যে-ভাষার সাহিত্য হয়তো কোনো-না-কোনোভাবে আছে, কিন্তু কথ্যভাষা রূপে তার আর অস্তিত্ব নেই, সে-ভাষাও মৃত।
Published : 21 Feb 2025, 10:57 AM
ভাষার ইতিহাস হল ভাষার মৃত্যুর ইতিহাস। আসলে মৃত্যু থেকে পরিত্রাণের ইতিহাস।
যেমন, নাম তার জানা যায়নি। প্রাচীন সভ্যতার দেশ ইথিওপিয়ার মানুষ ছিল সে। পৃথিবীতে একমাত্র সে-ই, যে ছিল মেসমেসভাষী। দুহাজার সালে, আন্দাজ আশি বছর বয়সে, মারা যাওয়ার আগে, দীর্ঘ তিরিশ বছর এই পৃথিবীতে ছিল সম্পূর্ণ একা। সঙ্গী না-থাকার জন্য কথাও বলতে পারেনি এত-এত বছর। অথচ তার মেসমেসভাষা কোনো আদিম পরিবারভুক্ত ছিল না। ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ সেমিটিক গোত্রের। তবু লোকটি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষাটি সরকারিভাবে মুছে গেছে।
এরকম কত-কত ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ থেকে, সেসবের খবরই আমরা রাখি না। যেমন উইলিয়াম রোজারিও। একজন ইন্দো-পর্তুগিজ মানুষ। সে ছিল কেরলের কোচি-এলাকার। পর্তুগিজ-ভিত্তিক ক্রেওলভাষী ছিল সে। দুহাজার দশ সালের অগাস্টে মারা যায়। আর সেইসঙ্গে তার ভাষাও চিরকালের জন্য চলে যায় কবরের অন্ধকারে।
তার দশ বছর আগেই, দুহাজার সালে, বিশ্বব্যাপী মোট প্রায় ৭,০০০ ভাষা মুখর ছিল। এর মধ্যে সর্বাধিক বিলুপ্তির আশঙ্কায় দিন গুনছিল ক্ষুদ্র ভাষাগুলো। দুহাজার চার সালে প্রকাশিত একটি অনুমানে বলা হয়েছিল, দুহাজার পঞ্চাশ সালের মধ্যে কথিত ভাষাগুলোর প্রায় ৯০% বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আশঙ্কা কি হয় না-যে ওই ৯০% ভাষার ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যানে আমার ভাষা বাংলা নেই তো?
দুই
অনেক ভূখণ্ডে দীর্ঘ দিন ধরে পাশাপাশি একাধিক ভাষা মিলেমিশে রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবিক কি তাই? আমার ভাষাটি বিলুপ্ত ভাষায় রূপান্তরিত-যে হচ্ছে না, বুঝব কী করে? পাশের ভাষাটি একটু একটু করে আমার ভাষাকে দখল করে ফেলে আমার মাতৃভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টায় নেই তো? এই-যে বলছি, কেন কি; বলছি, জানকারি; বাংলা শব্দের সহজ রূপ কাঁচি বাদ দিয়ে বলে ফেলছি, কেঁচি; এভাবে আত্মসর্বনাশে আমরা মগ্ন হয়ে নেই তো? এমনিতেই ঔপনিবেশিকতার চাপে হাজারো ইংরেজি শব্দের ভার তো রয়েইছে; বরং ইংরেজি মাধ্যমের ঝলকানিতে সে ভার বাড়ছে। আগের থেকেই আছে পর্তুগিজ ভাষার বৈচিত্র। তার উপর ফ্রেঞ্চ, স্পানিশ ভাষার জেল্লায় আমরা অভিভূত। একসময় আরবি-ফার্সির চাপে কত-কত বাংলা শব্দ হারিয়ে গেছে, তার ইয়ত্তা নেই। যেমন— গরম। সামনে চৈত্র মাস আসছে। তখন, বেশ গরম পড়েছে-যে বলব, ভেবে দেখেছি কি, আগে এই বাক্যটিকে আমরা কেমন ভাবে বলতাম?
এছাড়া ভাষা-বিলুপ্তির আরো দুটো পরস্পরবিরোধী রূপ আছে। এক. কোনো কথ্য ভাষার সাহিত্য না থাকলে, সে-ভাষা, ধরে নিতে হবে, মৃত্যুর দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। দুই. যে-ভাষার সাহিত্য হয়তো কোনো-না-কোনোভাবে আছে, কিন্তু কথ্যভাষা রূপে তার আর অস্তিত্ব নেই, সে-ভাষাও মৃত। যেমন সংস্কৃত। যেমন লাতিন।
অনেক ধর্মগ্রন্থের ভাষাও শুকিয়ে মরে গেছে চর্চার অভাবে। মিল্টন, রেনে দেকার্ত প্রমুখ অমিত প্রতিভাবান ব্যক্তিগণ ইংরেজির পাশাপাশি তাঁদের অনেক লেখাই লাতিন ভাষায় লিখেছিলেন টেকসই হবে ভেবে। কিন্তু হল তার উলটো। ইংরেজি টিকে গেল আর লাতিন হল বিলুপ্ত। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মহাপরাক্রমশালী ভাষা সংস্কৃতও স্রেফ ধর্মগ্রন্থ, ধর্মোপসনালয়ে ও আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ থেকে আজ প্রাণহীন। তবে? কোন উপায়ে বাঁচবে আমার ভাষা?
‘ভাষাশিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “ভাষামাত্রেরই একটা মজ্জাগত স্বভাব আছে, তাকে না মানলে চলে না। স্কটল্যাণ্ডের ও ওয়েল্সের লোকে সাধারণত আপন স্বজন-পরিজনের মধ্যে সর্বদাই যে-সব শব্দ ব্যবহার করে থাকে তাকে তারা ইংরেজি ভাষার মধ্যে চালাবার চেষ্টামাত্র করে না। তারা এই সহজ কথাটি মেনে নিয়েছে যে, যদি তারা নিজেদের অভ্যস্ত প্রাদেশিকতা ইংরেজি ভাষায় ও সাহিত্যে চালাতে চায় তা হলে ভাষাকে বিকৃত ও সাহিত্যকে উচ্ছৃঙ্খল করে তুলবে। কখনো কখনো কোনো স্কচ লেখক স্কচ ভাষায় কবিতা প্রভৃতি লিখেছেন কিন্তু সেটাকে স্পষ্টত স্কচ ভাষারই নমুনা স্বরূপে স্বীকার করেছেন। অথচ স্কচ ও ওয়েল্স ইংরেজের সঙ্গে এক নেশনের অন্তর্গত।…
‘বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পারসী আরবী শব্দ চলে গেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যে-সব পারসী আরবী শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তো কোনো-এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে।…
‘উর্দু ভাষায় পারসী ও আরবী শব্দের সঙ্গে হিন্দী ও সংস্কৃত শব্দের মিশল চলেছে—কিন্তু স্বভাবতই তার একটা সীমা আছে। ঘোরতর পণ্ডিতও উর্দু লেখার কালে উর্দুই লেখেন, তার মধ্যে যদি তিনি ‘অপ্রতিহত প্রভাবে’ শব্দ চালাতে চান তা হলে সেটা হাস্যকর বা শোকাবহ হবেই।’
তিন
পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি, মাতৃভাষাকে রক্ষা করার জন্য যে-জাতি লড়াই করেছে। প্রাণ দিয়েছে। তাই বলে সেই পুণ্যে তার ভাষা চিরনিরাপত্তা ভোগ করবে— এমনটা আশা করা মূর্খামি। ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিবে যায় বারেবারে।’ ঘাস কাটা হয় বাগানের, আবার ঘাস গজিয়ে জঙ্গলে ভরে যায় বাগান। তাই একবার পথে নেমে, একবার বিপ্লব করে, প্রাণ দিয়ে, ভাষার নিরাপত্তা রক্ষা সম্ভব নয়। পুনঃপুন জাগরূক থাকতে হয় জাতিকে। যখন বহিঃশত্রুর মোকাবিলা করতে হবে, দরকার হবে তখন আন্দোলন করার। প্রাণ দেওয়ারও। কিন্তু ভেতরের শত্রুকে পরাজিত করতে বেশি দরকার ভাষাকে খোঁচা মেরে-মেরে জাগিয়ে রাখার।
ভাষাকে অন্তরের মধ্যে জাগিয়ে রাখব কী করে? যেভাবে সব ভাষার বড়ো বড়ো কবি-সাহিত্যিকরা করেছেন। যেমন আমাদের রবীন্দ্রনাথ করেছেন, যেমন জীবনানন্দ। ‘মানসী’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—
‘মনে করি হল বলা ছিল যাহা বলিবার।
হয়তো তোমার ভাবে তুমি এক বুঝে যাবে,
আমার মনের মতো আমি বুঝে যাব আর—
নিশীথের কন্ঠ দিয়ে কথা হবে দুজনার।’
এই-যে ‘নিশীথের কণ্ঠ’, সেই কণ্ঠ দিয়ে বলার প্রয়াস, পৃথিবীর আলোবাতাসের চেয়েও অপার্থিব এক চেষ্টা, ব্যবহারিক জীবনে বা কবিতায় তার সফল প্রকাশ: কোনো শঙ্কিত আলো যদি অন্ধকারে জ্বলে ওঠে, সে-আলোর প্রতাপ যে-কোনো বিরুদ্ধ শক্তিকে জয় করতে পারে।
তার জন্যে দরকার সাহিত্য। সেই সাহিত্য রচনা করবার জন্যে চাই কল্পনাশক্তি আর চিন্তা, চাই মনন।
তেমন সাহিত্যের অপেক্ষায় একটা জাতি শতবর্ষ অপেক্ষা করে থাকতে পারে।
সর্বদা বাঙময় হতেই হবে, তার মানে নেই। নীরবতাকে মুখর করে তুলতে পারেন কবিই। ওই ‘মানসী’ গ্রন্থেরই ‘মৌন’ কবিতায় কবি লিখছেন:
‘আরো ঊর্ধ্বে দেখো চেয়ে অনন্ত আকাশ ছেয়ে
কোটি কোটি মৌন দৃষ্টি তারকায় তারকায়।
প্রাণপণ দীর্ঘ ভাষা জ্বলিয়া ফুটিতে চায়।’
এ তো শহিদের রক্তের সমতুল্য! নাকি অধিক?