়ার আগে বক্তৃতা করেছিলেন শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন। সুলতান ভাই সেদিন উপস্থিত থাকতে পারেননি, ব্যক্তিগত কী একটা কাজে ব্যস্ত থাকায়। পরে তিনি বেশ আক্ষেপ করেছিলেন ছোটোদের এ-রকমের এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে না পারার জন্য।

যা-ই হোক, ১৯৬৮ সালে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের তৃতীয় সংস্করণ বের হওয়ার পর সুলতান ভাই ছোটোখাটো একটা চা-বিস্কুটের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। সেই আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান, কামাল লোহানী, সৈয়দ শামসুল হক, কবি জামালুদ্দিন, আতোয়ার রহমান ও মুর্তজা বশীর। সামান্য একটু দেরিতে এসে পৌঁছেছিলেন তোফাজ্জল হোসেন ভাই। তাঁকে দেখে উজ্জ্বল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেন উপস্থিত সবাই। পরে জেনেছিলাম, ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র এই তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশের ব্যাপারে তিনি কিছু অর্থ সাহায্য করেছিলেন, না হলে ঐতিহাসিক এই সংকলনটি সহজে আলোর মুখ দেখত না।

‘পুঁথিপত্র’র সামনে জমায়েত হওয়া সবাই এবার মোহাম্মদ সুলতান ভাইয়ের উষ্ণ আহ্বানে বিউটি বোর্ডিংয়ের দিকে এগোতে থাকেন। আমাকে লক্ষ্য করে সুলতান ভাই বলেন, ‘আপনিও আসেন।’ আসলে আমি এসেছিলাম ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের একটি কপি সংগ্রহ করার জন্য। সে কথা বলতেই সুলতান ভাই বললেন, ‘আগে চা-টা খেয়ে নিই। তারপর সংকলনটা দেব।’

কী আর করা, সংকোচপ্রবণ মনে অগ্রজদের অনুসরণ করতে থাকি। এক সময় আমরা একে একে এসে ঢুকি বিউটি বোর্ডিংয়ের টি-রুমে, আমরা তরুণরা যার নাম দিয়েছিলাম চা-শালা। আবুল হাসানের দেওয়া নাম। ঢুকেই আগে থেকে অ্যারেঞ্জ করে রাখা চেয়ার-টেবিল দখল করে বসেন সবাই। কেবল আমি দাঁড়িয়ে থাকি। আমাকে কামাল লোহানী ভাই চিনতেন, কবি জামালুদ্দিন আর হাসান হাফিজুর রহমান ভাই চিনতেন। তাই আমাকে তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ‘বসেন’ বলে ইশারা করতেই সুলতান ভাই বললেন, ‘ও হলো আখতার, আখতার হুসেন। ছোটোদের জন্য লেখে। আর খেলাঘর করে। বসেন আখতার।’

আমি দু’পাশে টেবিলসমেত তিনটে তিনটে করে পাতা চেয়ারে সবাই বসার পর পরের টেবিলে যাঁর পাশে বসি, তিনি আর কেউ নন, তোফাজ্জল হোসেন, অচিরকালের মধ্যেই যিনি আমার প্রিয়তম মানুষ তোফাজ্জল ভাই হয়ে ওঠেন। তাঁর পাশে বসতেই কোনোরকম দ্বিধা-সংকোচ ছাড়াই বলে ওঠেন, ‘আমি আপনার লেখা কোনো কাগজে উঠলেই পড়ি। কেননা, আমার অফিসে দৈনিক-সাপ্তাহিক সব কাগজ আসে।’

ওদিক থেকে আমাকে দেখে ঘাড় উঁচিয়ে আতোয়ার রহমান ভাই বলে ওঠেন, ‘আখতার হুসেন তো। ও সত্যিই তরুণদের মধ্যে ভালো লেখে। চৌষট্টি সালেই ‘আজাদ’-এ আমাদের শিশুসাহিত্য নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তাতে ওর একটা ছড়ার পুরো উদ্ধৃতি দিয়েছিলাম।’ আমার তখন চরম দ্বিধা-সংকোচে প্রায় মরে যাওয়ার দশা। ফ্যান চলছে পুরোদমে। তবুও ঘামতে শুরু করি।

একটু পরে সুলতান ভাইয়ের দোকানের একজন কর্মচারী এসে ঢোকেন আমাদের ঘরে। হাতে হিসেব করা কয়েকটা সংকলন--‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। সুলতান ভাই সবার হাতে একটা করে সংকলন তুলে দেন। কেবল দুটো সংকলন তুলে দেন হাসান হাফিজুর রহমান ভাইয়ের হাতে। হাসান ভাই করেন কী, উঠে দাঁড়িয়ে একটু উবু হয়ে বাড়তি সংকলনটা আমার হাতে তুলে দেন। তাই দেখে সুলতান ভাই বলেন, ‘ওকে তো আমিই দেবো। এখান থেকে বেরুবার পর।’

হাসান ভাই বলেন, ‘আমাদের সবার হাতে ঐতিহাসিক একটা সংকলন। আর ওর হাতে থাকবে না! যাওয়ার সময় তুমি ওর জন্য বরাদ্দ সংকলনটা আমাকে দিয়ে দিয়ো। তা হলেই হবে।’

এরপর এলো চা-বিস্কুট। কিন্তু সৈয়দ হক ভাই সন্তুষ্ট হলেন না। তিনি পকেট থেকে বিশ টাকার একটা নোট বের করে টি-বয়কে বললেন, ‘সের দেড়েক মিষ্টি নিয়ে এসো। ছানার সন্দেশ থাকে যেন।’ তখন একসের মিষ্টির দাম আট কি নয় টাকার মতো ছিল।

চা-বিস্কুট খেতে খেতে নানা ধরনের কথাবার্তা চলতে লাগল। এরই ফাঁকে ফাঁকে তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা চলতে লাগল। তিনি জিগ্যেস করলেন, ‘এই সংকলন কি প্রথম দেখছেন?’

‘জি না,’ আমি বলি। ‘আমার কাছে দ্বিতীয় সংস্করণের সংকলনটাই আছে। তবে সেটা কুলাউড়ায় আছে এখন।’

‘কুলাউড়ায় কেন?’

‘আমার আব্বা ওখানে রেলে চাকরি করেন তো, তাই। আমার বইয়ের সংগ্রহ সঙ্গে করে আনতে পারিনি।’

‘ঢাকায় কোথায় কী করেন?’

‘দৈনিক আজাদ’-এ চাকরি করি। প্রুফ রিডিং সেকশনে। পাশাপাশি ‘আজাদ’-এর সাহিত্য সম্পাদক আ. ন. ম. গোলাম মোস্তফার (পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ) সহকারী হিসেবেও কাজ করি। নবিশি করছি সাব-এডিটিংয়েও।’

এবার সংকোচের সঙ্গেই তোফাজ্জল ভাইকে জিগ্যেস করি, ‘কিছু মনে করবেন না, আপনি কী করেন?’

‘আমার অফিস তোপখানা রোডে। প্রেস ক্লাবের অপোজিটে ‘পাকিস্তান পরিষদ’। আমি তার পরিচালক।’ তারপর নিজের হাতের সংকলনটি খুলে পাতা উল্টে দেখান তাঁর গানটি। বলেন, ‘আমার লেখা।’

আমার একটু অবাক হওয়ার দশা। আর সেটা এ কারণে যে, একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে রচিত আবদুল গাফফার চৌধুরীর গানের সঙ্গেই শুধু নয়, মানুষটির সঙ্গেও সরাসরি পরিচিত। তেমনি এই মাত্র সাক্ষাৎ পরিচিত হলাম মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে একই সময়ে রচিত দ্বিতীয় গানটির রচয়িতা তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। সত্যি, এ আমার পরম ভাগ্য!

সেদিন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের তৃতীয় সংস্করণের প্রকাশনা উপলক্ষে বিউটি বোর্ডিংয়ে আয়োজিত দাওয়াতে আমার গুরুস্থানীয় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন, অল্পকালের মধ্যেই তাঁদের সবার সঙ্গেই আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার মধ্যে বিশেষভাবে আমাকে বলতে হবে তোফাজ্জল হোসেন, আমার তোফাজ্জল ভাইয়ের কথা। তাঁর সঙ্গে আমার কত না স্মৃতি! কিছুই ভুলিনি আমি।

১৯৬৭ সালের মধ্যভাগের কথা। সেদিন ‘আজাদ’-এ আমার নাইট শিফটে অফিস। তাই ঘুম থেকে উঠে নাশতা সেরে সোজা চলে আসি ‘সংবাদ’ অফিসে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতেই দেখা সত্যেনদার (বিশিষ্ট লেখক সত্যেন সেন) সঙ্গে। দেখা হয় রণেশদা (বরেণ্য সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্ত) ও শহীদুল্লা কায়সার ভাইয়ের সঙ্গেও। তিনজনই বসতেন দোতলায়। বজলুর রহমান, মানে আমাদের খেলাঘরের ‘ভাইয়া’, তখনো আসেননি। সম্পাদক জহুর হোসেন চৌধুরী তখন নিচের তলার নিউজ সেকশনে সাব-এডিটরদের সঙ্গে বসে গল্প বলায় মেতে আছেন। যেনতেন গল্প নয়। সবই জমাট আদিরসাত্মক গল্প। তিনি গল্প বলেন, আর থেকে থেকেই বুক-খোলা হাসিতে ফেটে পড়েন সাব-এডিটরদের সবাই। আমাদের সেখানে যাওয়া নিষেধ থাকলেও চুপেচাপে কখনো-সখনো সেসব শুনতাম। আর মুখে হাত-চাপা দিয়ে সবার মতোই হেসে উঠতাম।

যাই-হোক, ওপরে দোতলায় উঠতেই একে একে সবার সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। সবাই আমার ভালো-মন্দ জিগ্যেস করেন। কেবল সত্যেনদা তাঁর চেয়ার থেকে উঠে এসে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে এসে বলেন, ‘চলো, আখতার, তোপখানা রোডে একটু যাব। তোমাকে পেয়ে ভালোই হলো। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। চোখের সমস্যা দিন দিনই খারাপ হচ্ছে।’

প্রসঙ্গত বলি, সত্যেনদা শারীরিকভাবে কাবু হওয়া সত্ত্বেও সহজেই রিকশায় চড়তে চাইতেন না। তবুও আমি তাঁকে বলি, ‘সত্যেনদা দু’মাস পর গতকাল আমি বেতন পেয়েছি। চলেন রিকশাতেই যাই।’ দোতলা থেকে নিচের তলায় নামতে নামতে বলি, ‘আজকে আপনি কিছুতেই না করতে পারবেন না।’

রিকশা ভাড়া তখন আজকের ভাড়ার সঙ্গে সাত আসমানের ফারাক ছিল। বারো আনা ভাড়াতেই রিকশাঅলা আমাদের দু’জনকে নিয়ে তোপখানা রোডে সদ্যই গড়ে উঠতে থাকা ‘মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন’ ভবনের সামনে এনে তার রিকশা দাঁড় করায়। আমি আগে নেমে পড়ে সত্যেনদাকে হাত ধরে রিকশা থেকে নামতে সাহায্য করি। সত্যেনদা এবার বলেন, ‘পাকিস্তান কাউন্সিল’-এর অফিস তুমি চেন?’

বলি, ‘চিনব না কেন?’

সত্যেনদা বলেন, ‘আমাকে দোতলায় নিয়ে চলো।’

সামান্য একটু হেঁটে আমরা ‘পাকিস্তান কাউন্সিল’-এর (আমরা বলতাম ‘পাকিস্তান পরিষদ’) উন্মুক্ত প্রবেশপথে ঢুকেই সিঁড়িতে পা রাখি। সিঁড়ি ভেঙে এসে উঠি দোতলায়। কী অবাক করা ব্যাপার, দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই যে মানুষটি সত্যেনদাকে জড়িয়ে ধরেন, আর ‘সত্যেনদা’ ‘সত্যেনদা’ বলতে বলতে তাঁর ডান হাত ধরে চেম্বারে নিয়ে তাঁকে বসান, তিনি আর কেউ নন, তোফাজ্জল হোসেন, আমার তোফাজ্জল ভাই, একুশের দু’টি প্রধান ঐতিহাসিক গানের একটির রচয়িতা। আমাকে দেখে তিনি বলেন, ‘ভালোই হলো। সত্যেনদাকে নিয়ে আসলেন, আমাদের মধ্যে কথা হবে।’ তারপর সত্যেনদার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘কি খাবেন সত্যেনদা, বলুন। দুপুর হয়ে গেছে, নিশ্চয়ই কিছু খাওয়া হয়নি। দুপুরের খাবারটা আজ আমার এখানেই খেতে হবে আপনাকে। না করতে পারবেন না।’

সত্যেনদা কোনো কথা বলেন না। তার মানে এখানে দুপুরের খাবার খাওয়ার ব্যাপারে তাঁর সম্মতি আছে। মুখে তাঁর উজ্জ্বল হাসি।

‘আখতার, আপনি কী খাবেন, বলেন,’ জিগ্যেস করেন তোফাজ্জল ভাই। ‘মাছ-ভাত খেলেই ভালো হয়,’ আমি বলি। ‘তবে সত্যেনদার সুবিধার জন্য কাঁটা ছাড়া মাছের তরকারি আর নিরামিষ হলেই ভালো হবে।’

তোপখানা রোডে, বিশেষ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবের বিপরীত দিকের রাস্তার লাগোয়া খাবারের দোকান আর হোটেলের ছড়াছড়ি। সেদিন তোফাজ্জল ভাই তাঁর অফিস সহকারী, আর পিয়নদের দিয়ে মাছ-নিরামিষ আর ভাত-ডাল খাবারের মনকাড়া আয়োজন করেছিলেন। সত্যেনদা যে এই আয়োজনের খাবার খেয়ে ভীষণ তৃপ্ত হয়েছেন, সেটা তাঁর মুখ দেখেই স্পষ্ট বোঝা গেল। সেদিন তোফাজ্জল ভাইও খেয়েছিলেন আমাদের সঙ্গে।

খাবারদাবারের পর শুরু হলো চা-পান পর্ব। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই শুরু হলো সত্যেনদা আর তোফাজ্জল ভাইয়ের মধ্যে কথা। যখন কথা শুরু হলো, তখন সত্যেনদা বললেন, ‘তোফাজ্জল সাহেব, দরজাটা বন্ধ করে দিলে ভালো হয়।’

তোফাজ্জল ভাই চেয়ার থেকে উঠে নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। তারপর বললেন, ‘এবার বলেন সত্যেনদা।’

‘আপনি তো জানেন তোফাজ্জল সাহেব,’ সত্যেনদা বলতে লাগলেন। ‘সংবাদ’-এ নিয়মিত বেতন পাই না। চোখের দৃষ্টি হারাতে বসেছি। আমার বই লেখালেখি চলে অন্যের সাহায্যে। আমি বলি, আর একজন লেখে। যে লেখে, তাকে মাসে মাসে কিছু টাকা দিতে হয়। আপনি কি আমাকে এ-ব্যাপারে কিছুটা সাহায্য করতে পারবেন?’

তোফাজ্জল ভাই এবার বলেন, ‘কত টাকা তাকে দিতে হয় মাসে?’

‘পঞ্চাশ টাকা।’

‘ঠিক আছে, টাকাটা মাসে মাসে আমিই দেব,’ তোফাজ্জল ভাই নিঃসঙ্কোচে বলেন।

‘আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?’

তোফাজ্জল ভাই বলেন, ‘না, কোনো অসুবিধা হবে না।’

সত্যেনদা তাঁর চায়ের কাপে শেষ চুমুকটা দিতে দিতে বলেন, ‘এ মাসের টাকার জোগাড় করতে পেরেছি। অ্যাডভোকেট মাহবুব সাহেব দিয়েছেন। আপনাকে আগামী মাসের শুরু থেকেই দিলে চলবে।’ তারপর একটু থেমে বলেন, ‘আমি সরকারের চিহ্নিত পলিটিক্যাল ক্রিমিনাল। টাকাটা নিতে আমি আসব না। আসবে আখতার। আমি আপনার এখানে আসলে আপনার চাকরির অসুবিধা হতে পারে। খামে ভরে টাকাটা আখতারের হাতে দিলেই আমি পেয়ে যাব।’

তোফাজ্জল ভাই বলেন, ‘ঠিক আছে, তাই হবে। আখতার প্রত্যেক মাসের সাত তারিখে আমার এখানে চলে আসবে। তবে সাত তারিখ রোববার (তখনকার সাপ্তাহিক ছুটির দিন) পড়লে, পরের দিন আসবে।’ এবার আমার দিকে তাকিয়ে তোফাজ্জল ভাই বলেন, ‘কথাটা ঠিক মনে থাকবে তো ছোটো ভাই!’

‘অবশ্যই থাকবে,’ আমি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বলি।

সত্যেনদা, রণেশদাসহ আমার পরিচিত নেতা-কর্মীদের প্রতি তোফাজ্জল ভাইয়ের এই যে সহযোগিতার হাত বাড়ানো, এর মূলে ছিল তাঁর সঙ্গে মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট পার্টির গোপন সম্পর্ক। এসবই ধীরে ধীরে জেনেছি। তবে দলের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি সবসময়ই ভালো উদ্যোগকে প্রাণপণ সহায়তা দিতে কোনোদিন দ্বিধাগ্রস্ত হননি। অসম সাহসী ছিলেন তিনি। ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।

যা-ই হোক, আজ একথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার করতেই হবে যে, সত্যেনদা ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস, আর স্বাধীনতার পরপর চোখের আর হাঁপানির চিকিৎসার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকার দিন-মাসগুলো বাদে, তোফাজ্জল ভাই তাঁর কথা রেখেছেন। প্রত্যেক মাসে আমার হাত দিয়ে সত্যেনদাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাঠিয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে তিনি যখন ১৯৭৩ সালে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবেন বলে দিন-তারিখ ঠিক হলো, ঠিক তার তিনদিন আগে তোফাজ্জল ভাই নারিন্দার মুনীর হোসেন লেনে প্রেস শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা করিম ভাই আর হেলেন ভাবির বাসায় আমাকে নিয়ে হাজির হলেন। তাঁর অনুরোধে আমিই তাঁকে নিয়ে আসি। দেখা মাত্র শুরু হলো নাটকের মতো দৃশ্য। দু’জন-দু’জনকে গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন। মনে হতে লাগল, তোফাজ্জল ভাই যেন তাঁর এমন একজন আত্মীয়কে হারাতে চলেছেন, যিনি ছিলেন তাঁর শেকড়তুল্য কেউ। যাঁকে ছাড়া তিনি যেন আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবেন না।

ঘটনার শেষ এখানেই নয়। আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৭৭ সালে তখনকার সোভিয়েত দূতাবাসের তথ্য বিভাগের চাকরিটি হারাই। আমি একা নই, একদিনে আমরা ২০ জন। ‘বাকশালী’ বলে পরিচিত ছিলাম বলে তখনকার পরিস্থিতিতে কোথাও আমি চাকরি পাচ্ছিলাম না। বাধ্য হয়ে তখনকার পশ্চিম জার্মানিতে চলে যাওয়া। সেখানে ছয় মাসের মাথায় সত্যেনদার একটা চিঠি পাই। তাতে তাঁর শান্তিনিকেতনে জীবনযাপন কেমন চলছে, সেসব কথা বলার পর পরই তিনি লিখেছিলেন, ‘তোফাজ্জল সাহেব যে টাকা দিতেন প্রতি মাসে, সে তো তুমিই বহন করে আনতে। তাঁর পাঠানো টাকার বদৌলতে আমি তিন তিনটি বই লিখতে পেরেছিলাম নিশ্চিন্তে। যে মেয়েটি আমার বলা কথা শুনে লিখত, তার বেতন পেতে অসুবিধা হয়নি বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এখন আমি বিপদে পড়ে গেছি, আখতার। আমার চোখের দৃষ্টি দিনদিনই আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। তুমি জার্মানিতে গেছ শুনে তোমার ঠিকানা জোগাড় করে এই চিঠি লিখছি। তুমি কি আমাকে মাসে মাসে তিনশোটি করে টাকা পাঠাতে পারো? তা হলে আমার লেখালেখির সুবিধা হয়।’

সত্যেনদার এই চিঠিটি পেয়ে আমি কেঁদে ফেলেছিলাম। ঝট করে চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সুঠামদেহী তোফাজ্জল ভাইয়ের চেহারাটা। মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না রেখে তাঁকে তিনশোর জায়গায় ভারতীয় রুপিতে পাঁচশো করে টাকা পাঠাতে শুরু করলাম। এটা চলেছিল সত্যেনদার মৃত্যুর আগের মাস পর্যন্ত। মোট সাতটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন সত্যেনদা, কেবল আমাকে অনুরোধ জানানো এই চিঠিটা খুঁজে পাচ্ছি না। আর ছ-টা চিঠি আছে। হয়তো সেটা কাগজপত্রের ভিড়ে লুকিয়ে আছে কোথাও।

পাকিস্তান কাউন্সিল বা পাকিস্তান পরিষদ কট্টর পাকিস্তানি আদর্শের বেড়াজালেই আটক থাকত, যদি না প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কর্মকর্তা হিসেবে ভাষাসৈনিক তোফাজ্জল ভাই দায়িত্ব পালন করতেন। সরকারি পদস্থ কর্মকর্তা হলেও অসম সাহসী মানুষ ছিলেন তিনি। না হলে এখানে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত যেসব অনুষ্ঠান হয়েছে, তার প্রতিটি অনুষ্ঠান আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে অনেক অবদান রেখেছে।

আটষট্টি সাল। তবে তারিখ ও মাসের কথা মনে নেই। সেদিন এই পাকিস্তান কাউন্সিল তথা পাকিস্তান পরিষদের মঞ্চের পাটাতনে চেয়ার-টেবিল পেতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, কবি ও গীতিকার ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান একটা কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করেছিলেন। তরুণ-কবিদের সংখ্যাই ছিল বেশি। তিনি অনুষ্ঠানের সভাপতি। তবে কবিদের কেউ তেমন আমাদের পরিচিত নন। একের পর এক কবিতা পড়ছিলেন তারা। তবে এসব কবিতায় দেশে চলমান আইউব-বিরোধী আন্দোলনের কোনো কথা বা ছাপ ছিল না। প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি-বন্দনাই ছিল সেসবের মূল বিষয়।

আমরা যখন কবিতা পাঠের আসরে উপস্থিত হই, তখন সেটা মাঝামাঝি অবস্থায় এবং দু-তিনজন কবির কবিতা শোনার পর আমাদের মনে ঘা লাগে। এসব কী কবিতা! ছড়াকার আবু সালেহকে আমি পিঠে খোঁচা দেই, সে ফিরে তাকায়। খোঁচা দেই কবি শাহাদাত হোসেন বুলবুলের পিঠে। সে-ও আমার দিকে ফিরে তাকায়। এই খোঁচাখুঁচির অর্থ হচ্ছে, যা চলছে, তাকে চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। ফলে যা হওয়ার, তাই হলো। আবু সালেহ মনিরুজ্জামান স্যারকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, আমি এবার ছড়া পড়ব। আমার পরে ছড়া পড়বে আখতার হুসেন, তারপর শাহাদাত হোসেন বুলবুল।’ আমাদের তখন ভয়ানক দাপট ঢাকা শহর জুড়ে। স্যার, মৌন সম্মতি দিলেন। আবু সালেহ পড়ল তার সেই বিখ্যাত ছড়া--

আমার মুখের খাবার যারা কাড়িং

আর তো আমি তাদের নাহি ছাড়িং

দেশটা থেকে তাড়িং এবং মারিং।

নিশ্চুপ পরিষদ হল হাততালিতে ফেটে পড়ল। আবু সালেহ এ-রকম আরও চার পাঁচটি ছড়া পড়ল। প্রত্যেকটি ছড়া শেষ হয় আর তুমুল হাততালি। আমি যখন পড়তে শুরু করলাম ছড়া, আমার বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটল না। শাহাদাত হোসেন বুলবুলের বেলাতেও না। আমাদের ছড়া পাঠ শেষ হতেই সেই কবিতা পাঠের আসর আর জমল না। ম্লান হয়ে গেল আসর। দর্শকরা একে একে বেরিয়ে যেতে লাগলেন। মনিরুজ্জামান স্যার বললেন, ‘আসর আর জমবে না। কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানের এখানেই সমাপ্তি টানা হলো।’

এই অবস্থায় তোফাজ্জল ভাইয়ের প্রতিক্রিয়ার বিবরণটা এবার একটু তুলে ধরা যাক। মনিরুজ্জামান স্যার আর তোফাজ্জল ভাইয়ের মধ্যে ‘তুমি তুমি’ সম্বোধন করে কথা শুরু হলো। তাঁরা কি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বছরের শিক্ষার্থী ছিলেন! তোফাজ্জল ভাই আমাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘এই আখতার, সালেহ, বুলবুল, যেও না।’ তারপর মনিরুজ্জামান স্যারকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘বুঝতে পেরেছো তো, দেশ কোন্ দিকে যাচ্ছে! ওসব শাদামাটা কবিতা-টবিতা দিয়ে কিছু হবে না। গরমাগরম লেখা চাই।’ তারপর তিনি মনিরুজ্জামান স্যার, তাঁর সঙ্গে আসা দু-তিনটি ছেলে এবং আমাদের তিনজনকে চা-বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করে আন্তরিকভাবে বিদায় দিলেন।

এরপর আমরা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় বসবাসকারী তরুণ ও প্রবীণ ছড়াকারদের ছড়া পাঠের আসর এই পাকিস্তান পরিষদের মঞ্চে কতবার যে বসিয়েছি, সে কথা বলে শেষ করা যাবে না। এবং আমাদের চাইতেও দ্বিগুণ উৎসাহে তোফাজ্জল ভাই পরিষদের হলে জায়গা করে দিয়ে, কোনো ভাড়া না নিয়ে, যে উৎসাহদাতার ভূমিকা পালন করেছেন, আমি সে জন্য তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসের একজন নেপথ্যের অদম্য যোদ্ধা বলেই মনে করি।

‘উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী’ এ দেশের পথনাটকের জনক। অনেকেই দাবি করেন, না উদীচী নয়, অন্য সংগঠন বা ব্যক্তি। কিন্তু দলিলপত্রসমেত আমরা প্রমাণ হাজির করতে পারব যে, উদীচীই এ ব্যাপারে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেছে। আমার লেখা ও উদীচী প্রযোজিত প্রথম পথনাটকের নাম ছিল ‘জাগো সবাই’। সম্প্রতি আমি নাটকটি রচনা করার তারিখসমেত তার পাণ্ডুলিপিটি খুঁজে পেয়েছি। এটি আমরা ঢাকা শহরের মূল মূল কেন্দ্রসহ বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সম্মেলনে মঞ্চস্থ করেছি। গিয়েছি শ্রমিক এলাকাতেও--আদমজী, বাওয়ানী, ডেমরা ও উজালা ম্যাচ ফ্যাক্টরির নিকটবর্তী মাঠে। কৃষকদের মধ্যে নাটক নিয়ে আমরা সরাসরি উপস্থিত হয়েছি মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, রায়পুরা ও গৌরনদীতে। অথচ বাংলাদেশের প্রথম পথনাটকটির রিহার্সাল যে পাকিস্তান পরিষদের মঞ্চে দিন সাতেক ধরে হয়েছিল এবং নাটকটি দেখে তোফাজ্জল ভাই কতটা মুগ্ধ হয়েছিলেন, সে কথা বলে শেষ করার নয়। প্রকৃত দেশপ্রেমিক তিনিই, যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও শুভকাজে সহায়তা করেন, কোনো পুরস্কারপ্রাপ্তির লোভ করেন না। তোফাজ্জল ভাই ছিলেন তেমনই একজন মানুষ।

মনে আছে, নন্দিত চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘পোস্টার’ ছোটোগল্পের নাট্যরূপ দেওয়ার কথা। নাট্যরূপ দেওয়ার পর রিহার্সাল দু’জায়গাতে হয়েছিল--তখনকার জিন্নাহ অ্যাভেনিউর (এখনকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ) চারতলায় ‘বাংলাদেশ-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতি’র অফিসে। কিন্তু সেখানে উঠতে অসুবিধা হয় বলে আমি তোফাজ্জল ভাইয়ের পারমিশন নিয়ে পাকিস্তান পরিষদের মঞ্চে ‘পোস্টার’ নাটকের মহড়া বা রিহার্সাল শুরু করি। নাটকটি মঞ্চায়নের আগের দিন, কার কাছ থেকে যেন খবর পেয়ে জহির রায়হান ভাই নিজে এসে উপস্থিত। মহড়া দেখে ভয়ানক খুশি। আমার খুব প্রশংসা করলেন।

প্রশংসা করলেন পাত্রপাত্রীদের। তারপর তোফাজ্জল ভাই আসতেই শুরু হলো তাঁদের দু’জনের মধ্যে কথা। সেই তুমি তুমি। জহির ভাই বললেন, ‘ফিল্মের কাজে ব্যস্ত থাকি বলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে পারি না। কিন্তু ভাইবো না, আমি তোমার খোঁজ রাখি না। সরকারি কর্তা হইয়া যে-সব কাজ তুমি করতাছো, কয়জনে তা করে!’ তারপর চা-পর্ব শেষে নাটকের পাত্রপাত্রীসহ আমার মাথায় হাত রেখে শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নিলেন জহির রায়হান ভাই। বলে গেলেন, ‘আমার প্রিয় একটা গল্প। তার নাট্যরূপ দেখে মানুষ খুশি হোক, এই কামনা করি। ভালো থেকো সবাই।’

দেখতে দেখতে এসে গেল সেই ঐতিহাসিক ঊনসত্তর সাল। আগরতলা মামলার বিরুদ্ধে উত্তাল দেশ। বের হলো আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সম্পাদনায় লিটল ম্যাগ ‘কণ্ঠস্বর’। তরুণ সব কবি ও প্রবন্ধকারের উপস্থিতিতে কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় এই সাময়িকীটির হর্তাকর্তারা মিলে একটা সম্মেলনের আয়োজন করলেন। জায়গা, পাকিস্তান কাউন্সিল তথা বাংলাদেশ পরিষদ। শহীদ মুনীর চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই সম্মেলন। প্রবন্ধ ও কবিতা ইত্যাদির পাঠ শেষে মুনীর চৌধুরী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তা ছিল একটা নিটোল প্রবন্ধস্বরূপ। টেপ রেকর্ডারে সে ভাষণ যেমন রেকর্ড করা হয়েছিল, তেমনি আবদুল মান্নান সৈয়দ ভাই শর্টহ্যান্ডেও সে ভাষণটিকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন।

এই সম্মেলন শেষে তোফাজ্জল ভাই যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন, এক অর্থে তা তুলনারহিত। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ভাইয়ের রচনা সমগ্রর ৪র্থ খণ্ডে এর ভালো সাক্ষ্য পাওয়া যায়। পাকিস্তানের প্রতি তোফাজ্জল ভাইয়ের মনোভাব কতটা বিরূপ ছিল, ঘৃণায় কতটা ঠাসা ছিল, সায়ীদ ভাই তা তুলে ধরেছেন স্পষ্ট ভাষায়।

স্বাধীনতা সংগ্রামের আগ পর্যন্ত উদীচীর কোনো স্থায়ী দফতর বা কার্যালয় ছিল না। যাযাবরের মতো আজ এখানে, তো কাল ওখানে। এইভাবে চলেছে কত দিন, কত বছর। কত পরিবার, ব্যক্তি উদীচীর মহড়ার জন্য জায়গার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, সে আরেক ইতিহাস। স্বাধীনতার পর ১৪/২ তোপখানা রোডের দোতলায় যে আমরা এসে উঠি, সেটা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি অনুমোদন ও নির্দেশে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ভারতীয়, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের গায়ক, শিল্পী ও সাহিত্যিকরা স্বাধীন বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিলেন। তাঁদের প্রতি আমরা যথাযথ শ্রদ্ধা প্রদর্শনে কার্পণ্য করিনি। এসেছিলেন কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে উদীচীর তরফ থেকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা ছিল। স্থান নির্বাচন করা হয়েছিল পরিবর্তিত নামের ‘বাংলাদেশ পরিষদ’ মঞ্চে। কিন্তু সেদিন সরকারি একটা অনুষ্ঠানের তারিখ সপ্তাহখানেক আগে থেকেই ঠিক করা ছিল বলে ভানুদাকে বাংলাদেশ পরিষদে সংবর্ধনা দেওয়া এবং তাঁর কৌতুক শোনার সুযোগ আমাদের হয়নি। সেটা হয়েছিল বাংলাদেশ পরিষদের পেছনে ন্যাপ অফিসের ফটক লাগোয়া একটা ঘরে। কিন্তু তোফাজ্জল ভাই স্বস্তিহীন ছিলেন না। তাই সরকারি সেই অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে ন্যাপ অফিসে এসে সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে ভানুদাকে পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেন, ‘ভানুদা, আমার হলে, ‘বাংলাদেশ পরিষদে’ আপনাকে সংবর্ধনা দেয়ার সুযোগ দিতে না পারার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। মর্মাহত।’

ভানুদা ঝটিতি তোফাজ্জল ভাইয়ের মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেন, ‘হায় হায় বলে কি, বলে কি আমার ছোটো ভাই। সবে তো শুরু হলো। আবার আসব। ঢাকা শহর আমার প্রাণের শহর। এই অনুষ্ঠান শেষে পুরোনো ঢাকা, বিশেষ করে দক্ষিণ মৈশুণ্ডিতে যাব।’

১৯৭২ সালের ঘটনা। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার মাস দুয়েক পরের কথা। স্বাধীনতা পাওয়ার পর নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় উত্তাল দেশ। তার মধ্যেও থেমে নেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। উদীচী মঞ্চস্থ করল আমার লেখা পথনাটক ‘সাচ্চা মানুষ চাই’। এ নাটকেরও রিহার্সাল হয়েছিল বাংলাদেশ পরিষদের মঞ্চে। তোফাজ্জল ভাই রিহার্সাল দেখে বলেছিলেন, ‘দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এমন নাটকের ভয়ানক প্রয়োজন।’ একই কথা বলেছিলেন নাটকটির মঞ্চায়ন দেখে ন্যাপ-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ।

এর মধ্যেই একদিন শুনলাম, ‘স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী’ বলে একটা নতুন গানের দল বাংলাদেশ পরিষদে গানের অনুষ্ঠান করবে। উপস্থিত হলাম অনুষ্ঠান দেখতে। আমাকে খবরটা দিয়েছিল উদীচীর গানের স্কোয়াডের সদস্য গায়ক ফিরোজ সাঁই। গিয়ে দেখি, জমজমাট আসর। মঞ্চে হারমোনিয়াম নেই, তার বাদকও নেই। তবলা বা ঢোল নেই। আছে ড্রাম আর ড্রাম বাদক, গিটার এবং গিটার বাদক। আমাকে আশ্চর্য করল হঠাৎ করেই বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের উপস্থিতি। তিনি আসার পর ড্রাম, গিটার ইত্যাদি বাজিয়ে শুরু হলো গানের অনুষ্ঠান। তোফাজ্জল ভাই চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই গান শুনছিলেন আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন শেখ কামালকে। লোকগীতি, কিন্তু তা-ই পরিবেশন করা হচ্ছে পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্র সহযোগে। একের পর এক গান গাইতে লাগল আমার অপরিচিত সব তরুণ গায়ক। পরে তাদের কারও কারও সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। সে পরিচয় গভীরও হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন আজম খান। গানের অনুষ্ঠান প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে চলল। দর্শকের উপস্থিতিও ভালো। গানের তালে তালে তারা নাচানাচিও করছিল।

অনুষ্ঠান শেষে শেখ কামাল তাঁর ভাষণে সেদিন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যান্ড দলের জন্ম হলো। গান শুধু চুপ করে শোনার ব্যাপার নয়। গানের তালে তালে নাচানাচি করলে খুব ভালো লাগে। ব্যায়ামও হয়। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ বাংলাদেশ পরিষদের পরিচালক প্রধানকেও--তিনি মঞ্চ ভাড়া বাবদ কোনো টাকা নেননি বলে। আমরা তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।’

একথা বলেই অনুষ্ঠান শেষ করা হয়।

তোফাজ্জল ভাই এবার এগিয়ে এসে শেখ কামালকে বলেন, ‘বাবা, তুমি আর গানের দলের সদস্যরা কিছু মুখে না দিয়েই এখান থেকে চলে যাবে?’

‘সে আয়োজন করেছেন কি, স্যার,’ শেখ কামাল জিগ্যেস করেন।

‘আসেন আমার ঘরে’, তোফাজ্জল ভাই আহ্বান জানান।

ফিরোজ সাঁইয়ের টানাটানিতে আমিও গিয়ে ঢুকি।

পেট ভরে সবাই মিষ্টি, শিঙাড়া ইত্যাদি খাই। খাওয়া শেষ করে তোফাজ্জল ভাইকে শেখ কামাল বলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে বলে কি এত সব আয়োজন!’

‘না বাবা,’ তোফাজ্জল ভাই বলেন। ‘যে কাণ্ড আপনারা আজ ঘটালেন, ব্যান্ড গানের উদ্বোধন করলেন, একটা ব্যান্ড দলের জন্ম দিলেন, সেই আনন্দে এবং আপনার বক্তব্য আমার খুব ভালো লেগেছে বলে।’

এ কথা বলার পর শেখ কামাল অবনত হয়ে তোফাজ্জল ভাইয়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলেন। করে বললেন, ‘আজ থেকে আপনি আমাদের একজন অভিভাবক হয়ে গেলেন। আমরা আপনার এখানে আরও অনুষ্ঠান করব।’ তারপর আমরা শেখ কামালসহ বেরিয়ে আসি। সেদিনের কথা এখনো মনে আছে।

কত স্মৃতি! ১৯৭৩ সালে, দিন-মাস মনে নেই, কলকাতা থেকে এলেন ‘ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার’-এর কর্ণধার রুমা গুহঠাকুরতা এবং তাঁর দলবল। অনেক জায়গায় তারা সংবর্ধিত হলেন, গান গাইলেন। কিন্তু উদীচী বাদ যাবে কেন? তারাও সিদ্ধান্ত নিল, রুমা গুহঠাকুরতাকে সংবর্ধনা দেবে তাঁর ইয়ুথ কয়্যারের দলসহ। রুমাদির হাতে সময় ছিল না। ছুটের ওপরে ছিলেন।

সিদ্ধান্ত হলো, পরের দিন বেলা ঠিক এগারোটায় তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তাঁরা যেখানে এসে উঠেছেন, সেখান থেকে তাঁদের আনার ব্যবস্থা করা হবে যে বাড়িতে তারা উঠেছেন, সে বাড়ির মালিকের গাড়িতে করে। এই কথা শুনে অনুষ্ঠানের আগের দিন তোফাজ্জল ভাই আমার খোঁজে পাঠালেন তাঁর এক অফিস সহকারীকে। সেদিন সকাল থেকে অফিস কামাই দিয়ে উদীচী অফিসেই ছিলাম। পাকিস্তান পরিষদ আর উদীচীর কার্যালয় একেবারেই কাছাকাছি। তোফাজ্জল ভাইয়ের সহকারী উদীচী কার্যালয়ের দোতলায় উঠে প্রথম দরজার মুখে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘আখতার সাহেব কে?’ আমি ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে আধা-পরিচিত লোকটার কাছে যেতেই তিনি বললেন, ‘আপনাকে তোফাজ্জল স্যার ডাকছেন।’ আমি উদীচীর দোতলা থেকে নেমে অফিস সহকারীসহ বাংলাদেশ পরিষদের দোতলায় এসে উঠি। তোফাজ্জল ভাই আমাকে দেখেই কিছুটা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন, ‘কাল এগারোটায় সংবর্ধনা দেবেন রুমা গুহঠাকুরতা ও তাঁর দলবলকে। কিন্তু কীভাবে তাদের সংবর্ধনা দেবেন? ফুলের মালা বা তোড়া দিতে হবে না? কিছু খাওয়াতে হবে না?’

আমি ভাবলাম, তাই তো! আমি তখন একটা কাগজের টুকরোয় মোস্তফা ওয়াহিদ খান, একরাম আহমেদ এবং অন্য আরও কয়েকজনের নাম লিখে অফিস সহকারীকে উদীচী অফিসে পাঠাই। বলে দেই, তারা যেন এখানে চলে আসে।

একরাম আহমেদ, ওয়াহিদ, ফয়সাল, সেন্টু, গোলাপ, মল্লিক চলে আসেন তোফাজ্জল ভাইয়ের কামরায়। সবাই জায়গামতো বসেন। বসার পর তোফাজ্জল ভাই উপস্থিত সবাইকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘সংবর্ধনা তো দেবেন, কিন্তু কীভাবে?’

‘আমরাও তো সে কথাই ভাবছি,’ বললেন ওয়াহিদ।

‘শুনুন,’ বলতে থাকেন তোফাজ্জল ভাই, ‘আমি শুনেছি আপনাদের আর্থিক সংকট যাচ্ছে। সবাইকে ফুলের মালা আর একটা করে ফুলের তোড়া দেব। এসব-কিছু কেনাকাটার দায়দায়িত্ব আমার ওপরে ছেড়ে দেন আপনারা। কাছেই ভালো মিষ্টির দোকান আছে। তা-ও কিনে নিয়ে আসব আমরা। আপনারা শুধু আমাদের জানান, দলে সদস্য কতজন।’

বিকেলের মধ্যেই জানানো হয় রুমা গুহঠাকুরতাসহ মোট সাতজন।

পরের দিন অনুষ্ঠানের সামান্য আগেভাগে বাংলাদেশ পরিষদের মঞ্চে মাইক, লাউড স্পিকার ইত্যাদি ফিট করা হয়। যথাসময়ে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার-এর শিল্পী এবং দলনেত্রী রুমা গুহঠাকুরতা এসে উপস্থিত হন। আমরা তখন দোতলা থেকে নিচে নেমে এসেছি। হাতে ফুলের মালা আর তোড়া। তাঁরা গেটের গোড়ায় আসতেই তোফাজ্জল ভাইয়ের দেওয়া ফুলের মালা ও তোড়া তাঁদের গলায় পরিয়ে দেই। তুলে দেই হাতে। তারপর তাঁদের নিয়ে দোতলায় উঠি। তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে রুমাদি ও তাঁর দলের সদস্যদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। খুশি হন তিনি।

অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে ইদু ভাই এবং একরাম আহমেদ সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন উদীচীর তরফ থেকে। এরপর রুমাদি বাংলাদেশে তাঁর আসার এবং প্রাণঢালা অভ্যর্থনা পাওয়ার অনুভূতি ব্যক্ত করেন। শুরু হয় ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারের অনুষ্ঠান। আমাদের জানা-অজানা গানগুলোই তাঁরা এত শৈল্পিকভাবে গেয়ে চলেন যে মুগ্ধতায় আমাদের হতবাক হওয়ার দশা। আট থেকে নয়টা গান তাঁরা গেয়ে শোনান। তারপর আপ্যায়নের পালা। রুমাদি যে মিষ্টির এত ভক্ত, কে সেটা জানত! বেশ মজা করে তিনি এবং তাঁর দলের সবাই একের পর এক মিষ্টি খেয়ে চলেন। রুমাদি বলেন, ‘ঢাকার মিষ্টি সত্যিই জাদু জানে।’

উদীচীর কার্যালয়েও আমরা তাঁদের নিয়ে আসি। তাঁদের হাতে সময় অল্প থাকায় দুটো গান শোনান উদীচীর গানের দলের শিল্পীরা। দিদি আমাদের শিল্পীদের মন খুলে প্রশংসা করেন।

এখনো মনে পড়ে, উদীচী অফিসে বসে রুমাদি এবং তাঁর দলের সদস্যদের কীভাবে সংবর্ধনা দেওয়া যায়, এ নিয়ে নানা প্রস্তাব আসছিল। কিন্তু পয়সার কথা ভেবে বাতিল হয়ে যাচ্ছিল। সেদিন যদি তোফাজ্জল ভাই নিজের টাকা দিয়ে ফুলের মালা, ফুলের তোড়া আর পর্যাপ্ত মিষ্টি কিনে দিয়ে আমাদের সহায়তা না করতেন, আমাদের রীতিমতো লজ্জায় পড়তে হতো। এমনই মানুষ ছিলেন তোফাজ্জল ভাই।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোফাজ্জল ভাই ঢাকাতেই ছিলেন। ছিলেন বাংলাদেশ পরিষদের প্রধান পদে। আমি প্রায় প্রতিদিনই তাঁর কাছে যেতাম। বিশেষ করে বাংলাদেশ পরিষদের ছোট্ট অথচ সমৃদ্ধ লাইব্রেরি থেকে বাছাই করে বই নেওয়ার জন্য। আমাকে তিনি বই ধার দিতেন নিয়ম ভঙ্গ করে। কেননা, বাইরের কাউকে বই দেওয়ার নিয়ম ছিল না। ওখানে বসেই পড়তে হতো। আমাকে বই বাসায় নিতে দিতেন। আমি ঠিক সময় মতো ফেরত দিতাম বলে। মাঝেসাঝে তিনি সাজেস্ট করতেন এ বই পড়তে, ও বই পড়তে। প্রমাণ পেয়েছি, তিনি ঋদ্ধ মনের পাঠক না হলে আমাকে যেসব বই পড়তে বলতেন, অন্য কেউ তা পারত না। তাঁর সাহচর্যে আমার পাঠক-মন সত্যিই দিগন্ত-খোলা হয়ে উঠেছিল।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর তাঁকে মোশতাক মন্ত্রিসভার তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের নির্দেশে খুলনায় বদলি করা হয়। তারপর তাঁর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি।

কিন্তু হঠাৎ করেই তোফাজ্জল ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় ১৯৭৭ সালের শেষ কি, ১৯৭৮ সালের প্রথম দিকে। তখন গঠিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃত খুনিদের উদ্যোগে ফ্রিডম পার্টি। যে ঘটনার কথা বলছি, সেদিন ফ্রিডম পার্টির সভা চলছিল দুপুরের দিকে। হঠাৎ করে তাদের নিজেদের মধ্যে গোলমাল বেঁধে যায়। পিস্তলের গোলাগুলি চলতে থাকে। বেশ কয়েকজন আহত হয়। একজন মাঝবয়েসি লোক আহত হয় পিস্তলের গুলি তার ডান পায়ে লাগায়। সে অবস্থায় সে উবু হয়ে অনেক কষ্টে বাংলাদেশ পরিষদের প্রবেশপথের মুখে এসে পড়ে। তখনো গোলাগুলি চলছিল। আমি সেদিন ওই সময় উদীচী অফিসেই ছিলাম। গোলাগুলির শব্দ শুনে দোতলার জানালা দিয়ে তাকাতেই আহত লোকটাকে ওইভাবে দেখে গামাকে (উদীচীর এটা সেটা আনা-নেওয়ার কাজ করত। খুবই বিশ্বস্ত ছেলে) অফিসে রেখে আমি নিচে নেমে আসি। এবং খুব সন্তর্পণে আহত লোকটার কাছে গিয়ে তার অবস্থাটা সরাসরি দেখি। কালবিলম্ব না করে তাকে টেনে লোহার গেটের ভেতরে নিয়ে আসি। তারপর দোতলায় উঠে যাই। উঠে গিয়ে যাঁকে দেখি, তাঁকে এখানে এই মুহূর্তে দেখব বলে কল্পনা করিনি।

তিনি তোফাজ্জল ভাই। বলি, ‘আপনি না খুলনায়? আজ এখানে কেন?’

জবাবে বলেন, ‘অফিসিয়াল একটা কাজে এসেছিলাম। ভাবলাম, আমার পুরোনো কর্মস্থলটা একটু ভিজিট করে যাই। পুরোনো সহকর্মীদের একটু দেখে যাই। দিনকাল ভালো না।’

তাঁর কথা থামতেই আমি তোফাজ্জল ভাইকে বলি, ‘আপনার পরিবর্তে নতুন যিনি এসেছেন, তাঁকে তো আমি চিনি না। তাঁকে বলে আমাকে একটু সাহায্য করবেন?’

তোফাজ্জল ভাই বলেন, ‘বাইরে গোলাগুলি হচ্ছে।’

‘হ্যাঁ, সে-কথাই বলছি। ফ্রিডম পার্টির পিস্তলের গুলিতে একজন মাঝবয়েসি লোক পায়ে আঘাত পেয়েছে। রক্ত ঝরছে। সম্ভবত গুলিটা ক্ষতস্থানেই ঢুকে আছে। ভয়ে জোরে কাতরাচ্ছেও না লোকটা। তাকে ওপরে নিয়ে আসতে চাই। আহত লোকটা আপনাদের অফিসে ঢোকার গেটের কাছেই পড়ে আছে।’

তোফাজ্জল ভাই তখন তাঁর জায়গায় বসা নতুন প্রধান কর্মকর্তাকে বললেন, ‘আপনার সাহায্য চাই আমি।’

‘অবশ্যই পাবেন’, নতুন কর্মকর্তা এবার তাঁর দু’জন অফিস সহকারীকে লক্ষ্য করে আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘ওনার সঙ্গে যাও। আহত লোকটাকে ওপরে নিয়ে আসো।’

হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। দ্রুত নেমে আসি নিচে। তিনজন মিলে ধরে আহত লোকটাকে দোতলায় নিয়ে আসি। আসতেই তোফাজ্জল ভাই প্রধান দরজাটা বন্ধ করে দেন।

আহত লোকটা এবার কিছুটা জোরে কাতরাতে থাকে। তোফাজ্জল ভাই পিস্তলের গুলি লাগা জায়গাটা দেখেন। তারপর বলেন, ‘টয়লেট পেপার আছে?’

‘আছে’, অফিস সহকারী বলেন।

‘স্যাভলন আছে?’

‘আছে।’

‘দ্রুত নিয়ে আসো,’ নির্দেশের সুরে বলেন তোফাজ্জল ভাই।

অফিস সহকারী টয়লেট পেপার আর স্যাভলন আনতেই তোফাজ্জল ভাই টয়লেট পেপারে স্যাভলন ঢেলে তাই দিয়ে ক্ষতস্থান পরিষ্কার করতে থাকেন। এই অবস্থা দেখে বাংলাদেশ পরিষদের নতুন প্রধান তোফাজ্জল ভাইকে লক্ষ্য করে বলে ওঠেন, ‘স্যার, আপনি বসুন, কাজটা আমাকে করতে দিন। আপনার বয়স হয়েছে।’

‘না, কাজটা আমিই করি। আপনি আপনার একজন সহকারীকে সাবধানে পাশের মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে পাঠান, দেখুক কোনো ডাক্তারকে পাওয়া যায় কী-না! পেলে তাঁকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করুন।’

‘স্যার, আমি নিজে যাচ্ছি মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনে।’

‘সাবধানে যাবেন,’ তোফাজ্জল ভাই বলেন।

আহত লোকটার চিৎকার থামাতে প্রথম থেকেই একজন অফিস সহকারী তার মুখ চেপে ধরেছিল। মাঝে মাঝে ছেড়ে দিচ্ছিল, যাতে নিশ্বাস নিতে কষ্ট না হয়। রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল। পড়ছিল মেঝেতে। মোছার কাজ করছিল আরেকজন সহকারী।

পাঁচ থেকে দশ মিনিটের মাথায় নতুন কর্মকর্তা তাঁর কামরায় ঢোকেন। সঙ্গে একজন ডাক্তার। হাতে তাঁর চিকিৎসার যন্ত্রপাতি রাখার ছোটো একটা বাক্স। এসেই চিমটার মতো কিছু একটা বের করে ক্ষতস্থানে সামান্য খোঁচা দিতেই আহত লোকটা চিৎকার করে ওঠে। ঝট করে তার মুখ চেপে ধরে ডাক্তার সাহেব বলে ওঠেন, ‘গুলিটা ক্ষতস্থানের ভেতরেই আছে। হাসপাতালে নিতে হবে।’

‘তাহলে উপায়?’ তোফাজ্জল ভাইয়ের গলায় কিছুটা হতাশার সুর।

ডাক্তার সাহেব বলেন, ‘একটা গাড়ি লাগবে। ওকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। জরুরি বিভাগে।’

‘ডাক্তার সাহেব, আপনি কি যাবেন,’ তোফাজ্জল ভাই জিগ্যেস করেন।

পরিষদের নতুন পরিচালক প্রধান বলেন, ‘আমাদের অফিসের গাড়ি আছে। তাতে করেই তাকে নিয়ে যাব।’

‘মেডিকেলে রোগীও যাবে, ডাক্তার সাহেবও যাবেন, আমিও যাব,’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেন তোফাজ্জল ভাই।

আমি বলি, ‘আপনি যাবেন, আমি যাব না?’

‘দরকার নেই’, তোফাজ্জল ভাই বলেন। ‘আমরা সরকারি লোক, প্রভাব খাটাতে পারব।’ তারপর নতুন প্রধানকে বলেন, ‘নিচে একজনকে পাঠান, দেখে আসুক বর্তমান অবস্থা কেমন?’

একজন অফিস সহকারী নিচে নেমে গিয়ে সব দেখে-শুনে ফিরে এসে বলেন, ‘এখন অবস্থা শান্ত। যাওয়া যাবে।’

তারপর তোফাজ্জল ভাই, ডাক্তার সাহেব গাড়িতে গিয়ে ওঠেন এবং আমিসহ আরো দু’জন মিলে বহন করা আহত লোকটাকে গাড়িতে তুলে দেই। ড্রাইভার স্টার্ট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দ্রুত গিয়ে ওঠেন প্রধান সড়কে। মেডিকেল কলেজ অভিমুখে যেতে যেতে একসময় গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে যায়।

পরে শুনেছিলাম, সেদিনই দ্রুত অপারেশন করে আহত লোকটার ক্ষতস্থান থেকে গুলি বের করা সম্ভব হয়েছিল। এসবই হয়েছিল তোফাজ্জল ভাইয়ের প্রভাবে তাঁর অতিঘনিষ্ঠ কুমিল্লার একজন ডাক্তারের জন্য। এমনই মানুষ ছিলেন তিনি। যাঁরাই তাঁকে জানত, কেউ শ্রদ্ধা না করে পারত না।

আহত লোকটা ছিল একজন পান-বিড়ি বিক্রেতা। সে আর খুঁজে পায়নি তার পসরা সাজানো ছোটো টিনের বাক্সটা। তাকে চারদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। তার জন্য পাঁচশোটি টাকা তোফাজ্জল ভাই দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ পরিষদের সেই নতুন প্রধানের কাছে। আহত লোকটা যদি কখনো তাঁর কাছে আসে, তিনি যেন সেই টাকাটা তার হাতে তুলে দেন। যেন নতুন করে সে তার কারবার শুরু করতে পারে। এসেছিল সে, সুস্থ হওয়ার দিন-দশেক পর বাংলাদেশ পরিষদের দোতলায়। তার হাতে নতুন প্রধান টাকাটা তুলে দিয়েছিলেন। নতুন করে শুরু করেছিল তার ব্যবসা।

এ কথা জানতে পেরেছিলাম দিন পনেরো পরে হঠাৎ করে বাংলাদেশ পরিষদের প্রধান ফটকের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা নতুন পরিচালকের মুখ থেকে। উদীচী অফিসে ঢোকার আগেই বাংলাদেশ পরিষদের প্রধান ফটকের মুখ। আমাকে দেখেই তিনি চিনতে পেরেছিলেন। তারপর আদ্যোপান্ত বলেছিলেন সব কথা।

১৯৯৩ সালের মধ্য ভাগের কথা। আমি কী একটা কাজে গিয়েছিলাম পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনে বিখ্যাত সুরকার, গায়ক শেখ লুৎফর রহমান ভাইয়ের বাসায়। এ-কথা সে-কথা বলার পর তিনি জানতে চাইলেন, ‘আখতার, তোমার কাছে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনটা আছে? আমার কাছে ছিল, কোথায় রেখেছি, এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘কী করবেন সংকলনটা দিয়ে,’ আমি জিগ্যেস করি।

তিনি বলেন, ‘ওটাতে তোফাজ্জল হোসেনের একটা গান আছে না, আমি ওটার সুর করতে চাই। গানের কথাগুলো খুব ভালো।’ তারপর একটু থেমে বলেন, ‘তুমি কি গানটা, অথবা সংকলনটা আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবে?’

‘পারব,’ আমি কোমল সুরে বলি।

সত্যিই আমি কথা রেখেছিলাম। পুরো ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনটাই তাঁর বাসায় গিয়ে তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সংকলনটা পেয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘হপ্তা খানেক পরে এসো। গানটা কেমন সুর করলাম, শুনে যেয়ো।’

আমি সম্মতি জানিয়ে চলে এসেছিলাম। গিয়েছিলাম হপ্তা খানেক পরে। তবে নানা ব্যস্ততা আর সামান্য শারীরিক অসুস্থতার জন্য গানটার সম্পূর্ণ সুর করতে পারেননি। কেবল মুখটা করেছেন। সেটুকু গেয়ে শোনালেন। খুব ভালো লাগল।

তারপর? তারপর হঠাৎ করেই শুনলাম লুৎফর ভাই ভয়ানক অসুস্থ। বাসায় দেখতে গেলাম আমি আর উদীচীর সংগীত বিভাগের মধ্যমণি ফারুক ফয়সাল। ভালোভাবে কথা বলতে পারছিলেন না লুৎফর ভাই। আমাদের তেমনভাবে চিনতেও পারছিলেন না।

তারপর তো ১৯৯৪ সালের ৩০ নভেম্বর তিনি আমাদের ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। তোফাজ্জল ভাইয়ের বিখ্যাত গানের কথাগুলো পুরোপুরি আর তিনি সুরের জালে বদ্ধ করতে পারলেন না। আমার মনে একটা গভীর আক্ষেপ থেকে গেল।

তবে এই লেখাটা লিখতে গিয়ে ঘটনাক্রমেই তাঁর সুপ্রিয় সন্তান তারিক সুজাতের কাছ থেকে জানতে পারলাম, তাঁর বাবার সেই গানটার সুর করা হয়েছে। ক্যাসেট বদ্ধও করা হয়েছে। গেয়েছেন সুখ্যাত গায়ক-গায়িকা যথাক্রমে সুবীর নন্দী ও ফাহমিদা নবী, দেশখ্যাত গায়ক-সুরকার আবদুল লতিফের সেই পুরোনো সুরেই। সুরটা জানা ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শব্দসৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল মহলানবীশের। সুরটা নতুন করে কণ্ঠে ধারণ করতে শিল্পী দু’জনকে তিনিই সাহায্য করেছেন। আমার মনে সেই আক্ষেপের রেশটা আর নেই।

আমার তোফাজ্জল ভাই যেখানেই থাকুন, তাঁর আত্মা যেন শান্তিতে থাকে--এটাই আমার চিরকালের একান্ত কামনা।