Published : 12 Jul 2023, 05:08 PM
বিশ শতকের বিশ্ব সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হয়েও তার জীবন কেটেছে নিভৃতে, জনারণ্য থেকে দূরে থেকেই তিনি লিখেছেন ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং’; চেক বংশোদ্ভূত সেই ফরাসি ঔপন্যাসিক মিলান কুন্ডেরা ৯৪ বছর বয়সে বিদায় জানালেন এ পৃথিবীকে।
রয়টার্স জানায়, কুন্ডেরার ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে গড়ে তোলা মোরাভিয়ান লাইব্রেরির (এমজেডকে) মুখপাত্র আনা ম্রাজোভা বুধবার এই লেখকের মৃত্যুসংবাদ দেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন কুন্ডেরা। গত মঙ্গলবার প্যারিসে তার মৃত্যু হয়।
১৯২৯ সালে চেক রিপাবলিকের ব্রনোতে জন্মগ্রহণ করেন কুন্ডেরা। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণের সমালোচনা করায় ১৯৭৫ সালে তাকে নির্বাসন নিতে হয় ফ্রান্সে।
ব্যক্তিজীবনে তিনি দীর্ঘদিন সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলেছেন, ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতির সঙ্গে।
নিজের লেখনীর দক্ষতা দিয়েই হয়ে উঠেছিলেন বিশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী ঔপন্যাসিকদের একজন। সমসাময়িক যে লেখকদের বই বিশ্বে সবচেয়ে বেশিবার অনূদিত হয়েছে, সেই লেখকদের একজন কুন্ডেরা।
গত কয়েক দশকে বহুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য তার নাম এসেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের নোবেল তার জোটেনি।
সিএনএন লিখেছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময় চেকস্লোভাকিয়ার লেখক, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রভাবশালী প্রজন্মের অংশ ছিলেন কুন্ডেরা। সেই প্রজন্মের ধারায় ভেসে অনেকের মত তিনিও কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
যুদ্ধের পরপরই কমিউনিস্ট শাসনের অধীনে চলে গিয়েছিল চেকস্লোভাকিয়া। পরবর্তী বেশ কিছু বছর সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন কুন্ডেরা।
এরপর তৎকালীন শাসন ব্যবস্থার সমালোচনা করে ১৯৫০ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। অবশ্য কয়েক বছর পর সেই সদস্যপদ ফিরেও পান।
ষাটের দশকের শেষ দিকে ‘নব্য উদারনীতির’ উত্থাল সময়ে পার্টির একজন প্রভাবশালী সমালোচক হিসেবে পরিচিতি পান কুন্ডেরা। ইতিহাসে ওই সময়টা পরিচিত ‘প্রাহা বসন্ত’ নামে।
ওই সময়েই তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য জোক’ প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি সেই সময়ের চেকস্লোভাকিয়ায় কমিউনিস্ট শাসনের চিত্র ফুটিয়ে তোলেন শ্লেষ আর কটাক্ষপূর্ণ ভাষায়।
কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য থেকে ভিন্ন মতাবলম্বী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠার পথে ওই বইটি ছিল তার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ। সে সময় দেশে ও বিদেশে বহুল বিক্রিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষে পৌঁছে যায় ‘দ্য জোক’। এবং এই বইয়ের কারণেই তাকে প্রিয় প্রায় সবকিছু হারাতে হয়।
সমাজতন্ত্রের আরও গণতান্ত্রিক একটি সংস্করণ পাওয়ার যে স্বপ্ন চেকরা দেখছিলেন, তা ভেঙে দিয়ে ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় আগ্রাসন চালায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৭০ এর দশকের শুরুতে মিলান কুন্ডেরার বই নিষিদ্ধ করা হয়, সরিয়ে ফেলা হয় লাইব্রেরি থেকে। কুন্ডেরা তার শিক্ষকতার চাকরিটিও হারান, তার লেখা প্রকাশের ওপর আসে নিষেধাজ্ঞা।
রাষ্ট্রের শত্রু আখ্যা দিয়ে এই লেখকের ওপর শুরু হয় বিরামহীন নিপীড়ন। তার ফোনে আড়ি পাতা হত নিয়মিত, তার জীবনকে করে তোলা হয় দুর্বিষহ। শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়তে বাধ্য হন কুন্ডেরা, তার নাগরিকত্বও বাতিল করে চেকস্লোভাকিয়া।
নির্বাসিত কুন্ডেরার বাকি জীবন কেটেছে প্যারিসে, ১৯৮১ সালে তিনি ফ্রান্সের নাগরিকত্ব নেন। সেখানেই তার তার সাহিত্যিক জীবন সত্যিকার অর্থে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করে।
তার সবচেয়ে প্রশংসিত তিনটি বই ‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’, ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং’ ও ‘ইমর্টালিটি’ সে সময়ই প্রকাশিত হয়।
এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং' প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। বইটি থেকে পরে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়। ড্যানিয়েল ডে লুইস ও জুলিয়েট বিঁয়োশে অভিনীত সেই চলচ্চিত্র নির্মাণের সময় পরামর্শক হিসেবেও কাজ করেন কুন্ডেরা। তবে পরে তিনি বলেছিলেন, বইটির মূল চেতনার সঙ্গে সিনেমাটির খুব কমই মিল পেয়েছেন তিনি।
কুন্ডেরা বিশ্বাস করতেন উপন্যাসের শক্তিতে। বলতেন, উপন্যাসকে স্বতন্ত্র একটি শিল্পমাধ্যমের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং' থেকে সিনেমা হওয়ার পর তিনি নিজের লেখার বিষয়ে অনেক বেশি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠেন। তার লেখার অনুবাদগুলো তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়তেন এবং সব ধরনের ‘অ্যাডাপ্টেশন’ তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।
গদ্য লেখার এমন এক ভঙ্গি কুন্ডেরা রপ্ত করেন, যেখানে তার চরিত্রেরা ভেসে বেড়ায় নিরেট বাস্তবতার দৈনন্দিন জীবন আর ভাবনালোকের মাঝে। তীব্র শ্লেষ আর রসবোধের মিশেলে সেইসব অম্লমধুর গল্পের ভাঁজে ভাঁজে থাকে গভীর দার্শনিক বিতর্ক আর স্বৈরশাসনের পদতলে নিপীড়িত জীবনের ব্যাঙ্গাত্মক চিত্রায়ন।
নিভৃতে জীবন কাটানো এই লেখক বিশ্বাস করতেন, লেখকের যা বলার, তা বলবে তার লেখা। সে কারণে সাক্ষাৎকার দিতেন কালেভদ্রে।
ফ্রান্সে নির্বাসনে যাওয়ার প্রায় এক যুগ পর ‘ইমর্টালিটি’ নামে নিজের চেক ভাষার সবশেষ উপন্যাসটি লেখেন কুন্ডেরা। জন্মভূমির সঙ্গে নিজের জটিল সম্পর্ক আর নির্বাসনের ইতিবৃত্ত সেখানে তিনি তুলে ধরেন।
পরের জীবনে কুন্ডেরা নিজের দেশে গেছেন খুব কম। যখন যেতেন, ঘোরাফেরা করতেন পরিচয় লুকিয়ে, হোটেলে উঠতেন অন্য নামে। ২০১৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র যখন কুন্ডেরার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিল, ততদিনে তিনি একজন ফরাসি লেখক হয়ে উঠেছেন, যিনি থাকেন ফ্রান্সে।