আগা শহীদ আলী এই কবিতায় ঢাকার সুক্ষ্ণ মসলিন কাপড়ের মর্যাদা ও কদর সম্পর্কে তার দাদীর প্রশংসার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন।
Published : 04 Jan 2025, 04:11 PM
ঢাকাই মসলিন
....পুরো এক বছর ধরে, তিনি ঢাকাই মসলিনের অতি-সূক্ষ্ম নমুনাগুলি সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিলেন।
-অস্কার ওয়াইল্ড/দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে
সেই স্বচ্ছ ঢাকাই মিহি কাপড়
যা বোনা বায়ু, প্রবাহিত জল,
কখনও সন্ধ্যার শিশির নামে পরিচিত:
একটি মৃত শিল্প এখন, একশ বছরেরও
অধিক কাল ধরে মৃত।
"কেউ জানে না এখন," আমার দাদী বলেন,
"কি যে সে কাপড়, যেমন পড়তে
তেমন স্পর্শে।" একবার তিনি পরেছিলেন,
উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া একখানি শাড়ি
তার মায়ের বিয়ের শাড়ি, একেবারে খাঁটি প্রমাণিত হয়েছিল
যখন ছয় গজের পুরো কাপড়টি একটি আংটির মধ্যে দিয়ে
গলিয়ে আনা গিয়েছিল।
বহু বছর পরে, যখন শাড়িটি ছিঁড়ে যায়,
তখন সোনালী জরির সূতোয় অনেকগুলো
নকশাঁ-কাটা রুমাল সূচিকর্ম করা হয়
রুমালগুলো বিলিয়ে দেয়া হয়েছিল
ভাইঝি ও পুত্রবধূদের মাঝে।
সেসবও এখন হারিয়ে গেছে।
ইতিহাসে আমরা শিখেছি: তাঁতিদের
হাত কেটে ফেলা হয়েছিল,
বাংলার তাঁতগুলো নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল,
এবং কাঁচা তুলা ব্রিটিশরা জাহাজ
ভরে ইংল্যান্ডে পাঠাতো।
তার সামান্য ব্যবহারের ইতিহাস,
আমার দাদী শুধু বলেন,
আজকের মসলিন কেমন যেন
এত কর্কশ মনে হয় এবং শুধুমাত্র
শরৎকালে, কেউ যদি ভোরে নামাজ আদায়ের জন্য
ঘুম থেকে ওঠে, তবে সে কি
আবার সেই একই বুনট অনুভব করতে পারবে।
একদিন সকালে, তিনি বলেন, বাতাস
শিশির-মাখা ছিল: আনমনে তিনি
তার আংটির মধ্যে দিয়ে সেটিকে টানছিলেন।
..........................
অনুবাদ ও ভূমিকা: আসাদ মিরণ
..........................
ডব্লিউ.ডব্লিউ নর্টন অ্যান্ড কোম্পানী কর্তৃক প্রকাশিত "নর্টন অ্যান্থোলজি অফ পোয়েট্রি" হল বেশ কয়েকটি সাহিত্য সংকলনের মধ্যে একটি। ১৯৭০ সাল থেকে এটি প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমানের এটি সপ্তম সংস্করণে রয়েছে। এই সংস্করণগুলির এক একটিতে সারা পৃথিবী থেকে ১৭০০-১৮০০ এর অধিক কবিতা স্থান পায়। তাই অনেকেই "নর্টন অ্যান্থোলজি অফ পোয়েট্রি"-সংকলনগুলিকে কবিতার ধর্মশাস্ত্র হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এই সংকলনের চতুর্থ সংস্করণে আগা শহিদ আলীর দু'টি কবিতা স্থান পেয়েছে। তার একটি হল "ঢাকাই মসলিন।" (কবিতা নং-১৮৩৫, পৃষ্ঠা নং-১৯৮৭)
আগা শহীদ আলী (১৯৪৯-২০০১): নতুন দিল্লিতে কবির জন্ম। বেড়ে উঠেছেন কাশ্মীরে। তিনি আধুনিক মুক্ত পদ্যের সাথে ঐতিহ্যগত বিন্যাস একত্রিত করে আলাদা এক বৈচিত্র্যের জন্ম দিয়েছেন। তার কাব্যে একদিকে যেমন হিন্দু-মুসলিম, অন্যদিকে পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক ঐতিহ্যও প্রতিফলিত হয়, যা তাকে সংস্কৃতির আন্তঃসম্পর্ক এবং সার্বজনীন মানব অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ করে।
১৯৮৭ সালে আগা শহীদ আলী "ঢাকাই মসলিন" কবিতাটি রচনা করেন। প্রায় সমান দৈর্ঘ্যের তিনটি লাইনের সমন্বয়ে মোট এগারটি স্তবক নিয়ে কবিতাটির গঠন। সেখানে তিনি হারিয়ে যাওয়া অতীতকে পুনরুজ্জীবিত করতে এবং নস্টালজিয়ার গভীর অনুভূতি উস্কে দিতে কাব্যিক হাতিয়ার হিসেবে একটি শক্তিশালী চিত্রকল্পকে কাজে লাগান। কবিতাটি অস্কার ওয়াইল্ডের উপন্যাস "দ্য পিকচার অক ডোরিয়ান গ্রে"-এর একটি এপিগ্রাফ দিয়ে শুরু হয়েছে, যেখানে ১৭ এবং ১৮ শতকে ঢাকায় তৈরি চমৎকার মসলিন কাপড়ের প্রশংসা করা হয়েছে।
আগা শহীদ আলী এই কবিতায় ঢাকার সুক্ষ্ণ মসলিন কাপড়ের মর্যাদা ও কদর সম্পর্কে তার দাদীর প্রশংসার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। কবি সেখানে প্রাণবন্তভাবে মসলিনকে একদিকে যেমন দুর্লভ, স্বচ্ছ বলে বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে সেটিকে বাতাসের মতো সুক্ষ্ণ, প্রবাহিত জল আর সন্ধ্যার শিশিরের স্নিগ্ধতায় উদ্ভাসিত করেছেন।
এই রূপকগুলি মসলিন কাপড়ের উচ্চমার্গ এবং ব্যতিক্রমী প্রকৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে। কবিতার মধ্যে, মসলিন কাপড়ের নির্ভেজালত্ব এবং তার কারুকার্য বা শিল্পকুশলতা একটি পরীক্ষামূলক আচারিক-পর্বের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। কাপড়টি একটি আংটির মধ্যে দিয়ে গলিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল, যা কাপড়ের মৌলিকতা ও উচ্চতর কারুকার্যের একটি প্রতীকী শুদ্ধতা। কবির দাদি উত্তরাধিকার সূত্রে ঠিক এ রকম একটি মূল্যবান শাড়ি লাভ করেছিলেন, যা আংটির মধ্য দিয়ে সফল উত্তরণের মাধ্যমে খাঁটিত্বের সাক্ষী বহন করে।
কবির দাদী এই চমৎকার শিল্পকর্ম হারিয়ে যাবার জন্য পরিতাপ করেছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে ঢাকাই মসলিনের সৌন্দর্য ও তাৎপর্য এখন প্রায় বিস্মৃত। যে কাপড় এক সময়ে মানুষ শ্রদ্ধা ও গর্বের সাথে পরত, তা এখন শুধুই অতীতের এক ধ্বংসাবশেষ বা স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে বিদ্যমান। ছেঁড়া কাপড়ও কখনও কখনও মূল্যবান হয়। তাইতো মসলিন শাড়ির মলিনতার অবশিষ্টাংশ দিয়ে মূল্যবান রুমাল তৈরী করা হয়েছিল এবং সেগুলি ভাইঝি ও পুত্রবধূদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল।
সময়ের সাথে সাথে, সেই রুমালও হারিয়ে গেছে। বছরের পর বছর কেটে গেছে, কাপড়ের ভৌত অবশিষ্টাংশ ক্ষয়ে গেছে। কেবল বিবর্ণ স্মৃতি এবং অতীতের সাথে সংযোগের জন্য কবির আকাঙ্ক্ষাটুকু রেখে গেছে। এক সময়ের মূল্যবান শৈল্পিকতার প্রতিনিধিত্ব করা রুমাল, অধরা হয়ে উঠেছে এবং কালের বালুচরে হারিয়ে গেছে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য কারণেও কবিতাটি ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহন করে। সেখানে দেখা যায়, মসলিন তাঁতীদের অন্ধকার ইতিহাস সন্ধান করার সাথে সাথে কবিতাটি একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকে মোড় নিয়েছে। যেখানে, নিষ্ঠুর নিপীড়ক হিসাবে চিত্রিত ব্রিটিশ উপনিবেশকারীরা তাঁতিদের হাত কেটে ফেলেছিল, তাঁতগুলিকে নীরব এবং বাংলার শিল্পোৎপাদন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল। তারা মসলিন তৈরির জন্য ব্যবহৃত তুলা ইংল্যান্ডে পাঠাতো, এভাবে স্থানীয় সম্পদের শোষণকে তীব্রতর পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে এই ঐতিহাসিক নিপীড়ন এবং শোষণের আখ্যান, মসলিনের জন্য কবির দাদীর শ্রদ্ধা ও প্রশংসার যেন সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান নির্ণয় করে।
যদিও বর্তমান বাজার মসলিন কাপড় তৈরী করার চেষ্টা করছে, তবুও কবিতাটি ইঙ্গিত দেয় যে তার পরিমার্জন (মিহি) ও গুণগতমান ঠিক অতীতের মতো নয়। উৎপাদকরা এটিকে যতই মিহি করার চেষ্টা করুক না কেন, তা আসল মসলিনের নির্ভেজালত্ব এবং শৈল্পিকতার সাথে মেলে না।
সামগ্রিকভাবে, আগা শহীদ আলীর "ঢাকাই মসলিন" কবিতাটি সুক্ষ্ণ মসলিন কাপড়ের হারিয়ে যাওয়া মূল্য ও শৈল্পিকতার জন্য একটি গভীর এবং নস্টালজিক আকাঙ্ক্ষাকে চিত্রিত করেছে। এটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং কারুশিল্পের একটি মর্মস্পর্শী স্মারক হিসাবে কাজ করে যা ইতিহাসের ধ্বংসলীলায় ছাপিয়ে গেছে। উপরন্তু, কবিতাটি ঔপনিবেশিক নিপীড়ন ও শোষণের অন্ধকার ইতিহাসের উপর আলোকপাত করে। প্রাণবন্ত চিত্র এবং ব্যক্তিগত প্রতিফলনের মাধ্যমে, কবি আমাদের সম্মিলিত অতীতকে সংরক্ষণ ও সম্মান করার তাৎপর্য তুলে ধরেন। ক্ষতি এবং পরিচয়ের সার্বজনীন ভাবনাগুলিকে বন্দি করে, "ঢাকাই মসলিন" পাঠকদের একটি সংস্কৃতি মুছে ফেলার স্থায়ী প্রভাব নিয়ে চিন্তা করার আমন্ত্রণ জানায়৷