Published : 13 Dec 2016, 11:05 AM
"তরল শাদায়, পাল ছেঁড়া, ভাঙ্গা, নাবিকহীন নিমজ্জিত নৌকার মতো অথৈ বিনাশে যেন ডুবে যাচ্ছে সে, এমন মনে হলো আমিনার। ওপাশে, জ্যোৎস্নার ঠাণ্ডায় দেহ ভিজিয়ে তার ভাই তার ছোটবোন; তারা জানছে না আমিনা এ্যাখোন দুই ভাগ হয়ে যাচ্ছে- " (সমুদ্রের ফেনা, আবুল হাসান)
এক বিচিত্রকর্মা লেখক আবুল হাসান, তার লেখক জীবনের বয়স কত তা নির্ণয় করার দায়িত্ব পাঠকের, কিন্তু শরীরী আবুল হাসান বেঁচে ছিলেন মাত্র আটাশ বছর। এই অল্প সময়েই অনেক পাঠকপ্রিয় কবিতার জন্ম দিয়ে বাংলা সাহিত্যাকাশে এক উচ্চ আসনে সমাসীন কবি আবুল হাসান। একজন লেখকের সবচেয়ে বড় ক্ষমতা কি? পাঠককে চূড়ান্ত সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করানো, নির্মম বাস্তবতার ভেতর প্রবেশ করিয়ে দিয়ে বহমান ঘটনার সঙ্গে হাঁটতে বাধ্য করা। নির্দ্বিধায়, ভাবনার বাউল কবি আবুল হাসান- ছেনি, বাটালি, করাতের সাহায্যে, সুদক্ষ কারিগরের মতোই তাঁর কবিতার মাধ্যমে এই কাজটি করে দেখিয়েছেন । কিন্তু গল্পে? পাঠক কতটা পরিচিতি তাঁর গল্পের সাথে?
'সমুদ্রের ফেনা' গল্পটির ভেতরের গল্প কি? ছোট গল্পে কিসের পরিস্ফুটন ঘটে- চরিত্রের নাকি জীবনসত্যের? ছোট গল্পে চরিত্র কখনোই প্রাধান্য পেতে পারে না, বা পাওয়া উচিৎ নয়। সমুদ্রের ফেনা গল্পটিতে আবুল হাসান মানবমনের নিগূঢ় চৈতন্যকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন শব্দের কারুশিল্পের মাধ্যমে, ভাবনার বিশালত্বে। 'সমুদ্রের ফেনা' কখনও কোন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিলো কিনা জানা নেই- তবে এটি গ্রন্থভুক্ত হয়েছে আবুল হাসান রচনা সমগ্র নামক গ্রন্থে, যেটি প্রকাশ করেছে বিদ্যা প্রকাশ।
সকল সময়ের মনোপযোগী ভাষাচিন্তায় আবুল হাসান এই গল্পের চরিত্রগুলোকে সাজিয়েছেন, হয়তো নিজ জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিবৃত করেছেন আমিনা চরিত্রের মাধ্যমে। আবুল হাসান এই গল্পের শব্দমায়ায় মানবমনের বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচল বিন্দুতে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন পাঠককে। মানবমনের চৈতন্যমগ্নতার একটি শিল্পিত রূপ 'সমুদ্রের ফেনা।' আমিনা এক ভালোবাসাবঞ্চিত চরিত্র। কিছুটা বিপদগ্রস্ত, তার ভাইয়ের সাথে থাকে- ভাই নিজেও দোল খাচ্ছে অনিশ্চিত বর্তমানের ঘোরে, আছে আরেক ছোট বোন। ভাই নিজে কবিতা লেখেন, সেখানেও আছে অপ্রাপ্তি, না পাবার বেদনা। গল্পের শুরুতেই আমিনার ভাবনায় স্পষ্ট হয়, আমিনার দীর্ঘশ্বাস- সে তার ভবিষ্যতকে এভাবে উপস্থাপন করে, 'একটা ভবিষ্যৎ, বালিশের অবিশ্বাস্য আগুনের মত হলুদ দাঁতে তার আপাদমস্তক চিবিয়ে অন্ত সারহীন করে রেখে যাচ্ছে।' এক সংসার ক্লান্ত চরিত্র যার নিজের সংসার বলে কিছু নেই, যে এমন একটা বয়সে উপনীত যেখানে একজন সঙ্গীর খুব অভাব অনুভব করে সে, ভালবাসার অভাব। এমন এক সময়ে গল্পে অভিষেক ঘটে শাহনেওয়াজ নামক চরিত্রের।
আধুনিক কালের এ কথাকার তার গল্প 'সমুদ্রের ফেনা' –তে এমন এক রূপকল্প পাঠকের সামনে উন্মোচন করেছেন, যা পাঠক মাত্রকেই একটা কুয়াশামাখা অনুভূতির মধ্যে ভাসিয়ে দেয়। গল্প নির্মাণেও এক সাধক মনের প্রয়োজন হয়, এ কথা কোনভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না। মানুষের মনের সংকীর্ণ সীমানা ছাড়িয়ে সমাবেশের সুরে আমাদের তাড়িত করে এক অদ্ভুত অনুসন্ধিৎসু বোধের সম্মুখে।
ভোরের ঘুম কামড়ে থাকা শরীরে লেপটে থাকা শাড়ী গুটিয়ে নিতে গিয়ে এক অন্যরকম অনুভূতির সন্ধান পায় আমিনা। এক অবচেতন রোষ তাকে কামড়ায়, আসলে এক অপূর্ণ শরীরী চাহিদার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকে সে, কল্পনা করে, কেউ একজন তাকে বর্ষার ঢেউয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, ঘুম জড়ানো চোখে সে বাড়ী থেকে পালিয়ে যায় পাহাড়ে- বুনো ঝর্ণার জলে নিজেকে সমর্পণ করে নির্দ্বিধায়।
'শাহেদের খুব প্যাসনেট হাত ছিল। ওয়াটার কালারের যে আঁচড়- আমার মনে হয় ও 'কনস্টেবলে'র আঙ্গিক নিয়ে আঁকে। কিন্তু ও আর ছবি আঁকবে না, ও ছেড়ে দেবে। ওর কবিতা ও পুড়িয়ে দিয়েছে। কবিতা- শিল্প- ছবি, এতে নাকি কিচ্ছু হবে না, ও ফিরে যাবে বলেছে, গাঁয়ে ফিরে মাকে নিয়ে থাকবে।' নতুন একটি চরিত্র কত বৈচিত্র্য নিয়ে একটা গল্প প্লটে প্রবেশ করতে পারে তা উপরোক্ত কয়েকটি বাক্যে অনুধাবন করা খুব সহজ হয়ে পড়ে। একটা অসাধারণ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে একটি নতুন চরিত্রকে একটা নতুন Event এ প্রবেশ করিয়ে 'Change of State' – এ প্রবেশ করাতে সক্ষম হন আবুল হাসান।
'ভাইয়া সে রাতে বলেছিলো, আমাদের ওসবের কদর নেই। শুধু কবিতায় জীবন চলে না শুধু শিল্প নিয়ে জীবনের হোচ্ছে তলা-ফুটো নৌকা। সুতরাং অন্য কাজ করা চাই অর্থরোচক, স্বার্থসিদ্ধ। সুজিতকে বলেছিলো ভাইয়া এখন তোর অন্য কাজে নামা উচিৎ।' গল্পের ভেতরের গল্পকে পারিপার্শ্বিক ভাবনার ভেতর নিক্ষেপ করা আবুল হাসান এক নতুন ধরনের আত্মোপলব্ধির মধ্যে নিজের বিশ্বাসকে নিক্ষেপ করেন, যা, হয়তো তিনি নিজেও বিশ্বাস করতেন না।
'আমিনা এখন অনেক বড় হয়ে গেছে। আমিনার বুকের মধ্যে অপর্যাপ্ত শ্যাওলা ও মাছ। জানালাটা ভেজিয়ে দিয়ে 'ও বড় নিঃসঙ্গ' ধরণের স্বগতোক্তি করে ঘরে ঢুকতেই দ্যাখে, সামনের চৌকাঠে একটা বিড়াল ঘুমানো, খাটো খাটো ছায়া ঝুলছে খিমকির পাশের জায়গাটায়। আর একটা অবিভক্ত মেঘ খুলে ফেলে চাঁদ আপেল-ছুরি-করা বালকের মতো দৌড়চ্ছে।' বা হাসানের ঘুম হবে না আজ। হাসান অনেক দিন ঘুমায় না। কবিতা লেখে না। চাকরি 'ভাল্লাগে না' বলে সংবাদ পত্রে কাজ নিয়েছে। চাকরিতে তার মতো লোক শান্তি পায় না । বাংলাদেশের চাকরি মানে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দৌড়ানো।' গল্পে সময়কে দুইভাগে ভাগ করে এক আখ্যান রচনা করার চেষ্টা লক্ষণীয়। Acceleration বা Deceleration গল্পের ভেতরের গতিকে কোনভাবেই প্রভাবিত করে না। মূলত Fabula time ও story time এর টানাপোড়নে তৈরি হওয়া সম্পর্কের মধ্যে বোঝাপড়া চলে সন্তর্পণে। আবুল হাসানের বর্ণিত সময় যে চিরন্তন। শিল্প-সাহিত্যের যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলা সময়ের ফোড়নে কয়েকজন মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন। খুব অস্থির সময়ের রোষানলে পড়ে তাদের সুকুমার মনোবৃত্তি আছড়ে পড়েছে নির্মম বাস্তবতার ধাতব স্তরে।
'আমিনার ঘরে ঢুকে অবশেষে তার কবিতা ভুলে গিয়ে সে দেখলো; লম্বা তনুর অবশিষ্ট বাহুতে একটা শ্বেত হংস পাখা ঝাপটাচ্ছে। আর মাথা থেকে ঢেউ খেলানো বুকের হৃদয়- রোচক হরণ কোরে আমিনার উরু অবধি একটা তরল লন্ঠন ওপাশের আমগাছ থেকে নেমে, ক্যামন নমনীয় একটা অনাদৃত ভঙ্গীতে 'ওর একজন সঙ্গী দরকার' লিখে টেবিলের খোলা ড্রয়ারে নিঃসঙ্গ শ্বেত পেন্সিলটা রেখে তারপর আমিনার চুল বিছানো চেয়ারে বসে পড়েছে। যেন কিছুটা নির্বিকার!' গল্পকার আবুল হাসান এখানে চরিত্রের অন্তর্বয়নকে নতুন ভাবে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
আবুল হাসান 'সমুদ্রের ফেনা' গল্পে Fictional narrative এর মাধ্যমে তার গল্পভাবনাকে পূর্ণতা দেন। একটি সার্থক Fictional narrative-এর যে উপাদান, তার সবগুলোই দেখতে পাওয়া যায় এই গল্পে। Characters, Dialogue, Settings, Plot, Point of view, Beginnings- Transitions- Endings-এর সবগুলোই তার গল্পে উপস্থিত। পাঠকের হৃদয়ে বঞ্চনার, অপ্রাপ্তির দ্যোতনা তৈরি করে পাঠকের ভাবনা সমুদ্রে এক অচেনা ঝড় তুলে দিতে সক্ষম এই গল্প।
গল্পের একেবারে শেষের দিকে এসে আবুল হাসান চরিত্রগুলোর ভেতর অনুচ্চারিত কষ্টবোধের অনুভবে ডুবিয়ে দেন পাঠককে। গল্পে তাই কোন চরিত্রই প্রধান হয়ে ওঠেনি, কিন্তু প্রত্যেকটি চরিত্রই প্রধান চরিত্র হবার যোগ্য দাবীদার। আবুল হাসানের গল্পপাঠ শেষে পাঠককে খুব দোটানায় পড়ে যেতে হয়, পাঠক কোন আবুল হাসানকে মনে রাখবে, কবি আবুল হাসান নাকি গল্পের কারিকর আবুল হাসানকে।