Published : 10 May 2015, 12:31 PM
বাংলাদেশের শিল্পকলার ইতিহাসে আধুনিক ভাস্কর্য শিল্পের যাত্রা নভেরা আহমেদের হাত ধরেই। তিনি এর পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। বাংলাদেশে (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) জন্ম নেয়া এই নারী ভারতীয় উপমহাদেশের স্কাল্পচারেই আধুনিকতম নারী। বাংলাদেশের জাতীয় শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য । গত ৪৫ বছর ধরে তিনি প্যারিসে কাটান। এ সময়ের মধ্যে তিনি একবারও দেশে আসেন নি। তিনি কখনো শিল্পকর্মের স্বীকৃতি চাইতে আসেন নি। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার তাঁকে একুশে পদক প্রদান করলেও তিনি সেই সম্মান নিতে আসেন নি। বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিয়েও দেশে আনা যায়নি তাঁকে। খানিকটা লোকচক্ষুর অন্তরালেই কাটিয়েছেন জীবন। আশ্চর্যজনক আড়াল তৈরি করেছিলেন নিজের চারপাশে। দেশের শিল্পীদের সঙ্গেও যোগ ছিল না তাঁর। গত ৬ মে, ৭৬ বছর বয়সে প্যারিসের শঁন পামেল গ্রামে চূড়ান্ত অন্তরালেই চলে গেলেন এ শিল্পী।
নিজের সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী শিল্পসাধনা ও অজ্ঞাতবাসের জীবন তাঁকে পরিণত করে রেখেছিল জীবন্ত কিংবদন্তীতে। তাঁর শিল্পের গভীরে ডুবেও তাঁর জীবনের রহস্য ভেদ করতে চেষ্টা করেছেন কেউ কেউ। দেশের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখুক, তাঁর বেঁচে থাকাই আমাদের দেশের শিল্পাঙ্গনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি প্রবাসে যোগাযোগহীন থেকেওে এদেশের ভাস্কর্যশিল্পে প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন। শুধু চিত্রকলা নয়, তাঁর প্রভাব চিত্রকলা ছাপিয়ে অন্যান্য শিল্পেও অনুভূত হয়েছে। তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে তাই দেশের শিল্পাঙ্গনে শোকের ছায়া বিস্তার করেছে। বর্তমান শিল্পীদের কাছে বিষয়টা আরো মর্মস্পর্শী। তাঁর শিল্পকর্ম ও জীবন এখনো সাধারণ মানুষের মধ্যে সমান বিস্ময়ের। এ নিয়ে কথা বলা হয়েছে দেশের কথাশিল্পী ও চিত্রশিল্পীদের সঙ্গে।
প্রায় সমসাময়িক হয়েও শিল্পী মুর্তজা বশীরের সঙ্গে নভেরা আহমেদের সাক্ষাৎ ঘটেছে মাত্র একবার। তার আগে থেকেই তিনি প্রবাসী। ১৯৭৩ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে মুর্তজা বশীরের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। তাঁর ভাষায়, 'ওনার সাথে আমার তেমন সাক্ষাৎ বা পরিচয় ছিল না। একবারই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল '৭৩-এ প্যারিসে। এক প্রদর্শনীতে আমার আটটি ছবি প্রদর্শিত হচ্ছিল। সেখানে তিনি এলেন। হাতে একটি লাঠি। তিনি আমাকে বললেন, কেমন আছেন? আমি বললাম, ভাল। ব্যাস এইটুকুই।' নভেরা আহমেদের অবদান বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, তিনি বাংলাদেশের আধুনিক ভাস্কর্যের সূচনা করেছিলেন। যখন এদেশে ভাস্কর্যচর্চা শুরুই হয়নি, তখন তিনি ভাস্কর্য চর্চা করেছিলেন।'
প্রবাস-পূর্ব সময়ে নভেরা আহমেদের সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎ-আলাপ ঘটেছে এমন স্বল্প কয়েকজনের মধ্যে সৈয়দ শামসুল হক অন্যতম। ১৯৫৬ সালে হামিদুজ্জামনের সঙ্গে শহীদ মিনারের নকশা তৈরি করছিলেন নভেরা আহমেদ। কিন্তু পরবর্তীকালে শহীদ মিনারের স্থপতির নাম থেকে নভেরা আহমেদের নাম বাদ পড়া নিয়ে বিভিন্ন সময় লেখালেখিও করেছেন সব্যসাচী এই লেখক । তাঁর মৃত্যুতে ব্যাথাতুর এই লেখক বলেন, 'নভেরা আহমেদের সঙ্গে আমার স্মৃতি খুব বেশি নয়। দু-তিনবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে তাঁর সঙ্গে। শহীদ মিনার তৈরির সময়ে দেখা ও কথা হয়েছে। তাঁর মাথায় সব সময় আধুনিক চিন্তা কাজ করতো। শহীদ মিনারে তো হামিদুজ্জামানের সঙ্গে তাঁর কাজ জড়াজড়ি করে আছে। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁর নাম উচ্চারিত না হওয়ায় আমি কয়েকবার লিখেছি। আমার 'হৃৎকলমের টানে'তে লিখেছি।
তিনি খুব আন্তরিক ধরনের মানুষ ছিলেন। সদালাপী মানুষ ছিলেন। জীবন যাপনে খুব উল্লসিত ছিলেন। উপভোগ করতেন সবকিছু। পরবর্তীকালে তিনি নিজেকে যেভাবে গুটিয়ে নিলেন, সেটা আমার কাছে বিস্ময় বলে মনে হয়েছে। তখন তিনি সে রকম মানুষ বলে আমার ধারণায় আসে নি। প্যারিসে গিয়েও আমার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়নি। আমি খুবই দুঃখিত। আমি তাঁর সম্পর্কে এইটুকুই বলতে পারি, তিনি খুব বড় মাপের শিল্পী ছিলেন।'
'নভেরা' নামক জীবন-উপন্যাস নভেরা আহমেদের অনুপস্থিতি ও তাঁর সম্পর্কে জানার অভাব অনেকটা পূরণ করেছে। প্রবাসপূর্ব কালের নভেরাকে জানার জন্য এটা সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরের কাজ। নভেরা আহমেদের ঘনিষ্টজন, সহকর্মী, তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে মিশেছেন এমন ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে উপন্যাসটি লিখেছেন কথাসাহিত্যিক হাসনাত আবদুল হাই। নভেরা আহমেদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ এতটা কমে গিয়েছিল যে, নব্বইয়ের দশকে উপন্যাসটি লেখার সময় তিনি নিশ্চত ছিলেন না নভেরা বেঁচে আছেন কি না। 'তাঁর সঙ্গে দেখা করা সৌভাগ্য হয়নি আমার। এমনকি নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি (১৯৯৫ সালে) সময়ে তাঁকে নিয়ে যখন লিখছিলাম, তখন আমরা জানতামই না, তিনি জীবিত আছেন। পরে জেনেছি, ১০-১২ বছর পরে।'
তাঁকে নিয়ে কাজ করা সম্পর্কে বলেন, 'একজন আধুনিক শিল্পী, ব্যতিক্রমী জীবন যাপন করছেন। প্রথমত এই থেকে মনে হয়েছে তাঁকে নিয়ে লেখা যেতে পারে। এটা মনে হওয়ার পর তাঁকে যারা কাছ থেকে দেখেছেন, এক সঙ্গে কাজ করেছেন ও মিশেছেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে, সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লেখাটা তৈরি করা হয়েছে।' শিল্পাঙ্গনে নভেরা আহমেদের অত্যাবশ্যকীয়তা তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, আন্দোলনের ছোঁয়া, পত্র-পত্রিকা পাঠের ভিত্তিতে আমাদের শিল্পাঙ্গন অনেকটা আধুনিক হয়েছে। তবে নভেরা আহমেদ এদেশে এলে শিল্পাঙ্গন আরো কর্মমুখর হতে পারতো।
তাঁর মৃত্যুতে আমি খুবই ব্যথিত। তিনি দেশে না আসুক, বিদেশে থেকেও তিনি আমাদের দেশের শিল্পাঙ্গনে অবদান রেখে চলেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে সেই শূন্যতা তৈরি হল।
শিল্পী মনিরুল ইসলাম নিজেও দীর্ঘদিন ইউরোপে থেকেছেন। কিন্তু তার সঙ্গেও দেখা হয়নি নভেরা আহমেদের। তবে শিল্পীজীবনের প্রথম থেকেই তাঁর শিল্পকর্মের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন শিল্পী মনিরুল ইসলাম । 'আমরা যখন আর্ট স্কুলের ছাত্র, তখন লাইব্রেরির সামনে নভেরা আহমেদের ভাস্কর্য ছিল। আমরা তখন তা বুঝতাম না। পরে বুঝেছি এগুলো খুবই আধুনিক শিল্পকর্ম।' তিনি আক্ষেপ করে বলেন, 'এর তেমন যত্ন হতো না। এখনও যে শিল্পকর্মের খুব যত্ন হয়, তাও না। তবে তাঁর ব্যাপার আলাদা।' নভেরা আহমেদের অজ্ঞাতবাস সম্পর্কে তিনি বলেন, 'প্যারিসে যাওয়া-আসার সুবাদে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতে পারতো। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের কোনো আর্টিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন না। এটা তাঁর শিল্পীজীবন। অনেক বড় বড় শিল্পীরাও একইভাবে জীবন কাটিয়েছেন। নভেরা আহমেদও তেমন। এটা তাঁর একান্তই ব্যক্তিগত। তাঁর পূর্ণাঙ্গ জীবনী তৈরি হলে হয়তো কারণ জানা যাবে।
তবে শিল্পীর সঙ্গে তার দেশের একটা নাড়ীর যোগাযোগ থাকে। প্রবাস জীবনের প্রথমে হয়তো ইমিগ্রেশন, অর্থনৈতিক নানা ব্যাপার যুক্ত থাকে। পরে তা ফুলফিল হয়ে গেলে সে সমস্যা থাকে না। যে কারণে তাঁরা এক সময় দেশে ফেরেন। গ্রামে জন্ম হলে গ্রামে, পাহাড়ে জন্ম হলে পাহাড়ে, আবার দুর্গম-প্রত্যন্ত স্থানেও চলে যান কেউ কেউ। নভেরা আহমেদ তা রক্ষা করেননি অজ্ঞাত কারণে।'
তিনি আক্ষেপের স্বরেই বলেন, 'আমিও দীর্ঘদিন যাবত প্রবাসে। তারপরও এখনো দেশে নিয়মিত যাওয়া আসা করি। কে কতদিন বাঁচে তা বলা যায় না। আমরা ইতোমধ্যে সফিউদ্দিন আহমদ, কিবরিয়া সাহেবকে হারিয়েছি। তাই দেশের জন্য কিছু রেখে যাওয়া জরুরি। তিনি দেশে ফিরে এলে, এদেশের শিল্পে তাঁর ছোঁয়া লাগতো।' প্রয়াণ-উত্তর সময়ে নভেরা আহমেদের স্মৃতি সংরক্ষণের তাগিদ দিয়ে বলেন, 'এখনো ফ্রান্সে বা বিভিন্ন দেশে তার যে শিল্পকর্ম আছে তা এনে, যথাযথ সংরক্ষণ করে তাঁর প্রতি সম্মান জানানো যেতে পারে।'
শিল্পী মাসুক হেলালও তাঁর উত্তরপ্রজন্মের শিল্পী। তিনিও শিল্পকলায় নভেরা আহমেদের শূন্যতা অনুভব করছেন। দেখা করার চেষ্টা করেও তাঁর স্ব-আরোপিত আড়াল ভাঙতে পারেন নি। তিনি বলেন, 'তাঁর সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি। আমি ঢাকায় আসার অনেক আগেই তিনি প্যারিস চলে গেছেন। আমি যখন প্যারিসে গিয়েছি, বহুবার চেষ্টা করেছি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। পারি নি।' নভেরা আহমেদকে তিনি দেশের আধুনিক শিল্পীদের একজন উল্লেখ করে বলেন, 'তিনি আমাদের এখানে প্রথম আধুনিক শিল্পী। আমাদের যদি দশজন আধুনিক শিল্পীর কথা বলতে হয়, তাহলে উনার নাম বলতে হবে। কারণ উনি যখন স্কাল্পচার শুরু করেন, উপমহাদেশের কোনো মেয়ে স্কাল্পচার শুরু করেন নি। তিনি তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন। আমরা যেমন পরে জেনেছি তিনি শহীদ মিনারের নকশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। উনার যে কাজ তার সঙ্গে মিলিয়ে অনেকেই বলেন, শহীদ মিনারের মূল নকশা উনার হাতেই করা।' দেশে নভেরা আহমেদের অনুপস্থিতির শূন্যতা অনুভব করে তিনি বলেন, 'প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে ফিরিয়ে আনতে। তিন-চারবার রাষ্ট্রীয় দূত পাঠিয়েছিলেন। প্যারিসপ্রবাসী মুকাভিনয়শিল্পী পার্থপ্রতিম মজুমদার, শিল্পী সাহাবুদ্দিন আহমেদকে দিয়েও চেষ্টা করেছেন। পারেন নি। অজ্ঞাত বা ব্যক্তিগত কারণে তিনি এলেন না। এলে এদেশের শিল্প উন্নতিতে অবদান রাখতেন।'
উত্তর প্রজন্মের শিল্পী রণি আহমেদ বিশ্লেষণ করেন নভেরা আহমেদের শিল্পকর্ম। তিনি বলেন, 'সে সময় বিশ্বে যে শিল্পআন্দোলন হচ্ছিল নভেরা আহমেদ তা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। অর্থাৎ, তৎকালে বিশ্বের যে কনটেম্পরারি ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল, তিনি সেটাকে দেশীয় ভাষা-রূপ দিতে চেয়েছেন তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিতে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তখন এ ধরনের কাজ খুবই নতুন ছিল। আবার সে সময়ের প্রেক্ষিতে এটা দরকারও ছিল।
তাঁর মধ্যে হেনরি ম্যুরের 'প্যানিট্রেশন অফ মাচ'-এর অনুপ্রেরণা আছে। যে কারণে তাঁর সৃষ্ট ফিগারগুলোর মধ্যে ছিদ্র দেখা যায়। তখনকার আন্তর্জাতিক এই ফর্মটাকে তিনি অনেকটা দেশীয় সংস্কৃতি ও বিষয়বস্তুতে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। ম্যুরের তৈরি ফিগারের মতো অতটা ফ্যাট না করে অনেক থিন করার চেষ্টা করেছেন। আবার তাঁর স্কাল্পচারে বারবারা হেপওয়ার্ডের বিখ্যাত ফ্যামিলি নামের কনসেপেক্টের একটা ব্যাপার আছে।
তাঁর কাজ দেখলে মনে হয়, তিনি হয়তো একটা পরিবারকেই খুঁজছিলেন। যে কারণে তাঁর স্কাল্পচারে ফ্যামিলির একটা উপস্থিতি আছে। হতে পারে, তিনি ফ্রান্সে সেই ফ্যামিলিকেই খুঁজে পেয়েছিলেন।'