Published : 20 May 2024, 07:58 PM
'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন' নামের লাল রঙের বহন-বান্ধব পেপারব্যাক বইটি সামনে ধরে রেখে পড়ছি আর ইউটিউবের প্লে-লিস্ট থেকে কানে বাজছে টার্কিশ বাঁশিতে রুমির সুফি সুর। সুরটা অভাবনীয় রকমের শান্ত, কিন্তু তীব্র এবং গভীর। বইটিও তাই। এ বছর বইমেলায় বের হয়েছে বইটি। মুহম্মদ মুহসিন রচিত 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন' বাংলা ভ্রমণ সাহিত্য জগতে নতুন একটি বই হিসেবে যুক্ত হলো। সেই সাথে সৈয়দ মুজতবা আলীর রম্য-বৈঠকে একজন একনিষ্ঠ 'চ্যালা'র সন্ধানও পাওয়া গেলো।
'কুসতুনতুনিয়া' হলো বর্তমান ইস্তাম্বুল। নগরটি বাইজেন্টাইনদের কব্জায় থাকা অবস্থায় 'কনস্টান্টিনোপল' নাম ছিলো। যার অর্থ কন্সটান্টাইনের শহর। পরবর্তীকালে ফাতিহ সুলতান মুহাম্মদ কন্স্টান্টিনোপল জয় করে, এর নাম পরিবর্তন করে রাখেন 'ইস্তাম্বুল' (মতান্তরের 'ইসলামবুল', অর্থাৎ ইসলামের শহর) এ নামটিই এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে।(সূত্র: উইকিপিডিয়া)
এটা জানার পর এবং বাবা উইকিপিডিয়া ও মামা গুগলকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো লেখক কেন বইয়ের নাম 'ইস্তাম্বুলে কয়েকদিন' না দিয়ে 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন' দিলেন।
কারণটা আমার কাছে মি. ক্লিন দিয়ে পরিষ্কার করা অতি আধুনিক কর্পোরেট অফিসের গ্লাসের মতো ঝকঝকে হয়ে গেলো। মহানবি (স.) যখন মুসলমানদের 'কুসতুনতুনিয়া'য় যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং আমাদের লেখকও মাশাআল্লাহ যথেষ্ট ধর্মপ্রাণ বলেই মনে হয়েছে, তখন 'ইস্তাম্বুলের' বদলে 'কুসতুনতুনিয়া' দেয়াটাই যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে আমার কাছে। আর ইস্তাম্বুল তো সবার এখতিয়ারের মধ্যের অঞ্চল। মামা গুগলের শরণাপন্ন না হয়েও ইস্তাম্বুল সম্পর্কে সবাই ওয়াকিবহাল। আর এদিকে গুগল মামার সহযোগিতা ছাড়া 'কুসতুনতুনিয়া' সম্পর্কে তারাই জানেন যারা ইসলামি পণ্ডিত আহ্মাদ বিন হানবাল দ্বারা সংগৃহীত হাদীসের বিশাল সংগ্রহ 'মুসনাদে আহমাদ' পড়েছেন। যারা পড়েননি তারা আলগার উপরে গুগল করে কেবল মহানবি(স.)-এর হাদিসের তথ্যটুকুই জানবেন।
লেখকের 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন' নাম দেবার আর একটা বড়ো কারণ এটাও হতে পারে 'কুসতুনতুনিয়া' নামটি অপ্রচলিত ও ইউনিক। নামটি আমার মতো অনেক পাঠকেরই পছন্দ হবার কথা, প্রচ্ছদটিও।
লেখক তুরস্কে যান একজন পর্যটকের বেশে। গেলে কী হবে? সৃষ্টিশীল মন একই সঙ্গে দর্শনীয় স্থান দেখেছেন সেগুলোর অতীত ইতিহাস গুগল করে জেনে যথেষ্ট উপভোগ করেছেন এবং ফিরে এসেছেন আবু আইউব আনসারি(রা.)-এর মতো নবিজির গুরুত্বপূর্ণ সাহাবির মাজার জিয়ারতের পর। এখানে একটা দারুণ ব্যাপার লক্ষ করলাম। সেটা হলো এই যে, লেখকের এই সফরটা শুধু বউকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া নয়। বা যদি বলি আর দশটা বিদেশ সফরের মতো জাস্ট সফর ছিলো না। কেবল বিদেশি পণ্য কেনার মতো সাচ্ছন্দ্য জাহির করার মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিলো না। বিদেশে তো আমাদের দেশের অনেক মধ্য ও উচ্চবিত্তই নিয়মিত যাচ্ছেন আসছেন। হাতে গোনা এক দুইজন ছাড়া কার কার এমন ভ্রমণকাহিনি বের হচ্ছে? যেখানে মানুষের জীবনটাই একটা চলমান সফর প্রক্রিয়া সেখানে নিজ-ভূমির বাইরের সফরকে তো জীবনের ভিন্ন পৃষ্ঠার সফর হিসেবে দেখাই যায়। যারা নিয়মিত বিদেশ সফরের মতো ভাগ্য পাচ্ছেন নিজেদের অভিজ্ঞতা বর্ণন বা কোনো জ্ঞান-দর্শনের গ্রন্থিত প্রকাশের মতো তাদের সেরকম প্রজ্ঞা কোথায়? নিজের অধীত বিদ্যাকে কেবল সার্টিফিকেট আর বিদেশে যাবার টিকিটের মধ্যে যারা আটকে রাখতে পারে তাদেরকে আমার খুব ইনোসেন্ট লাগে। বইটি পড়ে যতোদূর মনে হয়েছে কোনো সফরে সবাই যা দেখে তাই দেখে সন্তষ্ট হয়ে বাড়ি ফিরে আসার লোক 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন'- এর লেখক নন। জার্নিটা লেখকের জ্ঞানজগতের কাঙ্ক্ষিত জায়গাটাতেও ঘুরিয়ে আনতে পেরেছে বলে মনে হয়েছে।
লেখক বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহের 'নয়নচারা' গল্পের 'আমু'র মতো চেতনাপ্রবাহ রীতির ডানায় ভর করে চলে গেছেন স্বদেশের প্রান্তে।
মওলানা জালালউদ্দিন রুমি ও তদীয় গুরু শামসুদ্দিন তাবরিজির মাজার দর্শন করতে কোনিয়ায় গিয়ে লেখক বরফে প্রতিবিম্বিত আলোর চকমকির মধ্যে খুঁজছেন 'বরিশাইল্যা' চেহারার কোনো টঙের দোকান। আমু যেমন পিচের মধ্যে 'ময়ূরাক্ষী'কে খোঁজে, তেমনি লেখকও মাইনাস নাইন টেম্পারেচারে 'বরিশাইল্যা' টঙের দোকান খোঁজেন।
যেকোনো বৈরী পরিবেশে মানুষ সবার আগে নিজের আপন স্মৃতিকে খুঁজে ফেরে। লেখকের ভাষায়:
'... চোখ দেখছে কোনিয়া তথা কাইনিয়া নগরীর রাতের দৃশ্য যেখানে চোখ ধাঁধাঁনো স্ট্রিটলাইটের রাস্তার জমে থাকা বরফের স্তূপগুলো অদ্ভুত আলোর চকমকি খেলছিল। চোখ দেখছে আলোর এমন চকমকি, কিন্তু খুঁজছে বরিশাইল্যা চেহারার কোনো টঙের দোকান যেখানে ঘন গাভীর দুধে তৈরি হবে ধোঁয়া ওঠা মাদকতাময় দুই কাপ চা। এক কাপ আমার জন্য, আরেক কাপ আমার বৌয়ের জন্য।' (বরিশালে নয়, জালালউদ্দিনের কাউনিয়ায়; পৃ.: ১০৩)
লেখক করোনার পরপরই সস্ত্রীক তুরস্ক ঘুরতে যান। এখানে একটি বিষয় আজকের দিনের জন্য বলা জরুরি যে, আসলে শব্দটি 'সস্ত্রীক' না হয়ে 'স্ব-স্ত্রীক' হওয়া যুক্তিসম্মত। কারণ আজকাল অনেক পয়সাওয়ালাই সস্ত্রীক (যেহেতু স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এবং সেটা পরস্ত্রীও হতে পারে) বিদেশ সফরে যান। নিজের স্ত্রীর মাথায় কাজের নানা উসিলা গছিয়ে দিয়ে সুন্দর মতো তুরস্কের মতো দেশে পাড়ি জমান। কিন্তু স্ত্রীটি যে কার তা আর পর্দার বাইরে আসে না। অবশ্য সেলিব্রিটি হলে কখনো সখনো পর্দা লিক হয়ে নেটিজেনদের কবলে পড়ে যান।
এ ব্যাপারে লেখকের লেখায় পুরোপুরি ঈমান রেখেই বলা যায় তিনি স্ব-স্ত্রীকই গিয়েছিলেন।
কারণ, লেখক খুব রসিকতার মধ্যে দিয়ে তদীয় স্ত্রীর সঙ্গে সফরের নানা দিক বইটিতে উপস্থাপন করেছেন। স্ত্রীর প্রসঙ্গ বর্ণনার পদ্ধতিতে অনেকটা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'রেইনকোট' গল্পের কথক নুরুল হুদার ঢঙ পাই। স্ত্রীকে চিরায়ত পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির মতো খুব গৌণও করছেন না, আবার একেবারে স্ত্রীর একান্ত আনুগত্যও প্রকাশ করছেন না। 'কুসতুনতুনিয়া'য় যাওয়া ফিক্সড হলে লেখকের মনের ইচ্ছারা যে ভাষায় লেখককে আদেশ করলো তা হলো : 'যা বাছা, বউয়ের সাধটা মেটা, মক্কামদিনা সুবিধামতো যাবি, এবার ফেরাউনের দেশের দুটো ভিসার জন্য একটা দাপাদাপি শুরু কর'।(ইসতিম্বোলিঁ থেকে ইস্তাম্বুল, পৃ.০৭)
বইটিতে লেখকের কথা বলার ভঙ্গিতে আমি সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা ভঙ্গি টের পেয়েছি । সম্ভবত আমার মতো পাঠকমাত্রই সেটা পাবেন। যেমন বিমানে 'ল্যাম্ব-লাহামের' মিল সারার পর লেখকের পাকস্থলি যতোখানি পানি চাচ্ছিলো, তা তিনি পাননি। অর্থাৎ প্রচুর পানি খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও লেখক সেটা পাননি। যা পেয়েছেন সেটা হলো- 'নাপিতের হোজবাটির মতো দেয়া প্লাস্টিক-বাটি'। এই বর্ণনা একেবারেই মুজতবা আলীয়। এরকম আরও অনেক প্রমাণ দেখানো যাবে। লেখকের হোম ম্যানেজারকে অটোমান সুলতান আবদুল মজিদের বালাখানায় গিয়ে ৭৫০টি বাতি দেখানোর বর্ণনাতেও আছে সরস উইট। যেমন, 'সুলতান আবদুল মজিদের চোখের হাল কি এত খারাপ ছিল যে ৭৫০টি বাতি লাগতো তার চোখের প্রয়োজনীয় রোশনাইর ব্যবস্থা করতে?'(এক রাজার দুই কবর, পৃ.৫৯)
লেখকের বর্ণনায় আর একটি বড়ো প্রবণতা লক্ষ করেছি। সেটি হলো কোনো একটা স্থানে গিয়ে সেই স্থানের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে তথ্য দেয়া। এতে অনেকের কাছেই মনে হতে পারে 'বইটিতে তো শুধু তথ্য আর তথ্য, ভ্রমণ কোথায়?'
আমি আগেই বলেছি জীবন মানেই সফর। লেখক যেসব অঞ্চলে বায়োলজিক্যালি গিয়েছেন, সেসব অঞ্চলে তিনি ঐতিহাসিকভাবেও অ্যাটাচড হবার চেষ্টা করেছেন। এ জন্য লেখক হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য পাওয়ার জন্য, দেখাটাকে আরও পোক্ত-পরিষ্কার করার জন্য গুগলের সহযোগিতা নিয়ে দর্শনীয় যেকোনো স্থানের অতীতে চলে গেছেন। এতে করে দুই ধরনের ভ্রমণ হয়েছে লেখকের, সঙ্গে পাঠকেরও। ফলে বর্ণনায় তথ্যের পাহাড় থাকাতে আমার মতো উম্মি পাঠকের জন্য অনেক সুবিধা হয়েছে। যেমন, 'তোপকপি স্টেশন', 'আয়া সোফিয়া', 'মেডেন্স টাওয়ার' 'বসফরাস প্রণালি'র মতো অজস্র স্থান ও বিষয়ের অর্থ এবং আদ্যপান্তের ঐতিহাসিক পরিচয় পেয়েছি আমরা। আবার 'মওলানা' কেন 'মেভলানা' উচ্চারিত হয় সে সম্পর্কিত তথ্য ও লেখকের মতামতও আছে বইটিতে।
।
কাজী নজরুল ইসলাম যে যে কারণে টার্কিশ সংস্কৃতি, সুরের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, সেই কারণের একটা ছিলো কামাল পাশার তুরস্ককে ওয়েস্টার্নাইজড করার প্রক্রিয়া। পাশা তুর্কির মধ্যে আরবি-ফারসির চেয়ে রোমান ভাষার আধিপত্য কায়েম করতে চাইলেন, চালু করলেন রোমান হরফে তুর্কি লেখার চল,সাথে রোমান ভঙ্গিতে আরবি-ফারসি শব্দের উচ্চারণরীতিও। বিশ্বযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পতনে তুরস্কের সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা বেশ জেঁকে বসেছিলো। নিজেদের উন্নতির জন্য নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতিকে মোটামুটিভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য পাশ্চাত্যকরণের কামালীয় পন্থাকে তারা অবলম্বন করলেন।
এই বিষয়ে অবশ্য 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন'-এর লেখক একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন।
প্রশ্নটি হলো: ' মজার বিষয় হলো তুর্কী ভাষাকে এভাবে 'নাই' বানানোর হুকুমদাতা মহাদর্পে বনে গেলেন তুরস্কের নায়ক। খালি তুরস্কের না, আমাদের মতো দূর দেশের অনেকেরও স্বপ্নের নায়ক। কিন্তু আমরা এই হুকুমদাতাকে নায়ক ভাবলেও, একই কায়দায় বাংলা ভাষার হাজার বছরের বর্ণমালাকে পালটে দিয়ে যারা আরবি বর্ণমালায় বাংলা লেখার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাদেরকে আমরা জঘন্য খলনায়ক বলেই জানি। একই কাজের জন্য একজনকে মনে করি নায়ক, আরেকজনকে মনে করি খলনায়ক। এর ভিতরের পলিটিক্সটা বড়ো গোলমেলে।'(বরিশালের নয়, জালালউদ্দিনের কাউনিয়ায়, পৃ. ৯৫)
আমার কাছে মনে পাকিস্তানের চাপাচাপির সঙ্গে কামাল আতাতুর্কের চাপাচাপির মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য ছিলো। কামাল সাহেব দেশের উন্নতির কথা ভেবে হয়তো করেছিলেন, পাকিস্তান করেছিলো
স্রেফ নিজেদের আধিপত্য কায়েম করার জন্য। লেখকের কাছে লাগা গোলমেলে পলিটিক্সটাই মূলত যেকোনো দেশের রাজনীতি বোঝার মূল পয়েন্ট। একটি দেশের উন্নতি কি তথাকথিত ডিক্টেটরদের ধান্দার কুশপুত্তলিকা, নাকি সেটাকে তারা মনে প্রাণে ধারণ করেন--এটা বোঝা খুব জরুরি পাঠ বলে মনে হয় আমার কাছে। ফলে,লেখকের প্রশ্নটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ।
কামাল আতাতুর্কের তৈরি করা আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের যথেষ্ট নামডাক থাকলেও এই বাংলাদেশের মতো সেখানেও যে ছিনতাই হয় তা আমরা লেখকের রসাত্মক বর্ণনার মধ্যে পাই।
টার্কিশ যেসব স্ক্রিপ্ট আর সুরের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে, তার কোনোটাতেই ছিনতাইয়ের মতো 'আমাদের সংস্কৃতি'র খুব আপন একটা সংস্কৃতি আমি দেখিনি। তবে আমাদের অতীত ইতিহাসের মতো আধিপত্যবাদী আচরণ, রাজনৈতিক কূটক্যাচালি, মনস্তাত্ত্বিক টানা-পড়েন প্রচুর পেয়েছি। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান আর চিন্তার দিক থেকে যে তুর্কিরা যথেষ্ট অগ্রসর তা টিভিতে দেখা তুরস্ক আর 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন' পড়ে মেলাতে পারি।
লেখক তুরস্কের একটি মসজিদের অদ্ভুত স্থাপত্যশৈলীর বর্ণনা দিয়েছেন যার সঙ্গে সাধারণ মসজিদের বহুত ফারাক আছে।
কী করে 'হাগিয়া সোফিয়া' গির্জাটি সুলতান মুহাম্মদের প্রচেষ্টায় 'আয়া সোফিয়া' মসজিদে পরিণত হলো সেই ইতিহাস লেখক এখানে তথ্যের ভাঁজে উইটের চমক বসিয়ে বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি স্ত্রীকে খুশি করার ব্যাপারে লেখকের মনের শান্তিও বিধৃত হয়েছে। লেখকের স্ত্রী 'আয়া সোফিয়া'তে ২০২২ সালে না গিয়ে যদি ১৯৩৪ সালে যেতেন তাহলে একটি জাদুঘর দেখবার সৌভাগ্য অর্জন করতেন। কেননা তখন কামাল আতাতুর্কের কল্যাণে 'আয়া সোফিয়া'কে জাদুঘর করে রাখা হয়েছিলো। ১৯২০ সালে সে দেশের কোর্টের একটি রায়ের মাধ্যমে জাদুঘর থেকে আবার মসজিদে পরিণত হয় 'আয়া সোফিয়া'। ফলে, বহু পরিবর্তিত একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা মসজিদে পরিণত হলেও সেখানে কিছু অদ্ভুত বিষয় তো দেখা যাওয়ারই কথা। 'আয়া সোফিয়া'র গম্বুজের গায়ে সরাসরি মানুষের আকৃতির চিত্রকর্ম। অথচ চিরাচরিত মসজিদের গায়ে এমন প্রাণীর চিত্রকর্ম দেখা যায় না। লেখকের ভাষায়,
'টুরিস্ট হিসেবে মসজিদ দেখতে গিয়ে গম্বুজের উপরের দিকটায় তাকিয়ে একটু ধাক্কা খেলাম। বড় গম্বুজের উপরে চারদিকে চারটি মনুষ্যরূপ চিত্র এবং ছোট গম্বুজেও অমন সংখ্যক চিত্র দেখতে পেলাম। বড় গম্বুজের চিত্রগুলো অনেকটা নারীমূর্তি রূপে জিব্রাইল, মিকাইল, ইস্রাফিল ও আজরাইলের পাখাওয়ালা চিত্র। একেবারে মিম্বর বরাবর উপরে গম্বুজে মা মেরী ও শিশু যীশুর ছবি।... মসজিদে এমন মানুষের ছবি দেখে ধাক্কাতো একটু লাগারই কথা।' (ইসতিমবোলিঁ থেকে ইস্তাম্বুল, পৃ. ২৭)
একদিকে এমন চিত্রকর্ম খচিত গম্বুজ, অন্যদিকে কুরআনের আয়াত তেলাওয়াতের মনোমুগ্ধকর সুর। লেখকের মনোজগতের সঙ্গে পাঠকের মনেও ভক্তির একটা ভিন্নরকম বোধ সৃষ্টি হলো।
মহান রবকে ডাকার ব্যাপারে তুর্কিরা যে বাহ্যিক কোনো আড়ম্বরপূর্ণ প্রস্তুতি নেন না তা আমি বইটির সঙ্গে সঙ্গে টিভি-সংযোগেও দেখেছি। চাল-চলনে ওয়েস্টার্ন, কিন্তু নামাজের ওয়াক্ত হলে সোজা মসজিদে। বা কোনো কারণে কবরে গেলে নারী-পুরুষ যে যার মতো করে কবর জিয়ারত করছে। যে যার মতো করে খোদাকে ডাকছে। কেউ কারো ডাকার রাস্তাকে পরিশুদ্ধ বা রুদ্ধ করার দায়িত্ব নিয়ে তাদের ওপর হামলে পড়ছে না।
এভাবে লেখক তাঁর সফরে নানা স্থানে ঘুরতে ঘুরতে নানা জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রশ্ন উৎপাদন করতে সমর্থ হয়েছেন। লেখক 'কুসতুনতুনিয়া' শুধু চোখের দেখাও দেখে আসতে পারতেন। তা না করে লেখক মনের চোখকে প্রসারিত করে একটি সফরের খুটিনাটি পাঠকের সামনে তুলে ধরলেন। লেখক আমার তুরস্ক যাবার আগ্রহে আরেক চোট ফুল স্পিডে বাতাস দিয়ে দিলেন। বাংলা সংস্কৃতির প্রভাবক হিসেবে তুরস্ককে দেখতে একবার যেতেই হবে দেখছি!
সর্বোপরি বলতে চাই 'কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন' বইটি পড়ে আমি খুব আনন্দ পেয়েছি, ঋদ্ধ হয়েছি।