ইলিয়াস ভাইয়ের বিষবৃক্ষের বিষ ও মধু

সমাজ-ইতিহাসের অনেক বড় ঘটনার বহুমুখি অভিঘাতকে শিল্পরূপ দেওয়ার জন্যই লোকজীবনের গভীর থেকে এগুলো তুলে এনেছেন।

গোলাম ফারুক খানগোলাম ফারুক খান
Published : 4 Jan 2023, 06:57 AM
Updated : 4 Jan 2023, 06:57 AM

আমাদের গ্রামের পরানের থুত্থুরে দাদি এক ভোররাতে খোয়াবে দেখলেন, পশ্চিমের পথ ধরে একটা ভয়াল কবন্ধ গড়িয়ে গড়িয়ে গ্রামে ঢুকছে। ধড়মড় করে উঠে খোয়াবের কথা সবাইকে জানালে ভোর হতে না হতেই সারা গ্রামে ঢ্যাঁড়া পড়ে গেল। রুদ্ধশ্বাসে সবাই এক আসন্ন দুর্দৈবের অপেক্ষা করতে থাকল। দুদিন যেতে না যেতেই কলেরায় গ্রামের তিন-তিনটা পাড়া উজাড়। কোনো কোনো বাড়িতে সন্ধ্যায় চেরাগ দেওয়ার লোকও রইল না। আমাদের জুকা বিলের সংযোগ-খালের মুখ যে শত বছর ধরে এক দেওয়ের পাহারায় ছিল তা গ্রামের ছেলেবুড়ো কে না জানে! কতজনই তো রাতবিরেতে সেখানে মাছ ধরতে গিয়ে শ্যাওড়া গাছের মাথায় সেই আসমানজোড়া দেওয়ের উলটো পা দেখে জাল-বড়শি ফেলে পালিয়ে বেঁচেছে! এসব অভিজ্ঞতার গল্প বাংলাদেশের দেশগেরামে হাজার বছর ধরে অজস্রধারায় উৎসারিত হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষরা শুনেছেন, আমরা শুনেছি। স্তিমিত জনস্মৃতিতে জোরে টোকা দিলে আজও অনেক আশ্চর্য কথাকাহিনি বেরিয়ে আসে।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-১৯৯৭) তাঁর দুটো উপন্যাসের প্রশস্ত ক্যানভাসে নিপুণ শিল্পীর হাতে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে স্মৃতি-শ্রুতির এইসব মণিরত্ন গেঁথে তুলেছেন। প্রথম উপন্যাস 'চিলেকোঠার সেপাই' (১৯৮৬)-এ পাই যমুনা নদীতে ঘোড়ার হাঁকডাকের জনশ্রুতি। কোনো বড় ধরনের বালা-মুসিবত, সংকট, বিপর্যয় এ জনপদের মানুষের সামনে এলেই রাতের যমুনা নদীতে শ দুয়েক ঘোড়া একসঙ্গে ডেকে তা জানিয়ে দেয়। সে ডাক এমনই তরাসজাগানো যে তা শুনে বাইরের মানুষ নীরবে ঘরে সেঁধিয়ে যায়। দ্বিতীয় উপন্যাস 'খোয়াবনামা' (১৯৯৬)-তে দেখি রাতের বেলায় কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে পাকুড়গাছের মাথায় এক অলৌকিক মুনশি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তার গলায় শেকল জড়ানো আর গতর ছাইভস্মমাখা। দিনের বেলা রোদ হয়ে সে ছড়িয়ে থাকে সারা বিলজুড়ে আর রাতভর বিল শাসন করে ওই পাকুড় গাছের ওপর থেকেই। মুনশির হুকুমে বিলের গজার মাছগুলো রাতের বেলায় ভেড়ার পাল হয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে সাঁতার কাটে। সারা এলাকায় চেরাগ আলি ফকিরের গান ভেসে বেড়ায়: 'সিথানে পাকুড়গাছ মুনসির বসতি।/তলায় গজার মাছ অতি হিংস্রমতি।।/গভীর নিশিতকালে মুনসির আদেশে।/বিলের গজার মাছ রূপ লয় মেষে।।'

কিন্তু আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ভূতপ্রেতের গল্প বলার জন্য এসব অলৌকিক বিষয়ের অবতারণা করেননি। সমাজ-ইতিহাসের অনেক বড় ঘটনার বহুমুখি অভিঘাতকে শিল্পরূপ দেওয়ার জন্যই লোকজীবনের গভীর থেকে এগুলো তুলে এনেছেন। 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসে ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনির উৎস হলো আঠারো শতকের ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ফকির মজনু শাহ গঙ্গা পার হয়ে পালাবার সময় মারা যান বিহারের এক গ্রামে। লোকবিশ্বাস হলো, তাঁর মৃত্যুর সময় সব জায়গায় ফকিরদের অশ্বারোহী বাহিনীর ঘোড়াগুলো একসঙ্গে চিৎকার করে সবাইকে সতর্ক করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। যমুনার চরেও হয়ত সে বাহিনীর একটি অংশ ছিল। যেকোনো দুর্যোগের আগে যমুনার গভীর থেকে সেই ঘোড়ার ডাক আজও জেগে ওঠে। এদিকে 'খোয়াবনামা'র পাকুড় গাছের মুনশি হচ্ছেন মজনু শাহর একজন অনুসারী মুনশি বয়কতুল্লাহ শাহ। বিদ্রোহী ফকিরদের সঙ্গে মহাস্থান কেল্লার দিকে যাওয়ার জন্য করতোয়ার দিকে ছুটতে ছুটতে তিনি গোরাদের সর্দার টেলরের গুলিতে মরে ঘোড়া থেকে পড়ে যান। কিন্তু মরার পর ঘটে এক অদ্ভুত ঘটনা -- নকশা-আঁকা লোহার পান্টি হাতে উঠে বসেন কাৎলাহারের পাকুড় গাছের মাথায়। সেই থেকে তাঁর কাজ বিল পাহারা দেওয়া।

উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের নগরে ও গ্রামে যে বিপুল আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা-ই 'চিলেকোঠার সেপাই'য়ের মূল উপজীব্য। ব্যক্তিজীবনের নানা দ্বন্দ্ব ও টানাপোড়েন তো এখানে আছেই। অন্যদিকে সাতচল্লিশের বাংলাভাগ গ্রামের কৃষক ও বৃত্তিজীবী শ্রেণির ওপর যে বিচিত্র অভিঘাত সৃষ্টি করেছিল তার এক মহাকাব্যিক রূপায়ণ 'খোয়াবনামা।' এভাবে বললে আসলে কম বলা হয়। এ উপন্যাস আরো অনেক কিছু -- সমাজ-সংস্কৃতি ও ইতিহাস মিলিয়ে বাংলার গ্রামসমাজের এক নিবিড় পাঠ। আমাদের অনেক প্রচলিত ধারণা সম্পর্কেই তা প্রশ্ন তোলে। নানারকম লোকবিশ্বাস, কিংবদন্তি, প্রবাদ-প্রবচন, গান ও ছড়ার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে উপন্যাসের দ্বন্দ্বময় জগৎ।

এ দুটো বইয়ের ভেতর দিয়ে ইলিয়াস উপন্যাসের ভূমিকা সম্পর্কে নিজস্ব একটি বোধে এসে পৌঁছেছিলেন। একটি সার্থক উপন্যাসকে মানুষের প্রতিদিনকার জীবনে কোনো গভীর সত্য বা প্রশ্নের উন্মোচন করতে হয়। পাঠককে প্রচলিত মূল্যবোধ বা সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনো জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাতে হয়। এই ছিল তাঁর উপলব্ধি। দেশ-বিদেশের অনেক উপন্যাস পাঠ এবং দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি এ জায়গায় আসতে পেরেছিলেন। বিশেষ প্রেরণা পেয়েছিলেন আফ্রিকার উপন্যাস থেকে। নাইজেরিয়ার চিনুয়া আচেবে ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় কথাসাহিত্যিক। আচেবের লেখায় আফ্রিকার লোকবিশ্বাস ও লোকপুরাণের সহজ ব্যবহার তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।

বাংলা ছোটগল্পের জগতেও আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কীর্তিমান। বস্তুত গল্প দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু এবং গল্পের সীমিত পরিসরে জীবনের গভীর সত্য উন্মোচনের শিক্ষা তাঁকে এগিয়ে দিয়েছিল উপন্যাসের বিস্তৃত ভুবনে। ১৯৬০ সালে 'সমকাল' পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর প্রথম পরিণত গল্প 'স্বগত-মৃত্যুর পটভূমি' পাঠকদের নজর কেড়েছিল। সে গল্প ছিল তখনকার আধুনিকবাদী চেতনার প্রকাশ -- এক ছায়া-ছায়া, ধোঁয়াটে জগতে অবরুদ্ধ আত্মার আর্তি। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য গল্প 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'ও নিজের ভেতরে গুমরে-মরা এক অসুখী আত্মার রোমান্টিক চাপাকান্না। ধীরে ধীরে তিনি এসে দাঁড়ান এমন এক জায়গায় যেখানে ছোটগল্প মানে শল্যবিদের হাতে নির্মোহ ছুরি। সমাজকে কাটাছেঁড়া করে তার ভেতর থেকে বের করে এনেছেন পুঁজ-রক্ত-বিষ। 'উৎসব' এমনই এক দয়ামায়াহীন গল্প। হাসান আজিজুল হক তাঁর একটি প্রবন্ধের নাম দিয়েছিলেন 'আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষ।' অনেক গল্পে, হাসান আজিজুল হকের ভাষায়, 'মধ্যবিত্ত সংকীর্ণ জীবনকে তিনি জুতোপেটা করেছেন।' আবার 'যোগাযোগ'-এর মতো মানবিক রসে টইটম্বুর গল্পও লিখেছেন যেখানে মানুষের মায়া-মমতা উথলে ওঠে। এমন গাঢ় জীবনরসের নিঃসার তাঁর উপন্যাসেও কি নেই? পুরান ঢাকার জীবনের সরস চিত্রায়ন এবং নানা খুঁটিনাটির নিখুঁত বর্ণনায়ও তাঁর গল্প বিশিষ্ট। হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধের শিরোনাম যথার্থই তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বিষবৃক্ষে যেমন বিষফল ফলেছে, তেমনি তা থেকে মধুও ঝরেছে।

'অন্য ঘরে অন্য স্বর' (১৯৭৬), 'খোঁয়ারি' (১৯৮২), 'দুধভাতে উৎপাত, (১৯৮৫), 'দোজখের ওম' (১৯৮৯), 'জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল' (১৯৯৭) -- এই পাঁচটি বই নিয়ে ইলিয়াসের গল্পের সংসার। তাঁর একটি মাত্র প্রবন্ধের বই 'সংস্কৃতির ভাঙা সেতু' (১৯৯৮) চিন্তার নিজস্ব দ্যুতিতে এখনো অম্লান।

তিনি দীর্ঘদিন লেখক শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাংগঠনিক কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা দেশ। উপন্যাসের প্রয়োজনেও প্রচুর ঘোরাঘুরি করতেন বিশাল বাংলায়। সমাজ-সংস্কৃতি, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর গভীর কৌতূহল ও প্রজ্ঞা ছিল। এইসব লিপ্ততা তাঁর দেখার চোখকে আরো অন্তর্ভেদী করে তুলেছিল।

কিশোর-বয়সে পুরোনো 'সমকাল'-এর পাতায় 'স্বগত-মৃত্যুর পটভূমি' পড়ার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তেমন কিছু আহরণ করতে পারিনি। লেখকের সঙ্গে পরিচয়ের সুযোগ হয়েছিল আশির দশকে। তাঁর পুরান ঢাকার বাসায়। প্রয়াত বন্ধু আবু মোহাম্মদ বাবলু নিয়ে গেছিলেন। প্রথম পরিচয়ের জড়তা কাটিয়ে অনায়াসে তিনি ইলিয়াস ভাই হয়ে যান। বন্ধু নাঈম হাসান সম্পাদিত 'নিরন্তর' সাহিত্যপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে পরে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। পেশাগত কাজে যোগাযোগের সূত্রেও। অনেকদিন তাঁর বাসায় আড্ডা দিয়েছি। সেখানেই কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে দীর্ঘ আলাপের সুযোগ হয়েছিল। মহাশ্বেতা দেবী ইলিয়াস ভাই সম্পর্কে বলতেন: 'আমরা কী আর লিখলাম, লিখেছে তো ইলিয়াস!' নাঈম হাসানের বাসায় অনেক রাতেও আড্ডায় আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। অসাধারণ উচ্ছল ও সহজ মানুষ ছিলেন ইলিয়াস ভাই। তাঁর সরস মন্তব্য আর প্রাণখোলা হাসি ভোলার নয়। মাত্র ৫৩ বছরের আয়ু ছিল তাঁর। এই সংক্ষিপ্ত জীবনে অল্প লেখার মধ্য দিয়েই তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক দিয়েছেন। বিশাল মাপের মানুষটির কাছ থেকে যে স্নেহ ও শিক্ষা পেয়েছি তা এই দীন জীবনের মলিন বসনে হীরের ফুল হয়ে ফুটে আছে।

তাঁর সম্পর্কে লেখার প্রসঙ্গ আছে অজস্র। অনেকে লিখেছেন এবং লিখছেনও। আমার অতি সামান্য কিছু কথা দিয়ে আজ মৃত্যুদিনে তাঁকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই।