Published : 23 Aug 2016, 09:53 PM
মূলত গল্পকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হলেও, হোর্হে লুইস বোর্হেস(১৮৯৯-১৯৮৬) ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, প্যারাবোল-রচয়িতা ও গল্পকার। ২৪ আগস্ট তার ১১৭তম জন্মদিন। বাংলাভাষার শীর্ষস্থানীয় অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের অনুবাদে বোর্হেসের অসামান্য একটি প্যারাবোল অনুবাদের মাধ্যমে আর্হেন্তিনার এই অসামান্য লেখককে বিডিনিউজটোয়েটিফোর ডটকম-এর আর্টস বিভাগের পক্ষ থেকে জানাই জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলী। বি. স.
সেদিন পীতাঙ্গ সম্রাট কবিকে তাঁর প্রাসাদ দেখালেন। তাঁরা প্রাসাদের পশ্চিম প্রান্তের সারবদ্ধ প্রথম অলিন্দগুলি পার হয়ে এগিয়ে গেলেন; গিয়ে দাঁড়ালেন সেখানে যেখানে মুক্তমঞ্চের অসংখ্য সিঁড়ির মতো নেমে গেছে সেইসব অলিন্দচত্তর। গিয়ে মিশেছে স্বর্গপুরীতে বা নন্দনকাননে। সেখানে ধাতব মুকুর আর পেঁচানো জটাজালে বিস্তৃত জুনিপার ঝোপঝাড় এক গোলকধাঁধারই ইঙ্গিত দেয়। প্রথমে ওরা বেশ হাস্যলাস্যেই ওই ধাঁধায় হারিয়ে গেলেন যেন বা লুকোচুরি খেলা খেলতে খেলতে; কিন্তু পরে তাঁদের চিত্তে জমে শঙ্কা কারণ সোজাসিধে পথগুলো চলিষ্ণু অবস্থাতেই ক্রমে বেঁকে যাচ্ছিল (আসলে ওই পথগুলো ছিল এক একটা গোপন বৃত্ত)। রাত ঘনিয়ে এলে তাঁরা আকাশের গ্রহরাজি দেখেন, এবং লগ্ন হলে একটা কচ্ছপ বলি দেন। এরপর সেই আপাতঃ ঘোরলাগা অঞ্চল থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসেন, কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কাবোধ থেকে বেরোতে পারেন না। এবং শেষ পর্যন্তও এই বোধ তাঁদের সঙ্গে সেঁটেই থাকে। প্রশস্ত অলিন্দ-চত্ত্বর আর পাঠাগার তাঁরা পার হয়ে আসেন, পার হন জলঘড়িরাখা ষড়ভুজ কক্ষটিও। একদিন সকালবেলা এক উচ্চমিনার থেকে তাঁরা দেখেন এক প্রস্তর মানবকে, কিন্তু লোকটা মুহূর্তে কোথায় হাওয়া হয়ে যায় যে আর কখনো তাকে দেখাই গেল না। চন্দনকাঠের নৌকায় চড়ে তারা কত ঝিলিমিলি জলের নদী পেরিয়ে গেলেন–নাকি একটি নদীই তারা বার বার পার হলেন? রাজ শোভাযাত্রা পেরিয়ে যায় কত জনপদ আর লোকে করে সাষ্ঠাঙ্গে প্রণিপাত। কিন্তু একদিন তাঁরা এক দ্বীপে এসে তাঁবু গাড়ে, সেখানে একটি লোক রাজাকে প্রণিপাত করে না কারণ সে তো কখনো দেবদূত দেখেই নি। তখন আর কি, রাজজল্লাদকে তার কল্লা নিতে হলো। কালো চুলের মাথা আর কৃষ্ণাঙ্গ যুবানৃত্য আর জটিল আঁকিবুকির সোনালী মুখোশ নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে থাকে; বাস্তব আর স্বপ্নের ভেদরেখা যায় ঘুঁচে–নাকি বাস্তবই হয়ে দাঁড়ায় স্বপ্নের স্বরূপ? তখন মনেই হয় না যে পৃথিবীটা এক বাগিচা কি জলাধার কি স্থাপত্যশিল্প কি জমকালো সব সাকার বস্তুর সমাহার ছাড়া অন্য কিছু। প্রতি শতপদ ফারাকে এক একটি মিনার উঠে ফুঁড়ে গেছে নীল আকাশ; চর্মচক্ষে তাদের রঙ এক ও অভিন্ন, তবু প্রথম মিনার দেখতে হলুদ আর সারির শেষটি লাল। এই রঙের ক্রমবিস্তার খুবই নাজুক, ফিনফিনে আর মিনার সারিও খুব দীর্ঘ ও প্রলম্বিত।
অন্যলোকে যখন রাজপ্রাসাদের অপূর্ব, অত্যাশ্চর্য সব হর্মরাজীর বৈভবে অভিভূত, তখন মনে হয় কবিকে তা স্পর্শও করেনি। তখন শেষ মিনারের আগেরটায় এসে কবি উচ্চারণ করেন তাঁর সংক্ষিপ্ত কাব্যবাণী। আজ এই কবিতার সঙ্গেই অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছে তাঁর নাম; এবং যেমন জাঁদরেল ঐতিহাসিক বলেন, ওই কাব্যই কবিকে দিয়েছে যুগপৎ অমরত্ব আর মরণ। কবিতাটি গেছে হারিয়ে। কেউ কেউ বলেন, কাব্যে ছিল মাত্র একটি চরণ; অন্যেরা বলেন এতে ছিল মাত্র একটি শব্দ। কিন্তু সত্য হলো, অবিশ্বাস্য হলেও সত্য হলো, ওই কবিতায় ভর করেই দাঁড়িয়ে ছিল সেই বিশাল প্রাসাদ, তার সর্বাঙ্গে চুলচেরা সুক্ষ্নতায় প্রতিটি চীনামাটির নক্সাবন্দিতে, গোধুলির আলোতে ছায়াতে খেলা করা প্রতিটি মরণশীল মানুষ আর দেবতা আর ড্রাগনের বংশের, সুখী অসুখী হর্ষোৎফুল্ল মুহূর্ত নিয়ে বাস করা বংশধরদের লীলাখেলা। সবাই এখন নিরব, নিথর। কিন্তু পীতাঙ্গ সম্রাট চীৎকার করে বলেন, "ওরে, লুট হয়ে গেছে আমার প্রাসাদ।" তখন নেমে আসে জল্লাদের খড়গ এবং এক কোপে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে কবিপ্রবরের কল্লা।
অন্যলোকে অবশ্য গল্পটা বলে একটু ভিন্ন কায়দায়। দুনিয়ার কোনো দুটি জিনিসই নয় হুবহু এক। ওরা বলে কবি যদি নিজের কবিতাটি একবার উচ্চারণ করেন তো তাতে পুরো প্রাসাদই যায় তলিয়ে–এমন যেন শেষ অক্ষরটি নিয়ে তা ভেঙে পড়ে খান খান হয়ে। এ ধরণের পুরান অবশ্য সাহিত্যের কেচ্ছা কাহিনির চেয়ে বেশি কিছু নয়। কবি ছিলেন সম্রাটের ক্রীতদাস এবং সেভাবেই হয়েছে তাঁর মরণ। তাঁর রচনাও ঢুকে গেছে বিস্মৃতির গহ্বরে কারণ বিস্মৃতিই তার নিয়তি। কিন্তু তাঁর উত্তরসূরি মানুষ এখনো খুঁজে বেড়ায়, বৃথাই খুঁজে ফেরে সেই একটি শব্দ যার ভেতর পোরা আছে বেবাক ব্রহ্মান্ড।
আর্টস-এ প্রকাশিত খালিকুজ্জামান ইলিয়াসের অন্যান্য লেখা: