Published : 09 Oct 2024, 08:21 PM
‘দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার’। আশার বংশের অবসান। এডগার অ্যালান পো'র (১৮০৯-১৮৪৯) লেখা একটি গথিক হরর। গল্পটি শুরু হয় অজ্ঞাতনামা একজন কথক যখন তার শৈশবের বন্ধু রোডেরিক আশারের বাড়িতে পৌঁছয়। দেশের দূরবর্তী কোন প্রান্তে থাকাকালীন চিঠিটি পেয়েছিল কথক। রোডেরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে বন্ধুর সাহায্য চেয়েছিল। পথিমধ্যে বেশ কয়েকটি অদ্ভুত ঘটনা দেখে, অনেকটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে পুরনো প্রাসাদে ঢুকে পড়ে সে। সেই সাথে দেখতে পায়, একটা সূক্ষ্ম ফাটল প্রাসাদের সামনের ছাদ থেকে এঁকেবেঁকে দেয়াল বরাবর নেমে হ্রদের কালো জলে মিলিয়ে গেছে।
আশারদের এই প্রাচীন ভবনে মাত্র দুটো প্রাণী বাস করে। রোডেরিক ও তার ছোট বোন ম্যাডেলিন। রোডেরিক ছবি আঁকতো, গিটার বাজাতো। কিন্তু তার চিন্তাভাবনা ছিল পুরোপুরি অসংলগ্ন। কথকের মতে, রোডেরিকের এই অদ্ভুত বিষন্নতার মূলে ছিল অধিকতর স্বাভাবিক এবং বোধগম্য একটি কারণ—সেটি তার আদরের বোন—তার দীর্ঘ দিনের একমাত্র সাক্ষী—এই পৃথিবীতে তার শেষতম ও একমাত্র আত্মীয়ার দীর্ঘকালব্যাপী কঠিন অসুখ—মৃত্যুই যার আসন্ন পরিনতি। ম্যাডেলিন বস্তুত মনো-দৈহিক রোগ ক্যাটালেপসিতে ভুগছিল। সহজ ভাষায়, ক্যাটালেপসি এমন একটা মনো-দৈহিক অবস্থা যেখানে পারকিনসন এবং সিজোফ্রেনিয়া মিলেমিশে এক হয়ে যায়। শেক্সপিয়রের রোমিও-জুলিয়েট, জর্জ এলিয়টের সাইলাস মারনার, আর্থার কোনার ডয়েলের দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব রেসিডেন্ট পেশেন্ট এবং ইউজিন স্যু'র মিস্ট্রি অব প্যারি উপন্যাসে আমরা এই রোগে আক্রান্ত চরিত্র দেখতে পাই।
কথক আশার ভবনে ম্যাডেলিনকে অস্পষ্ট দেখেছিল। ফ্যাকাসে সাদা শরীর। মুখে গোলাপি আভা। নিজের অলক্ষ্যে কথককের সামনেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল সে। ওইদিন সন্ধ্যায়ই কথক ম্যাডেলিনের মৃত্যুর কথা জানতে পারে। ঘটনার আকস্মিকতা তাকে বিহ্বল করে তোলে। এদিকে রোডেরিক জানায়, আশারদের পারিবারিক রীতি অনুযায়ী ম্যাডেলিনের মৃতদেহটি প্রাসাদের অভ্যন্তরে একটি ভূগর্ভ-কক্ষে পনেরো দিনের জন্য রক্ষিত থাকবে। কফিনে ম্যাডেলিনের দেহটি রেখে তামার পাত মোড়ানো সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে স্যাঁতসেঁতে আলো-বাতাসহীন ভূগর্ভ-কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। কথকের ভাষ্যমতে—'আমাদের শোকের ভারটিকে সেই আতংকের রাজ্যে যথাযথভাবে নামিয়ে রেখে শবাধারের ঢাকনাটিকে আংশিকভাবে সরিয়ে মৃতের মুখের দিকে ভাল করে তাকালাম। ভাই ও বোনের মুখের একটা বিশেষ মিল এই প্রথম আমার মনোযোগ আকর্ষণ করল। আমার মনের অবস্থাটা অনুমান করে রোডেরিক এমন কয়েকটি কথা বলল যা থেকে জানতে পারলাম—ম্যাডেলিন ও সে যমজ ভাইবোন এবং তাদের দু'জনের মধ্যে একটা দুর্বোধ্য রকমের পারস্পরিক প্রভাব আগাগোড়াই ছিল। আমরা অবশ্য মৃত দেহটির ওপর বেশিক্ষণ আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে রাখতে পারলাম না—কারণ একটা অস্পষ্ট ভয়ের অনুভূতি ধীরে ধীরে আমাদের মনে সঞ্চিত হচ্ছিল। যে ব্যাধি পরিপূর্ণ যৌবনকালেই তাকে সমাধির গহ্বরে ঠেলে দিয়েছিল তার স্বাভাবিক পরিণতিতেই মৃতের মুখে ফুটে উঠেছিল একটি রক্তিম আভা আর তার ঠোঁটে লেগেছিল এমন একটি হাসির ছোঁয়া যা মৃতের মুখে বড় ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ঢাকনাটিকে শবাধারের ওপর বসিয়ে স্ক্রু আটকে দিয়ে লোহার দরজায় কপাট লাগিয়ে আমরা বেশ কষ্ট করে ওপরে উঠে এলাম।'
গল্পের এ পর্যায়ে ম্যাডেলিনের মৃত্যু এবং রোডেরিকের সাথে তার সম্পর্ক আমাদের অনেকটা অনিশ্চয়তায় ফেলে দেয়। অ্যালান পো' এটা সচেতন ভাবেই করতেন তার রচনায়। যাতে করে পাঠক নিজস্ব বুদ্ধিমত্তা দিয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এমন একটি সম্পর্ক আমরা দেখতে পাই, গেয়র্গ ট্রাকল (১৮৮৭-১৯১৪) ও তাঁর বোন গ্রেটার মধ্যে। সিস্টার্স গার্ডেন শিরোনামে একটা কবিতা লিখেছিলেন ট্রাকল। ধারণা করা হয়, কবিতাটি গ্রেটাকে নিয়েই লেখা। এই কবিতায় বোনের রূপ তুলে ধরা হয়েছিল পৃথিবীর সমান্তরালে পরাবাস্তব জগতের আদলে। এছাড়াও ট্রাকলের রোজারি হিমস কবিতায় 'টু মাই সিস্টার' অংশে এমন কিছু চিত্রকল্প রয়েছে যা এই গল্পের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। যদিও পাঠক মাত্রই সবকিছু ব্যাখ্যা করতে চায় আক্ষরিক অর্থে, কবি-সাহিত্যিককে দাঁড় করায় নৈতিকতার কাঠগড়ায়। এতে দোষ নেই। তবে কিছু কিছু অসংজ্ঞায়িত সম্পর্ক থাক না নিজস্ব রহস্য নিয়ে। সমালোচকের দৃষ্টি এড়িয়ে। পুরোপুরি জানা হয়ে গেলে সেই সৌন্দর্যকেই হয়তো মনে হবে অজাচার।
পরবর্তী দিনগুলোতে রোডেরিকের মানসিক বিকার বাড়তে থাকে। একদিন ঝড়ের রাতে বিচিত্র সব শব্দে কথক ঘুমোতে পারে না। দেখতে পায় রোডেরিক একটি প্রদীপ হাতে তার দরজায় দাঁড়িয়ে। উদভ্রান্ত, আতঙ্কিত চেহারা। চারদিকটা নীরবে দেখে নিয়ে রোডেরিক তাকে প্রশ্ন করে—'তুমি কিছু দেখনি? তাহলে তুমি কিছু দেখনি? অপেক্ষা করো! দেখতে পাবে।' কথা বলতে বলতে হাতের বাতিটাকে আড়াল করে নিয়ে হঠাৎ জানালা খুলে দেয়। ঘরের বাইরে তখনও পুরদস্তুর ঝড়ের তাণ্ডব চলছে। তাকে শান্ত করতে কথক ল্যান্সলট ক্যানিংয়ের একটি বই পড়তে শুরু করে। যেখানে প্রটাগনিস্ট এথেলরেড শান্তিপূর্ণ পথে একজন সন্ন্যাসীর আশ্রমে ঢুকতে গিয়ে বাঁধা পেয়ে জোরপূর্বক ঢোকার চেষ্টা করে। কিন্তু ভেতরে ঢুকে সে দেখতে পায় সন্ন্যাসীর পরিবর্তে সেখানে বসে আছে একটি ড্রাগন। ড্রাগনটির মুখ থেকে বেরুচ্ছে আগুনের হলকা। মাথার ওপরে ঝকঝকে পেতলের ফলকে লেখা রয়েছে—'এখানে যে প্রবেশ করবে সে বিজয়ী আর ড্রাগনকে যে মারতে পারবে সে ফলক বিজয়ী!'
এথেলরেড হাতে গদা তুলে নিয়ে ড্রাগনটিকে আঘাত করলে গগনবিদারী চিৎকার করে সে মারা যায়। ক্যানিংয়ের গল্পে যখন ক্লাইম্যাক্স চলছে ঠিক তখনই আশারদের প্রাসাদ আলোকিত হয়ে ওঠে। কথকের মনে হতে থাকে হ্রদের কালো জল থেকে এই আলোকচ্ছটা উঠে এসেছে। এদিকে দরজার বাইরে ধাতব ঝনঝন শব্দ, সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ। কথক ভয়ে-আতঙ্কে বিপর্যস্ত অবস্থায় রোডারিকের দিকে তাকায়। দেখতে পায় রোডেরিকের দৃষ্টি দরজার দিকে নিবদ্ধ। সারাটা মুখে নেমে এসেছে ইস্পাত কাঠিন্য। যেন আঙ্ক্ষিত কোনো নিয়তির কাছে নিজেকে সঁপে সে আপন মনে চলেছে, আমি বড় হতভাগ্য! আমার সাহস হয়নি, কথা বলবার সাহস হয় নি। তাকে আমরা জীবন্ত সমাধিস্থ করেছি। তারপর কথককে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে— তোমাকে বলি নি আমার ইন্দ্রিয়গুলো খুব তীক্ষ্ণ হয়েছে? আজ তোমাকে আবার বলছি— ফাঁকা কফিনে তার নড়চড়ার ক্ষীণ শব্দ আমি শুনতে পেয়েছি। অনেক, অনেকবার শুনতে পেয়েছি। বলবার সাহস হয়নি। আজ যখন গল্পে এথেলরেড সন্ন্যাসীর দরজা ভাঙলো, ড্রাগনকে মেরে ফেলল। সেও আসছে। আমাকে মারতে। আমি কোথায় পালাব? কোথায় পালাব? সে তো এই মুহূর্তেই এখানে আসবে। হঠাৎ কথক দেখতে পায় দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ম্যাডেলিনের সমুন্নত অবয়ব। তার সাদা পোশাকে ছিল রক্তের দাগ। বিশীর্ণ দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল তীব্র সংগ্রামের চিহ্ন! মূহুর্তকালের জন্য ম্যাডেলিন চৌকাঠের ওপরে দাঁড়িয়ে, কাঁপতে কাঁপতে একটা আত্মচিৎকার দিয়ে রোডেরিকের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল। চরম মৃত্যুযন্ত্রণায় প্রচন্ড আবেগে ভাইকে জড়িয়ে ধরেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। এদিকে আতঙ্কের শিকার হয়ে রোডেরিকও তখন বিগতপ্রাণ।
গল্পের শেষভাগে অ্যালান পো'র লেখা 'ড্রিম উইথ ইন অ্যা ড্রিম' কবিতার সাদৃশ্য রয়েছে। বই পড়ে হবহু সেই ঘটনার মতন আরেকটা ঘটনা দেখবার অভিজ্ঞতা কথকের কাছে স্বপ্নের মধ্যে স্বপ্নই বটে। কথক প্রাণ নিয়ে কোন মতে আশারদের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসে। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় প্রাচীন প্রাসাদটি ফাটল বরাবর ভেঙে হৃদের জলে মিলিয়ে গেছে।
শুরুতে বলেছিলাম গল্পটি গথিক হরর। এটা চিত্রকর্ম, কল্পসাহিত্য ও চলচ্চিত্রের এমন একটি শাখা যেখানে কল্পনা, ভয়, আতঙ্ক, মৃত্যু কখনো সখনো প্রেমের মেলবন্ধন ঘটানো হয়। গথিক সাহিত্যের উৎস হিসেবে ধরা যেতে পারে হোরাস ওয়ালপোলের উপন্যাস দ্য ক্যাসল অফ অটরান্টো (১৭৬৪), যেটির দ্বিতীয় সংস্করণের উপশিরোনাম ছিল 'অ্যা গথিক স্টোরি'। এসব কল্পকাহিনীতে ভয় ও আতঙ্ক পাঠকদের আনন্দময়তার অনুভূতি দেয়, যাকে রোমান্টিসিজমের সম্প্রসারণ বলা যেতে পারে; সেসময় এটা ছিল একদম নূতন। ইংল্যান্ডে গথিক সাহিত্য চর্চা শুরু হয় আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং উনিশ শতকে তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেসময়ের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিকর্ম ছিল মেরি শেলীর (১৭৯৭-১৮৫১) ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন পাশাপাশি এডগার অ্যালান পো'র (১৮০৯-১৮৪৯) রচনাবলী। এই ধারার একটি দুর্দান্ত উপন্যাস লিখেছিলেন আইরিশ লেখক ব্রাম স্টোকার (১৮৪৭-১৯১২)। ড্রাকুলা নামের সেই উপন্যাসটি সাহিত্যজগতে সারা ফেলে দিয়েছিল। রোমান্টিসিজমের এই চরম রূপটি একসময় জার্মানিতেও প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়।
মনে প্রশ্ন জাগে—মাত্র চল্লিশ বছরের জীবনে নানাবিধ টানপোড়েন থাকা সত্ত্বেও সমসাময়িক সাহিত্যিকদের তুলনায় অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯) কেন এতটা এগিয়ে ছিলেন? ব্যক্তিগত টানাপোড়েন একদিকে তাকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছিল, তিনি সৃষ্টিতে পরিণত হয়ে উঠছিলেন। অন্যদিকে বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭) ও মালার্মে (১৮৪২-১৮৯৮) তাকে ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করে অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছিলেন। সাফল্যের পাল্লা আরও ভারী হয়ে উঠেছিল যখন ডি এইচ লরেন্স (১৮৮৫-১৯৩০) তাকে আমেরিকান ক্লাসিক সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন। দাঁড় না করে অবশ্য উপায়ও ছিল না। অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯) বিশ্বসাহিত্যে নূতন নূতন ম্যাটেরিয়াল যোগ করে যাচ্ছিলেন। ১৯৬০ সালে রজার কোরম্যানের আমেরিকান সংস্করণে—দ্য ফল অব দ্য হাউস অব আশার গল্পটিকে অ্যালান পো'র শ্রেষ্ঠ গল্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই গল্পে রোডেরিকের সঙ্গীতচেতনা, শিল্পবোধ, ভয়ের সঙ্গে নিয়ত সংগ্রাম, আতঙ্ক ও অতীন্দ্রিয়তা সর্বোপরি ম্যডেলিনের ও তার যুগল মৃত্যু পাঠককে ডার্ক ফ্যান্টাসির দিকে টেনে নিয়ে যায়। পাঠকেরা পরাবাস্তব কোন জগতে পরিভ্রমণ করতে থাকেন। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা কথকের ভূমিকায় পাঠক যেনো নিজেকেই দেখতে পান।