আমেরিকাতে বসে একসাথে তুলি পুরা বাংলাদেশকে এক চামুচে। কিন্তু কাছে এলে নিজের বিভাগ, গ্রাম, এলাকা, শেষে নিজের বাসা।
Published : 07 Feb 2024, 10:17 PM
দুই
বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পুরাদস্তুর অবাক হযে গেলাম।
চারদিকের আঁধারের মাঝেও দেখা যাচ্ছে অনেক পুরাতন হয়ে গেছে বাড়িটা। আমাদের বাড়ির চারদিকে উঠে গেছে ঝকমকে বহুতল বহু ভবন, অভিজাত রকমারি আধুনিক সব বিল্ডিং। আমাদেরটা যেন ছোট হয়ে দেবে গেছে। জলাবদ্ধতা রোধে রাস্তা অনেক উঁচু করা হয়েছে। একতলার অর্ধেকটা রাস্তার থেকে নিচে। কাতালগঞ্জের জলাবদ্ধতা সর্বজন বিদিত বিষয়। যদিও শুনলাম পুরা চট্টগ্রাম জুড়ে এখন থৈ থৈ পানি জমে এখানে ওখানে সেখানে বহুখানেই।
এককালে আমরা থাকতাম একতলা দোতলা জুড়ে, ডুপ্লেক্স, মাঝখান দিয়ে ছিল সিঁড়ি দোতলায় উঠবার জন্য। পাঁচতলা পর্যন্ত ভাড়াটিয়াদের সিঁড়ি আলাদা করে কাটা বাহির থেকে। সিঁড়ির গোড়াতেই ছিল দারোয়ান কেয়ারটেকারদের থাকবার ঘর। কিন্তু এখন একতলাটা পুরাটা জুড়ে দারোয়ানরা থাকছেন। আমাদের দোতলাতে ঢুকবার জন্য দরজা কাটা হয়েছে উপরের তলার বাসিন্দাদের ব্যাবহৃত সিঁড়িটির দোতলা থেকে। সময়ে সময়ে আমি হয়তোবা জেনেছিলাম তথ্যগুলো কিন্তু তারপর আবার স্মৃতিতে ধুলো জমে ঝাপসা হয়ে গেছে অনেক কিছু।
আমরা অবশ্য থাকবার জন্য উঠলাম চার তলাতে।
ঐখানের ভাড়াটে চলে গেছে। চারতলা ধুয়ে মুছে রাখা হয়েছে আমাদের জন্য।
বাসার সামনে একটা কমিউনিটি সেন্টার হয়েছে। সানাই বাজছে।
পাশেই হিন্দু মন্দির। উলুধ্বনি আসছে। তখনো জানি না যে সহসাই শুরু হবে ওয়াজ মাহফিল। প্রচুর শব্দ চারদিকে। এর মাঝে আজান শুরু হলো। আর ঐদিকে মশারা তো ভোঁ ভোঁ করেই যাচ্ছে। ক্রমাগত ভোঁ ভোঁ।
আমিও আম্মার সাথে ভন ভন করেই গেলাম এই বলে যে তুমি আমাকে এ কোথায় নিয়ে এলে, মশার রাজ্যে! আম্মাই যেন অপরাধী, যেন সব মশার জননী আমার আম্মা।
আম্মা খুব বিরক্ত হয়ে বললেন, গুলশানে কি মশা কম!
এর আগে কিন্তু বলতেন, নাহ নাহ কি এতো মশা গুলশানে? তুমি আমেরিকা থেকে এসেছো তো তাই বেশী বেশী মনে হচ্ছে। ওরা আসলে তুমি এসেছো শুনে দেখা করতে এসেছে। বলে আবার হাসতেন। আমি এসেছি বলে যে আম্মা খুব খুশি হয়েছেন তাই যেন ধরা পড়তো তার হাসিতে।
যাই হোক, এখন টানছেন কাতালগঞ্জের পক্ষ।
মানুষ এমনি হয়-- আপন থেকে আপনতর দিকে যায়।
এই আমরা প্রবাসীরা, যত যাই কিছু হোক ভালোবাসি বাংলাদেশ, আমেরিকাতে বসে একসাথে তুলি পুরা বাংলাদেশকে এক চামুচে। কিন্তু কাছে এলে নিজের বিভাগ, গ্রাম, এলাকা, শেষে নিজের বাসা। এটাই মানুষ করে, এটাকে লোক-প্রশাসনের ভাষায় বলা হয় আঞ্চলিকতা। কিন্তু আমাদের প্রবাসীদের জন্য এটা আরেকটু এগিয়ে গিয়ে হয় ফেলে আসা স্মৃতিকে খোঁজা। সেই গাছ, মাছ, পানি, নদী নালা খোঁজা। গাছটা মরে গেলে বা বেঁকে গেলে স্মৃতি বাধাগ্রস্ত হয়, মন সেটা মেনে নিতে পারে না। মন খুঁজে সেই স্মৃতিরই আঙ্গিনা, আলিঙ্গন। বিদেশে সবই এতো উন্নত তারপরও মাটির বাসনে পান্তা ভাত খেতে আমরা কেন যে ভালোবাসি তা ওই স্মৃতির-ই ব্যাঞ্জনা। ওই যেমন স্বরবর্ণ ব্যাঞ্জন বর্ণ কোনটার পর কোনটা পর পর বসে তা মুখস্ত বলতে গেলে আমরা হয়তোবা ভুলভাল বকি বা বলি কিন্তু বাক্য গঠন করি তারই উপর, তেমনি ভাবে থরে থরে সাজানো থাকে আমাদের অবকাঠামো, তার উপরই দাঁড়ায় মনোজগতের উপরি কাঠামো। স্মৃতির সাথে মিল-ঝুল খুঁজতে ব্যস্ত থাকে মন। আমার যেমন বড় প্রশান্তি লাগে ধানমন্ডিতে ঘুরতে, সর্বত্র আমি আমি স্মৃতি, তেমনটি মোটেও মনে হয়না গুলশানে। এখানে কাছাকাছি অতীতের তেমন কোনো বিশাল স্মৃতি নেই। আমাদের গুলশান বসতি মাত্র কিছু বছরের।
২২ বছর পর কাতালগঞ্জের এই বাড়িতে এসে আমি পড়লাম ভয়কর স্মৃতির সংকটে। কিছুই নেই আগের মতো। দোতলায় আমাদের সব আগেকার জিনিসপত্র যেমন ছিল, আছে এখনো ওখানে, তেমনি ভাবেই আছে। ঢাকায় চলে যাবার সময় আমরা কিছুই সাথে করে নিয়ে যাই-নি।
কিন্তু আমরা থাকছি চারতলায়। বলেছি আগেই দীর্ঘদিনের অব্যবহারে ওখানে দোতলায় এই মুহূর্তে থাকা সম্ভব নয়। পরিষ্কার করে ওতে আমাদের ঢুকতে ঢুকতে যাবার সময় হয়ে যাবে। দুই চার দিনের বেড়ানোয় অতীত ছোঁয়ার সময় খুব সীমিত।
আমাদের পাঁচতলার ভাড়াটে পরিবার এলো দেখা করতে। আমাদের এই চারতলার সাময়িক আবাস তো এক্কেবারে ফাঁকা। বসবে কোথায়? দোতলা খোলা হলো। পুরানো কাল থেকে বের করে আনা হলো চারটে চেয়ার। আমার মনে হল এলিস ইন ওয়ানডারল্যান্ড-এর গুহায় ঢুকে কেউ এনে দিলো চারটি সোনার সিংহাসন। ওতে বসতে আমার পরানপোড়ে। কতকাল পরে দেখা ওদের সাথে। দারোয়ানের ছেলেরা ওই চেয়ার আনতে গেলে আমিও ছুটলাম দেখতে দোতলায় আমাদের বাসাটা। আম্মা নিষেধ করলেন, বললেন-ও, ওই ধুলাময় ঘরে পা দিলে আগামী কয়েকদিন আমি কেবল হাঁচিই দিতে থাকবো, তারপরও গেলাম। কিন্তু চারদিকে এতো ধুলা জমা হয়েছে যে দরজা দিয়ে কোনো মতে একটা উঁকি দিলাম কি দিলাম না! চার বছর খোলা হয়নি। ওই যে মহামান্য করোনা বেগমের কারণে আম্মা আসেননি তাই সব বন্ধ ছিল। দরজা থেকেই ফিরতে হলো। আমি আসবো না যুগ যুগ ধরে আর বাসাটাও দরজা খুলে সেজেগুজে বসে থাকবে আমার আশায় তা তো হয় না! হয় কি?
প্রথম রাতেই পাঁচতলা থেকে চট্টগ্রাম শহর দেখবো ভেবে ছাদে যেতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু তালা মারা ছাদ, চাঁদ দেখা হবে না। চট্টগ্রামের আকাশে তো আর নতুন কোনো চাঁদ উঠবে না, যা ঢাকায় দেখেছি তাই দেখবো কিন্তু তারপরও চট্টগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে চাঁদ দেখতে আমার মন খুব চাইছিল। চাঁদ নিয়ে সব ভালোবাসা এই মাটিতেই তো প্রথম জন্মেছিলো। কিন্তু চাঁদের চাবি নিখোঁজ। ছাদে যাওয়া যাবে না। চারদিকে নতুন নতুন বিল্ডিং হচ্ছে কে কোন দিক দিয়ে টপকে টাপকে আমাদের ছাদে লাফিয়ে নামবে ব্যাটম্যানের মতন, তারপর নিরাপত্তার সংকট। তাই ছাদে তালা। এবং চাবি নিখোঁজ।
বুঝতেই পারছি সহসাই আম্মা ভ্রু কুঁচকে তাকাবেন দারোয়ান ফ্যামিলির দিকে।
ওরা চাবি কিভাবে নিখোঁজ করেছে তার সবিস্তারিত বিবরণ চাইবেন তিনি। ছোট্ট একটা চাবি যা তারা সামলে রাখতে পারেনা তারা তার বাড়ি সামলাবে কিভাবে এটাই আম্মা এরপর অনেকক্ষণ ধরে ভাববেন।
তিনতলার ভাড়াটে এলো বিরিয়ানি নিয়ে, রাতে আমাদের খাদ্য সংকট নিয়ে ভাবনা থাকলো না। তবে দেশের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ জোরেসোরে বক্তব্য রেখে গেলেন, সারারাত যে আমরা মা মেয়ে ঠক ঠক করে কাপলাম না সেই ঢের। যেহেতু আমি দেশে থাকি না, তাই কেমন করে যেন অনেক কিছুই আমার চিন্তার আওতায় থাকে না। নিরাপত্তা নিয়েও আমি বেশ উদাসীন।
আমার ভাবটা এমন যেন ছুটে আসতে থাকা বিপদটি ঠিক আমার নাক বরাবর এসে থমকে দাঁড়াবে, ভাববে এতো পরবাসী, এতো দিনে এসেছে নিজের দেশে, একে মাফ দিয়ে আক্রমণের ম্যাপ থেকে একে একদিকে সরিয়ে দেওয়া উচিত।
আম্মা কিন্তু খুবই চিন্তিত। দুই জন মানুষের একা একা চিটাগং আসা উচিত হয়নি বারে বারে বলতে লাগলেন। যদিও উনি খেয়াল করছেন না যে আমাদের সাথে একজন দাড়িওয়াল বডি গার্ড পাঠানো হয়েছে ঢাকা থেকে ইনস্ট্রাক্টেড বাই ইমতিয়াজ ফ্রম আমেরিকা। এনাকে পাত্তা দেওয়া হচ্ছে না। রাখাও হয়েছে হোটেলে। দরকার পড়লেই ডাক দেওয়া হবে, উনি পাহাড় পর্বত টপকে উর্ধশ্বাসে "সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান " মুভির স্টাইলে ছুটে আসবেন। আমাদের ছোটবেলায় দেখা মুভ গুলোর নাম মনে পড়তে লাগলো।
এটাই তো চাইছিলাম। যাবো একবার ডুব দিয়ে অতীতে।
"যেহেতু চট্রগ্রাম পীর আউয়ালিয়ার শহর, আল্লাহ নির্ভর থাকাই ভালো “ — তিনতলার বাসিন্দার এই বিচক্ষণ মতামতের প্রেক্ষিতে ওনাকে মানে দি বডি গার্ডকে বলে দেওয়া হয়েছে আগামীকালকে সারাদিন সব দরগাহ ছুঁয়ে বেড়াতে। এদিকে আজ এতো রাত হয়ে গেছে, ' দি বডি গার্ড ' যার জন্য নতুন এই শহর, সে একা একা কি করছে জানার জন্য আম্মা আবারও ফোন করলেন। উনি জানালেন, রাতভর উনি আমানত শাহ হুজুরের দরগাতে এবাদত বান্দেগী করে রাত যাপন করবেন।
যতদূর জানি, মামলা মোকাদ্দমাতে জেতার উদ্দেশ্যে লোকজন ওনার মাজার জেয়ারত করে থাকেন। চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কর্ণফুলী নদীতে আমানত শাহ (রাঃ) সেতু এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ আমানত হল তার নামেই নামকরণ করা হয়েছে। চোখ বড়ো করে আম্মাকে বললাম, আমাদের বডি গার্ডের বিরুদ্ধে কোনো মার্ডার কেইস নেই তো!!
আম্মা খুব বিরক্ত হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকলেন। আম্মাকে ভয় দেখানো গেলো না, খুবই সাহসী রমণী।
কত গেছি এককালে আমানত শাহ (রাঃ) হুজুরের দরগায়, গরীবুল্লাহ শাহ (রাঃ )মাজারে, মিসকীন শাহ(রাঃ ) মাজারে। গরীবুল্লাহ শাহ (রাঃ ) সম্পর্কে যা জেনেছিলাম অনেক আগে তা এইরকম যে --
সম্রাট শাহজাহানের জ্যেষ্ঠ পুত্র দারাশিকোর ভৃত্য ছিলেন "রুই উল্লাহ" নামে এক তরুণ। দারাশিকো সামুগড়ের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দি হবার পর রুই উল্লাহ যোগ দেন আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীতে। তখন দারাশিকোকে বন্দি অবস্থায় আওরঙ্গজেবের দরবারে নেবার উদ্যোগ নেয়া হলে তিনি যোগ দেন তার সঙ্গি হিসেবে। দারাশিকোর বন্দি জীবনে তিনি তার ঘনিষ্ঠতা অর্জন করেন। পরে জাগতিক ভোগ-বিলাস, তার কাছে অর্থহীন মনে হওয়ায় তিনি সৈনিক জীবন থেকে বিদায় নেন। চলে যান পাটনায়। সেখানে গিয়ে তিনি ইবাদত-বন্দেগিতে মনোনিবেশ করেন এবং আধ্যাত্মিক সাধক পুরুষ হযরত রুকন উদ্দীনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে তিনি গরীবউল্লাহ শাহ (রহ.) হিসেবে বহুলভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সম্ভবত সপ্তদশ শতকের প্রথমদিকে তিনি চট্টগ্রামে আসেন এবং বর্তমানে জিইসি মোড়ের দক্ষিণ-পশ্চিমের পাহাড় চূড়ায় ইবাদতের জন্যে উপযুক্ত স্থান নির্ধারণ করেন। এককালে পুরা পাহাড় জুড়ে ছিল নিরবরতা আর জঙ্গল। তারপর ওই মাজার ঘিরেই গড়ে উঠেছে লোকারণ্য।
তিনতলার বাসিন্দা যেতেই দেখলাম আম্মা এদিক ওদিক প্রচুর তালা লাগালেন।
তারপর শুয়ে পড়লেন। আমি বেশ গর্ব করেই জানালাম, ডালাসে কোনো দিনও তালা চাবি লাগাই না আমরা, এত্ত নিরাপদ। আম্মা আমার কথা যেন কানেই তুললেন না!
আমিও মশার সাথে মারামারি করা বন্ধ করে মশারিতে ঢুকে ফোনের ডাটা খরচ করে ইন্টারনেটে কিছুটা হামা দিয়ে বেড়ালাম। দেখলাম চিটাগং এর কিছু ইতিহাসও। যখন এখানে ছিলাম মনে পরে না কখনো উৎসাহী ছিলাম এই শহরের গোড়া পত্তনের ইতিহাস জানতে। এতো বছর পার করে জানতে ইচ্ছে হলো কী কোথায় কেমন করে এলো এই শহর। তবে যা পড়লাম সবই এলোমেলো ভাবে পড়লাম । এক জায়গায় দেখলাম ১৭৭৬ সালে প্রণীত ব্রিটিশ মানচিত্রে ছিল চট্টগ্রাম সরকার। তখন চট্টগ্রাম নামটি সরকারি দলিলে প্রচলিত ছিল না। এর নাম ছিল ইসলামাবাদ, যা ১৬৬৬ সালে মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খান রেখেছিলেন। স্থানীয়ভাবে ইসলামাবাদের আটপৌড়ে নাম ছিলো চাটিগাঁও। ব্রিটিশরা এই নামটিই গ্রহণ করে। চাটিগাঁওয়ের সংস্কৃত উচ্চারণ চট্টগ্রাম। এখনো চট্টগ্রামকে অনেকে চাটগাঁ বলে অভিহিত করে থাকে। চাটগাঁর সাধু রূপ- চট্টলা।
আরেক জায়গা থেকে জানলাম,পাল বংশের শাসনামলে আরব পর্যটক ও ব্যবসায়ীরা চট্টগ্রাম বন্দরকে 'সমন্দর' নামে চিনতো, ধর্মপালের শাসনামলে চট্টগ্রাম তার অধীনে ছিল। ধর্মপাল নামটা ইতিহাস পড়ুয়াদের কাছে পরিচিত নিঃসন্দেহে। আমার কাছে খুবই পরিচিত। কত পড়েছি মুখস্ত করেছি পাল সাম্রাজ্যের ইতিহাস।
আরেকটি বিষয় তো আমাকে খুবই মুগ্ধ করলো, সেটি জগৎখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতার বয়ান।
১৩৪৬ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম আসেন বিখ্যাত মুর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা। তিনি লিখেছেন -“বাংলাদেশের যে শহরে আমরা প্রবেশ করলাম তা হল সোদকাওয়াঙ (চট্টগ্রাম)। এটি মহাসমূদ্রের তীরে অবস্থিত একটি বিরাট শহর, এরই কাছে গঙ্গা নদী- যেখানে হিন্দুরা তীর্থ করেন এবং যমুনা নদী একসঙ্গে মিলেছে এবং সেখান থেকে প্রবাহিত হয়ে তারা সমুদ্রে পড়েছে। গঙ্গা নদীর তীরে অসংখ্য জাহাজ ছিল, সেইগুলি দিয়ে তারা লখনৌতির লোকেদের সঙ্গে যুদ্ধ করে।…আমি সোদওয়াঙ ত্যাগ করে কামরু (কামরূপ) পর্বতমালার দিকে রওনা হলাম।”
বাহ্, বেশ অথেনটিক বিষয়াবলী জানা যাচ্ছে আমাদের চট্টগ্রাম শহরকে ঘিরে। আজ থেকে শতবর্ষ পরে আমার লেখাটি পড়েও অনেকে দেখবেন আজকের চট্টলাকে। ভাবনাটা মনে আসতেই নিজেই নিজেকে বললাম,বাহ্, বেশ তো। সব লেখারই একটা মাজেজা থাকতে হয়। গাছের উপর যে নিজের নাম লিখে সেও ভাবে কোনো এক দিন এখান দিয়ে যাবার সময় সে বা আর কেউ একজন তার নামটা দেখবে। দেখলেও কি, না দেখলেও কি, কিন্তু সে ভাবে দেখবে, এই রকম একটি প্রত্যাশা নিয়েই লেখে।
ইতিহাস ঘাটতে গিয়ে বেশ ইন্টারেস্টিং একটা তথ্য পেলাম, ১৫৮১ সাল থেকে ১৬৬৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম সম্পূর্ণভাবে আরাকান রাজাদের অধীনে শাসিত হয়। একারণেই আমি প্রচুর বার্মিজ মানুষ কি দেখি চট্টগ্রামে? আমার বান্ধবী যে মিনেসোটা থেকে ফোন করেছিল ওর শাশুড়িও বার্মিজ ছিলেন। আমি তো ভেবেছিলাম ওর শ্বশুর প্রেমে পাগল হয়ে সীমানা টপকে ঐদিকে গিয়ে মিয়ানমার থেকে ওনাকে ভাগায়ে নিয়ে বিয়ে করে নিয়ে এসেছেন। এখন ভাবছি বা মনে হচ্ছে আসলে ওনারা এধারেই ছিলেন। জিজ্ঞেস করতে হবে বান্ধবীকে। আগেই বলেছি দেশে এলেই সবার সব কিছু আমার জানা চাই। সবজান্তা হবার ঝোঁক চাপে যেন। ঘটনা শুনেছি আমেরিকায় বসে অথচ এখন তার ডিটেলস চাই দেশে এসে। এদিকে মনে হচ্ছে, আমি মোটামুটি একরাতেই একজন ইতিহাস গবেষক ও বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলাম। দেখলাম আরকান রাজসভায় পদ্মাবতী খ্যাত কবি আলাওলের মতো বাংলা কবিদের অভুত পৃষ্ঠপোষকতায় সেখানে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত উন্নতি হয়েছিল ওই সময়ে। (আমার মেয়েকে 'অভুত' 'প্রভূত' শব্দগুলো বলতে গেলে সে ভাববে ওই সময়ে আরকান রাজসভায় ভুত-টুত এর সমাবেশ হতো ।) বাংলার সর্বত্র যে প্রচুর কবি-তে গিজগিজ করবে তাতো দেখছি বহু আগেই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিলো । হুম, ভলোই, আমিই জেনেছি তা এতো পরে। আর আমিই কেবল লাফঝাফ মেরে ভাবছি এতো কবি কেন চারদিকে। এহহ তো হোনাই থা (হিন্দি)|
আমার পিলে চমকানো একটা ভাব হলো যখন দেখলাম ১৬৬৬ সালে মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে বাংলার সুবেদার শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রাম দখলের জন্য সৈন্যবাহিনী প্রেরণ করে। তার মানে কি এই চট্রগামের মানুষও এককালে ১ টাকায় ৮ মন চাল কিনতো !! শায়েস্তা খাঁ মানেই তো, টাকায় ৮ মন চাল, এতো সর্বজন বিদিত সত্য। ওহ নো, আই শুড বর্ন এট ডেট টাইম। ভাবলাম আম্মাকে বলি, কিন্তু পরক্ষণে মনে হলো আম্মা শুনলেই বলবেন, তাহলে এতো এতো চাল খেয়ে বাস্ট করতে। আম্মা ঘুমাচ্ছেন ঘুমাক।
রাত দশটা বেজে গেছে মনে হয়, কিন্তু ঘড়ি দেখে আমি অবাক, রাত বারোটা প্রায় বাজে বাজে। এতক্ষণ এলোপাথারি ভাবে ঘুরছিলাম ইতিহাসের পাতায়। আমার রক্তে যে এক ইতিহাসের ছাত্রের প্রবল প্রভাব আছে তাই অনুভব করলাম। আমার বাবা যদি হতেন সংগীতজ্ঞ তাহলে কি এই সময়ে আমি গুনগুনিয়ে গান করতাম! কে জানে! তবে মনে পড়ছে আব্বুকে।
ঘুম ঘুম সময় যেন।
সারাদিনের জার্নির ধকলের ফলাফল হয়তোবা। ঘুমায়ে পরতে হবে। আজ আমি আর আম্মা এক খাটে। আমি এবার দেশে এসেছিলাম আম্মার সাথে থাকতে আর তাই নিয়ত গুনে বরকত হয়ে একদম এক খাটে গিয়ে ঠেকলাম। বহু বছর আম্মার সাথে এক খাটে ঘুমানো হয় না। ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে গেলে আলাদা খাটে, আলাদা ঘরে, যেতে যেতে আলাদা বাসা এবং আমার মতন অনেকেই আলাদা দেশে ও মহাদেশে চলে যায়। যেতে যেতে বহুদূর। আম্মার দিকে চাইলাম। এই মায়ের বুকে ঢুকেই নিশ্চয়ই ছোট বেলাতে ঘুমাতাম। আমার শুমশুমিকে যেমন বুকের মাঝে নিয়ে ঘুমিয়েছি ওর পুরাটা শিশুকাল। এখন মনে হয় আম্মার কাছে সে রকম আবদার করতেও লজ্জা লাগবে আমার!! আম্মা নিজেই গুটলি সুটলি একটুখানি হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। লাগছে এক অসহায় শিশু। শুয়েও আমার এতো আলোতে আর ঘুম আসছে না। আম্মা ঘুমিয়ে গেছেন বহুক্ষণ। লাইট জ্বালিয়ে ঘুমায় আম্মা। এ- ও দুই যুগের ধাক্কা। আব্বু মারা গেছেন ২৪ বছর। সেই থেকে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাচ্ছেন একজন। কত রকম ভাবে যে মানুষের একাকিত্ব প্রকাশিত হয়। আলোতে দেখা যাচ্ছে গভীর আঁধারে বসে থাকা একজনকে। এমনিতে কিন্তু সে প্রচুর মুখরিত থাকে চারদিকের সবকিছু নিয়ে। কখনো কখনো আমার মাতার মাতামাতিতে তান্ডবও হয়ে যায়, টর্নেডো বয়ে যায়। মশারি তুলে আমি আবার নামলাম বাতি নিভাতে। আম্মা ঘুমের মাঝেই যেন টের পেলন, চোখ না খুলেই বললেন, লাইট নিভাবে না।
আমি আছি তো, ভয় কি?
আম্মা বললেন, অন্ধকারে আমার ঘুম আসে না।
বললাম, চারদিকের জানলা দিয়ে বাহিরের সবাই আমাদের দেখতে পাচ্ছে। আম্মা এবার আর কোনো প্রতিবাদ করলেন না, অন্য দিকে ফিরে ঘুমিয়ে পড়লেন।
আগেই বলেছি এই তলার ভাড়াটে না থাকায় আমরা এতে উঠেছি । জানালাতেও পর্দা নেই। বিছানার চাদর দিয়ে পর্দা ঝুলিয়েছি। তারপর-ও এদিক ওদিক দিয়ে কেবলি মনে হচ্ছে সবাই দেখতে পাচ্ছে। বাতি নিভিয়ে দিলাম। বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হলো বুঝি নিউ -ইয়র্ক এর কোনো বারান্দায় দাঁড়ালাম, ওই যে হাই-রাইজ সব দালান কোঠা, আসমান ছোঁয়া চারদিক, তার প্রতিফলন। ঠিক পিছনের বাড়িটা অদ্ভুত। শুধু কাঠামো দাঁড়িয়েছে। কোনো দেওয়াল নেই, ফ্লোর আছে। ভুতুড়ে বাড়ি মনে হচ্ছে।
কানা চোখে চেয়ে দেখতে চাইলাম ভুত টুথ কেউ আছে কিনা ওখানে, আমাকে চেয়ে চেয়ে দেখছে কিনা ওঁনারা কেউ কে জানে। নিজেই নিজেকে বললাম, নেই মনে হয়। থাকলে এতক্ষণে হালুম করে আমার ঘাড় চেপে ধরতো।
তবে বুঝলাম এই রকম পরিবেশে দাঁড়িয়ে খুব সহজেই একটা হালুম খামুল পিলে চমকানো 'গেছো পেত্নী' বা 'চট্টগ্রামের লাল দৈত্য ' নামক গল্প লিখে ফেলা যায়। আমি ভেতর সভয়ে এসে চারতলার অন্য খালি রুমগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। আম্মা ডেকে বললেন, শিগ্রী ঘুমাতে আসো। অন্ধকারে ভুতের মতন ঘুর ঘুর করতে হবে না। সবাই সব কিছু ওই অশরীরীদের দিকেই দেখছি তাক করে ভাবছে। তবে শুলাম না। চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুটা সময়, শুধু আমি আর আমার চিটাগং। সেই একদার এক শহরে আমি জানালা ভেদ করে চেয়ে রইলাম আঁধারে।
এবার এলেন নীরবে জীবনানন্দ দাশ,
“হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে
সরু-সরু কালো-কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার,
শিরীষের অথবা জামের,
ঝাউয়ের— আমের;
কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে!”
নাই মানে কি এই চট্টগামকে? মনে পড়ছে না এই চিটাগংকে যেমন দেখেছিলাম তেমনভাবে! আমাদের নিচের ডুপ্লেক্স অংশটা থেকে দেখলে কি সেই একই রকম লাগতো !!
আম্মা ডাকছেন। শুতে এসে আমি আম্মাকে বললাম, কালকে আমরা দোতলায় আমাদের অংশে চলে যাবো। আম্মা আমাকে অবাক করে দিয়ে কাঁদতে শুরু করলো, বললেন, ওই অংশ ২ দিনে পরিষ্কার করা যাবে না।
আমি বুঝতে পারলাম না সে কেন কাঁদছে, এতে কাঁদার কি আছে !! কিন্তু এরপর একবারও আর বলিনি যে আমি আমাদের নিজেদের বহুদিনের থেকে আসা বসবাসের অংশে গিয়ে থাকতে চাই। কিন্তু সত্যিই আমি বলতে চাইলাম, যেখানে আমি আমরা আব্বুর সাথে থাকতাম, আমরা তিনভাইবোন আর তোমাকে নিয়ে আম্মা আমাদের যে ভীষণ সুন্দর একটা জীবন ছিল আমি সেখানে গিয়ে থাকতে চাই। হয়তো আম্মা আমার কথা বুঝেছে নয়তো সে কেন কাঁদলো! আমাদের কিছুই যে আর আগের মতো নেই, তাই কেন আমি মানছি না তাই কি সে কাঁদলো! এতো বদলে যাওয়া জীবন হলো কেমন করে আমাদের !!
আমি এসেছি আমার বাবার বাড়িতে কিন্তু কোথাও আমার আব্বু নেই। আমার নিজেরই আজ বহু বছর পর আনমনে কাঁদতে মন চাইছে, হাক ছেড়ে, ডাক ছেড়ে। সত্যি বলছি আমি আব্বু আব্বু বলে চিল্লায়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠতে চাইলাম। কিন্তু চুপচাপ নীরবে বসে রইলাম।
রাতে কিন্তু স্বপ্নে আব্বু ঠিকই এলেন।
তখন আমি তার হাত ধরে নাচতে নাচতে বেণী দুলিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। আমি যেন যেতে লাগলাম ওয়ান্ডারল্যান্ডের দিকে। দিকে দিকে মশালের আলো। সর্বত্র মোমবাতির আলো। কোথাও কোনো অন্ধকার নেই তারপরও যেন দেখতে পাচ্ছি জোনাকির ঝিকিমিকি, নুপুরের রিনিঝিনি, সোনালী আলোয় ভরপুর স্বপ্নীল এক জগৎ। আমি পরিস্কার দেখতে পেলাম একটি মেয়ে পরম নির্ভরতায় তার বাবার হাত ধরে খুশিতে মগ্ন হয়ে ডগমগিয়ে ফিরে যাচ্ছে তার বাবার সাথে নিজেদের বাসায় যার দরজার উপর বড় করে লেখা 'হোম সুইট হোম '। আমার আব্বুকে আমি ফিরে পেয়েছি, আহা আমার মায়ের আর কোনো দুঃখ থাকবে না। আমি স্বপ্নের মাঝেই বড় খুশি হয়ে উঠলাম, হ্যাঁ, আমাদের মায়ের আজ তাহলে বড় আনন্দের দিন। আমি নিজের পিতাকে ফিরে পাবার চেয়েও শতগুনে বেশি খুশি হলাম এই ভেবে যে, আমার আম্মাকে আর বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতে হবে না। আমার আম্মা আনন্দে আবার ঝলমল করে উঠবে।
হায়, রাতের স্বপ্ন কেন এতো মনোবাঞ্ছা পূরণীয় হয়!
নাস্তা এসেছে, ওঠো।
আম্মার কথায় ঘুম ভেঙে গেলো। আমার আর ঢুকা হলো না স্বপ্নে আমাদের বাসাতে, সেই দোতলাতে । আপন মনেই মনে হলো, বাবা না থাকলে বাবার বাড়িও থাকে না। মায়েদের তো আমাদেরই আগলে রাখতে হয়। বাবা না থাকলে মায়েদের সেই জোর তেজ বলিষ্ঠতা থাকে না আর। নকলভাবে তা ধরে রাখতে গিয়ে আরো বেকায়দায় থাকেন তারা।
জানিয়েছি আগেই একতলাটাতে দারোয়ান ফ্যামিলির অবস্থান। পুরাটা জুড়ে ওরা থাকে। এখানে ছিল আমাদের ড্রয়িং রুম, গেস্ট রুম ডাইনিং ও কিচেন। সব বেদখল। পানি ওঠে প্রচুর। এমনভাবে একতলার চারদিকে প্রাচীরের বাঁধ তোলা হয়েছে যে আমার মনে হয়েছে ওতে ঢুকতে হলে মশা মাছির মতন একদম ছোট হয়ে গিয়ে উড়ে উড়ে ঢুকতে হবে। কোথাও সিঁড়ি বা দরজা দেখলাম না, সব বন্ধ। ওখান থেকে নাস্তা এসেছে ভেবেছিলাম। আম্মা বললেন, না, সবুজ হোটেল থেকে এনেছে দারোয়ানের তিন জন ছেলের কোনো একজন। আগামী কালকে হয়তো আনবে কোনো এক লাল হোটেল থেকে। জানতে চাইলাম হলুদ হোটেল নেই, কালকে ওখান থেকে আনতে বলো। আম্মা কিছুই বললেন না। বুঝতে পারছে এই সব হোটেল আমার পছন্দ হচ্ছে না। বা কিছুই আমার পছন্দ হচ্ছে না।
আম্মা বললেন তোমরা তো ছোটবেলাতে সবুজ হোটেল পছন্দ করতে, এখন কি হলো? সবুজ হোটেল বদলে গেলে তো রাগ করতে, এখন যে নিজেই পছন্দ করছো না তার কি? কথাতে যুক্তি আছে কিন্তু মায়েরা থাকবেন যেন সদা সর্বদা আমাদের সব অভিযোগ শোনার দায়িত্ব নিয়ে। কাউকে তো বলতে হবে, কোথাও তো রাগ ঝাড়তে হবে, বেগানা রাগ, যে রাগ জায়েজ নয় তাও যেন ঝাড়তে হয় ওই একজনের উপর। যে অভিযোগের কোনো পরিমাপ নেই তাও যাবে একজনের কাছেই, মায়ের কাছে।
দিনভর আমরা প্রচুর কাজ করলাম। সাথে করে নিয়ে আসা অনেক কাজ। কাজগুলো আম্মার। আমি সাথী ওনার। উনি যেদিক যায় আমি সেদিক যাই। একনিষ্ঠ ফলোয়ার। অনেক অফিসে গেলাম, শহরের এ মাথা থেকে ওমাথা ছুটে বেড়ানো হলো। আম্মা নিজেও দেখলাম অনেক জায়গা ভুলে গেছেন। তবে সবখানে আমার ওই এক অনুভূতি কিছুই আর আগের মতন না। সবই অচেনা। আমার বর আমেরিকা থেকে ফোন করে জানতে চাইছিল তাই বা কি করে হয়, পাহাড় যাবে কোথায়। তা ঠিক। ডিসি হিলের পাহাড়টা দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে পাহাড়িকা স্কুল -টা কে দেখে ভালো লাগলো, এখানে আমার এস এস সি পরীক্ষার সেন্টার পরেছিল। তার সামনে একটু ডানদিকের একটা মোড়ে আমার বান্ধবী সুপর্ণা থাকতো, ওর কথা মনে পড়লো। এতো কম সময়ে ওর সাথে আর দেখা করা সম্ভব নয়। ওর বাসা আর পাহাড়িকার মাঝেই যে সরকারি অফিসটা আছে তাতেই আম্মার কাজ।
যথারীতি কেরানি পিয়ন থেকে মোটামুটি সবাই বুভুক্ষ, এককথায় "কিছু দিয়ে যান"।
ভার্সিটিতে টয়লেটের দেয়ালে এককালে যেমন লেখা দেখতাম "ভালোই দিয়া গেলেন " তার থেকে একধরণের ফিড ব্যাক পেয়েছে যেন এরা সবাই। বলে দিলো ২টার মধ্যে এটা ওটা কাগজ না নিয়ে এলে আজকে আর কাজ হবে না। আম্মা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন বাদ দাও, হবে না, চলো এক্ষুনি প্লেনের টিকেট কেটে ফিরে চলে যাই ।
এতো সোজা! বললাম, এখনই বাসায় চলো কাগজ নিয়ে ফিরে আসা যাবে, না গেলে তখন দেখা যাবে। এবং এরপর আমরা দুজনই ঠিকই কাগজ নিয়ে ফিরে এসে কাজ শেষও করলাম। আম্মা এবার খুব খুশি। আম্মা যখন হাল ছেড়ে দেয় তখন আমি ধরি। হাল ছাড়া আম্মাকে তখন বড় অসহায় লাগে। আজ কত বছর হয় সে একাকী একজন মানুষ। সুদীর্ঘ দিনের একাকিত্ব। একা একা সব সামলে ফেরা একজন যোদ্ধা মানুষ। আমি আম্মাকে বললাম, সুলতানা রাজিয়া চলুন এবার খেতে যাই, আম্মা এদিক ওদিক চাইলো, ভাবছে কাকে সুলতানা রাজিয়া ডাকছি। আমার আব্বু যেহেতু ছিলেন ইতিহাসের মানুষ তাই বহু ইতিহাস খ্যাত চরিত্রের নাম ঘুরে ফিরেছে বহুবার আমাদের খাবার টেবিলে, পড়ার ঘরে বা ড্রইংরুমে। আম্মার এ নাম না জানার কোনো কারণ নেই। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে আমার দিকে না তাকিয়েই কি যেন কি বলছে নিজে নিজে। মনে হয় আওড়াচ্ছে যত্সব।
আমি হাসলাম।
বুঝলাম জ্যাক-এ জ্যাক-এ গেলে কাজ হয় দ্রুত, জোকের মতন তখন জেকে বসে কাজ করে নিয়ে বের হয়ে আসা যায়।
অফিসটি থেকে বের হয়ে আমরা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে রইলাম কোন একটা বাহনের জন্য। আম্মা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলেন একঠেলা তরমুজের দিকে। সে খুবই বিরক্ত হয়ে আছে সমগ্র পরিস্থিতির উপর।আম্মাকে খুশি করতে বললাম, বলত, জাতীয় ফল তরমুজ হলো না কেন? ওটার উপরে সবুজ ভিতরে লাল, ওটা তো কাঁঠালের মতনই গায়ে গতরে বড়। আম্মা সাদা সাপ্টা বলে দিলেন, আমাকে কি কেউ কোনোদিন জিজ্ঞেস করেছিল কোনটাকে জাতীয় ফল বানাবে?
আমি ভাবলাম, আরে তাই তো! ভেরি ব্যাড। মহারাণীকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। বাই দা ওয়ে, আমার মায়ের নাম কিন্তু আবার রানী। আব্বু ডাকতেন রানু। বাই ডিফল্ট নামের কারণে সব কিছুতে সে মতামত দিতে অধিকারপ্রাপ্ত। বললাম, কাঁঠালের সাথে তেলের একটা সম্পর্ক আছে তাই ওটা জাতীয় ফল। আম্মা হাসতে লাগলেন।
আমরা এরপর খেতে গেলাম একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। আমাদের সেই গার্ড-কে আম্মা কয়েকবার ফোন করলেন। একবার উনি বললেন গরীবুল্লাহ শাহ -(র:) মাজারে, আরেকবার বললেন আমানত শাহ (র:) হুজুরের দরগায়। দুপুরের খাওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে সে বললো, আস্ত মাছের মাথা দিয়ে ভাত খেয়েছে। কি আনন্দ, আমরা কাজ করে মরি আর উনি মাথা খেয়ে বেড়াচ্ছেন।
এই দোকানে আমরা যাই অর্ডার করি বলে ৩০ মিনিট সময় লাগবে। কি আজব। বসে থাকলাম গালে হাত দিয়ে। আমাদের আসেপাশে বেশ কিছু গুচ্ছ গুচ্ছ ছেলে মেয়ে কলকলাচ্ছে।
আমি যা ভাবছিলাম আম্মা তাই বললেন, বললেন ওদের তুমি আর তোমার বান্ধবী সোনালী পৃথার মতন মনে হচ্ছে। আমি হেসে বললাম, আমরা আরো অনেক সুন্দর এবং প্রাণবন্ত ছিলাম। দেখো না ওরা সবাই হাতের ফোনের দিকেই বেশি মন দিচ্ছে, তাহলে আর একসাথে এসে বসা কেন!
আম্মা বললেন, তোমাদের সময়ে সেল ফোন থাকলে তোমরাও এই করতে। আমি শুধু বললাম, উফ মাদার ওদের পক্ষ নেবে না। ইউ আর মাই মাদার। শুমশুমের কথা মনে এলো, সেও এরকম করেই বলে। এমন করেই আবদার করে।
খাওয়া শেষে বের হয়ে এরপর গেলাম টিকেট কাটতে।
আমাদের বাহকের চালক জানালো, আমরা চাইলে আধা ঘন্টাতে পুরা শহরের চারদিকে এক চক্কর দিয়ে আসতে পারবে সে এখন, এতটাই উন্নত হয়েছে রাস্তা ঘাট যোগাযোগ ব্যবস্থা। কোতোয়ালি, টাইগার পাস, জি এস সি মোড়, দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, বহদ্দার হাট, শাহ আমানত শাহ সেতু, ফিশারি রোড হয়ে সে দ্রুত এই বাণিজ্যিক রাজধানীকে প্রদক্ষিণ করতে পারবে। আরো বললো, কদমতলী ফ্লাইওভার, আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার তো আমাদের দেখাই উচিত সেই সাথে আমানত শাহ(রাঃ) সেতু।
নতুন কিছুতে আমার মন নেই, আমি চাইছি পুরাতন কিছু দেখি। আমার অনাগ্রহ দমিয়ে দিলো চালককে।
তবে থেমে না থেকে চালক বললো “বোনঝি, বিপনী বিতান যান, সেটি পছন্দ হবে"। আমি কিছু বললাম না। গড় গড় করে সে আরো কিছু জায়গার নাম বললো। বুঝলাম সেগুলো এখনো আদি ও অকৃত্রিম রূপেই আছে। তবে এবার আর যাওয়া হবে না সেগুলো খুঁজে দেখতে।
ঠিক করলাম বাসেই ফিরে যাবো বাংলার পথ ঘাট দেখতে দেখতে। প্লেনের উঠে মেঘ দেখার দরকার নেই। আমেরিকা ফেরত যেতে যেতে সারা পথে তো ওই মেঘ-ই দেখবো।
এবার দেখা হবে না পতেঙ্গা সমুদ্র্র্র সৈকত, ফয়েজ লেক, বায়েজিদ বোস্তামী মাজার আরো অনেক কিছু। বাংলার মেঠো পথ-ই দেখবো, সেই ভালো।
মনে এলো সৈয়দ শামসুল হক এর স্মরণীয় পংক্তিগুলো:
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, ‘কোথা থেকে তুমি এলে ?’
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙার বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈবর্তের বিদ্রোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।