তবু দস্তরখানা নামের একখণ্ড সুতিবস্ত্র মুসলিম আভিজাত্যের বুনন নিয়ে, কয়েক হাজার মাইল পথ ঘুরে, বাংলার খড়ের চালা আর মাটির দরিদ্র ঘরে কী করে এল, ভাবতে বসলে গালে হাত দিতে হয়।
Published : 13 Apr 2025, 02:55 PM
বাঙালি মুসলমান কী খায়? তার আগে জানতে হবে— বাঙালি মুসলমান কাকে বলব।
দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে পূর্ব পারস্যের ঘোর নামে এক ছোট্ট রাজ্যের শাসক (তাজিক বংশোদ্ভূত) মুইজুদ্দিন মুহাম্মদ ঘোরি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার চেহারা আমূল বদলে দেন।
১১৯২ সালে দিল্লি জয় করার পর মুহাম্মদ ঘোরি প্রতিনিধি-শাসক হিসেবে কুতুবউদ্দিন আইবেককে সেখানে নিয়োগ করে বেরিয়ে পড়েন অন্যান্য ভূখণ্ড জয় করতে। এরই মধ্যে, ১২০৪ সালে, ঘোরিরই অন্যতম সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে গাঙ্গেয় অঞ্চলে একটি অভিযান পরিচালিত হয় এবং মামলুকরা নতুন অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।
১২০৬ খ্রিস্টাব্দে মুইজুদ্দিন নিহত হন। তাঁর কোনো সন্তান না থাকায় বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী কে হবেন? এমন প্রশ্নে আত্মবিশ্বাসী ঘোরির উত্তর ছিল, তাঁর এক হাজার ক্রীতদাসকে এমন ভাবে তিনি সুশিক্ষিত করেছেন, যারা দুনিয়া শাসন করতে পারে। মৃত্যুর পর মুইজুদ্দিনের সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে যায়। যেমন তিনি ভেবেছিলেন, ঘোরির মামলুক সেনাপতিরা এসব সালতানাতের নেতৃত্ব লাভ করেন। যেমন তাজউদ্দিন ইলদিজ, ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মহ বখতিয়ার খিলজি, নাসিরউদ্দিন কাবাচা, কুতুবউদ্দিন আইবেক যথাক্রমে গজনি, বাংলা, মুলতান এবং দিল্লির শাসক হন।
বাংলায় ইখতিয়ারউদ্দিনের আসার পর তুর্কিদের গেড়ে বসতে আরো অনেক বছর সময় লেগে যায়। প্রায় শতবর্ষ। বলা যায়, বাঙালি মুসলমান গঠনের সেই শুরু। সেকালে ধর্মান্তরিতদের সংখ্যা যত বেড়েছে, তত বেড়েছে শত্রুতা। গলাগলিও হয়েছে কখনো। দীর্ঘ আটশো বছর দুই সম্প্রদায়ের সম্পর্কস্রোত কখনো ঘূর্ণি তুলে, কখনো শান্ত তরঙ্গায়িত হয়ে এত দূর এসেছে। এরকমই এক ক্ষণিক সুসময়ে নজরুলকে লিখতে হয়েছিল:
বদনা গাড়ুতে গলাগলি করে
নব-প্যাক্টের আশনাই।
মুসলমানের হাতে নাই ছুরি,
হিন্দুর হাতে বাঁশ নাই।
তুর্কি, আরব, হাবশি, মোগল, পাঠান— নানান উচ্চাভিলাষী জাতির সংস্পর্শে-সংঘর্ষে এভাবেই আটশো বছর পেরিয়ে গেল। তার অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের সামাজিক গঠনক্রিয়া আজো শেষ হয়নি যদিও, তবু একধরনের আদল সে পেয়ে গেছে। এবং সেই আদলে তার হাজার বছর আগের আদি জলপানের ভঙ্গিটিকে, ভাঙাচোরা হলেও, আজো দেখতে পাই। ফলে সে ধর্মে মুসলমান, কিন্তু জাতিতে আজো বাঙালি।
এই-যে বাঙালি কিন্তু মুসলমান, এদের যেমন অনেকগুলো স্তরবিশিষ্ট নিজস্ব একটা সমাজ আছে, তেমনই আছে সম্প্রদায়-নিরপেক্ষ একটা সমাজ, যা বৃহত্তর, যাদের আমরা বলি— বাঙালি। পাল-পার্বণ এলে সেই বৃহত্তর সমাজ থেকে হিন্দু বন্ধুরা আবদার করে— ‘ইদে কী খাওয়াবি, বল।’
উত্তরের অপেক্ষা না করেই তাদের সরল দাবি— ‘বিরিয়ানি খাব কিন্তু। মাটন। সঙ্গে চিকেন চাঁপ হলেই চলবে। শেষপাতে বুরহানি আর ফিরনি। ব্যস। হবে তো?’
বন্ধুটি জানে না, কলকাতায় এবং শহরাঞ্চলে অধুনা-অতিপ্রচলিত এ-সব খাবার বাঙালি মুসলমানের রান্নাঘরে আজো তেমন সড়গড় হতে পারেনি। এবং আরো একটা কথা— শহরাঞ্চলের এইসব রেস্টুরেন্ট আদপে বাঙালি মুসলমানেরই নয়। এগুলো মূলত বিহার-ইউপি থেকে আসা ভাগ্যান্বেষীদের। আদিতে লখনউবাসীদের, যারা এ-অঞ্চলে এসেছিল অউধের নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর আকর্ষণে। পরবর্তীকালে সেই একদা-লখনউবাসীদের এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের সূত্রে এইসব রেস্টুরেন্টের পত্তন হয়েছিল কলকাতায়, মূলত জ্যাকারিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে। আদি বলতে আমজাদিয়া, আমিনিয়া, রয়াল ইন্ডিয়া হোটেল। দেশভাগের পর সর্বাধিক বিখ্যাত আমজাদিয়া চলে যায় লাহোরে। লাহোরেও, শোনা যায়, তার খ্যাতি কম নয়। ওই এলাকার বিখ্যাত মিষ্টির দোকান আলাউদ্দিন। দেশভাগের সময় তাদেরও একটা অংশ চলে যায় ঢাকায়। আলাউদ্দিন এখন ঢাকার মিষ্টির দোকানের সবচেয়ে বড়ো চেন।
ফলে বাংলার দক্ষিণ থেকে উত্তর— সব এলাকারই আদি মুসলিম হোটেলগুলো অবাঙালি মুসলমানদের মালিকানাধীন। তাই সেসব রেস্টুরেন্ট মোগলাই ঘরানার না-হলেও বাঙালি ঘরানার নয়। সেসব হোটেলে কখনো ফুলকপির তরকারি বা বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল আশা করা যায় না। বাংলা ভূখণ্ডে এটা কী করে-যে সম্ভব হল, বড়ো একটা গবেষণার বিষয়।
তাহলে বাঙালি মুসলমানরা কী খায়, জানতে গেলে তাদের অন্দরে যেতে হবে।
দুই
যদি বাঙালি বলে বিশ্বাস করো, তাহলে এটাও বিশ্বাস করতে হবে— আমানি শব্দটি এবং খাবারটি অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান জ্ঞানত জানে এবং আবাল্য খেতে দেখে আসছে। গ্রামের বাঙালি মুসলমানের খাদ্যাভ্যাসে ‘আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান।’
কবিকঙ্কণ মুকুন্দ আনুমানিক ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দে চণ্ডীমঙ্গল কাব্য লিখেছিলেন। ‘আমানি’ শব্দটির লিখিত বয়স পাঁচশো পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে গেল। আর ভাত?
সহস্রাধিক বছর আগে চর্যাগীতিকায় ভুসুকুপাদ লিখে গেছেন—
কাল মুসা উহন বাণ।
গঅণে উঠি চরই আমণ ধাণ।।
অর্থাৎ-- ইঁদুর কালো, তার রং দেখা যায় না। আকাশে উঠে সে আমন ধানের উপর চরে বেড়ায়।
এহেন বাঙালি যতই সবুজঘন বাংলায় বাস করুক, হরিয়ালি কাবাব তার খাদ্যাভ্যাসে কখনো ছিল না এবং আজো নেই।
সুদূর চর্যাগীতিকা আর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মাঝখানে রয়েছেন শাহ মুহম্মদ সগীর। আর তাঁর ইউসুফ-জোলেখা কাব্য। রচনাকাল ১৩৯১ থেকে ১৪১০-এর মধ্যে। অর্থাৎ, এটি শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের চেয়ে কিঞ্চিৎ পুরনো। বলা হয়, শাহ মুহম্মদ সগীরই প্রাচীনতম বাঙালি মুসলমান কবি। তাঁর কাব্যের পটভূমি মধ্যপ্রাচ্য হলেও সগীর সুদূর মিশরের পটভূমিতে নিয়ে গিয়েছেন বাংলার পান-সুপুরি। লিখেছেন— ‘কাহাক খাওয়ায় কেহ কর্পূর তাম্বুল।‘
এমনকি ‘সন্দেশ’ শব্দটি পর্যন্ত পৌছে গেছে তাঁর কাব্যে:
কণক কাটোরা ভরি মধুমিষ্ট সুখে
জলিখা তুলিয়া দেন্ত ইসুফক মুখে।
ঘৃত মধু শর্করা বহুল দুগ্ধ দধি
সুধারসে পূরিত সন্দেশ নানা বিধি।
এ তো প্রায় সাতশো বছর ওপারের কথা। কিন্তু বাঙালি মুসলমান সমাজে এসব খাবারের ধারাবাহিকতা আছে কি?
তাহলে আমাদের দেখতে হবে দু-টো পুরনো বই, দেখতে হবে— বাঙালি মুসলমান কী খেয়ে আসছে।
খুব বেশি অতীতে আমরা যেতে পারব না। আমরা যাব মীর মশাররাফ হোসেনের (১৮৪৮–১৯১২) কাছে। তাঁর ‘আমার জীবনী’ নামের জীবনকথায়। দেবীপদ ভট্টাচার্য-সম্পাদিত, শতবর্ষপ্রাচীন গ্রন্থে মুসলমান বাঙালির যেসব খাবারের উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোর চারটি নমুনা এরকম:
১। ধনীর অতিথিশালায় গরিবের জন্য ‘মোটা আঊস ধান্যের ভাত আর খেসারীর ডাল’। (পৃষ্ঠা ১৪)
২। প্রসুতির খাবার কেমন? ‘ভাজা চালের গুঁড়া জলে সিদ্ধ করিয়া সামান্য একটু আখের গুড়ের মিষ্টির সহিত ঝালে ঝোলে একত্র করিয়া সেই কিম্ভূতকিমাকার খাদ্য প্রসূতিকে দেওয়া হয়।‘ (পৃষ্ঠা ৬০)
৩। ‘চাচিই উনুন জ্বালিয়া রান্না করিলেন। সোল মাছ আর সরু চালের ভাত।‘ (পৃষ্ঠা ১৮৬)
৪। ‘জলযোগের ব্যবস্থা কি? দুধ, চিঁড়ে, খেজুরের গুড়, কোন কোন দিন বাগানের পাকা কলা।‘ (পৃষ্ঠা ১৯৪)
এরপর আমরা পড়ব সৈয়দা মনোয়ারা খাতুনের স্মৃতিকথা থেকে কয়েকটি অংশ। সৈয়দা মনোয়ারার (১৯০৯-১৯৮১) জন্ম এক ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারে, যশোর জেলার কেশবপুরের মির্জানগর গ্রামে। বাবার নাম সৈয়দ মোনায়ম বকশ। ‘স্মৃতির পাতা’ নামের আত্মকথায় তিনি লিখছেন:
১। ‘পুণ্যের দিন… একটা স্মরণীয় দিন ছিল।… বাজনা আসত ঢোল সানাই কাঁসি বাঁশি সব।… দলে দলে প্রজারা সালাম করত, টাকা রাখত। বড়ো বড়ো কাঁসার থালা রাখা থাকত টাকা রাখার জন্যে।… দু’টো খাসি জবাই করা হত, পুকুর থেকে বড়ো বড়ো মাছ তোলা হত, বাগান থেকে ঝুড়ি ভরে তরকারি আসত।‘
২। ‘নৌকায় চলতে চলতে গৌরীঘোনা বলে একটা জায়গা পথে পড়ত। সেখানে আমাদের তালুক ছিল।… সতীশ নামে এক হিন্দু ব্রাহ্মণ ওখানকার কাছারির নায়েব ছিল। তাকে খবর পাঠালে সে এসে আমার মাকে সালাম পাঠাত,… পাঠাত ডাব, নারকেল, ঝুনো নারকেল। জাল ফেলে মাছ ধরে পাঠাত, বাড়িতে কোনও খাবার রান্না করে পাঠাত। কিংবা সন্দেশের হাঁড়ি পাঠাত।‘
৩। ‘পোলাও আমার নানি নিজে রাঁধতেন। অনেকে বলত মিশ্রীডাবার মেয়ে, নোনা চিংড়ি, যাতে দাও তাই মজে।
৪। পাঁচ পয়সা দিয়ে বড়ো এক জোড়া ইলিশ মাছ কিনতেন, তাও দরজায় আসত। একটা ভাজতেন, একটা রাঁধতেন, ইলিশ মাছের পিঠে করে সকলে নাস্তা করতেন।‘
৫। ‘সেজো ভাই পাখির গোস্ত খেতে খুব ভালোবাসত, নারকেল দুধ দিয়ে ভুনা করে দিতে হত।‘
টুকরো-টুকরো এইসব বর্ণনা থেকে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অন্দরের দৃশ্যমালা আমরা খানিকটা দেখতে পাই। তাদের ভাষা। তাদের জীবনযাপন। তাদের খাবার-দাবার। তারা কারা?
বড়ো একটা দল থেকে চলার পথে একদল মানুষ ক্রমে অন্য ধর্মাচরণে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল একদিন। কিন্তু তাদের ভাষা রইল একই। অল্পস্বল্প পরিবর্তন হলেও তারা নিবেদিত রয়েছে সেইসব খাদ্যেরই প্রতি, যেগুলোকে আমরা বাঙালি খাবার-দাবার বলি। তারাই বাঙালি মুসলমান।
তবু দেখি, বাঙালি মুসলমানরা ঠিক কী-কী খায়। তাদের রান্নার পদ্ধতি কেমন। তৈজসপত্রই-বা কোন ধরনের।
তিন
বাঙালি মুসলমানের খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে-সব আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বা ক্রিয়াকর্ম, সেসবের কিছু পরিচয় এখানে রইল। যেমন চাটু, চিলমচি (পুরনো কলকাতায় শব্দটি চালু ছিল।), ডেকচি, ডেগ, তন্দুর, তাওয়া, তিজেল, পাতা, পাতিল, পিকদানি, পেয়ালা, পলা/পলি, পানের বাটা, পিরিচ, বাবুর্চি, হুঁকো, যাঁতি, যাঁতা, রেকাবি, লাকুড়ি/লাকড়ি-- এরা প্রামাণ্য বাংলায় স্থান পেয়েছে। এদের কিছু শব্দ বাংলায় এসেছে মুসলমানদের ন্যাওটা হয়ে। অর্থাৎ তুর্কি, পাঠান এবং মোগল শাসকদের আর তাঁদের অনুচরদের সঙ্গে। এই জাতিগুলির আরবি এবং ফারসি লব্জ থেকেও। বাকি শব্দ এ-দেশীয় অথবা বাইরে থেকে অন্য সূত্রে বাংলায় এসেছে। যেভাবেই আসুক, শব্দগুলো প্রামাণ্য বাংলায় ঠেলেঠুলে বেশ-একটা জায়গা করে নিয়েছে।
বাকি রইল খানা, তশতরি, রকাবদার, দস্তরখানা, তশরিফ, দাওয়াত, মেহমান, গোসল, পানি, খিলাল— এই ধরনের আরো অনেক শব্দ। এরা প্রামাণ্য বাংলায়, চেষ্টা করেও, জায়গা পায়নি। তবু বাঙালি মুসলমানরা এই শব্দগুলো নিজের লব্জে ধারণ করে আছে। আছে; তবে বক্তার ঠোঁটে প্রামাণ্য বাংলায় গৃহীত প্রতিশব্দটিকে একপায়ে খাড়া রাখতে হয়েছে। পরিস্থিতি-অনুযায়ী দাওয়াত টুক করে সরে যায়, সামনে আসে— নিমন্ত্রণ। এমন ক্ষেত্রে সবচেয়ে তৎপর থাকতে হয় পানি এবং জল শব্দদুটিকে। অবস্থাক্ষেত্রে এরা মুহূর্মুহূ একে অন্যের জায়গা নেয়। এ-পারের বাঙালি মুসলমানের জল-বন্দিত্ব এবং ওপারের বাঙালি হিন্দুর পানি-গিরফতারি আমরা মেনে নিয়েছি কীভাবে? ধরা যাক বাড়িতে শুধু আমরাই রয়েছি। খেতে বসেছি। টেবিলে রয়েছে পানি। হ্যাঁ, পানিই। কিন্তু, সেসময় কোনো অমুসলমান বন্ধুর প্রবেশ ঘটলে মুহূর্তে পানির গ্লাসগুলো হয়ে যাবে জলের গ্লাস। এই সচেতনতা যে কতটা শিকড়প্রসারী, বোঝা যায় আমার দশ বছরের নাতনির মুহূর্তে রূপান্তরিত জলে!
এইভাবে বাংলার দুইপারে দুই সম্প্রদায় নিজেদের প্রভুত্ব কায়েম রেখে আসছে।
তালিকার দিকে যদি তাকাই, আমরা দেখব— বাঙালি মুসলমান ‘মুসলমানি’ (আলোচনার সুবিধের জন্য শব্দটি ব্যবহার করছি।) শব্দ যত ব্যবহার করে আসছে, তার চেয়ে বেশি— অনেক বেশি— ব্যবহার করছে সর্বজনগ্রাহ্য বাংলা। কেন করে?
তারা বাঙালি বলে।
প্রামাণ্য বাংলায় স্থান পাওয়া ‘মুসলমানি’ শব্দগুলো তো বাংলা হয়ে গেছেই। যেগুলো স্থান পায়নি, ‘মুসলমানি’ শব্দের তকমা নিয়ে আজো রয়ে গেছে, সেরকম বেশ কিছু আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দ তারা বলে বটে। তবে প্রভুদের বা বড়োদের মুখে শুনে-শুনে শিখেছে। প্রকৃত অর্থ এবং উচ্চারণ অনেকে জানেও না। তবু-যে বলে, এটা নিশ্চিত সেই শুরুর দিনগুলোর, অর্থাৎ কয়েক শতাব্দী আগের, পরিচয়-সংকট থেকে। যেমন মেহমান শব্দটি। ‘অতিথি’ শব্দটি সে জানে। তবু বহু জায়গায় তাকে উচ্চারণ করতে শোনা যায়— মে’মান। বিষয়টি আমরা এভাবেই দেখেছি।
কোনো-কোনো ক্ষেত্রে বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে লোকাচার। এবং সেই লোকাচারের শিকড় কত দূরে, তার গভীরতার পরিমাপ করা এখন দুঃসাধ্য। সেসবের কোনো-কোনোটার শিকড় নিশ্চিত ত্রয়োদশ শতক পেরিয়ে আরো অতীতে, যখন নাকি তুর্কিরা বাংলায় আসেইনি। তাছাড়া লোকাচার অঞ্চলভেদে পালটে যায়। পালটে যায় লোকাচারের চরিত্র এবং তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা শব্দও। দুই বাংলার এত-এত জনপদের মুখের ভাষা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। যেমন ধরা যাক সিন্নি শব্দটির কথা। সত্যপিরের সিন্নির কথা সবাই জানি আমরা। মুসলমান সমাজে সিন্নি দেওয়ার চল আছে মসজিদে, মাজারে, স্থানীয় কোনো ‘বাবার থানে’। বাংলা জুড়ে কত-না পির! সেইসব পিরের আস্তানায় কত রকমের সিন্নি দেওয়ার প্রথা। সব আয়ত্তে আনা সম্ভব নয়। যেমন, ১৩৩৯ সালের ‘সাহিত্য-পরিষদ-পত্রিকা’-র তৃতীয় সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ চোখে না-পড়লে আমরা জানতেই পারতাম না ‘ময়মনসিংহের সাধারণ গৃহস্থ মুসলমান পরিবারে অনুষ্ঠিত কয়েকটি সিন্নী ও আচার-নিয়মের বিবরণ’ নামের প্রবন্ধটির কথা। ওই প্রবন্ধে কামিনীকুমার দত্তরায় ‘ষষ্ঠীর সিন্নী’ প্রসঙ্গে লিখছেন: ‘পূর্ব্বে মুসলমান পরিবারে, আম-কাঁঠাল পাকিলে, ষষ্ঠীর সিন্নী না হওয়া পর্যন্ত বাড়ীর অন্ততঃ একজনে তাহা খাইতেন না। কোনও এক নিদ্দিষ্ট দিনে আম-কাঁঠালের বিশেষ যোগাড় করিয়া মোল্লাকে খবর দিতেন। তিনি আসিয়া কয়েকটা আগপাতায় আম-কাঁঠাল সাজাইয়া দিয়া ফতুয়া পড়িতেন। তারপর সকলে মহাস্ফূর্তিতে এক সারিতে বসিয়া সেই সকল খাইতেন। বর্তমানে ক্বচিৎ ইহা দেখা যায়। কিন্তু জ্যৈষ্ঠ মাসে নিতান্ত দুঃখিনী জননীও কন্যাকে নিজ বাড়ীতে এখনও আনাইয়া থাকেন। তাঁহার জামাতা আম-কাঁঠাল এবং মধু কিংবা দুধ লইয়া শ্বশুরালয়ে আসেন।’
এতসব খোঁজ রাখি না আমরা। তাই বাংলার মুসলমান-বাড়িতে অবলীলায় মোগলাই খাবার আশা করি। বাঙালি মুসলমান-বাড়িতে মোগলাই খাবার পাওয়ার ধারণা, এই ধারণাটা তো হিন্দু বাঙালির। কী করে এবং কখন থেকে এমন ধারণা তার হল? চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতকে বাংলার কেউ বিরিয়ানি জানত না। শাহ মহম্মদ সগীরের ইউসুফ-জুলেখা কাব্যে সমস্ত খাবারই বাংলার। তারপরে ষোড়শ শতকে আর-একটি সমাজচিত্র অঙ্কিত হয়েছে কবিকঙ্কণ মুকুন্দর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে। বলতে গেলে, উপন্যাসোপম কাব্য। সেখানে ১৩০ সংখ্যক কবিতার পুরোটাই গুজরাট নগরের মুসলমানদের সম্পর্কে বর্ণনা। ত্রিপদী ছন্দে লেখা কবিতায় মুকুন্দ যে-যে বিষয় বর্ণনা করেছেন, শেষ দুটি পদ বাদ দিলে, সবই মুসলমান সমাজের ধর্ম-সম্পর্কিত। যথা:
বসিল অনেক মিঞা আপন টবর নিঞা
কেহো নিকা কেহো করে বিহা
মোললা পড়াইয়া নিকা দান পায় সিকা সিকা
দোয়া করে কলিমা পড়িআ।
করে ধরি করা ছুরি মুরগী জবাই করি
দশ গণ্ডা দরে পায় কড়ি
বকরি জবাই জথা মোললাকে দেই মাথা
দরে পায়ে কড়ি ছয় বুড়ি।
জত শিশু মুসলমান করিআ দলিজখান
মখন্দম পড়ায়ে পড়ানা
রচিআ ত্রিপদী ছন্দ গান কবি শ্রীমুকুন্দ
গুজরাটপুরের বর্ণনা।
ফলে মুসলমান বললেই যে-ছবি অধিকাংশ হিন্দু বাঙালির চোখে আজো ভাসে, সেটিতে ষোড়শ শতকের এই সিলমোহরটি মারা। প্রায় পাঁচশো বছর বয়স হল ছবিটার। কী মোক্ষম বর্ণনা মুকুন্দর! বুকে যেন গেঁথে দিয়েছেন। আজো এতটুকু মলিনও হয়নি। এর সঙ্গে অনেক পরে যুক্ত হয়েছে মোগলাই খাবার। কেননা, তখনো মোগলরা বাংলায় গেড়ে বসেনি। আর মোগলাই খাবার তো তুর্কিদের মতো নয়!
অনেক পরে আঠারো-উনিশ শতকে যখন হিন্দুস্থানি মুসলমানরা কলকাতায় এল, এল লখনউয়ের সংস্কৃতি, মোগলাই খানা ছিল তাঁদের সঙ্গী। প্রথমে মেটিয়াবুরুজ, ক্রমে কলকাতা শহরে বেশ কয়েকটি মোগলাই রেস্টুরেন্ট গজিয়ে ওঠে। শুরু হয় বিরিয়ানি-সংস্কৃতি। কিন্তু এর সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের কোনো সংযোগ ছিল না এবং আজো নেই।
যদি বিরিয়ানি-সংস্কৃতির বিপরীত কিছুর উল্লেখ করতে হয়, বলতে হয় বাংলার পোলাও-সংস্কৃতির কথা।
প্রশ্ন আসতেই পারে-যে কেন পোলাও এত গুরুত্ব পেল বাঙালি মুসলমানের কাছে? বিরিয়ানি কেন নয়?
সুদূর অতীতকাল থেকে ইরানে পোলাও ছিল একই সঙ্গে অভিজাত এবং জনপ্রিয় একটি খাবার। ভারতে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তুর্কিরা। তুর্কিরা আলতাই পর্বতের পাদদেশ থেকে যখন ছড়িয়ে পড়ে উত্তরে, পশ্চিমে, দক্ষিণে— তারা ছিল বুনো, কৌলীন্যহীন এবং হিংস্র। সেই তুর্কিরা-যে একদিন পৃথিবী জুড়ে সভ্যতার ধারক হবে, তার ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল তৎকালীন দুনিয়ার উন্নত ইরানি সংস্কৃতির প্রতি তাদের আকর্ষণ থেকে। তুর্কিরা যখন বাংলা দখল করে, ত্রয়োদশ শতকের সেই শুরু থেকে দু-তিন শতাব্দীর অশান্ত সময়েও তাদের শিকড় চারিয়ে যাচ্ছিল বাংলার মাটিতে। তৈরি হচ্ছিল নতুন এক সমাজ, যারা পরে বাঙালি মুসলমান নামে পরিচিতি পাবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠী শিখেছিল তুর্কিদের সঙ্গে আসা আদি ফার্সি পোলাও ঠিক নয়, তার দেশজ সংস্করণ। খুঁজলে এরকম আরো কিছু জিনিস পাওয়া যাবে বাঙালি মুসলমান সমাজের অন্দরে, যা বাকি ভারত থেকে আলাদা।
আকবরের আমলে, মানসিংহ-কর্তৃক, বাংলা পরাধীন হয়। তার আগে সুলতানি আমল ছিল বাঙালি মুসলমানের ভিত্তি। ফলে, মোগলাই খাবারকে বাঙালি কখনো নিজের করে নিতে পারেনি। তাহলে ঢাকায় কাচ্চি বিরিয়ানির উদ্ভব আর বিকাশ হল কী করে? তেহারিই-বা এল কোত্থেকে? এখানে আমরা ইতিহাসের পাতা একটু উলটে দেখি।
চার
১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে দাঊদ শাহ কররানিকে পরাজিত ও নিহত করে আকবরের বাহিনী বাংলার সুলতানি যুগের অবসান ঘটায়। শুরু হয় মোগল যুগ। কিন্তু মুনিম খান থেকে রাজা মান সিংহ পর্যন্ত পরপর ন-জন মোগল সুবাদারের কেউ সম্পূর্ণ বাংলা দখল করতে পারেননি। এই সময়টি বাংলার অস্থির সময়। দ্বাদশতম সুবেদার ইসলাম খান চিসতিই প্রথম বাংলাদেশের নদীমাত্রিক চরিত্রটি বুঝতে চেষ্টা করেন এবং শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করে ১৬০৬ সালে রাজমহল থেকে অনেকটা পুবে, ঢাকায়, তাঁর রাজধানী স্থাপন করেন। শহরটির নাম হয় জাহাঙ্গিরনগর। বাংলায় ঢাকা মোগলদের প্রতিষ্ঠিত একমাত্র শহর, যেটি আজো প্রাণচঞ্চল। সরকারিভাবে রাজধানী ঢাকা থাকলেও ১৭০৩-এ তার গৌরব অনেকটা ম্লান হয়ে যায়, যখন সুবেদার শাহজাদা আজিম-উস-সানের সঙ্গে বাংলার দিওয়ান মুর্শিদকুলি খানের মতদ্বৈধতা দেখা দেয় এবং সম্রাটের নির্দেশে মুর্শিদকুলি খান দিওয়ানি দপ্তর মুখসুদাবাদে নিয়ে চলে যান। সেই থেকে মুখসুদাবাদের, যা পরে হয় মুর্শিদাবাদ, উত্থান। এই পর্বটি পরিণতি পায় ১৭১৬ খ্রিস্টাব্দে, মুর্শিদকুলি খান বাংলার সুবেদার হলে। ওই বছর মুর্শিদাবাদই হয় বাংলার রাজধানী এবং প্রধান শহর। ঢাকা থেকে রাজধানী সরে এলেও ঢাকার সাংস্কৃতিক গুরুত্ব কমেনি। মোগলাই চলন তার থেকে গেছে। আর, পশ্চিমবঙ্গে-যে নতুন করে মোগলাই সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়বে, তার সময় আর পাওয়া যায়নি! ১৭১৬ থেকে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত— মাত্র ৪১ বছর! তারপর পলাশি। তারপর যত জৌলুস কলকাতার। বাদবাকি পশ্চিমবাংলা থেকে গেল আদ্যিকালের সেই তুর্কি চলনের ছিটেফোঁটা নিয়ে।
এখানে একটু পোলাও-কথা। পোলাও রান্নার ধ্রূপদী বাবুর্চি আর নেই প্রায়। উৎকৃষ্ট পোলাও রান্না কী-যে পরিশ্রমের আর ধৈর্যের কাজ, যিনি দেখেছেন এবং সেই পোলাওয়ের স্বাদ গ্রহণ করেছেন, সেইসব ভাগ্যবানের সংখ্যাও এখন হাতে গোনা। এক উৎসব-বাড়িতে পোলাও রান্না হবে। ফজরের নামাজের অনেক আগে থেকে লেগে পড়েছে দুজন। তাদের কাজ কিলো-কিলো কাজু নখের ডগায় কুচি-কুচি করা, যে-কুচোগুলো চালের সঙ্গে মিশে গা-ঢাকা দেবে। এবং চাল আর কাজুর অনুপাতটি বাবুর্চির পেট থেকে কোনোদিন বেরোবে না। এটিই মৌল উপাদান। এরপর মসলা এবং তার পরিমাণ, সময়— সব কিছু মিলে যে-খাদ্যটি প্রস্তুত হবে, খেয়েই বলছি, কোনো বিরিয়ানির পক্ষে তেমন উচ্চতায় ওঠা সম্ভব নয়। বেশি কথা কী, সম্রাট শাহজাহানের রান্নাঘর থেকে নাম-না-জানা লেখক দ্বারা সংকলিত ফারসি বই ‘নুসখা-ই-শাহজাহানি’র ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সালমা ইউসুফ হোসেন (দ্য মোগল ফিস্ট: রেসিপিস ফ্রম দ্য কিচেন অফ এম্পারার শাহজাহান, রলি বুকস) । সেখানে পোলাও রান্নার ছাপ্পান্ন রকম পদ্ধতির বর্ণনা রয়েছে!
কিন্তু এ তো মোগলাই রান্নাঘরের হিসেব। তার আগের পর্বটি কেমন ছিল?
এখনো পর্যন্ত একটি মাত্র রান্নার বই পাওয়া গেছে প্রাক-মোগল যুগের। ‘নিয়ামতনামা’। যার অর্থ— আনন্দ-কাহিনী। সেটি বাংলায় অনুবাদ হয়েছে ‘নিমাতনামা’-নামে (অনুবাদ: সুপর্ণা দেব, ৯ঋকাল বুকস, ২০২৪)। আশ্চর্য এই বইটি মান্ডুর বিলাসী সুলতান গিয়াসউদ্দিন শাহ খিলজির লেখা। শেষ করেছেন তৎপুত্র নাসির শাহ। পঞ্চদশ শতকের শেষে এবং ষোড়শ শতকের এক্কেবারে শুরুর পর্বে বইটি সঙ্কলিত হয়। ‘নিমাতনামা’য় মোগলাই খাবারের বর্ণনা থাকার কথা নয়। কিন্তু কত রকমের মাংস রান্নার কৌশল-যে জানা ছিল তাঁদের, বইটি তার প্রমাণ। অন্তত কুড়ি রকমের ভাত এবং পোলাওয়ের বর্ণনা রয়েছে ছোট্ট এই বইটিতে। বিরিয়ানি নেই।
যদিও বিরিয়ানির খ্যাতি মোগলাই খাবার হিসেবে, মুনশি ফয়জুদ্দিনের লাল কেল্লার শেষ দিনগুলির বিখ্যাত বিবরণগ্রন্থ ‘বাজম-ই আখির, দ্য লাস্ট গ্যাদারিং’ পড়লে বোঝা যায়, কেল্লার শাহি রান্নাঘরে পোলাওয়েরই আদর ছিল বেশি। যেমন মোতি পোলাও, নুর-মেহলি পোলাও, নুকতি পোলাও, আনারস পোলাও, মুজাফফর পোলাও, জুমুররুদি পোলাও ইত্যাদির বর্ণনা রয়েছে সেখানে।
এতসব খটোমটো নাম বাঙালি মুসলমান জানে না। সেই-যে হোসেন শাহি আমল (১৪৯৪-১৫৩৮), যখন বাড়তে বাড়তে মুসলমান বাঙালির সংখ্যা ভারী হচ্ছিল; বাংলা জুড়ে, গ্রামেগঞ্জে, প্রজাদের নামাজ পড়বার জন্যে বহু মসজিদ তখন সুলতানি-অর্থে নির্মিত হয় (Revisiting a Royal Sultanate Manuscript from Bengal: The Sharafnama of Nasir al-Din Nusrat Shah of 938/1531–2, Emily Shovelton, 2021)। সেইসব মসজিদের কয়েকটি আজো টিকে আছে। কিন্তু সেইসব প্রজারা খাবে কী, পরবে কী, থাকবার মতো মাথা গোঁজার আশ্রয় আছে কি না, মধ্যযুগের সবচেয়ে বিখ্যাত আর জনপ্রিয় সুলতানও সেটা ভাবতেন না।
তবু দস্তরখানা নামের একখণ্ড সুতিবস্ত্র মুসলিম আভিজাত্যের বুনন নিয়ে, কয়েক হাজার মাইল পথ ঘুরে, বাংলার খড়ের চালা আর মাটির দরিদ্র ঘরে কী করে এল, ভাবতে বসলে গালে হাত দিতে হয়। সেই সময়পর্বের একটা বর্ণনা পাওয়া যায় গৌড়ের দরবারের। সুলতান নাসিরউদ্দিন নুসরত শাহের সময় নিজামি নামের এক পারস্যদেশীয় পর্যটক এসেছিলেন বাংলায়। ‘সরফনামা’ নামের এক ভ্রমণকথা আছে সেই পর্যটকের। তিনি লিখছেন, ‘‘নুসরত শাহের দরবারের একটি প্রাণবন্ত বর্ণনা একজন অজ্ঞাত দর্শনার্থীর দ্বারা প্রদান করা হয়েছে। প্রাসাদ এবং সুলতানের চারপাশের আচার-অনুষ্ঠান এবং পরিবেশের এটিই একমাত্র প্রাণবন্ত, বিস্তারিত, সমসাময়িক বিবরণ। এই অজ্ঞাতনামা কূটনীতিক বাংলায় একটি পর্তুগিজ মিশনের অংশ ছিলেন এবং সুলতানের চিত্তাকর্ষক এবং বিস্তৃত দরবারে তার সফরের বর্ণনা দিয়েছেন: শারীরিক জাঁকজমক, সশস্ত্র রক্ষীবাহিনী এবং উপহার প্রদানের অনুষ্ঠান এবং সম্মানজনক আচরণ যা দর্শনার্থীদের প্রদর্শন করতে বাধ্য করা হয়েছিল। ফটকে পৌঁছানোর পর পর্তুগিজ দলবলকে মাথার চুল পর্যন্ত তল্লাশি করা হয়েছিল, কাছে কোনো অস্ত্র আছে কিনা তা দেখার জন্য, এবং তিনি প্রথম ফটকের বর্ণনা দেন দুটি খিলানযুক্ত টাওয়ার-সহ, প্রতিটিতে চারটি করে চূড়া ছিল, যার একটির উপরে সোনার একটি বৃহৎ গোলক ছিল এবং খালি বুকে তরবারি এবং ঢাল বহনকারী সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছিল। এরপর তারা পরবর্তী ফটকে গেল। সেখানে তাদের ফের তল্লাশি করা হয়েছিল। এভাবে চলতে থাকে যতক্ষণ-না তারা নবম এবং শেষ ফটকে পৌঁছায়, যেখানে তারা দেখতে পায় একটি বিশাল মাঠ। সেখানে সৈনিকরা পোলো খেলছে। মাঠের শেষে চন্দন কাঠের পুরু স্তম্ভের উপর একটি বিশাল মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল, এবং উপরের অংশগুলি, যার উপর ছাদটি ছিল, ততটা পুরু ছিল না। সবগুলোই খোদাই করা ছিল... অনেক সোনালি ডাল এবং ছোট পাখি দিয়ে, এবং উপরের ছাদটি একইভাবে ... একটি চাঁদ এবং একটি সূর্য দিয়ে, প্রচুর সংখ্যক তারা এবং সমস্ত সোনালি দিয়ে মোড়ানো।
অবশেষে তারা সুলতানের সঙ্গে দেখা করে। সুলতান একটি বিশাল সোনালি ডিভানে জাঁকজমকের সঙ্গে বসে ছিলেন… খুব বড়ো এবং ছোটো বালিশের একটি ভাণ্ডার, যার সবগুলোই সূচিকর্ম করা, এবং তাদের উপর অনেক মূল্যবান পাথর এবং বীজ-মুক্তা ছিল, এবং তাঁর সামনে এসে আমরা দেশের রীতি অনুসারে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই, হাত বুকে আড়াআড়ি করে এবং মাথা যতটা সম্ভব নীচু করে।
নুসরত শাহ ধূসর আরবীয় ঘোড়া দেখে আনন্দিত হয়েছিলেন। পর্তুগিজরা সেটি নিয়ে আসে।… দরবারের কেন্দ্রে অবস্থিত পোলো মাঠ, বিস্তৃত রাজকীয় মঞ্চ, আনুষ্ঠানিক শিষ্টাচার— সবকিছুই পারস্যের দরবার-সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত বলে মনে হয়।’ (Revisiting a Royal Sultanate Manuscript from Bengal: The Sharafnama of Nasir al-Din Nusrat Shah of 938/1531–2, Emily Shovelton)।
যত দূরেই দৃষ্টি সম্প্রসারিত করা হোক, এমন দরবার থেকে বাংলার কোনো কুঁড়েঘরের অন্দর পর্যন্ত দেখা নুসরত শাহের পক্ষেও সম্ভব ছিল না।
ফলে ভাত, মুড়ি, গুড়, কখনো-বা দুধ, জুটে গেলে মাছ, খেয়েই প্রাণধারণ করে এসেছে বাঙালি মুসলমান। কালেভদ্রে মাংস কি জোটেনি? লোকজন এলে পোলাও? ঘরের গুটিকয়েক মুরগির একটি আর ছুরিটি সঙ্গে নিয়ে গুটিগুটি পায়ে সে যায় মসজিদের ইমামের কাছে। জবাই করাতে বেশ খানিকক্ষণ অপেক্ষা না করলে তার চলে? সেদিন মোড়লরা মাছ ধরলে লজ্জার মাথা খেয়ে চেয়েও বসে। একটা চারাপোনাও যদি পাওয়া যায়। মুংলির মাকে বলবে ভেজে দিতে। ন’দাদির দোকানে টুকচি গরম মশলা কি থাকবে?
খেতে বসে অতিথি খায় ঠিকই, কিন্তু সব কিছুর মধ্যেই দারিদ্রের যে-গন্ধ সে পায়, ন’দাদির দোকানের গরম মশলা তাকে চেপে দিতে পারে না। কী করে পারবে? মাসে সাড়ে তিন লাখ টাকা রোজগার হলেই এখন দেশের এলিটস্য এলিট গোত্রের, মানে দেড়শো কোটি জনসংখ্যার মাত্র এক শতাংশ লোকের স্তরের, একজন হয়ে ছড়ি ঘোরানো যায়। এতটা গরিব ছিল না সুলতানি আমল। এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান-বাড়ির অতিথির থালায় জোটে এমনই খাবার। আর, গৃহকর্তার? সে-প্রসঙ্গ এখানে আমরা তুলতে চাই না।