ওয়ের মৃত্যু ও একটি পুরনো লেখা

তাঁর পুরো সাহিত্যকর্মের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল যুদ্ধবিরোধী, বিশেষ করে আণবিক অস্ত্রবিরোধী প্রত্যয় ও প্রতিবাদ।

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 15 March 2023, 03:12 PM
Updated : 15 March 2023, 03:12 PM

গতকাল রাতে বিবিসি কি সিএনএন দেখতে গিয়ে হঠাৎ নিচের স্ক্রলে চোখে পড়ল জাপানের নোবেলবিজয়ী লেখক কেনজাবুরো ওয়ের মৃত্যুসংবাদ। আজকে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, তিনি প্রয়াত হয়েছেন আরও দশদিন আগে, তেসরা মার্চ। কিন্তু তাঁর প্রকাশক কোদানশা জানি না ঠিক কী কারণে খবরটা মাত্র গতকালই প্রকাশ করেছে। তিনি কবে, কোথায়, কীভাবে মারা গেছেন সে ব্যাপারেও তারা কোনো আলোকপাত করেননি। ওয়ে কেনজাবুরো (জাপানিতে এভাবেই লেখা হয় তাঁর নাম, আর ওয়ের উচ্চারণটা অনেকটা ওহ-এর কাছাকাছি)। প্রয়াত হয়েছেন ৮৮ বছর বয়সে। গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, বক্তৃতা ইত্যাদি মিলিয়ে তাঁর গোটা পঞ্চাশেক গ্রন্থ রয়েছে।

তাঁর পুরো সাহিত্যকর্মের একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল যুদ্ধবিরোধী, বিশেষ করে আণবিক অস্ত্রবিরোধী প্রত্যয় ও প্রতিবাদ। এর পেছনে অবশ্য তাঁর জীবনের একটি ব্যক্তিগত ট্রাজেডির ভূমিকা রয়েছে। তাঁর প্রথম পুত্রসন্তান, যার নাম তিনি রেখেছিলেন হিকারি তথা আলো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষদিকে হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মার্কিন পরাশক্তির আনবিক বোমা হামলাজনিত বিষাক্ত তেজস্ক্রিয়ার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছিল। তাঁর সেই আজন্ম পঙ্গু পুত্রের দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিজচোখে দেখার কষ্ট এবং তাঁর লালনপালন, সেবাযত্ন, শিক্ষা ও চিকিৎসার জন্য যে দুর্বহ বেদনা তাঁকে বহন করতে হয়েছিল জীবনভর, সেটিই তাঁকে এমন প্রবলভাবে যুদ্ধবিরোধী ও শান্তিবাদী করে তুলেছিল। তাঁর এই মহান ব্রত তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পালন করে গেছেন গভীর নিষ্ঠা ও নিবেদনের সঙ্গে; লেখালেখি, বক্তৃতা, প্রচারণা এবং আন্দোলন, প্রতিবাদে সরাসরি অংশগ্রহণের মাধ্যমে। একটি সুন্দর, শান্তিপূর্ণ, যুদ্ধমুক্ত পৃথিবীর জন্য তাঁর সেই ব্যক্তিগত লড়াই-সংগ্রামের আজ চির অবসান হল।

আজ মনে পড়ছে, ১৯৯৪ সালে তাঁর সামগ্রিক সাহিত্যকীর্তির জন্য তিনি নোবেল সাহিত্যপুরস্কারে ভূষিত হবার পর চটজলদি তাঁর একটি উপন্যাস পাঠের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ছোট একটি নিবন্ধ রচনা করেছিলাম আমি। আমার সেই সামান্য লেখাটির মাধ্যমেই সদ্যপ্রয়াত এই মহান সাহিত্যিকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

দা সাইলেন্ট ক্রাই: কেন্জাবুরো ওয়ের নীরব কান্না

সব জল্পনাকল্পনার অবসান ঘটিয়ে এবারে সাহিত্যের জন্য নোবেল পেয়ে গেলেন স্বদেশে বিখ্যাত কিন্তু বিদেশে তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত, জাপানি কথাসাহিত্যিক কেন্জাবুরো ওয়ে। গত কয়েকবছর ধরে প্রধানত অ-ইউরোপীয় ও অ-এশীয় লেখকদের মধ্যে পুরস্কার সীমাবদ্ধ থাকায় অনেকেরই ধারণা ছিল এবার এশিয়া কিংবা ইউরোপের কেউই হয়ত পুরস্কৃত হবেন। তাই বলে কিন্তু কেউই ওয়ের কথা ভাবেননি। বরং অন্যান্য সম্ভাব্য নামের মধ্যে জাপানেরই আরেক ঔপন্যাসিক শোশাকো এন্দোর উল্লেখ ছিল। এছাড়া চীনের নির্বাসিত কবি বেই দাও তো ছিলেনই। ইউরোপীয়দের মধ্যে নাট্যকার পিটার হান্ডকে, আইরিশ কবি সিমাস হিনি, বেলজিয়ান কবি ও ঔপন্যাসিক য়ুগো ক্লাউস প্রমুখ ছিলেন অনেকেরই পছন্দের। কিন্তু নোবেলকমিটি যেহেতু একটু চমকপ্রিয় তাই তাঁরা পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এলেন কেন্জাবুরোকে, যাঁর হাতে-গোনা কয়েকটি গ্রন্থ ছাড়া কিছ্ইু প্রায় ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। তবে তাঁদের এই নির্বাচন যে অসঙ্গত বা ভিত্তিহীন হয়েছে তা কিন্তু বলা যাবে না। কেননা ওয়ে যথার্থই একজন শক্তিমান লেখক, নিজেকে যিনি স¤প্রতি প্রয়াত স্বদেশী লেখক কোবো আবে ও মাসুজি ইবুসের উত্তরসূরি বলে দাবি করেন।

১৯৩৫ সালে জাপানের পশ্চিম প্রান্তের শিশোকু দ্বীপে জন্মগ্রহণকারী ওয়ে পড়াশোনা করেন তোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি সাহিত্যের ওপর। ছাত্রাবস্থাতেই লেখক হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই তাঁর একটি গল্পের জন্য জাপানের সম্মানজনক আকুতাগাওয়া সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। পাশাপাশি উপন্যাসেও হাতেখড়ি হচ্ছিল তাঁর। তরুণ বয়সেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস Our Age। কিন্তু সমালোচকেরা তাঁর যুদ্ধংদেহী জাপানের সমালোচনা ও যুদ্ধপরবর্তী পুঁজিবাদী সমাজের প্রতি কটাক্ষ সহ্য করতে না পেরে তাঁর পুস্তকের বিরূপ আলোচনা করেন। কেন্জাবুরো ১৯৬০ সালে মার্কিন-জাপান নিরাপত্তা চুক্তির বিরোধিতায় যে-ছাত্রদাঙ্গা হয় তার অগ্রভাগে ছিলেন। প্রবলভাবে যুদ্ধবিরোধী ও বামপন্থী ধ্যানধারণায় পুষ্ট ওয়ের লেখাতেও এর প্রভাব পড়েছে। যদিও আঙ্গিকের ও ভাষার পরীক্ষা-নিরীক্ষায় তিনি ছিলেন সর্বদাই তৎপর ও সৃষ্টিশীল। পশ্চিমের লেখকদের মধ্যে তাঁর ওপর জাঁ পল সার্ত্র ও হেনরি মিলারের বিপুল প্রভাবের কথা তিনি সানন্দে স্বীকার করেছেন।

তাঁর লেখালেখির মধ্যে আরেকটি নতুন মাত্রা সূচিত হয় প্রথম পুত্রসন্তানের জন্মের পর। জাপানের আরও অসংখ্য শিশুর মতো হিরোশিমা-নাগাসাকির আণবিক ধ্বংসযজ্ঞের তেজস্ক্রিয়তার সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় তাঁর ছেলেও বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নেয়। তারপর থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে আণবিক বোমাবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন, হিরোশিমা ও অন্যত্র ভ্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের সভায় বক্তৃতা করেন। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর লেখালেখি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর ওপর সেই বিকলাঙ্গ শিশুজন্মের মারাত্মক অভিঘাত, সর্বোপরি তাকে সারিয়ে তোলার নিরন্তর প্রয়াসের বহুমাত্রিক উপস্থাপনাই হয়ে ওঠে তাঁর রচনার অন্যতম প্রধান বিষয়। এর মধ্যে তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ A Personal Matter (১৯৬৪), সমালোচকেরা যাকে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে মনে করেন।

তো, স¤প্রতি নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর নিউ ইয়র্ক ফিফ্থ অ্যাভেন্যুর বিশাল বইয়ের দোকান বার্নস অ্যান্ড নোবেলএ গিয়ে তাঁর সবেধন নীলমণি একটিমাত্র বই, ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত বড়সড় উপন্যাস The Silent Cry সংগ্রহ করি। ক্ষুদে ক্ষুদে অক্ষরে তিনশত পৃষ্ঠার বই। বেশ ক’দিন লাগিয়ে পড়া শেষ করলাম। বেশ লাগল ধ্রুপদী ঘরানার এই উপন্যাসখানা। প্রধানত আত্মজৈবনিক এই বইয়েও ওয়ের সেই দুর্বহ ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডির সার্বক্ষণিক ছায়াপাত লক্ষ করা গেল। তবে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রগাঢ় ইতিহাসবোধ (গ্রন্থে ঘুরে ফিরেই এসেছে জাপান-মার্কিন সামরিক চুক্তিবিরোধী আন্দোলন ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালে কোরীয়দের ওপর জাপানি উৎপীড়নের অনুষঙ্গ), সমকালীন সমাজ, রাজনীতি (নায়কের ভাইয়ের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের অনুষঙ্গে সেখানকার বর্ণবৈষম্য-বিরোধী কৃষ্ণাঙ্গ-অধিকার আন্দোলনের প্রতি তাঁর সমর্থন জানানো), আধুনিক ও শিল্পোন্নত জাপানের আবেগহীন পুঁজিবাদী সমাজের নির্মমতা, বিকার ও বিচ্ছিন্নতা ইত্যাদি। ওয়ে যেন তাঁরই ভেতরের গভীর হতাশা, প্রতিবাদ ও বিবমিষাকে সূক্ষ্ণ, জটিল, দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক বর্ণনাকে প্রায়শই মিথ ও ম্যাজিকপ্রতিম অতিবাস্তবের উপস্থাপনা সহযোগে কাব্যিক ও বহুমাত্রিক ভাষায় তুলে ধরেন।

সবশেষে আমরা দেখতে পাই নায়কের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কনিষ্ঠ ভ্রাতার নেতৃত্বে জাপানের এক গ্রামে বিশাল বাণিজ্যবিপণীর আগ্রাসনের প্রতিবাদে সংঘটিত দাঙ্গা ও তাতে পরাভূত হয়ে তরুণ তাকাশার ভয়াবহ আত্মহত্যার দৃশ্য। লেখক-অধ্যাপক নায়কের জাপানত্যাগ ও আফ্রিকায় হস্তিপালকের চাকরি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে গ্রন্থকার যেন এই নির্মম সময়ের পীড়ন থেকে উৎসারিত তাঁর নীরব ক্রন্দনকেই ছড়িয়ে দেন সবার মাঝে। সেই সঙ্গে আমাদের উদ্বুদ্ধ করেন তাঁর স্বপ্ন দ্যাখা সেই প্রতীকী ‘কুড়েঘরটি’র অনুসন্ধানে ব্রতী হতে। The Silent Cry নিঃসন্দেহে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের একটি তাৎপর্যপূর্ণ উপন্যাস।