Published : 11 Jan 2024, 10:35 PM
অ্যালিস মুনরো প্রখ্যাত কানাডিয়ান কথাসাহিত্যিক এবং তিনি কানাডার চেখভ হিসেবে সমধিক পরিচিত ও প্রশংসিত। তিনি ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মূলত ছোটগল্প লেখক এবং ছোটগল্প লেখায় তার রয়েছে নিজস্ব শৈলি। তার গল্পে ঘটনাবলি অকালানুক্রমিক যেখানে অতীত ও বর্তমান অহরহ স্থান বদল করে। বর্ণনার মুন্সিয়ানায় মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত ও সাম্পর্কিক টানাপোড়েনসহ মানবজীবনের নানা জটিলতা চিত্রিত হয়েছে তার গল্পে। তার জন্ম কানাডার অন্টারিও প্রদেশে ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই এবং স্পষ্টত তার গল্পের প্রেক্ষাপটে থাকে সেই স্থানের ভূপ্রকৃতি ও জীবনাচার। ডিয়ার লাইফ (২০১২), টু মাচ হ্যাপিনেস (২০০৯), দ্য ভিউ ফ্রম ক্যাসল রক (২০০৬), রানঅ্যাওয়ে (২০০৪), দ্য লাভ অব এ গুড ওম্যান ( (১৯৯৮), ওপেন সিক্রেটস (১৯৯৪), ফ্রেন্ড অব মাই ইউথ (১৯৯০), দ্য মুনস অব জুপিটার (১৯৮২), ডান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস (১৯৭১) তার বিখ্যাত গল্পের বই। এখানে অনূদিত “ওয়াকার ব্রাদার্স কাউবয়” (Walker Brothers Cowboy) গল্পটি ব্যবসায়ে অসফল এক বিক্রয়কর্মীর ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের অপরিণত প্রেম ও সংসারের কাহিনী তুলে ধরে। ইংরেজি থেকে গল্পটি বাংলা তর্জমা করেছেন কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক বিনয় বর্মন। বি. স
রাতের আহারের পর বাবা বললেন, “নিচে গিয়ে কি দেখতে চাও হ্রদটা এখনো শান্ত আছে কিনা?” আমরা ডাইনিং রুমের আলোয় সেলাইরত মাকে ছেড়ে এলাম। মা স্কুল খোলা উপলক্ষে আমার জন্য জামাকাপড় বানাচ্ছিলেন। এর জন্য মাকে তার নিজের একটি পুরনো সুট ও উলের বস্ত্র কাটতে-ছিঁড়তে হয়েছে এবং সুন্দরভাবে ম্যাচিং করতে হয়েছে। আমাকে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে অসংখ্যবার মাপজোক দিতে হয়েছে। অকৃতজ্ঞ আমি উলের গরমে ঘেমে আমার শরীর চুলকেছি। আমার ভাইকে সামনের বারান্দার শেষদিকে পর্দাঘেরা ছোট জায়গাটিতে রেখে আসি। সে মাঝে মাঝে হাঁটু গেড়ে বসে পর্দায় মুখ ঘষে এবং কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে, “আমাকে একটি আইসক্রিম কোন এনে দাও।” কিন্তু আমি উত্তর দেই, “তুমি তো ঘুমিয়ে পড়বে।” আমি আর তার দিকে ফিরে তাকাই না।
তারপর আমি আর বাবা একটি লম্বা অপরিচ্ছন্ন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে থাকি। আলোকোজ্জ্বল ছোট দোকানের সামনে শেরউড আইসক্রিমের সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে। এটি হুরন হ্রদের পুরনো শহরের টাপারটাউন। হুরন হ্রদ একটি প্রাচীন শস্যবন্দর। স্থানটির এখানে-সেখানে ম্যাপল গাছ যেগুলোর শিকড় ফুটপাত ফুঁড়ে বেরিয়েছে এবং কুমীরের মতো দেখাচ্ছে। লোকজন বসে গল্পগুজব করছে। পুরুষদের গায়ে শার্ট এবং মহিলাদের গায়ে অ্যাপ্রন। এখানে তেমন কাউকে চিনি না, কিন্তু কেউ যদি বাবাকে মাথা নেড়ে বলে, “উষ্ণ রাত,” বাবাও একইভাবে মাথা নেড়ে তার প্রত্যুত্তর দেন। বাচ্চারা এখনো খেলাধুলা করছে। আমি তাদের কাউকে চিনি না, কারণ মা আমাকে ও আমার ভাইকে আমাদের উঠানে আটকে রাখে। তার যুক্তি, আমার ভাই এতো ছোট যে সে বাইরে বেরুনোর উপযুক্ত নয় এবং ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমার। তাদের এই সান্ধ্য খেলাধুলা দেখে আমার মন খারাপ হয় না, কারণ ওগুলো অগোছালো, উত্তেজনাহীন। বাচ্চারা তাদের ইচ্ছেমাফিক একজন দুজন করে বড় গাছের নিচে চলে যায়, যেমনভাবে আমার সারাদিন কাটে একাকীত্বে। তারা বসে বসে ধুলোবালিতে পাথর পোতে অথবা লাঠি দিয়ে আঁকিবুকি করে।
আমরা এখন এই বাড়ি ও বাড়ির আঙিনাগুলো পেরিয়ে যাই। আমরা বোর্ডের জানালাওয়ালা একটি কারখানার পাশ দিয়ে যাই। একটি কাঠের গুদাম যার উঁচু কাঠের গেইটগুলো রাতের জন্য তালা দেওয়া হয়েছে। শহর ভরা ছোট ছোট ছাপড়া আর হাবিজাবি জিনিসের দঙ্গল। আমরা পার্শ্বরাস্তায় একটি বালিময় পথ দিয়ে চলছি। পথের পাশে ভাঁটুইগাছ, কদলি ও নাম না-জানা নানারকম উদ্ভিদ। আমরা একটি খোলা জায়গায় প্রবেশ করি। জায়গাটি পার্কের মতো, ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করা হয়েছে। সেখানে একটি বেঞ্চ, হেলান দেওয়ার তক্তাটি উধাও হয়ে গেছে। ওখানে বসে হ্রদের জল দেখা যায়। প্রায়ান্ধকার আকাশের নিচে সন্ধ্যায় ধূসর, দিগন্ত মিটমিটে। খুব শান্ত পরিবেশ, সৈকতে নুড়িপাথরের ওপর ঢেউ গড়িয়ে পড়ার মৃদু শব্দ। দূরে, মূল শহরের দিকে, বালির বিস্তার, নিরাপদ সাঁতার অঞ্চলে একটি ওয়াটার স্লাইড পানিতে দুলছে, লাইফগার্ডের ভাঙাচোরা সিংহাসন। আরো আছে একটি লম্বা ঘনসবুজ দালান, ছাদযুক্ত বারান্দা যাকে প্যাভিলিয়ন বলা হয়, রবিবারের সুন্দর পোশাক পরিহিত কৃষক ও কৃষানিদের মেলা। শহরের এই অংশটি আমাদের চেনা। আমরা যখন ডাঙ্গাননে থাকতাম তখন গ্রীষ্মকালে দুই তিনবার এখানে বেড়াতে আসতাম। জাহাজঘাটে গিয়ে শস্যের নৌকা দেখতাম। সেগুলো পুরনো, জংধরা, নড়বড়ে। আমরা বিস্মিত হয়ে ভাবতাম এগুলো উত্তাল স্রোত পাড়ি দিয়ে কিভাবে ফোর্ট উইলিয়ামে যায়।
ভবঘুরে লোকেরা জাহাজঘাটে ঘুরে বেড়ায়। কখনো কখনো তারা সন্ধ্যায় নিরিবিলি সৈকতেও চলে আসে। বাঁকাচোরা পথে ঘোরাঘুরি করে এবং ঝোপের আড়ালে আবডালে বসে থাকে। কেউ একজন বাবাকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলে। আমি ভবঘুরে দেখে এতো ভয় পেয়ে যাই যে সে বাবাকে কী বলছে তা আর শোনার চেষ্টা করি না। বাবা একটু শক্তভাবে বলেন, “আমি তোমাকে একটি সিগারেট বানিয়ে দিতে পারি যদি এতে তোমার আগ্রহ থাকে।” বাবা তামাক বের করে একটি পাতলা কাগজে মুড়িয়ে-পাকিয়ে একটি সিগারেট বানান এবং ভবঘুরের হাতে দেন। সে এটি নিয়ে চলে যায়। বাবা নিজের জন্যও একটি সিগারেট বানান এবং তাতে আগুন ধরান।
বাবা আমাকে মহাহ্রদের গল্প শোনান। এখন যেখানে হুরন হ্রদ আগে সেখানে বিশাল সমতলভূমি ছিলো। একসময় উত্তর থেকে বরফ নেমে আসে, দূর নিচুভূমিতে। হ্যাঁ এভাবে- এই বলে হাত দিয়ে আমাকে দেখান। তিনি হাতের আঙুল ছড়িয়ে আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেই পাথরশক্ত মাটিতে চাপ দেন। তার হাতের চাপে অবশ্য মাটির কিছুই হয় না এবং তিনি বলেন, পুরনো বরফের চাঁইয়ে তার হাতের চেয়ে বেশি শক্তি। বরফ আবার সংকুচিত হয়ে যেখান থেকে এসেছিলো সেই উত্তর মেরুতে চলে যায়, কিন্তু বরফের যে আঙুলগুলো রয়ে যায় সেগুলোর চাপে মাটি বসে যায় এবং বরফ গলে হ্রদে পরিণত হয়। তা ছিলো নতুন। আমি আমার সম্মুখে সমতলভূমি দেখি, ডায়নোসর হাঁটাহাটি করছে, কিন্তু টাপারটাউনের ইন্ডিয়ানরা যখন এখানে ছিলো তখনকার হ্রদের তীর আমি কল্পনা করতে পারি না। সময়ের যে ক্ষুদ্র অংশ আমরা পেয়েছি তা আমাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে, কিন্তু একে আমরা নীরবে উদযাপন করি। এমনকি বাবা যতক্ষণ গৃহে থাকেন ততক্ষণ পার্থিব জীবন উদযাপন করেন একটু বেশি পরিমানেই। যখন মোটরগাড়ি ও বিজলিবাতি আসেনি সেই সময়টা আমরা বেশি দেখিনি। এই শতাব্দী যখন শুরু হয় তখন তিনি আর বেঁচে নেই। এটি যখন শেষ হবে তখন আমি হয়তো বুড়ো হয়ে বেঁচে থাকবো। আমি এটা নিয়ে ভাবতে চাই না। আমি চাই হ্রদ হ্রদের মতোই থাক, সেখানে থাক চিহ্নিত করা নিরাপদ সাঁতারের অঞ্চল, স্রোতধারা এবং টাপারটাউনের আলোক।
বাবা ওয়াকার ব্রাদার্সের বিক্রয় বিভাগে কাজ করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যবসা করে। সানশাইন, বয়েলস ব্রিজ, টার্নঅ্যারাউন্ড – এ সবই তার ব্যবসার এলাকা। তবে ডাঙ্গানন যেখানে আমরা বসবাস করতাম সেখানে এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা ছিলো না। ডাঙ্গাননের অবস্থান শহরের কাছে এবং মা এর জন্য কৃতজ্ঞতা বোধ করতেন। বাবা বিক্রি করতেন কাশির ঔষধ, আয়রন টনিক, কর্ন প্লাস্টার, হজমের ঔষধ, মেয়েলি রোগের বড়ি, মাউথওয়াশ, শ্যাম্পু, বাতের মালিশ, চর্মরোগের মলম, লেবু, কমলা ও র্যাস্পবেরির রস, ভ্যানিলা, খাবারের রঙ, ব্ল্যাক ও গ্রিন টি, আদা, লবঙ্গ ও অন্যান্য মশলা, ইঁদুরের বিষ। বাবা দুই চরণের একটি গান গাইতেন:
হরেক জিনিস আমার কাছে
মলম মালিশ সবই আছে
মায়ের মতে এটা খুব উৎকৃষ্ট গান নয়। ফেরিওয়ালার গান, বাবা তো ফেরিওয়ালাই! ঘরে ঘরে ঘুরে ঘুরে মালামাল বিক্রি করেন। আগের শীত পর্যন্ত আমাদের নিজেদেরই একটি ব্যবসায় ছিলো। বাবা রুপালি শিয়াল পালতেন এবং লোকজনের কাছে শিয়ালের চামড়া বিক্রি করতেন। যারা কিনতো তারা চামড়া দিয়ে টুপি, কোট, হাতমোজা ইত্যাদি বানাতো। চামড়ার দাম পড়ে গেলো। বাবা আশা করে থাকলেন পরের বছর বাড়বে। কিন্তু পরের বছরও দাম পড়া এবং তার পরের বছরের আশায় থাকলেন। তার পরের বছরও একই অবস্থা। বাবা ফিড কোম্পোনির কাছে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়লেন। আমি মাকে কয়েকবার মিসেস অলিফ্যান্টের কাছে ব্যাখ্যা করতে শুনেছি। ভদ্রমহিলা ছিলেন আমাদের একমাত্র প্রতিবেশি যার সঙ্গে মা কথা বলতেন। (মিসেস অলিফ্যান্ট ছিলেন স্কুলটিচার এবং বিয়ে করেছিলেন এক দারোয়ানকে।) আমরা সমস্ত কিছু শিয়ালের ব্যবসায় ঢেলে দিয়েছিলাম, মা বলেন, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই আসেনি। অনেকেই আজকাল এমন কথা বলবে, কিন্তু মায়ের জাতীয় দুর্যোগ নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই, তিনি তার নিজের সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। ভাগ্য আমাদেরকে রাস্তার দরিদ্র লোকজনদের মধ্যে ছুঁড়ে দিয়েছে (ব্যাপারটা এমন নয় যে আমরা আগে দরিদ্র ছিলাম না, কিন্তু সেটা ছিলো এক ভিন্ন ধরনের দারিদ্র্য)। মা একে গ্রহণ করেছিলেন সম্মান ও তিক্ততার সঙ্গে, আপোসহীনভাবে। কোনোকিছুই মাকে আরাম দিতো না- সুন্দর বাথটাব ও ফ্লাশ টয়লেটযুক্ত বাথরুম কিংবা ট্যাপের পানি, ঘরের পাশের হাঁটার রাস্তা ও বোতলের দুধ। এমনকি দুটি প্রেক্ষাগৃহ, ভেনাস রেস্তোরাঁ, উডওয়ার্থ যেখানে দৃষ্টিনন্দন শীতল ঘরে জীবন্ত পাখিরা গান গায়, নখের সমান ছোট ছোট উজ্জ্বল মাছ পানির ট্যাঙ্কে সাঁতরায়। মা এসবের ধার ধারেন না।
বিকেলে মা সায়মন্স গ্রসারিতে যান এবং জিনিসপত্র বহন করার জন্য আমাকেও সঙ্গে নেন। তার গায়ে সুন্দর পোশাক, সাগরনীল রঙ, ওপরনিচে ছোট ছোট ফুলের নকশা, নীল সিল্কের ওপর এটি পরা। মাথায় সাদা খড়ের একটি গ্রীষ্ম টুপি, মাথার একদিকে হেলানো, পায়ে সাদা জুতো যা আমি কিছুক্ষণ আগে পিছনের সিঁড়িতে খবরের কাগজের ওপর রেখে পরিষ্কার করেছি। আমি আজ চুল ধুয়েছি যা খুব শীঘ্রই শুকিয়ে ঝরঝরে হয়ে যাবে, শক্ত ঝাঁকড়া চুল মাথার ওপরে ফিতা দিয়ে বাঁধা। রাতের খাবার খেয়ে বাবার সঙ্গে বাইরে বেরুনোর চেয়ে এটি সম্পূর্ণ ভিন্ন। দুটো বাড়ি পেরুতে না পেরুতেই বুঝে গেছি আমরা সর্বজনীন বিদ্রূপের বিষয় হয়ে উঠেছি। পথপার্শের নোংরা শব্দগুলো যেনো আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছে। মা মনে হয় এসব খেয়াল করেন না। মা শান্তভাবে লেডি শপিংয়ের মতো হেঁটে যান। হ্যাঁ, লেডি শপিংয়ের মতো, বাহুর নিচে ছেঁড়া বন্ধনিহীন ঢিলা পোশাক পরা মহিলাদের পাশ দিয়ে চলে যান মা। আমাকে মা সাজিয়ে দিয়েছেন, কার্ল করা চুলের বাহার, ঘষেমেজে ঝকঝকে করা হাঁটু ও সাদা মোজা, এসব আমার একদম পছন্দ নয়। মা যখন জনসমক্ষে আমার নামটি উচ্চারণ করেন, উঁচুস্বরে, গর্বভরে, চিবিয়ে চিবিয়ে, সেটাও আমার অপছন্দ। রাস্তার অন্য যে কোনো মায়ের চেয়ে এই কণ্ঠ আলাদা।
মায়ের মাথাব্যথা। তাকে প্রায়শ শুয়ে থাকতে হয়। গাছের ঘন ছায়ার নিচে পর্দাঘেরা ছোট বারান্দায় ভাইয়ের সরু খাটে মা শুয়ে থাকেন। “আমি ঐ গাছের দিকে তাকাই এবং ভাবি আমি ঘরে আছি,” তিনি বলেন।
“তোমার যা দরকার,” বাবা তাকে বলেন, “তা হলো মুক্ত বাতাস এবং গাড়িতে করে গ্রামে ভ্রমণ।” বাবা তাকে ওয়াকার ব্রাদার্সের পথে তার সঙ্গে যাওয়ার ইঙ্গিত করেন।
মায়ের গাড়িতে করে গ্রামে ভ্রমণের ধারণা মোটেই সুখদ নয়।
“আমি কি আসতে পারি?”
“কাপড়ে মাপজোক দেওয়ার জন্য তোমাকে তোমার মায়ের প্রয়োজন হতে পারে।”
“আমি আজ বিকালে সেলাই করবো না,” মা বলেন।
“তাহলে আমি ওকে নিয়ে যাবো। তোমাদের দুজনকেই নিয়ে যাবো। একটু বিশ্রাম হবে।”
কী থেকে আমাদের বিশ্রাম হবে? কিছু মনে করো না। আমি আমার ভাইকে নিয়েই খুশি। আমি তাকে টয়লেটে নিয়ে যাই এবং তারপর দুজনে গিয়ে গাড়িতে উঠি। আমাদের হাঁটু অপরিষ্কার, আমার চুল বাঁধা নেই। বাবা ঘর থেকে দুটো ভারী বাদামি সুটকেস নিয়ে আসেন। সেগুলো বোতলে ভর্তি, গাড়ির পিছন সিটে রাখা হয়। বাবার পরনে একটি উজ্জ্বল সাদা শার্ট, টাই, সামার সুটের হালকা ট্রাউজার (বাবার অন্য সুটটি কালো রঙের, সেটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের জন্য, সেটির মালিক ছিলেন প্রয়াত চাচা) এবং ক্রিম কালারের একটি হ্যাট। এটি তার বিক্রয়কর্মীর পোশাক, পকেটে পেন্সিল গোঁজা। তিনি আরেকবার মায়ের কাছে যান, সম্ভবত বিদায় জানাতে। তাকে পুনরায় জিজ্ঞেস করেন যাবেন কিনা। মাকে বলতে শোনা যায়, “না, ধন্যবাদ। আমার এখানে চোখ বুজে শুয়ে থাকতেই ভালো লাগবে।” তাহলে আমরা রাস্তায় অ্যাডভেঞ্চারের আশা করতে পারি। রাস্তায় গাড়ি লাফিয়ে ওঠে, গরম বাতাস কেটে গিয়ে মৃদুমন্দ বাতাসে পরিণত হয়। যতোই রাস্তা দিয়ে এগুতে থাকি, বাড়িগুলো ধীরে ধীরে অপরিচিত হয়ে উঠে। তাড়াতাড়ি শহর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এই সংক্ষিপ্ত রাস্তা। সেই বিকালে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে, খামার অঙ্গনের উষ্ণ সময়, সম্ভবত কোনো এক গ্রামের দোকানে থামা, তিনটি আইসক্রিম কোন ও পপের বোতল, এবং বাবার গান গাওয়া। যে গানটি বাবা নিজেই বানিয়েছেন, এর নাম “ওয়াকার ব্রাদার্স কাউবয়”, এটি এভাবে শুরু:
বৃদ্ধ নেড ফিল্ডস, সে এখন নাই
তাই আমিই এখন এ গাড়ি চালাই
কে এই নেড ফিল্ডস? তার জায়গায় বাবা কাজ করছেন। তিনি মারা গেছেন। বাবার কণ্ঠ শোক-আনন্দময়, যা তার মৃত্যুকে অর্থহীন করে তোলে, এ এক কৌতুক বিপর্যয়। “দেখবো রিও গ্র্যান্ডে ফিরে এসে, গোধূলি বালিতে ভেসে ভেসে।” গাড়ি চালাতে চালাতে বাবা বেশির ভাগ সময় গান গাইতে থাকেন। এখনো গান গাইছেন, যখন আমরা শহর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি, ব্রিজ অতিক্রম করে হাইওয়েতে মোড় নিচ্ছি। তিনি গুনগুন করে গান গাইছেন, বিড়বিড় করে নিজেকেই শোনাচ্ছেন। বারবার ঘুরে ফিরে গাইছেন, নিজের মন থেকে। বড় রাস্তায় আমরা বাপ্তিস্ত ক্যাম্প, ভ্যাকেশন বাইবেল ক্যাম্প অতিক্রম করে যাই, আর তার গান চলতে থাকে:
“বাপ্তিস্তরা কোথায়, বাপ্তিস্তরা কোথা্য়
বাপ্তিস্তরা আজ সবাই কোথায় গেলো
তারা পানিতে, হুরন হ্রদের পানিতে
তারা তাদের সব পাপ ধুয়ে নিচ্ছে।”
আমার ভাই মানে ছোটকু এটিকে আক্ষরিকভাবে সত্য বলে মনে করে। সে তার হাঁটুতে ভর দিয়ে হ্রদটি দেখার চেষ্টা করে। “আমি কোনো বাপ্তিস্ত দেখতে পাচ্ছি না,” সে অভিযোগের সুরে বলে। “আমিও দেখতে পাচ্ছি না, পুত্র” বাবা বলেন। “আমি বলেছি, তারা হ্রদের নিচে।”
হাইওয়ে থেকে নামার পর আর রাস্তা পাকা নেই। ধুলোর কারণে আমাদের গাড়ির জানালা তুলে দিতে হবে। এখানকার ভূমি সমতল, তপ্ত, খালি। খামারের কাছে ভূরি ভূরি ঝোঁপঝাড়ে ছায়া, কালো পাইনছায়া ছড়িয়ে আছে যেখানে কেউ যেতে পারে না। লম্বা রাস্তায় আমাদের গাড়ি লাফিয়ে ওঠে এবং এর শেষে যা আছে তা আর ভালো লাগার মতো নয়। সামনে দরজা পর্যন্ত গজিয়ে ওঠা না-কাটা ঘাস, সবুজ পর্দা নামানো, ওপরের তলায় হা করে খোলা দরজা, লম্বা রঙ না-করা খামারবাড়ির চেয়ে অধিক ফাঁকাফাঁকা। অনেক বাড়িতেই এধরনের দরজা আছে, কিন্তু আমি কখনোই বুঝে উঠতে পারিনি কেন এই ব্যবস্থা। আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করি এবং তিনি বলেন ওগুলো স্বপ্নে হাঁটাহাটি করার জন্য। কী? বেশ, কিন্তু যদি স্বপ্নে হাঁটাহাটি করার সময় কেউ বাইরে যেতে চায়? আমার সঙ্গে কৌতুক করছে দেখে আমার খারাপ লাগে। সচরাচর এরকমই হয়, কিন্তু ছোটকু দৃঢ়ভাবে বলে, “তারা যদি সেটা করে, তবে তাদের ঘাড় ভেঙে যাবে।”
১৯৩০-এর দশক। এ ধরনের খামারবাড়ি, এ ধরনের বিকেল কতোটা ঐ দশকের বিষয়? বাবার হ্যাটের মতো, তার উজ্জ্বল রঙচঙে টাইয়ের মতো, আমাদের প্রশস্ত বোর্ডওয়ালা গাড়ির মতো (বিগতযৌবনা এসেক্স)। এরকম ধূলিভরা পুরনো গাড়ি খামারের পিছন আঙিনায় পড়ে থাকে। কতকগুলো অচল হয়ে পড়ে আছে, দরজা খুলে নেওয়া হয়েছে, সিট খুলে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে ব্যবহারের জন্য। কোনো জনপ্রাণী চোখে পড়ে না, মুরগি বা গরুছাগলও না। কেবল অস্থিচর্মসার কুকুর। তারা ডেরার নিচে শুয়ে থাকে, শুয়ে শুয়ে স্বপ্ন দেখে। বাবা গাড়ির দরজা খুললে তারা উঠে দাঁড়ায়। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলেন। “ভদ্র ছেলে, ঐ যে, বুড়ো ভদ্র।” তারা শান্ত হয়ে তাদের ডেরায় ফিরে যায়। প্রাণীদের কিভাবে শান্ত করতে হয় বাবা সেটা জানেন। আমি দেখেছি বাবা তার খামারে বেপরোয়া শিয়ালগুলোর ঘাড়ে আংটা দিয়ে ধরতেন। কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে আবার শব্দ করেন, এবং দরজায় দিকে হাঁক দেন। “কে আছেন ভেতরে, জনাবা, আমি ওয়াকার ব্রাদার্স থেকে এসেছি, আজ আপনার কী লাগবে?” একটি দরজা খোলে এবং বাবা সেইদিকে হারিয়ে যান। তাকে অনুসরণ করা নিষেধ, এমনকি গাড়ি থেকে নামাও নিষেধ। আমরা বসে বসে কেবল ভাবতে থাকি বাবা কী বলেন। আমি দেখেছি বাবা কিভাবে মাকে হাসানোর চেষ্টা করেন, যেনো তিনি খামারবাড়ির কোনো রান্নাঘরে, তার নমুনা বাকশোগুলো মেলে ধরেছেন। “আপনি কি পরজীবির আক্রমণে অতীষ্ঠ? মানে আপনার বাচ্চাদের মাথায়। ঐ কিলবিলে ছোট পোকাগুলো ভালো ভালো পরিবারের লোকজনের মাথায়ও দেখা যায়। সাবানে কাজ হয় না, কেরোসিনের গন্ধটাও সুখকর নয়, কিন্তু আমার কাছে আছে---।” অথবা, “বিশ্বাস করুন, সারাদিন বসে গাড়ি চালিয়ে আমি বটিকার মূল্য বুঝি, প্রাকৃতিক রোগমুক্তি। বড়দের একটি সাধারণ সমস্যা, যখন তাদের কাজকর্মের দিন শেষ হয়ে যায়, আপনার কী অবস্থা দাদীমা?” বাবা কাল্পনিক এক বাকশো বড়ি মায়ের নাকের সামনে দোলান, এবং মা শেষমেষ হেসে ওঠেন, অনিচ্ছাকৃতভাবে। “বাবা আসলে সেরকম বলেন না, বলেন কি?” আমি বলি, এবং মা বলেন, না, মোটেই না, সে যে অতিশয় ভদ্র।
আঙ্গিনার পর আঙ্গিনা, পুরনো গাড়ি, পাম্প, কুকুর, ধূসর গোলাঘর, ভেঙে-পরা ডেরা ও অচল বায়ুকল। পুরুষেরা মাঠে কাজ করতে গেছে, কিন্তু তারা যে কোথায় আমরা দেখতে পাই না। ছেলেমেয়েরা দূরে কোথাও গেছে, শুকিয়ে যাওয়া নদীতে হাঁটিহাটি করছে, কালোজাম খুঁজছে, অথবা তারা ঘরে লুকিয়ে আছে, জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে আমাদের দেখছে। আমাদের শরীর থেকে ঝরা ঘামে ভিজে গাড়ির সিট জবজবে। আমি ছোটকুকে বলি ভেঁপু বাজাতে, আমি এটি নিজে বাজিয়ে দোষের তলে পড়তে চাই না। সে ভালো জানে। আমরা রঙ রঙ খেলি, কিন্তু খুব বেশি রঙ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ধূসর রঙ গোলাঘর, ডেরা, টয়লেট ও ঘরবাড়ির জন্য, বাদামি রঙ আঙিনা ও মাঠের জন্য, কালো অথবা বাদামি রঙ কুকুরের জন্য। জংধরা গাড়িগুলোতে রঙধনুর নানারঙ, সেখান থেকে আমি বেগুনি বা সবুজ রঙ নেওয়ার চেষ্টা করি। একইভাবে আমি দরজায় উঁকি দিয়ে মেরুন অথবা হলুদ রঙের ছিটেফোঁটা খুঁজি। আমরা হরফ নিয়ে খেলতে পারি, ওটা পারলে ভালো হতো, কারণ ছোটকু এখনো বানান করা শেখেছি। খেলা শেষ হয়ে যায়। সে বলে যে আমার রঙগুলো ঠিক নয় এবং তার জন্য সে অতিরিক্ত পালা দাবি করে।
একটা বাড়িতে কোনো দরজা খোলে না, যদিও গাড়িটি আঙিনায় দাঁড়িয়ে। বাবা দরজায় আঘাত করেন ও বাঁশি বাজান, ডাক দেন, “কেউ আছেন কি? ওয়াকার ব্রাদার্সের লোক এসেছে!” কিন্তু বিন্দুমাত্র সাড়াশব্দ নেই। বাড়িটিতে কোনো বারান্দা নেই, কেবল একটি খোলা ঢালু সিমেন্টের চাঁই আছে, যার ওপরে বাবা দাঁড়ানো। তিনি ঘুরে গোলাঘরের আঙিনায় খোঁজেন, গোলা শূন্যই হবে কারণ তার ভিতর দিয়ে আকাশ দেখা যায়, অবশেষে তিনি উবু হয়ে তার সুটকেস হাতে নেন। ঠিক তখনই ওপর তলার একটি জানালা খুলে যায়, একটি সাদা পাত্র দেখা যায়, কেউ সেটি কাত করে নিচে দেয়ালের বাইরে তরল ময়লা ঢেলে দেয়। জানালাটি সরাসরি বাবার মাথার ওপর নয়, তবু তার গায়ে ময়লার ছিটেফোঁটা হয়তো লাগতে পারে। বাবা তার সুটকেসটি হাতে তুলে নেন এবং সেখান থেকে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে আসেন। তার মধ্যে কোনো তাড়াহুড়া নেই, বাঁশিও বাজানো নেই। “ওটা কী ছিলো জানো?” আমি ছোটকুকে বলি। “মুত।” সে হেসে কুটিকুটি।
গাড়ি স্টার্ট করার আগে বাবা পাকিয়ে একটি সিগারেট বানান ও আগুন ধরান। জানালা বন্ধ হয়ে গেছে এবং পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। আমরা কোনো হাত বা মুখ দেখতে পাইনি। “মুত, মুত,” ছোটকু সোৎসাহে গাইতে থাকে। “কেউ একজন মুত ঢেলে দিয়েছে!” “তোমাদের মাকে আবার এটা বলো না,” বাবা বলেন। “সে এই কৌতুকের জন্য দায়ী নয়।” “এটা কি তোমার গানের মধ্যে আছে?” ছোটকু জানতে চায়। বাবা বলেন, না তা হয়, তবে এ নিয়ে কী করা যায় সেটা ভেবে দেখবেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমি খেয়াল করলাম যে আমরা আর গলির মধ্যে ঢুকছি না, আবার বাড়ি ফিরে যাচ্ছি বলেও মনে হয় না। “এদিক দিয়েই কি সানশাইন যেতে হয়?” আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি উত্তর দেন, “না, ম্যাম, তা নয়।” “তুমি কি এখনো তোমার ব্যবসা-অঞ্চলের মধ্যে আছো?” বাবা মাথা নাড়েন। “আমরা দ্রুত যাচ্ছি,” ছোটকু সম্মতির সুরে বলে। আমরা আদতে শুষ্ক খানাখন্দ ভরা রাস্তা দিয়ে ঝাঁকি খেতে খেতে এগিয়ে চলেছি। সুটকেসের মধ্যে বোতলগুলো ঝনঝন খনখন শব্দ করছে।
আরেকটি গলি, একটি বাড়ি, রঙ করা নেই, রোদে শুকিয়ে রুপালি হয়ে গেছে।
“আমি ভেবেছি আমরা ব্যবসা অঞ্চলের বাইরে।”
“হ্যাঁ, বাইরে।”
“তাহলে আমরা কেন ভেতরে যাচ্ছি?”
“তোমরা দেখবে।”
একটা বাড়ির সামনে এক গাট্টাগোট্টা মহিলা ঘাসের ওপর শুকাতে দেওয়া কাপড়চোপড় তুলছেন। গাড়ি থামতে দেখে তিনি এক মুহূর্ত কটমট করে তাকান। তিনি ঝুঁকে কয়েকটি তোয়ালে তুলে নিয়ে তার বগলে অন্যান্য কাপড়ের সঙ্গে রাখেন। আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ভাবলেশহীন গলায় বলেন, “আপনারা কি পথ হারিয়েছেন?”
বাবা একটু সময় নিয়ে গাড়ি থেকে বের হন। “আমার সেরকম মনে হয় না,” তিনি বলেন, “আমি ওয়াকার ব্রাদার্সের লোক।”
“জর্জ গোলি আমাদের এলাকার ওয়াকার ব্রাদার্সের লোক,” মহিলা বলেন, “এবং এক সপ্তাহ আগেও সে এখানে এসেছে। হায় ঈশ্বর!” তিনি রুক্ষভাবে বলেন, “আর কিনা আপনি।”
“সেই সময়টাতে আমি শেষবারের মতো আয়নায় তাকিয়েছি,” বাবা বলেন।
মহিলা তার সামনের সমস্ত তোয়ালে সংগ্রহ করেন এবং শক্তভাবে ধরে নিচের পেটের দিকে এমনভাবে চাপ দেন যেন ব্যথা লাগছে। “ঐ লোকগুলোকে আমি দেখার চিন্তাও করিনি, আর আপনি বলছেন কিনা ওয়াকার ব্রাদার্সের লোক।”
“আমি দুঃখিত আপনি যদি জর্জ গোলিকে প্রত্যাশা করে থাকেন,” বাবা বিনীতভাবে বলেন।
“আমার দিকে তাকান। আমি মুরগির খোঁয়াড় পরিষ্কার করতে প্রস্তুত ছিলাম। আপনি হয়তো এটা অজুহাত ভাববেন, কিন্তু এটা সত্য। আমি প্রতিদিন এভাবে খোঁজাখুজি করি না।” মহিলার মাথায় একটা খড়ের টুপি, এর ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যরশ্মি তার মুখের ওপর এসে পড়েছে। গায়ে একটা ময়লা ঢিলাঢিলা পোশাক এবং পায়ে মলিন জুতো। “বেন, ঐ গাড়িতে কারা? তারা তো তোমার কেউ নয়?”
“আচ্ছা, আমি আশা করি ও বিশ্বাস করি তারা আমার কেউ,” বাবা বলেন, আমাদের নাম ও বয়স জানান। “তোমরা বেরিয়ে আসো তো। এই হলো নোরা, মিস নোরা ক্রোনিন। আচ্ছা নোরা তুমিই বলো, তুমি কি এখনো কুমারী, না কি কাঠের ডেরায় তোমার স্বামীকে লুকিয়ে রেখেছো?”
“আমার স্বামী থাকলে আমি তাকে অমন জায়গায় রাখতাম না, বেন,” মহিলা বলেন, এবং দুজনেই হাসতে থাকেন। মহিলার হাসি কিছুটা হঠকারী এবং রাগভর্তি। “তোমার ধারণা আমি আদবকায়দা জানি না, আমার পোশাক ভবঘুরের মতো,” তিনি বলেন। “রোদ থেকে সরে আসো। ঘরটা শীতল আছে।”
আমরা উঠান পেরিয়ে যাই (“ক্ষমা করবে তোমাদের এভাবে নিয়ে যাচ্ছি, বাবার শেষকৃত্যের পর থেকে সামনের দরজাটা আর খোলা হয়নি, আমার মনে হয় কব্জাটা খসে পড়েছে”) বারান্দার সিঁড়ি পর্যন্ত। সেখান থেকে রান্নাঘরে, যে জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা, ছাদ উঁচু, পর্দা নামানো, পরিচ্ছন্ন সাধারণ ঘর, মাদুর, ফুলের টব, পানপাত্র, অয়েলক্লথ ঢাকা গোলটেবিল। যদিও ঘরটা ধোঁয়ামোছা করা পরিচ্ছন্ন, কিন্তু কেমন একটা হালকা কটু গন্ধ। হয়তো ন্যাকড়া বা অয়েলক্লথের গন্ধ, কিংবা বৃদ্ধার গা থেকে আসছে এ গন্ধ। বৃদ্ধা ঘড়ির শেলফের কাছে আরামকেদারায় বসে ছিলেন। তিনি আমাদের দিকে ফিরে বলেন, “নোরা? কোম্পানির লোক নাকি?”
“অন্ধ,” নোরা চটপট করে বাবাকে বলেন। তারপর বলেন, “তুমি অনুমান করতে পারবে না মা। তার কণ্ঠ শোনো।”
বাবা চেয়ারের কাছে গিয়ে সামনের দিকে ঝোঁকেন এবং আশান্বিতভাবে বলেন, “শুভ অপরাহ্ন, মিসেস ক্রোনিন।”
“বেন জর্ডান,” কোনোরকম আশ্চর্য না হয়ে বৃদ্ধা বলেন। “তুমি দীর্ঘ সময় হলো আমাদের দেখতে আসোনি। তুমি কি দেশের বাইরে ছিলে?”
বাবা ও নোরা একে অপরের দিকে তাকান।
“ও বিবাহিত, মা,” নোরা উত্তেজিতভাবে বলেন। “বিবাহিত এবং দুটি বাচ্চা আছে এবং তারা এখানে।” তিনি আমাদের সামনের দিকে ঠেলে দেন, আমাদের হাত দিয়ে বৃদ্ধার শুষ্ক ঠাণ্ডা হাত স্পর্শ করান, সঙ্গে আমাদের নাম উচ্চারণ করেন। অন্ধ! জীবনে আমি এই প্রথম এতো কাছ থেকে একজন অন্ধকে দেখলাম। তার চোখ বোজা, চোখের পাতা নিচের দিকে দাবানো, মনে হয় যেনো চোখের গোলক নেই। শূন্য চোখের কোটর থেকে এক ফোঁটা রুপালি তরল গড়িয়ে পড়ে, ঔষধ অথবা অলৌকিক অশ্রু।
“আচ্ছা আমি একটি ভদ্র পোশাক পরে আসি,” নোরা বলেন। “মায়ের সঙ্গে কথা বলতে থাকো। এটা তার জন্য উপহার। আমরা কদাচিৎ মানুষের সাহচর্য পাই, তাই না, মা?”
“এই রাস্তায় লোকজন তেমন আসে না,” বৃদ্ধা শান্তভাবে বলেন। “আমাদের আশেপাশে যারা ছিলো তারা অনেকেই চলে গেছে।”
“এটা সব জায়গার জন্যই সত্য।”
“তোমার স্ত্রী কোথায়?”
“বাসায়। সে গরম আবহাওয়া পছন্দ করে না, তার খারাপ লাগে।”
“আচ্ছা।” গ্রামের লোকদের, বুড়োদের এই এক অভ্যাস, আচ্ছা বলা। একটু অতিরিক্ত ভদ্রতা ও উদ্বেগ সহকারে তারা বোখাতে চায়, “ব্যাপারটা কি তাই?”
নোরা নতুন পোশাক পরে কিউবান হিল পায়ে হলের সিঁড়ি দিয়ে গটগট করে হেঁটে আসেন। তার পোশাকে নানা রঙের ফুলের বাহার, যা মায়ের নেই। বাদামির ওপর সবুজ ও হলুদ, ফিনফিনে ক্রেপবস্ত্র, বাহু উন্মুক্ত। তার বাহু মোটা, চামড়া ভরা হামের মতো ছোট ছোট কালো দাগ। তার চুল ছোট, কালো, মোটা ও কোঁকড়া। তার দাঁতগুলো সাদা ও শক্ত। “জীবনে আমি এই প্রথম জানলাম যে সবুজ পপির মতো জিনিস হয়,” তার পোশাকের দিকে তাকিয়ে বাবা বলেন।
“জীবনে যা দেখোনি সেসব জিনিস দেখে তুমি বিস্মিত হবে,” নোরা বলেন। তার হাঁটাচলায় চতুর্দিকে সুগন্ধি ছড়িয়ে পড়ছে। পোশাকের নড়াচড়ার সঙ্গে তার গলার স্বর পরিবর্তন হচ্ছে, বেশ সামাজিক ও প্রাণবন্ত। “এগুলো পপি নয়, ফুল মাত্র। যাও তুমি কলে চাপ দিয়ে একটু ভালো ঠাণ্ডা পানি নিয়ে আসো। আমি এই বাচ্চাদের জন্য একটু শরবত বানাবো।” তিনি খাবারের তাক থেকে এক বোতল ওয়াকার ব্রাদার্স অরেঞ্জ সিরাপ নেন।
“তুমি বলছিলে তুমি ওয়াকার ব্রাদার্সে কাজ করো।”
“এটা সত্যি, নোরা। বিশ্বাস না হলে তুমি আমার গাড়িতে গিয়ে নমুনাগুলো দেখে আসতে পারো। আমি সরাসরি এখানকার দক্ষিণের জায়গাটা পেয়েছি।”
“ওয়াকার ব্রাদার্স? এটা কি সম্ভব? তুমি ওয়াকার ব্রাদার্সের মালপত্র বিক্রি করছো?”
“হ্যাঁ, জনাবা।”
“আমরা সবসময় শুনেছি তুমি ডাঙ্গাননের ওখানে শিয়াল পালো।”
“আমি সেটাই করছিলাম, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে।”
“কোথায় থাকো? কতোদিন ধরে এই বিক্রয়ের কাজ চলছে?”
“টাপারটাউনে থাকি। দুই তিন মাস হলো এই কাজ করছি। বেঁচে থাকার জন্য এটা করতে হচ্ছে। দারিদ্র্যের নেকড়েটাকে কাছে ঘেঁষতে দেই না।”
নোরা হাসেন। “ভালো, আমি মনে করি তুমি চাকরিটা পেয়ে ভাগ্যবান। ইসাবেলের স্বামী ব্র্যান্টফোর্ডে থাকে, সে দীর্ঘসময় চাকরিহারা ছিলো। আমি ভেবেছি ওদের যদি শীঘ্র কিছু না হয় তবে সবাইকে আমি খাওয়াপরার জন্য এখানে নিয়ে আসবো। এখন আর তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। আমি আর মা চালিয়ে যাচ্ছি।”
“ইসাবেলের বিয়ে হয়েছে,” বাবা বলেন। “মুরিয়েলেরও বিয়ে হয়ে গেছে?”
“না, সে পশ্চিমে একটা স্কুলে চাকরি করছে। পাঁচ বছর ধরে সে বাড়িতে নেই। আমার মনে হয় সে ছুটি উদযাপনের জন্য ভালো কিছু পেয়েছে। আমি যদি ওর মতো হতাম।” তিনি টেবিলের ড্রয়ার থেকে কিছু ছবি বের করেন এবং বাবাকে দেখান। “এ হচ্ছে ইসাবেলের বড় ছেলে, স্কুল শুরু করেছে। দোলনায় ওটা শিশুবাচ্চা। ইসাবেল ও তার স্বামী। মুরিয়েল। এ হচ্ছে ওর রুমমেট। এই লোকটার সঙ্গেই ও ঘুরে বেড়াতো, ওদের গাড়ি। লোকটা ওখানে একটা ব্যাঙ্কে চাকরি করতো। এ হচ্ছে মুরিয়েলের স্কুল, এখানে ছয়টি কক্ষ আছে। সে পঞ্চম শ্রেণি পড়ায়।” বাবা তার মাথা নাড়েন। “সে যখন স্কুলে যায় আমার সেই সময়টার কথা মনে আছে। রাস্তায় যখন তাকে তুলে নিতাম সে কতোই না লজ্জা পেতো। আমি তখন তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাই। সে একটি শব্দও উচ্চারণ করতো না, ভালো দিনের ব্যাপারে সম্মতিও প্রকাশ করতো না।”
“তার ঐ অভ্যাস কেটে গেছে।”
“তোমরা কাকে নিয়ে কথা বলছো,” বৃদ্ধা বলেন।
“মুরিয়েল। আমি বলছিলাম সে আর এখন আগের মতো লাজুক নেই।”
“গত গ্রীষ্মে সে এখানে ছিলো।”
“না মা, সেটা ছিলো ইসাবেল। গত গ্রীষ্মে ইসাবেল পরিবারসহ এখানে ছিলো। মুরিয়েল থাকে পশ্চিমে।”
“আমি ইসাবেলকেই বোঝাতে চাচ্ছিলাম।”
অল্পক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধা ঘুমিয়ে পড়েন, তার মাথা একদিকে হেলানো, মুখ খোলা। “তার এরূপ আচরণ ক্ষমা করো,” নোরা বলেন। “বয়সের কারণে এরকম হয়।” নোরা তার শরীর একটি চাদর দিয়ে ঢেকে দেন, এবং বলেন যে আমরা সবাই সামনের ঘরটায় গিয়ে বসবো যাতে আমাদের কথাবার্তায় তার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে।
“তোমরা দুজন,” বাবা বলেন, “বাইরে গিয়ে মজা করতে চাও?” যাহোক আমি এখানেই অবস্থান করতে চাই। রান্নাঘরের চেয়ে সামনের ঘরটা অধিক আকর্ষণীয়, খোলামেলা। সেখানে একটি গ্রামোফোন ও একটি পাম্প অর্গান আছে, দেয়ালে মেরির ছবি—যিশুর মা, আমি এটুকু জানি, হালকা নীল গোলাপি রঙ, মাথার চতুর্পাশে আলোকপ্রভা। আমি জানি এ ধরনের ছবি রোমান ক্যাথলিকদের বাড়িতে দেখা যায়, কাজেই নোরা নিশ্চয় সেই গোত্রের। কোনো রোমান ক্যাথলিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় নেই, তাদের বাড়িতেও কখনো যাইনি। আমি ডুঙ্গাননে আমার দাদী ও চাচী টেনার কথা ভাবি। তারা ইঙ্গিতে বলতে চেয়েছেন কেউ একজন ক্যাথলিক। তারা বলতেন, অমুক-অমুক ভুল পায়ে মাটি খোঁড়ে। সে ভুল পায়ে মাটি খোঁড়ে। নোরা সম্পর্কে তারা এরকমই বলতেন।
নোরা অর্গানের ওপর থেকে একটি আধাভর্তি বোতল নেন এবং দুটি গ্লাসে ঢালেন, যে গ্লাসগুলোতে আগে অরেঞ্জ জুস খাওয়া হয়েছে।
“রেখে দাও, অসুস্থতার সময় কাজে লাগবে,” বাবা বলেন।
“তুমি বেঁচে থাকতে নয়, “নোরা বলেন। আমি কখনো অসুস্থ হই না। আমি এটা রাখার জন্য রাখি। এক বোতলে আমার অনেক দিন চলে যায়, কারণ আমি একা একা পান করি না। এই আমার ভাগ্য।” তিনি এবং বাবা পান করেন, এবং আমি জানি এটা কী। হুইস্কি। একত্রে খোশগল্প করার সময় অন্য অনেক কথার মধ্যে মা আমাকে এ কথাটা বলেছেন, তোমাদের বাবা কখনো হুইস্কি পান করেন না। কিন্তু এখন দেখতে পাচ্ছি তিনি করেন। তিনি পান করেন এবং এমন সব লোকের কথা বলেন যাদের নাম আমি এর আগে কখনো শুনিনি। একটু পর তিনি একটি সাধারণ ঘটনার প্রসঙ্গে ফিরে আসেন। তিনি জানালা দিয়ে খালি করে দেওয়া চেম্বারপটের কথা বলেন। “আমাকে ঐ দৃশ্যে কল্পনা করো,” তিনি বলেন, “মধুর গলায় চিৎকার করছি, হে ভদ্রমহিলা, ওয়াকার ব্রাদার্সের লোক এসেছে, বাসায় কেউ আছেন?” তিনি নিজে চিৎকার করছেন, অর্থহীন হাসি হাসছেন, অপেক্ষা করছেন, গভীর প্রত্যাশা নিয়ে ওপরের দিকে তাকাচ্ছেন, তারপর, ওহ, দুই হাতে মুখ ঢেকে এমন ভঙ্গি করেন যেনো কারো করুণাভিক্ষা করছেন (যখন তিনি এরকম কিছু না করেন তখন আমি তার দিকে তাকাই)। নোরা হাসেন, তার হাসি ছোটকুর মতো তুমুল।
“এটা সত্য নয়, এক বিন্দু সত্য নয়!”
“একদম সত্য, ভদ্রমহিলা। ওয়াকার ব্রাদার্সের পদবীতে আমাদের নিজস্ব নায়ক আছে। আমি আনন্দিত তুমি এতে মজা পেয়েছো,” বাবা গম্ভীরভাবে বলেন।
আমি লাজুকভাবে বাবাকে বলি, “গান গাও।”
“কী গান? তুমি কি সবকিছু ছাড়িয়ে গায়ক হয়ে গেছো?”
বিব্রত হয়ে বাবা বলেন, “ড্রাইভিং করার সময় আমি একটুআধটু যে গান গাই, কিছু একটা করা হয়, ছন্দ বানানো হয়।”
কয়েকবার অনুরোধ করার পর বাবা গান শুরু করেন, কাচুমাচু দৃষ্টিতে নোরার দিকে তাকিয়ে। নোরা মাঝে মাঝে এমন খলখল করে হেসে ওঠেন যে তার হাসি না থামা পর্যন্ত বাবাকে অপেক্ষা করতে হয়, কারণ তার হাসিতে বাবারও হাসি চলে আসে। বাবা আবার তার বিক্রয়কর্মীর বচন শুরু করেন। নোরা যখন হাসেন তখন তার ভাঁজ করা দুহাতের চাপে তার বিশাল বক্ষ সংকুচিত হয়। “তুমি পাগল,” তিনি বলেন, “আস্ত পাগল।” তিনি দেখেন ছোটকু গ্রামোফোনের ওপর হিসি করছে। তিনি লাফ দিয়ে তার কাছে যান। “এখানে আমরা সবাই আনন্দ করছি, আর তোমার কথা কেউ ভাবছি না, ব্যাপারটা ভয়াবহ বটে,” তিনি বলেন। “তুমি চাও একটি রেকর্ড চালিয়ে দেই, তাই না? তুমি একটি সুন্দর গান শুনতে চাও? তুমি কি নাচতে পারো? আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তোমার বোন পারে, তাই না?”
আমি বলি, না। “তোমার মতো এতো বড় মেয়ে, দেখতে সুন্দর, আর নাচতে জানো না!” নোরা বলেন। “এখনই শেখার উপযুক্ত সময়। আমি নিশ্চিত তুমি একজন সুন্দর নর্কতী হবে। আমি এখন একটু নাচ দেখাই যা আমি আগে করেছি, এবং তোমার বাবাও করেছে, সেই নাচের দিনগুলোতে। তোমরা জানতে না তোমাদের বাবা একজন নর্তক, জানতে কি? হ্যাঁ, সে একজন মেধাবী লোক, তোমাদের বাবা !”
তিনি গ্রামোফোন রেখে অপ্রত্যাশিতভাবে আমার কোমর পেঁচিয়ে ধরেন। অন্য হাতটি দিয়ে আমার এক হাত ধরে আমাকে পিছন দিকে ঠেলে দেন। “এই হলো নাচের প্রক্রিয়া। আমাকে অনুকরণ করো। পা দেখো। এক এবং এক-দুই। ভালো হচ্ছে, সুন্দর, তোমার পায়ের দিকে তাকিও না। আমাকে দেখো, ঠিক আছে, দেখেছো কতো সোজা? তুমি একজন সুন্দর নর্তকী হবে। এক এবং এক-দুই। এক এবং এক-দুই। বেন, দেখো তোমার মেয়ে নাচছে।” আমার কাছে এসে আদর করে ফিসফিস কথা কও, ফিসফিস কথা যাতে অন্য কেউ শুনতে না পায় …
মেঝেতে বিছানো লিনোলিয়ামের ওপর ঘুরে ঘুরে, গর্বিত আমি, নাচছি। নোরা হাসছেন, আর আমাকে তার অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিতে দারুণভাবে আন্দোলিত করছেন। তার শরীর থেকে বেরুচ্ছে হুইস্কি, সুগন্ধি ও ঘামের গন্ধ। তার পোশাক ভিজে জবজবে, তার ওপরের ঠোঁটে এক বিন্দু ঘাম জমেছে, সেটি তার নরম কালো চুলে লেগে মুখের একপাশে ঝুলে আছে। তিনি আমাকে বাবার সামনে দ্রুত ঘোরান, আমি হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই। যতোটা তিনি ভান করেন তার ছাত্রী হিসেবে আমি এখনো ততোটা দক্ষ হতে পারিনি। তিনি আমাকে ছেড়ে দেন, আমার নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ।
“আমার সঙ্গে নাচো, বেন।”
“আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ নাচিয়ে, নোরা, এবং তুমি সেটা জানো।”
“আমি নিশ্চিত কখনোই এরকম ভাবিনি।”
“এখন ভাববে।”
তিনি বাবার সামনে দাঁড়ান, দু বাহু দুলছে, আশান্বিত। এক মুহূর্ত আগে তার যে বক্ষ আমাকে উষ্ণতা ও বিশালতায় বিব্রত করেছে তা এখন তার পুষ্পশোভিত পোশাকের নিচে ওঠানামা করছে। তার মুখ এতোক্ষণের শ্রম ও আনন্দে উজ্জ্বল।
“বেন।”
বাবা তার হাত নামিয়ে আনেন এবং মৃদুভাবে বলেন, “না, নোরা।”
নোরা গিয়ে রেকর্ডটি বন্ধ করে দেন। “আমি একা একা পান করতে পারি, কিন্তু একা একা নাচতে পারি না,” তিনি বলেন। “আমি আমার ধারণার চেয়ে অধিক পাগল নই, বোধ করি।”
“নোরা,” বাবা হেসে বলেন, “তুমি পাগল নও।”
“রাতের খাবার পর্যন্ত থেকে যাও।”
“ওহ, না। তোমাকে সেই ঝামেলার মধ্যে ফেলতে চাই না।”
“এটা ঝামেলা নয়। আমি খুশি হবো।”
“ওদের মা দুশ্চিন্তা করবে। ভাববে গাড়ি নিয়ে ডোবায় উলটে পড়েছি।”
“ও আচ্ছা।”
“এর মধ্যে তোমার অনেক সময় নিয়ে নিয়েছি।”
“সময়,” নোরা তিক্তভাবে বলেন। “তুমি কি আর কখনো আসবে?”
“পারলে আসবো,” বাবা বলেন।
“বাচ্চাদের নিয়ে এসো। বউকে নিয়ে এসো।”
“হ্যাঁ,” বাবা বলেন, “আসবো যদি পারি।”
তিনি আমাদের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত আসেন। বাবা বলেন, “তুমিও আমাদের এখানে বেড়াতে এসো, নোরা। আমরা গ্রোব স্ট্রিটে থাকি, বামদিকের রাস্তা দিয়ে ঢুকে, উত্তরে, দুইটি বাড়ি পরে, পুবদিকে, বেকার স্ট্রিট।”
নোরা এই দিকনির্দেশ মনোযোগ দিয়ে শোনেন না। নরম উজ্জ্বল পোশাকে তিনি গাড়ির কাছে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই সন্ধ্যায় ধুলোবালিযুক্ত গাড়ির গায়ে তার হাত এক অবোধগম্য ছাপ তৈরি করেছে।
বাড়ি ফেরার পথে বাবা কোনো আইসক্রিম বা পপ কিনে দেন না। তবে তিনি মফস্বলের এক দোকান থেকে এক প্যাকেট লিকোরিস মণ্ডা কিনে আমাদের সঙ্গে ভাগাভাগি করেন। মহিলা ভুল পায়ে মাটি খোঁড়েন, আমি ভাবি। শব্দগুলো আমাকে আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে অধিক বিষণ্ণ, থমথমে, বেপথু করে তোলে। বাবা বাসায় কোনোকিছু বলার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করে দেন না, কিন্তু লিকোরিস দেওয়ার সময় তার চিন্তামগ্ন ভাব দেখে আমি বুঝি, কিছু কিছু জিনিস আছে যা উল্লেখ করতে হয় না। হুইস্কি বা নাচ। ছোটকুকে নিয়ে চিন্তা নেই, সে অতোটা বোঝে না, বেশি হলে সে মনে রাখবে বৃদ্ধা মহিলা অথবা মেরির ছবির কথা।
“গান ধরো,” ছোটকু বাবাকে আদেশ দেয়। বাবা থমথমে গলায় বলেন, “আমি জানি না, আমার সব গান উধাও হয়ে গেছে। তুমি বরং রাস্তা দেখো এবং খরগোশ খুঁজে বের করো।”
কাজেই বাবা গাড়ি চালাতে থাকেন এবং ছোটকু রাস্তায় খরগোশ খুঁজতে থাকে। আমি অনুভব করি এই শেষ সন্ধ্যায় বাবার জীবন গাড়ি থেকে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। মন্ত্রপুত দৃশ্যের মতো অন্ধকার, অদ্ভুত। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে দয়াদ্র, সাধারণ, পরিচিত। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানো মাত্র অন্যরকম, যা কিছুতেই বোঝা যায় না, সমস্ত রকম আবহাওয়ায়, অচিন্ত্যনীয় দূরত্ব।
আমরা যখন টাপারটাউনের কাছে পৌঁছি, তখন আকাশ হালকা মেঘে ঢাকা, লেকের ধারে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সবসময়, প্রায় সবসময়, যেমনটা থাকে।