Published : 07 Oct 2023, 01:00 PM
[এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নরওয়ের লেখক ইয়োন ফসসে (Jon Fosse)। তিনি প্রায় আশিটি গ্রন্থের রচয়িতা। এর মধ্যে আছে নাটক, উপন্যাস, কবিতা ও শিশুসাহিত্য। তার একটি বিখ্যাত উপন্যাস Aliss at the Fire (মূল Det er Ales)। বইটি নরওয়েজিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ড্যামিয়ন সার্লস। মূল বইটি প্রকাশিত হয় ২০০৩ সালে এবং ইংরেজি অনুবাদটি বের হয় ২০১০ সালে। আমরা এখানে বইটির শুরুর দিকের অংশবিশেষ বাংলা তর্জমায় পেশ করলাম। ফ্ল্যাশব্যাক প্লটিংয়ের মাধ্যমে স্ট্রিম অব কনশাসনেসের বাকবিকারে পাঁচ প্রজন্মের বিয়োগাত্মক কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এই উপন্যাসে। পারিবারিক বন্ধন, স্মৃতিচারণ, অমূলপ্রত্যক্ষ, মৃত্যু, বিষাদ ইত্যাদি এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে টানা ছাড়া-ছাড়া গদ্যে। শব্দ ও বাক্য পৌনপুনিক এবং ব্যাকরণবিমুখ। কাহিনির শুরুতে দেখা যায় বৃদ্ধা সিংনা শুয়ে শুয়ে তার মৃত স্বামীর কথা চিন্তা করে, তাকে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং তারা কথাবার্তা বলে। এক ধরনের ভৌতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে কাহিনি এগিয়ে যায়। ]
আমি দেখতে পাচ্ছি সিংনে ঘরের ভেতর একটি বেঞ্চে শুয়ে আছে। আশেপাশের এটা-ওটা্র দিকে তাকাচ্ছে। পুরনো টেবিল, চুলা, কাঠের বাকশো, দেয়ালের তাক, সাগরের দিকে খোলা বিশাল জানালা। এসব সে দেখছে কি দেখছে না বোঝা যাচ্ছে না। এরকম আগেও হয়েছে। কিছুই বদলায়নি। তবু সে মনে করে সবকিছুই ভিন্ন। কারণ যেদিন থেকে লোকটি উধাও হয়ে গেছে সেদিন থেকে কিছুই আর আগের মতো নেই। সে এমনভাবে পড়ে আছে যেন সে সেখানে নেই। দিন আসে, দিন যায়; রাত আসে, রাত যায়। সেও দিনরাত অতিবাহিত করে। ধীরে ধীরে। তার কোনো চিহ্ন থাকে না। তাতে কোনো ভিন্নতা আসে না। সে কি জানে আজ কী বার? হ্যাঁ, সে মনে করে আজ বৃহস্পতিবার, মার্চ মাস, ২০০২ সাল। সে অতটুকুই জানে। সে জানে না আজ কত তারিখ। সে অনেক জিনিসেরই খবর রাখে না। খবর রেখেই বা তার লাভ কী? সে ভাবে এখনো সে আগের মতো নিরাপদ এবং নিজের মধ্যে সংহত আছে। যেমন ছিল লোকটি হারিয়ে যাওয়ার আগে। সেই হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তার কাছে ফিরে আসে। সেদিন ছিল মঙ্গলবার, নভেম্বরের শেষদিকে, ১৯৭৯ সাল। সঙ্গে সঙ্গে সে তার শূন্যতা টের পায়। সে হলঘরের দরজার দিকে তাকায়। দরজা খুলে যায়। তারপর সে নিজেকে দেখতে পায়, ঘরে ঢুকছে, দরজা বন্ধ করছে। সে নিজেকে দেখে, হাঁটছে, থামছে, দাঁড়াচ্ছে। সে জানালার দিকে তাকায় এবং দেখে লোকটি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ঘরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে, লোকটি দাঁড়িয়ে আছে, বাইরে অন্ধকারের দিকে তার চোখ। লোকটির লম্বা চুল, গায়ে কালো সোয়েটার। সে নিজে লোকটির জন্য এই সোয়েটার বুনে দিয়েছিল। শীতের সময় সে এটি গায়ে দিত। সে ভাবছে লোকটি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, অন্ধকারে মিশে আছে। হ্যাঁ অন্ধকারেই মিশে আছে। সে প্রথমবার যখন দরজা খুলে তাকালো লোকটি নজরেই এলো না। অথচ সে জানে, এমনি এমনি জানে, লোকটি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে ওখানেই তার দাঁড়িয়ে থাকার কথা। সে জানে লোকটির কালো সোয়েটার ও অন্ধকার মিলেমিশে একাকার। লোকটি অন্ধকার হয়ে গেছে অথবা অন্ধকার সেই লোক হয়ে গেছে। তার কাছে ব্যাপারটি এমনই। তার মনে হয় সে ঘরে এসেছে এবং লোকটিকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। সে অপ্রত্যাশিত কিছু দেখেছে। অদ্ভুত কিছু ঘটেছে। লোকটি সারাক্ষণ সেখানে ওভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। জানালার সামনে। সচরাচর সে লোকটিকে দেখে না। অথবা ভাবে সে তাকে দেখে। অথবা সে তাকে দেখে কিন্তু খেয়াল করে না। কারণ লোকটির দাঁড়িয়ে থাকাটা একটি অভ্যাসের মতো হয়ে গেছে, অন্য আর দশটা বিষয়ের মতো। বিষয়টি যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে, সে বাইরে থেকে ফিরে দেখে লোকটি দাঁড়িয়ে আছে। সে লোকটির কালো চুল ও কালো সোয়েটার দেখতে পাচ্ছে। এখন লোকটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে। সে কেন এমন করছে? সে ভাবে, লোকটি কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে? জানালার বাইরে যদি দেখার কিছু থাকে তবে কি সে সেটা বুঝতে পারবে? কিন্তু সেখানে দেখার কিছুই নেই, অন্ধকার ছাড়া। ভারী, কালো অন্ধকার। তারপর হয়তো একটি গাড়ি আসে, হেডলাইটের আলোয় রাস্তার অংশবিশেষ আলোকিত হয়। তারপর আর বেশি গাড়ি আসে না। এমনই তার প্রত্যাশা। সে এমন জায়গায় বাস করতে চায় যেখানে সে শুধু একা। যেখানে সে এবং লোকটি, আর কেউ নেই। সিংনে এবং আস্লে। যতটা সম্ভব নিরালা। যেখান থেকে সবাই চলে গেছে। যেখানে বসন্ত মানে বসন্ত, হেমন্ত মানে হেমন্ত, শীত মানে শীত, গ্রীষ্ম মানে গ্রীষ্ম। তার মনে হয় সে এরকম কোথাও বাস করতে চায়। কিন্তু এখন তো অন্ধকার দেখা ছাড়া আর কিছু নেই। লোকটি কেন ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অন্ধকার দেখছে? সে কেন এমন করছে? যখন কিছুই দেখার নেই, লোকটি কেন সবসময় ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভাবে, আহা এখন যদি বসন্ত হতো। যদি এখন বসন্ত আসতো, আলো আর উত্তাপ নিয়ে। ছোট ছোট ফুলে ভরে থাকতো মাঠ, গাছে গাছে পত্রপল্লব। কারণ এই অন্ধকার, এই অন্তহীন অন্ধকার অহর্নিশ সে আর সহ্য করতে পারছে না। তার মনে হয়, সে লোকটিকে কিছু বলতে চায়। হ্যাঁ, কিছু একটা, কিন্তু তারপর মনে হয় কিছুই নেই। সে ঘরের চারপাশে তাকায়, ঘর ঠিক আগের মতোই আছে। কিছুই বদলায়নি। কেন সে ভাবে এটি আগের চেয়ে ভিন্ন? সে ভাবে কেন আগের চেয়ে কিছু ভিন্ন হতে হবে? কেন সে এরকম ভাবে? কিছু একটা সত্যি সত্যি ভিন্ন হবে? সে ভাবে, কারণ লোকটি জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যে অন্ধকার থেকে তাকে আলাদা করা যায় না। কিন্তু ইদানিং লোকটির হয়েছেটা কী? কিছু কি ঘটেছে? সে কি বদলে গেছে? কেন সে এমন শান্ত হয়ে গেছে? হ্যাঁ, শান্ত, সে চিরকাল ওরকম শান্ত স্বভাবেরই। সে ভাবে। তার সম্পর্কে যা কিছুই বলো না কেন, সে ওরকম শান্তই ছিল। এখানে অস্বাভাবিক কিছু নেই। লোকটি অমনই, অমনই তার আচরণ। ঠিকই এমনই, সে ভাবে। এখন লোকটা যদি তার দিকে একটু ঘুরে দাঁড়াতো। তাকে কিছু বলতো, কিছু একটা। কিন্তু লোকটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে যেন তাকে আসতেই দেখেনি।
তুমি ওখানে, সিংনে বলে
লোকটি তার দিকে ফেরে, সে দেখে লোকটির চোখে অন্ধকার
আমার মনে হয় আমি, হ্যাঁ, আমি, আস্লে বলে
ওখানে দেখার মতো কিছু নেই, সিংনে বলে
না কিছু নেই, আস্লে বলে
তারপর লোকটি তার দিকে চেয়ে হাসে
না কেবলই অন্ধকার, সিংনে বলে
কেবলই অন্ধকার হ্যাঁ, আস্লে বলে
তাহলে তুমি কী দেখছো, সিংনে বলে
আমি জানি না আমি কী দেখছি, আস্লে বলে
কিন্তু তুমি তো জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছো, সিংনে বলে
আছি, আস্লে বলে
কিন্তু তুমি তো কিছু দেখছো না, সিংনে বলে
না, আস্লে বলে
তাহলে কেন তুমি সেখানে দাঁড়িয়ে আছো, সিংনে বলে
হ্যাঁ আমি সেটাই বলতে চাচ্ছি, সে বলে
হ্যাঁ তুমি কি কিছু ভাবছো, সে বলে
আমি কিছু ভাবছি না, আস্লে বলে
কিন্তু তুমি কি দেখছো, সিংনে বলে
আমি কিছু দেখছি না, আস্লে বলে
তুমি জানো না, সিংনে বলে
না, আস্লে বলে
তুমি শুধু সেখানে দাঁড়িয়ে আছো, সিংনে বলে
হ্যাঁ, আমি শুধু এখানে দাঁড়িয়ে আছি, আস্লে বলে
হ্যাঁ, দাঁড়িয়ে আছো, সিংনে বলে
এতে কি তুমি বিরক্ত হও, আস্লে বলে
ব্যাপারটা তা নয়, সিংনে বলে
কিন্তু তুমি কেন প্রশ্ন করছো, আস্লে বলে
এমনিই প্রশ্ন করছি, সিংনে বলে
হ্যাঁ, আস্লে বলে
আমি এর দ্বারা কিছু বোঝাতে চাইনি, আমি কেবল প্রশ্ন করছিলাম, সিংনে বলে
হ্যাঁ, আস্লে বলে
আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি, হ্যাঁ, সে বলে
অনেক সময় লোকজন কিছু বলে বটে কিন্তু তারা আসলে এর দ্বারা কিছু বোঝায় না, সম্ভবত, সে বলে
সম্ভবত প্রায় কখনোই না, সে বলে
তারা কেবল বলার জন্য বলে, এটি সত্য, সিংনে বলে
হ্যাঁ, ঠিক তাই, আস্লে বলে
তাদের কিছু বলতে হবে, সিংনে বলে
হ্যাঁ বলতে হবে, আস্লে বলে
ব্যাপারটা সেরকমই, সে বলে
এবং সে আস্লেকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এবং নিজে কী করবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। আস্লে এক হাত ওপরে তোলে এবং আবার নামিয়ে ফেলে। তারপর সে তার অন্য হাতটি তোলে এবং তার সামনে মাঝামাঝি ধরে রাখে। এবং তারপর সে আবার প্রথম হাতটি তোলে।
তুমি কী নিয়ে চিন্তা করছো, সিংনে বলে
না বিশেষ কিছু না, আস্লে বলে
না, সিংনে বলে
আমার মনে হয় আমি, আস্লে বলে
হ্যাঁ, আমি, সে বলে
এবং আস্লে সেখানে দাঁড়িয়ে তার দিকে তাকায়
আমি, সে বলে
আমি, আমি, হ্যাঁ, ঠিক আছে, আমি যা করব, সে বলে
তুমি, সিংনে বলে
হ্যাঁ, আস্লে বলে
তুমি করবে, সিংনে বলে
আমি, আস্লে বলে
আমি ভাবছি আমি কিছুক্ষণের জন্য খাঁড়িতে যাব, সে বলে
আজও, সিংনে বলে
আমি তাই মনে করি, আস্লে বলে
তারপর আস্লে জানালার দিকে ফেরে এবং সিংনে আবার তাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। বাইরের অন্ধকার থেকে তাকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। সে জানলার সামনে তার কালো চুল দেখতে পায়। তার সোয়েটার বাইরের অন্ধকারের সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে আছে।
(চলবে)