অলোকরঞ্জনের দ্রোহের মন্ত্রে উদ্দীপিত বিশ্বমুগ্ধ চিন্ময় আমাদেরকে আহবান করলেন: এবার চলো বিপ্রতীপে।
Published : 10 Sep 2024, 02:50 PM
বাংলা ভাষায় টি এস এলিয়ট নিয়ে যত চর্চা হয়েছে—সেই রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে—শেক্সপিয়র ছাড়া ইংরেজি ভাষার আর কোনো লেখককে নিয়ে অতটা হয়েছে কিনা সন্দেহ। চর্চা বলতে অবশ্য এখানে অনুবাদ এবং তাঁকে নিয়ে রচিত প্রবন্ধ নিবন্ধ ও গ্রন্থকেই বুঝানো হচ্ছে। পূর্ব ও পশ্চিম—উভয় বঙ্গেই এলিয়ট বাংলা ভাষায় বিশ শতকের সবচেয়ে আলোচিত লেখক, সম্ভবত গোটা বিশ্বেই। কিন্তু বাংলা ভাষায় হাতে গোনা কিছু প্রবন্ধ ছাড়া বাকি সবটাই বিশ্ব-স্রোতের সন্তান, অর্থাৎ অন্যভাষায় রচিত প্রবন্ধ বা গবেষণা থেকে নিষ্ক্রান্ত ধ্বনিপুঞ্জ; তাতে নেই এমন কোনো উন্মোচন যা অন্যত্র দুর্লভ, নেই এমন কোনো বয়ান যা প্রথার প্রতিমা নয়। প্রায় আশি বছরে গড়ে ওঠা ওই প্রতিমা ভেঙে প্রথম যিনি গাঢ় শঙ্খে ভিন্ন রুচির অধিকারের সুর ধ্বনিত করলেন তিনি চিন্ময় গুহ, আমাদের গদ্যের এক নিবিড় নিলীমা। আর তা কেবল বাংলা ভাষাতেই নয়, সেই চিন্ময়-সুর দখল করেছে খোদ ইংরেজি ভাষার দুষ্প্রবেশ্য দরবারকেও। কার্লোস ফুয়েন্তেস প্রান্তীয় অঞ্চল থেকে কেন্দ্রকে দখলের এক উপমা দিয়ে পাবলো নেরুদার কৃতির স্বাতন্ত্রকে চিহ্নিত করতে গিয়ে বলেছিলেন: “পাবলো নেরুদা গোলার্ধের এই শেষ সীমা থেকে ক্রিস্তোবাল কোলোনের জাহাজগুলোর গতি স্পানঞার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।( Desde ese limite polar de la tierra, Pablo Neruda envio las carabelas de Colon de regreso a Espana.—Personas,Carlos Fuentes, P 130)
এক সময়কার ‘পার্শ্বরেখায়িত’ (চিন্ময় গুহ’র ভাষায়) ভারতীয় ভূখণ্ড থেকে ইংরেজি বিশ্বের কেন্দ্রকে দখল করা,শাসনের ক্ষয়িষ্ণু ও ঝিমিয়ে পড়া দুর্গে বিস্ফোরক ছুড়ে মারা ছিল বিস্ময়কর ঘটনা। কিংবা বলা যায় ইংরেজি কার্তুজে ফরাসি বারুদে ঠাসা এক গুলি যার প্রস্তুতকারক কোনো ইংরেজ কিংবা ফরাসি নয়—যদিও তেমনই হওয়া ছিল সবচেয়ে স্বাভাবিক, সেই স্বাভাবিকতাকে দুমড়ে মুচড়ে একপাশে সরিয়ে রেখে ওই দুই জাতিরই এক সময়কার উপনিবেশ বঙ্গভূমির এক বিশ্ববাঙালি চিন্ময় গুহ। একসময় আমরা দুহাত ভরে গ্রহণ করেছি ওই দুই ভাষার উজ্জ্বল সব হিরেজহরত—চিন্ময় গুহ নিজেও। কিন্তু আমাদের মধ্যে--এই সাম্প্রতিক কালে--তিনিই হয়ে উঠলেন ‘দেবে আর নেবে’ শীর্ষক মন্ত্রণার সার্থক প্রয়োগকর্তা। আমাদের কাছ থেকে তাদেরও যে নেয়ার আছে, মননশীল রচনা ও মৌলিক গবেষণায় যে বাঙালি ভাবুকতা মোটেই পিছিয়ে নেই, সেই কথাটাই চিন্ময় গুহ বহুবছরের ব্যবধানে বিশ্ববলয়ে নমিত কিন্তু বিশ্বাসের দৃঢ় ভিত্তিতে জানিয়ে দিলেন। অলোকরঞ্জনের দ্রোহের মন্ত্রে উদ্দীপিত বিশ্বমুগ্ধ চিন্ময় আমাদেরকে আহবান করলেন: এবার চলো বিপ্রতীপে। তার এই বিপ্রতীপ মশালটির নাম Where the Dreams Cross: T. S Eliot and Frence Poetry । এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এলিয়টের মৃত্যুর ৩৫ বছর পর। জীবদ্দশায়ই এলিয়টকে নিয়ে ইংরেজি ভাষায় একাধিক গ্রন্থ বেরিয়েছিল, মৃত্যুর পরে সেই সংখ্যা দ্রুত গতিতেই বাড়তে থাকে। কিন্তু না ইংরেজিভাষী না ফরাসি জবানের কোনো সমালোচক বা গবেষক কখনোই এই কবির ফরাসি ঋণ নিয়ে লিখেননি উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু। যদিও স্বয়ং এলিয়ট ওই ঋণের ইশারা রেখে গিয়েছিলেন মৃত্যুর অন্তত পঁচিশ বছর আগেই ইয়েটসকে নিয়ে এক লেখায়: “The kind of poetry that I needed to teach me the use of my own voice did not exist in English at all: it was only to be found in French.” (Where the Dreams Cross, Preface, P -1X)
এমন নয় যে তিনি একবারই কেবল এই আভাস দিয়েছিলেন, চিন্ময় গুহ’র পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে বারবার তিনি এই কথা বলেছিলেন। কিন্তু কবি ও সমালোচক হিসেবে এলিয়টের ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠিত প্রবল প্রতিমা সমালোচক কিংবা গবেষককে সেই দিকে তাকাবার সুযোগ দেয়নি। এক অর্থে কবি হিসেবে বিগত দুই শতকে কিংবা তার পরেও এলিয়টের মতো এত প্রচারিত ও প্রভাববিস্তারী ব্যক্তিত্ব গোটা বিশ্বসাহিত্যেই বিরল। ফলে,তাঁর ওই খ্যাতি আর প্রতাপের প্রতি সম্ভ্রমবশত এলিয়টের ফরাসি-ঋণ পুরোপুরি আচ্ছাদিত রয়ে গেছে; যেন এলিয়টের মতো কবি ঋণী হতে পারেন না, যেন প্রভাবের উৎস নির্দেশ তাঁর প্রবল প্রতিমাকে ভেঙে চুরমার করে দেবে, যেন ইংরেজ অহংকার ক্ষুন্ন হয়ে যাবে ফরাসি ঋণের খোঁটায়।
কিন্তু উৎসুক ইংরেজ, এমনকি ফরাসিরাও কি এলিয়টের এই ফরাসি-সংযোগের কথা কিছুই জানতেন না? “এলিয়ট নিজে বিস্ময়করভাবে অকপটে শেষ দিককার উনিশ শতক আর বিশ শতকের প্রথমদিককার ফরাসি কবিতার প্রতি তার বিস্তৃত ঋণ সম্পর্কে বলেছেন।” (Where the Dreams Cross, P -1) তাহলে কেন তারা আমলে নেননি? কানাডিয় গবেষক E.J.H.Greene তার ফরাসি গ্রন্থ T S Eliot et la France(১৯৫০)-এ কিছুটা আভাস দিয়েছিলেন, যদিও চিন্ময় গুহর ভাষায় তা ছিল “Merely restated stereotyped views.” (Where the Dreams Cross, Preface, P -1X)। অন্যদিকে, হার্বার্ট হোয়ার্থ যদিও ১৯৬৫ সালে বলেছিলেন: “A whole book should be written on Eliot’s debt, which is a debt for all of us.” (Where the Dreams Cross, P -2) কিন্তু হোয়ার্থের এই কথা আমলে নেননি কেউ-ই। মার্কিন সমালোচনার চূড়ামনি হ্যারল্ড ব্লুম তার Genius-এ এলিয়টের ফরাসি ঋণের প্রসঙ্গে এলিয়টের উপর লাফর্গ, বোদল্যের আর ফরাসি গৌণ কবিদের প্রভাবের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তিনি অভিমুখ ঘুরিয়ে দিয়ে এলিয়টের গড়নে ইংরেজ কবিদের প্রভাবকেই তুঙ্গ বলে মনে করলেন:
“Notoriously, he asserted that his precursors were Dante and Baudelaire, or even French minor poets, rather than anyone before him who had written in English. But that is the usual poetic spiel: the central forerunners of The Waste Land are Whiteman’s “When Lilacs Last in the Dooryard Bloom’d” and Tennyson’s Maud: A Monodrama. Eliot Also liked to cite lesser Jacobean dramatists, John Webster and Cyril Tourneur, but his actual poetry is hunted by Hamlet, which is hilariously dubbed and aesthetic failure.” ( P 371)
অর্থাৎ, ফরাসি ঋণের কথা উল্লেখ করলেও, ব্লুম মূলত ইংরেজি কবিতার প্রতিই এলিয়টের ঋণের প্রাধান্যকে মূখ্য করে তোলেন। যদিও এলেন টেট উল্টোটাই বলেছিলেন এবং তা যথার্থই: “Eliot’s Frence heritage was more significant than the Elizabethan.” (Where the Dreams Cross, P -6) ইংরেজ, মার্কিন, এমনকি কোনো ফরাসি লেখক এলিয়টের উপর ফরাসি কবিতার প্রভাবের কথা মৃদু ও অস্ফূট স্বরে উচ্চারণ করলেও, প্রভাবের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রটি কারোর হাতেই ছিল না।
চিন্ময় গুহ তার এই অসামান্য গ্রন্থে ফরাসি কবিদের বীজাঙ্কুরের পাশেই এলিয়টের সাদৃশ্যসূচক পংক্তিগুলো মিলিয়ে আমাদের সামনে উন্মোচন করেন এলিয়টের গ্রহণক্ষমতা আর ঋণকে সুদে আসলে খাটিয়ে নেয়ার সক্ষমতাকে।
ইংরেজিতে এই বই লেখার পাশাপাশি বাংলাতেও তিনি একাধিক প্রবন্ধ লিখেছেন যা ছড়িয়ে আছে তার গাঢ় শঙ্খের খোঁজে ও অন্যান্য প্রবন্ধ( এলিয়টের প্রিয় বই: এক অনাবিষ্কৃত তালিকা) অন্ধ আয়না (জয়েস আর এলিয়ট: শতবর্ষ আগের দুই বিস্ফোরণ, ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’: ৪৩৪ লাইনের স্ক্র্যাপবুক), ঘুমের দরজা ঠেলে( ৩৪ নং ভুক্তি), বিন্দু থেকে বিন্দুতে (বিমর্ষ পাখির রঙে ভরা, এ পরবাসে: ভিভিয়েন এলিয়ট ও তাঁর সৃজনকর্ম) আর চিলেকোঠার উন্মাদিনী(চিলেকোঠার উন্মাদিনী: ভিভিয়েন এলিয়ট, কবর খোঁড়ার কবিতা, এলিয়টের ফরাসি ঋণ ও কিছু প্রশ্ন)শীর্ষক গ্রন্থধৃত মোট নয়টি প্রবন্ধে। প্রতিটি প্রবন্ধ একটি থেকে অন্যটি আলাদা। এলিয়ট সম্পর্কে তার প্রথম প্রবন্ধটি( চিলেকোঠার উন্মাদিনী: ভিভিয়েন এলিয়ট) লেখা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। দ্বিতীয় প্রবন্ধটিও(এক অনাবিষ্কৃত আকাশ) লেখা হয়েছিল একই বছর। তৃতীয় প্রবন্ধটি(এলিয়টের ফরাসি ঋণ ও কিছু প্রশ্ন) তিনি রচনা করে ১৯৯৮ সালে। এরপর প্রায় কয়েক বছরের বিরতি ২০০৩,৪,১০ ১৪, ২২, ২৩ সাল নাগাদ তিনি বাকি প্রবন্ধগুলো লিখেছেন। ফরাসি সাহিত্যের পাশাপাশি এলিয়ট তার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল গত সহস্রাব্দ থেকেই। বিশ বছরের এই কালপরিধির মধ্যে বাংলায় তিনি এলিয়ট নিয়ে যতগুলো প্রবন্ধ লিখেছেন প্রতিটি প্রবন্ধই বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে নতুন নতুন আবিষ্কারের মূলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক অর্থে, চিন্ময় গুহই প্রথম বিরাট প্রেক্ষাপটে, অনুসন্ধানের প্রাচুর্যে ও অভিনবত্বে, স্বচ্ছ সাদৃশ্য ও উন্মীলক বিশ্লেষণে তার গ্রন্থকে করে তুলেছেন অনাবিস্কৃত ধনরত্নে বোঝাই এক সোনার তরী। ডুবুড়ির মতো দুই ভাষার সিন্ধু সেচে মুক্তা আহরণ করেছেন। বোদল্যের আর ত্রিস্তাঁ করবিয়ের, পল ক্লোদেল আর জুল লাফর্গ, রেমি দ্য গুরমঁ আর জ্যাক রিভের, জুলিয়েঁ বেন্দা আর শার্ল মুরার, জ্যাক ম্যারিতাঁ আর ভালেরি লার্বোসহ আরও বহু ফরাসি লেখকের প্রভাবের সপ্তবর্ণের উজ্জ্বল পটভূমিকে চিন্ময় গুহ তুলে ধরেছেন এলিয়টের মৌলিকতার শর্ত হিসেবে যেখানে প্রভাব হয়ে উঠেছে উদ্দীপক ও সৃষ্টিশীল।
চিন্ময় গুহ’র এই গবেষণা বাংলায় রচিত প্রবন্ধগুলোর অন্য এক নিহিত এবং অকথিত বাণী এই যে যে-কোনো মৌলিক লেখক বা শিল্পী ঋণ ছাড়া যেমন বড় হতে পারেন না, তেমনি সম্ভব নয় মৌলিক হয়ে ওঠাও। এলিয়ট-এর এই বেশুমার ফরাসি-ঋণ তাকে প্রভাবিত করলেও সেই প্রভাব ছাপিয়ে এতটাই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আর সজীব করে তুলেছে যে বুদ্ধদেব বসুর সেই কাব্যগ্রন্থের (যে আঁধার আলোর অধিক) নামটিকে ইষৎ ঘুরিয়ে বলা যায় যে-প্রভাব মূলের অধিক।
দশ দিগন্তের দ্রষ্টা চিন্ময় গুহ‘র এলিয়ট-চর্চা কেবল বাংলা ভাষায়ই নয়, এলিয়ট নিয়ে গবেষণার বিশ্বপরিসরেও তাঁকে অনন্য করে তুলেছে। অন্য এক এলিয়টকে তিনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তার সামগ্রিক রচনার তূলনামূলক প্রেক্ষাপটে। চিন্ময় গুহ’র এই আবিষ্কারকে এলিয়টের ভাষায় বলা যায়:
The hidden is revealed,and the spectres show themselves.
নিষ্ঠাবান এলিয়ট-আবিষ্কারক চিন্ময় গুহর আজ জন্মদিন। তাঁকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা ও আলিঙ্গন।