চলে গেলেন শিশুসাহিত্যের নিবেদিতপ্রাণ আলী ইমাম

'ভাবলাম বইটা তোমার কাছে থাকলে বেশি কাজে আসবে। বাংলা শিশুসাহিত্যের উপকার হবে।'

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 24 Nov 2022, 07:54 AM
Updated : 24 Nov 2022, 07:54 AM

বিগত শতাব্দীর প্রথম ভাগের পাকিস্তান আন্দোলনের চাপে ১৯৪৭ সালের পর বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল আরব-পারস্য সংস্কৃতির প্রভাব। এর বিপরীত প্রতিক্রিয়ায় ষাটের দশকেই সামগ্রিকভাবে ঘটে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান। এরই পটভূমিতে সৃষ্ট রাজনীতির প্রভাবে বাংলাদেশের সাহিত্যে গতি পায় অসাম্প্রদায়িক ও নানামাত্রিক উদারতর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবল একটি ধারা। এক কথায় বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে সূচনা ঘটে নবতর এই জীবনদৃষ্টির। এর আঁচ এসে লাগে বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যেও। ষাটের দশকে রোকনুজ্জামান খান সম্পাদিত ‘কচি ও কাঁচা’ এবং এখলাসউদ্দিন আহমদ সম্পাদিত ‘টাপুর টুপুর’ পত্রিকার পাতায়ই এই ধারা সবচেয়ে স্পষ্ট রূপে দেখা দেয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর কালে একের পর এক এই ধারার লেখকদের বই প্রকাশিত হতে থাকলে ধারাটি স্পষ্টতা পায়। ২১ নভেম্বর আলী ইমামের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই ধারার সবচেয়ে অতিপ্রজ লেখকের সক্রিয়তায় যতি ঘটল। 

২.

১৯৭১ সালের একেবারে প্রথম দিকে আমরা থাকতাম মিরপুরের পল্লবীতে; তৎকালীন ইপিআরটিসির ঢাকা-মিরপুর দোতলা বাস সার্ভিসের পল্লবী ডিপোর কাছাকাছি এলাকায়। তখন আমি চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় ছোটদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানের সূত্রে আলী ইমাম নামটি আমার পরিচিত। অবশ্য টেলিভিশনের পর্দায় তাঁকে দেখি আরেকটু পরে, ১৯৭২ সালের কোনো এক সময়ে। তবে যত না টিভিতে দেখি তার চেয়ে বেশি তাঁর কণ্ঠ শুনি বেতারযন্ত্রে।

১৯৭৯-৮০ সালের দিকে চিত্তরঞ্জন সাহা তাঁর প্রকাশনা-সংস্থা মুক্তধারাকে নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেন। নানা ধরনের কর্মসূচি হাতে নেয় 'মুক্তধারা'। মনে পড়ছে এখনকার সেগুন বাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির মাঠে নিজেদের প্রকাশিত বই নিয়ে একটা মেলার আয়োজন করেছিল তারা। ওখানে কুইজ ধরনের একটা অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করছিলেন আলী ইমাম। সম্ভবত সেখানেই তাঁকে প্রথম চাক্ষুষ দেখি। কণ্ঠ শুনে সহজেই চিনে নিতে পারি তাঁকে।

ঐ বয়সে আলী ইমামকে আমার মনে হতো কথার জাদুকর! জেনে অবাক হতাম, কতকিছুই না তিনি জানেন! মুক্তধারা তখন বিনামূল্যে নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা প্রচুর ক্যাটালগ বিলি করত। যতদূর মনে পড়ছে সেই মেলা থেকেই আলী ইমামের ছোটদের গল্পের বই 'শাদা পরি' কিনেছিলাম। আমি তখন জানতাম 'পরী' শব্দটি দীর্ঘঈকার দিয়ে লেখা হয়। জীবনানন্দ দাশের নাম জানলেও 'শাদা' যে তিনি তালব্য শ দিয়ে লিখতেন সে ব্যাপারে সচেতন ছিলাম না। আলী ইমামের 'শাদা পরি' বইয়ের নামের দুই শব্দের বানানের ভিন্নতা আমাকে অবাক করলেও এর অন্তর্নিহিত কারণ জানার উপায় তখন ছিল না আমার; তবে আলী ইমাম লিখেছেন বলে এই বানানকে ভুল মনে হয়নি। কারণ যিনি এত কিছু জানেন, এত সুন্দর করে কথা বলেন, তিনি বানান না জেনে বইয়ের নাম লিখবেন তা মনে হয়নি! এখনকার পরিপ্রেক্ষিত থাকলে হয়তো এতটা নিশ্চিত থাকতাম না! কারণ ভাষাজ্ঞানের প্রাথমিকতা যে লেখায় নেই, তা যে বই হয়ে বের বের হতে পারে না তা সে সময়কার লেখকদের সাধারণ সংস্কৃতি। সে সময় তাঁদের সঙ্গে মিশে ততদিনে এসব কিছুটা বুঝতে শিখে গেছি। কিশোরদের সাপ্তাহিক পত্রিকা 'কিশোর বাংলা' বের হওয়ার পর তাঁকে আরো ভালো করে চিনলাম। কারণ ঐ পত্রিকার পাতায় তিনি নিয়মিত থাকতেন লেখা নিয়ে।

৩.

কোন বইটা কেন ভালো, কোনটার চেয়ে কোনটা ভালোতর এসব বিচার করবার ক্ষমতা তৈরি হওয়ার আগেই পাঠসতৃষ্ণ মনে তাঁর সে সময়ের লেখা কিশোর-উপন্যাস 'অপারেশন কাঁকনপুর' ভালো লেগেছিল; ভালো লেগেছিল মসলিন কাপড় তৈরির পটভূমিতে লেখা কিশোর-উপন্যাস 'তিরিমুখীর চৈতা'; গল্প-সংকলন 'শাদা পরি'র কথা তো বলেছিই।

খুবই ভালো লেগেছিল তাঁর লেখা ফিচারধর্মী বই 'পাখিদের নিয়ে'; পাখিদের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়েছিল কাছাকাছি সময়ে তাঁর লেখা পাখি বিষয়ক ছোটদের জন্য অন্য বইগুলো। তাঁর লেখায় পাখিদের প্রতি, প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা জাগানিয়া উপাদান আছে।

'কিশোর বাংলা' পত্রিকার পাতায় ‘রূপালি ফিতে' নামে সিনেমার নানা দিক নিয়ে নিয়মিত লিখছিলেন। আমি ছিলাম প্রতিটি পর্বের পাঠক। সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে অনেক কিছু আমি জেনেছিলাম ঐ লেখার মাধ্যমেই।

'কিশোর বাংলা'র নিয়মিত পাঠক ছিলাম বলে তাঁর সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল থাকতাম। জানতে পারতাম সে সময়ের কোনো কোনো সাহিত্য সম্পর্কিত অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি উপস্থাপক। তাঁর মিষ্টি করে কথা বলার ভঙ্গিটি ভালো লাগত খুব। আমি চমকিত হতাম তাঁর তথ্যবহুল কথাভঙ্গিতে। সব মিলিয়ে বলা চলে, সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে আমার কাছে আলী ইমাম ছিলেন রীতিমতো এক সাহিত্যিক তারকাবিশেষ।

৪.

আলী ইমামের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় হলো সাহিত্য সভার সংগঠন ‘অনুশীলন সংঘে' এসে। ঐ নামে একটি নিয়মিত সাহিত্য সভা পরিচালনা করতেন কার্টুনিস্ট-কবি শেখ তোফাজ্জল হোসেন তাঁর কর্মস্থল ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দোতলায়, অফিসকক্ষে। সেখানেও মাঝে মাঝে আসতেন তিনি। ঊনআশি-আশি সালের দিকে একদিন আলী ইমামের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচয় হয় সেখানেই। সেদিন অনুশীলন সংঘের সাহিত্য সভাশেষে বায়তুল মোকাররমের ফুটপাথে পত্রিকা দেখছিলাম। আলী ইমামও সেখানে এলেন কিছুক্ষণ পরই। আমাকে দেখে কথাও বললেন দু-একটা। আমার উৎসাহ দেখে আরও কথা হলো। এমনিতেই তাঁর কথা বলায় আকর্ষণ বোধ করতাম। তার ওপর সেদিন তিনি আমার সঙ্গে আন্তরিকভাবে অনেক কথা বলছিলেন। তাঁর কথার জাদুতে সম্মোহিত হয়ে গেলাম প্রায়। তাঁকে জানালাম, পত্রিকার পাতায় তাঁর লেখা দেখলেই পড়ে ফেলি, খুঁজে খুঁজে পড়ি তাঁর বই। একটু মাথামোটা গোছের হলেও এবং সব কিছুই কম কম বুঝলেও এটুকু বুঝেছিলাম, তাঁর সম্পর্কে আমার আগ্রহের কথা জেনে তিনি বেশ খুশি। কথা বলতে বলতে তাঁর সঙ্গে অনেকদূর হাঁটলাম বায়তুল মোকাররমের ফুটপাথ ধরে। নানা বিষয়ে আমার বালখিল্য কৌতূহল দেখে তিনি খানিকটা হয়তো কৌতুকও বোধ করেছিলেন। বোধহয় একটু মায়াও জন্মেছিল আমার প্রতি। স্টেডিয়ামের সামনে থেকে তিনি রিকশায় উঠবেন, আর আমি আমাদের তখনকার উত্তর শাহজাহানপুরের বাসায় ফিরব। হঠাৎ আলী ইমাম আমাকে বললেন, 'চলো আমার সঙ্গে!' জিজ্ঞেস করলাম, 'কোথায়?’ বললেন, 'আমাদের বাসায়! তোমাকে থাইল্যান্ডের মিউজিক শোনাব।' আসলে তাঁর প্রতি আমার কৌতূহল দেখে পটে গিয়েছিলেন তিনি নিজেও। অনুভব করছিলেন একজন আন্তরিক ও আগ্রহী শ্রোতার কাছে নিজেকে তুলে ধরার চাপ। আর আমার তো তখন গোগ্রাসে খ্যাতিমান মানুষদের কথা গেলার অভ্যাস। তাঁরও কথা গিলবার লোভ সামলাতে পারলাম না। সৌভাগ্যের বিষয় মনে করে রাজি হয়ে গেলাম প্রায় এক কথায়ই।

৫.

তিনি তখন থাকতেন ঠাটারিবাজারের পৈত্রিক বাড়িতে! বাসায় ঢুকে তো আমি বিস্মিত, চমকিত ও মুগ্ধ! এত বই! মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত থরে থরে সাজানো। কিছু বই আছে শেলফের বাইরে মেঝেতেও। খানিকটা এলোমেলো। বইপড়ার আগ্রহের কারণে দু-একটা লাইব্রেরিতে গিয়েছি। বই দেখেছি। আমার ছোট মামাও বই পড়তেন; তাঁর সংগ্রহেও সেলফভর্তি কিছু বই ছিল। কিন্তু কারো ব্যক্তিগত সংগ্রহে যে এত বই থাকতে পারে এমন অভিজ্ঞতা আমার সেটাই প্রথম! চকিতে অনুভব করলাম আলী ইমাম যে এত সুন্দর করে কথা বলতে পারেন তার কারণ তিনি নানা ধরনের বই পড়েন এবং সেই সূত্রে অনেক কিছু জানেন; ভালো করে জানেন বলে সুন্দর করে কথাও বলতে পারেন।

আমাকে বসতে বলে তিনি গেলেন ভেতরের ঘরে। একটু পরে দেখলাম তাঁর ছেলে কোঁকড়াচুলের ছোট্ট অন্তুকে, ঘরময় ছুটে বেড়াচ্ছে। যতদূর মনে পড়ে মেয়ে অনিতার জন্ম হয়নি তখনও। আলী ইমাম ক্যাসেট প্লেয়ারে কোনো একটা মিউজিক ছেড়ে দিলেন। বললেন, এটা থাইল্যান্ডের মিউজিক। কিছুদিন আগে থাইল্যান্ডে গিয়েছিলাম। আমি সাধারণত যেখানে যাই সেখানকার মিউজিক আর বই নিয়ে আসি। কণ্ঠে তা নিয়ে কী উচ্ছ্বাস! সত্যি বলতে কি থাইল্যান্ডের মিউজিক তখন আমার তেমন ভালো লাগেনি, বরং একটু দুর্বোধ্যই লাগছিল। আমার বিস্মিত চোখ কেবল তাঁর বইয়ের দিকে! সেলফের কোনো একটা তাক থেকে একটা বই বের করে আনলেন। দেখলাম তাঁর লেখা ছোটদের গল্পের বই 'চারজনে'। মাত্রই কদিন আগে বেরিয়েছে। খচখচ করে লিখে আমাকে দিলেন লেখকের উপহার হিসেবে।

লেখকের হাত থেকে বই পাওয়া যে আমার জন্য কী আনন্দের ছিল সেদিন! সত্যি কথা বলতে কি, অজান্তেই বইপত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আমার আগ্রহের সূচনা হয়েছিল সেদিন তাঁর সংগ্রহ দেখেই। কিছু দিনের মধ্যেই নিজের মনে প্রত্যয় অনুভব করেছিলাম, আমাকে লেখকই হতে হবে। লেখক হতে হলে যে অনেক বই পড়তে হবে সে ব্যাপারে সচেতনতার গভীরতাও সৃষ্টি হয়েছিল তাঁর বইয়ের সংগ্রহ দেখে।

৬.

এরপরে কতবার দেখা হয়েছে তাঁর সঙ্গে, কত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি। যতবার বাড়ি বদলেছেন সেখানেই যাওয়া হয়েছে। দেখা হয়েছে কখনো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজের সূত্রে, কখনো টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের অছিলায়, কখনো সাহিত্যের আড্ডায়, অনুষ্ঠানের দরকারে। তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক প্রসন্নতার বিভা! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচির ছেলেমেয়েদের উজ্জীবিত করার জন্য তাঁকে বিভিন্ন স্কুলে পাঠানো হতো। তিনি নিজে অসংখ্য বইয়ের রচয়িতা; যাদের কাছে গিয়ে তিনি কথা বলতেন তারা তাঁকে আপন মানুষ ভাবত। তাঁর কথায় যেমন কোনো বিষয়ে প্রাথমিক ধারণাটুকু থাকত, তেমনই থাকত তার অনুকূল অনুভূতিময়তা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সেজন্য তাঁকেই পাঠাতেন কিশোর-তরুণদের উদ্দেশে কথা বলতে।

কালের নিয়মে তাঁর প্রতি আমার মুগ্ধতাও কমে এসেছিল ধীরে ধীরে এক সময়। এমনকি কোনো কোনো ব্যাপারে বেড়ে উঠেছিল কিছুটা অপছন্দও। কিন্তু এ যে জীবনেরই স্বাভাবিক নিয়ম তা তিনি জানতেন ও মানতেন বলে আমার প্রতি ভালোবাসার কমতি ঘটেনি তাতে। একটুও কমেনি আমাদের সম্পর্কের ঘনত্ব! সবচেয়ে বড় কথা, তিনিও জানতেন, আমাদের দুজনের যোগাযোগের সূত্র কখনোই জীবিকা ও বৈষয়িকতা নয়। তিনি যখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের ক্ষমতাবান কর্মকর্তা তখনো তিনি আমার কাছে সে-কারণে আকর্ষণীয় ছিলেন না। টেলিভিশনের কর্মজগতের সেই মানুষটির সঙ্গে বরং আমার তেমন সম্পর্ক ছিল না। সাহিত্য, বিশেষ করে শিশুসাহিত্যই আমাদের মধ্যেকার যোগসূত্র। বাংলা শিশুসাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসার অকৃত্রিমতা দিয়েই আমাকে সিক্ত করে চলতেন অনাবিল স্নেহে, অবিরাম; মৃত্যুতে এসে তার ছেদ ঘটল।

৭.

শিশুসাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা যে কতটা অকৃত্রিম তার সামান্য পরিচয় দেয়া যায়। ঘটনা সামান্য হলেও এর তাৎপর্যের গভীরতা অনুভবনীয়। বেশ কয়েক বছর আগে, ১৯৯১ সালে কী এক কারণে তাঁর আজিমপুরের ভাড়া বাড়িতে গিয়েছিলাম। প্রকৃত কাজের কথা শেষ হতে না হতেই সাম্প্রতিকতম পঠিত বই নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন আমার সঙ্গে। কী কী বই বা পত্রিকা সংগ্রহ করেছেন আলাপ করতে লাগলেন তা নিয়ে। হঠাৎ উঠে গিয়ে সেল্ফ থেকে একটা বই খুঁজে বের করলেন। বইটি ছিল অশোক মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'ব্যাকরণ অভিধান'! বইটির প্রথম সংস্করণ ছিল সেটা এবং তখন খুব একটা সুলভও ছিল না ঢাকায়। বইটাতে সাইনপেনের মোটা কালিতে তিনি লিখলেন, “প্রিয় আহমাদ মাযহারকে, আলী ইমাম, ৩০। ১০। ৯১'। আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, 'ভাবলাম বইটা তোমার কাছে থাকলে বেশি কাজে আসবে। বাংলা শিশুসাহিত্যের উপকার হবে।'

আরেক দিনের কথা। এবারের ঘটনা ২০০০ সালের। তিনি তখন সেন্ট্রাল রোডের পাশে ভূতের গলির একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন। একদিন কী কারণে যেন গিয়েছিলাম তাঁর সে বাসায়। এ-কথা সে-কথা বলতে বলতে হঠাৎ সেলফ থেকে নবেন্দু সেনের লেখা 'বাংলা শিশুসাহিত্য: তত্ত্ব ও তথ্য' বইটি বের করে নিয়ে খসখস করে লিখলেন, ‘আহমাদ মাযহার সুজনেষু, আলী ইমাম, ২।৩। ০২'। বললেন, 'এটা আমার কাছে থাকলে সেলফে সাজানোই থাকবে। আর তোমার কাছে থাকলে উপকার হবে বাংলা ভাষার শিশুসাহিত্যের!'

তখন পর্যন্ত আমার লেখালেখিতে ক্ষীণ ধারায় শিশুসাহিত্য চর্চা থাকলেও এতে অগ্রাধিকার ছিল না। তাঁর কাছে শিশুসাহিত্য প্রাণের ব্যাপার ছিল বলেই অবলীলায় অনেক কষ্টে সংগ্রহ করা বই আমাকে দিয়ে দিতে পেরেছিলেন আমাকে অনুপ্রাণিত করতে। সত্যি বলতে কি, দুটি বই-ই আমার কাজে এসেছে দীর্ঘকাল ধরে। লুৎফর রহমান রিটন-সম্পাদিত 'ছোটদের কাগজ' পত্রিকায় আমি যে ধারাবাহিকভাবে বাংলা ব্যাকরণের লঘুপাঠী বই 'ভালোবাসা বাংলাভাষা' লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম সে তো তাঁর দেয়া এই বইটার উৎস প্রেরণার জন্যই। 'শিশুসাহিত্যের রূপরেখা' নামে আমার যে শিশুসাহিত্য বিষয়ক কিছুটা গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের বইটি আছে তার পেছনেও তো আলী ইমামের দেয়া নবেন্দু সেনের বইটির প্রেরণা! দুটি বই-ই এখনো প্রায়শই ব্যবহার করি; বারবার অনুভব করি তাঁর স্নেহস্পর্শ।

৮.

এতক্ষণ আমি যে স্মৃতিচারণ করলাম তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত অনুভবের বিষয়। কিন্তু তাঁর সম্পর্কিত এমন ধরনের স্মৃতি আরও অনেকেরই আছে। সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা নিয়ে নানা জনের কাছেই আছে গল্প। দীর্ঘকাল তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন। সেখানেও তাঁর কর্মিষ্ঠতার পরিচয় আছে। কিন্তু ব্যক্তিত্বের সামগ্রিকতায় তিনি যতটা না টেলিভিশনের মানুষ, তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন শিশুসাহিত্যের। বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে অবসর নিয়েছেন সরকারি চাকুরের পুরো মেয়াদে চাকরি করে। অসুস্থ হয়ে পড়ার আগে বিভিন্ন টেলিভিশন কেন্দ্রের বিচিত্র অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল তাঁর। বেতার-টিভি কথক হিসেবে বা নানা ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠানের সঞ্চালক হিসেবে তাঁর দক্ষতাকল্প এক সময় তাঁকে টেলিভিশনের 'হরফুন মৌলা' বানিয়ে তুলেছিল। ফলে সে সময়ের টেলিভিশন দর্শক মাত্রই আলী ইমামের নাম জানেন। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে যেমন তেমনই টেলিভিশন অনুষ্ঠান করিয়ে হিসেবে তিনি প্রভাবিত ছিলেন শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার দ্বারা। যেমন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে তেমনি টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা হিসেবে বাঙালি সংস্কৃতির আত্মাকে তিনি অনুভব করতেন যতটা মননের দ্বারা তারচেয়ে বেশি ইন্দ্রিয়জ অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে। তবে তাঁর সব পরিচয় ছাপিয়ে শিশুসাহিত্যিকের পরিচয়টাই সবচেয়ে বড়। কেবল আমার কাছেই নয়, তাঁর দীর্ঘকালের নিকটজনদের কাছেও তাঁর এই পরিচয়ই অনুভূত।

আমিও যখন পরিণত বয়সে পৌঁছেছি ততদিনে তিনি বার্ধক্যে; কিন্তু তা সত্ত্বেও কৈশোরক অস্থিরতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্বেই পেয়েছি তাঁকে। পরিণত বয়সে সাধারণত অবিমিশ্রভাবে কোনো কিছুকে গ্রহণ করা কঠিন হয়। সুতরাং আলী ইমামও শেষের দিকে আমার কাছে অবিমিশ্র গ্রহণীয় ছিলেন না; বরং তাঁর অনেক কিছু নিয়েই মুখর থাকতাম সমালোচনায়। কিন্তু তাহলে কী হবে, সবসময়ই অনুভব করেছি তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসা অটুট আছে। ক্লেদঘাঁটা জীবনের যত আপত্তি আর অপছন্দ এসে জমা পড়ুক না কেন সব উপচে তাঁর প্রতি আমার ভালোবাসাটাই শেষ পর্যন্ত থেকে যায়। খানিকটা কলহ করে সেই কথাটাই বলতাম তাঁকে। সদাহাস্য আলী ইমামও জানতেন সে কথা। আমার রূঢ়ভাষাও কখনো তাঁর মুখ মলিন করতে পারেনি। হেসে বলতেন তোমার সমালোচনাও তো আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাই! আর এরকমটাই তো আমি। তুমিও তো আমাকে ভালোবাসো এই সব কিছু নিয়েই!

৯.

আলী ইমামের চলে যাওয়ার দিন বার বার মনে পড়ছে একদিন আমি উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম তাঁর দ্বারা, এখনো উদ্বুদ্ধ হই বারবার! আমার মগ্নচৈতন্যে জেগে থাকেন শিশুসাহিত্যপ্রেমিক, বইপ্রেমিক ও প্রকৃতিপ্রেমিক আলী ইমাম!

অনেক সময় ভেবেছি কৈশোরোত্তীর্ণ বয়সে আলী ইমামকে ভালোবেসেছিলাম কেন? অনুভব করেছি এর উৎস শিশুসাহিত্যের প্রতি তাঁর নিষ্কলুষ ভালোবাসা। তিনি বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যের অঙ্গনে যে এক অনিবার্য নাম একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। কিন্তু হয়তো প্রশ্ন উঠবে শিল্পসাফল্যে বা সাহিত্যের বৈশ্বিক বিবেচনায়, এমনকি বাংলা শিশুসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেও আলী ইমামের শিশুসাহিত্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে উত্তরকালে? কালের ধুলোর আস্তরণে আলী ইমামের অজস্র লেখার অনেক পাতা হয়তো মলিন হয়ে পড়বে, হয়তো কোনো কোনো পাতা আর খুঁজেই পাওয়া যাবে না কোনো দিন। সেই বিচারের ভার কালের হাতেই রেখে দিতে হবে আমাদের। কিন্তু আমি খুব আন্তরিকতার সঙ্গে জোর দিয়েই বলতে পারি, শিশুসাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না! সামর্থ্য যা-ই থাকুক না কেন, সাহিত্যকে, বিশেষ করে শিশুসাহিত্যকে অন্তর দিয়ে তাঁর মতো গভীরভাবে ভালোবাসেন এমন মানুষ এখনো খুব বেশি দেখিনি। একটি শিশু যেমন তার বিকাশমানতার পর্যায়ে আনন্দে থাকতে থাকতে বা আনন্দ পেতে চেয়ে বেড়ে ওঠে আলী ইমামও আমৃত্যু ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। আর এমন মানুষ আমাদের সমাজে চিরকালই ছিল বিরল; সেই ধরনের মানুষ আরো বিরলতর হয়ে পড়ল তাঁর বিয়োগে!