এমনই এক সময়ে পরাক্রান্ত সুলতানের রক্তপিপাসার মুখে ঠান্ডা মাথায় রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখালেন শেহেরজাদ।
Published : 16 Jun 2024, 12:57 PM
“সুলতানের দিকে ফিরে শেহেরজাদ মৃদু গলায় বললেন, ‘একটা গল্প বলব?’
‘বলো,’ সুলতান বললেন।
শেহেরজাদ বললেন, ‘শুনুন তাহলে।’”
পটভূমি বা প্রেক্ষাপট না বললেও যে কেউ বুঝে ফেলবেন, এ উদ্ধৃতি আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা তথা আরব্যরজনীর। শত শত বছর ধরে বিশ্বজুড়ে অজস্র মানুষকে আনন্দ জুগিয়ে আসছে যে গল্প। যে গল্পের কেন্দ্রে আছে শেহেরজাদ, তার বোন দুনিয়াজাদ আর সুলতান শাহরিয়ার, কিন্তু এর পরিধি নেই কোথাও--না ভৌগোলিক অর্থে, না কালিক অর্থে, এমনকি ভাষিক অর্থেও নয়। কারণ এটি মহাবিশ্বের ক্রমসম্প্রসারণশীল তত্ত্বের মতোই ক্রমশ বিস্তৃত হয়ে যাচ্ছে। রচনা থেকে রচনার জন্মের যে-সাহিত্যতত্ত্ব, সেই অর্থেও এটি কেন্দ্র থেকে অনন্ত পরিধির দিকে ধাবমান।
অবিশ্বস্ত স্ত্রীর প্রতি ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতি রাতে একটি নারীকে বিয়ে করতেন শাহরিয়ার, রমণশেষে হত্যা করতেন তাকে। ঘৃণার এ বহ্ন্যুৎসবে যতি টানার দায়িত্ব নিলেন ‘সামান্য’ এক নারী, যার নাম শেহেরজাদ। অস্ত্র নয়, হিংসা নয়, স্রেফ গল্পের জোরে সুলতানকে ফিরিয়ে আনলেন ভয়ংকর এই পথ থেকে। একইসঙ্গে প্রাণ বাঁচালেন অসংখ্য নারীর। ‘শুনুন তাহলে!’--শেহেরজাদের এই কথাগুলো একইসঙ্গে নির্দেশ ও আমন্ত্রণ। যে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যানের ক্ষমতা শাহরিয়ারের নেই। নেই আমাদেরও। রাতের পর রাত কেটে যায়, শাহরিয়ার আর দুনিয়াজাদের সাথে আমরাও শুনে যাই শেহেরজাদের গল্প। গল্পের ভেতর গল্প, তার ভেতর আবার গল্প।
প্রতিরাতে এমন এক জায়গায় গল্প শেষ করে শেহেরজাদ, বাকিটা শোনার জন্য ছটফট করতে থাকেন সুলতান। এভাবে কাটতে থাকে রাতের পর রাত। সহস্র রাত। সুলতান নিজেও টের পান না কখন রক্তস্পৃহা কমতে শুরু করেছে তাঁর। তারপর একদিন গল্প শেষ হয়, কিন্তু ততদিনে শেহেরজাদের প্রেমে পড়ে গেছেন তিনি। গল্প বলার অবিশ্বাস্য দক্ষতা দিয়ে তাঁর মন জিতে নিয়েছেন শেহেরজাদ।
শেহেরজাদ একই সঙ্গে আরব্যরজনীর কথক এবং অন্যতম চরিত্র। গল্প বলিয়ে হিসেবে তুলনা নেই তার। শেহেরজাদ জানে, জীবনটা তার ঝুলছে পলকা এক সুতোয়। সুলতানের মুহূর্তের বিরাগে ধুলায় লুটাতে পারে মাথা। কিন্তু প্রখর মেধা, ধৈর্য ও স্থৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে রাতের পর রাত মৃত্যুকে এড়ায় শেহেরজাদ। সুলতানের প্রতি তার আচরণ আগাগোড়াই প্রশ্নহীন আনুগত্যের। কিন্তু এরই আড়ালে সুকৌশলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে সে। গল্পের মধ্যে কীভাবে একে স্থাপন করতে হয় শেহেরজাদ জানে। কোথায় থামতে হয় আর কোথায় চলতে হয় তা-ও জানে। যেন ধ্রুপদী এক নৃত্যশিল্পী সে। নাচের মুদ্রায় কোথাও ভুল হওয়ার উপায় নেই। কারণ ভুলের শাস্তি নিশ্চিত মৃত্যু। এক রাত নয়, দু-রাত নয়, হাজারটা রাত এভাবে অনিবার্যকে ঠেকিয়ে যায় সে। শিকারী শাহরিয়ার নিজেও বুঝতে পারে না কখন শিকারে পরিণত হচ্ছে সে। প্রতিরাতে একটি নারী হত্যার চক্রকে প্রথমবার থমকে দেওয়ার পর শেহেরজাদের আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে। তার গল্পের চরিত্ররাও যেন আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। শেহেরজাদ বিস্তার করে এক মায়াজাল, যে জালে ক্রমশ আটকে যেতে থাকে শাহরিয়ার। প্রাণ বাঁচানোর নতুন নতুন দরজা খুলে যেতে থাকে শেহেরজাদের সামনে।
কবে এবং কোথায় এই আখ্যানের শুরু? নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে না পারলেও অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতক-এই পাঁচশো বছরকে আরব্যরজনীর গল্পগুলোর সময়কাল বলে ধরে নেওয়া হয়। ইসলামী স্বর্ণযুগেরও শুরু অষ্টম শতকে, যখন আব্বাসীয় শাসনামলে বাগদাদ বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম নগরীতে পরিণত হয়। আরব্যরজনীর বহু গল্পের পটভূমি বাগদাদ। পরাক্রমশালী খলিফা হারুন আল রশিদ অনেক গল্পেই এসেছেন প্রধান চরিত্র হয়ে। প্রাচীন আরবি, গ্রিক, ভারতীয়, ইহুদি, পারস্য, মিশরীয়, মেসোপটেমিয় ও তুর্কি লোক ঐতিহ্যের প্রচুর উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এসব গল্পে। নানা উৎস এবং নানা সংস্করণের মেলবন্ধনে সম্পূর্ণভাবে বিকেন্দ্রায়িত এক উপাখ্যান-সংগ্রহ এই আরব্যরজনী, যাতে প্রণয়, আদিরস, ইতিহাস, হাস্যরস, বিয়োগান্তক ঘটনা, কবিতা, ধাঁধা, কৌতুক, প্রবাদ, হত্যারহস্য, রোমাঞ্চ কাহিনী, রাজনৈতিক আখ্যান, দার্শনিক ব্যাখ্যা, বিজ্ঞান কল্পকাহিনী সব জড়িয়ে-মড়িয়ে আছে।
আবার ফিরে আসি শেহেরজাদের কথায়। এটি যে সময়ের গল্প তখন নারী ছিল প্রান্তিকদেরও প্রান্তিক। সমাজে কোনো অধিকারই ছিল না তার। সর্বক্ষেত্রে পুরুষের অনুমোদনের ওপরই যাদের জীবন ও মৃত্যু নির্ভর করত। এমনই এক সময়ে পরাক্রান্ত সুলতানের রক্তপিপাসার মুখে ঠান্ডা মাথায় রুখে দাঁড়ানোর হিম্মত দেখালেন শেহেরজাদ। মেরিনা ওয়ার্নার ‘স্ট্রেঞ্জ ম্যাজিক: চার্মড স্টেটস অ্যান্ড দ্য অ্যারাবিয়ান নাইটস’ বইয়ে শেহেরজাদের এ কৃতিত্ব সম্বন্ধে বলেছেন, ‘রাতের পর রাত শেহেরজাদের গল্প ক্রমেই পরিণত হয় ভালোবাসা ও ন্যায়পরায়ণতার এক রাজনীতিতে, নিষ্ঠুর সুলতানের দৃষ্টিকে যেটি উন্মুক্ত করে মানবতার ভিন্ন এক রূপের প্রতি।’ গল্পের মায়াজাল বিছিয়ে শেহেরজাদ তৈরি করেন তাঁর নিজস্ব বয়ান। গল্পের মোড়কে নারীদের উপস্থাপন করেন বুদ্ধিমান ও আত্মপ্রত্যয়ী রূপে, এবং ক্রমশ ম্রিয়মান করে দিতে থাকেন নারীদের প্রতি সুলতানের অপরিসীম ঘৃণাকে। সহিংস, স্বৈরাচারী পুরুষদের গল্প বলেন শেহেরজাদ, যাদের বিবেকবোধ জাগ্রত হয় এবং এক পর্যায়ে সরে আসে হিংসা ও ঘৃণার পথ থেকে। এসব গল্প ক্রিয়া করে সুলতানের ওপরও, অবচেতনে তিনি নিজেও এগিয়ে যান সংশোধনের দিকে। গল্প বলাকে শেহেরজাদ ব্যবহার করেন চেতনাকে জাগিয়ে তোলার প্রাচীন এক কৌশল হিসেবে। সুলতানকে বাধ্য করে হত্যালীলা বন্ধ করতে। সে যে কেবল গল্পেরই প্রেমে পড়েছে তা নয়, ততদিনে হত্যার ইচ্ছেটাই মরে গেছে তার।
ক্ষমতাবানের মোকাবেলা করার ব্যাপারে ক্ষমতাহীনের এ কৌশলের সঙ্গে কেউ কেউ সাদৃশ্য খুঁজেছেন ‘পারেসিয়া’ (Parrhesia) তথা ক্ষমতাবানের মুখের ওপর সত্যকথনের কৌশলের। অলঙ্কারশাস্ত্রে ভয়ডরহীন, অকপট ভাষ্যের নাম ‘পারেসিয়া’। মিশেল ফুকো পারেসিয়াকে কথোপকথনের এমন এক উপায় হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন যেখানে মানুষ বাধাহীনভাবে নিজের মনোভাব প্রকাশ করে। ১৯৮৩ সালে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলেতে দেওয়া কয়েকটি বক্তৃতায় ফুকো পারেসিয়ার ধারণাটিকে বিশদ করেছিলেন। শেহেরজাদের কৌশলের সঙ্গে এর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন অনেক সমালোচক। প্রাচীন গ্রিসের উদাহরণ টেনে ফুকো বলেছেন, ‘যার সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছে, পারেসিয়ার চর্চাকারী তার তুলনায় কম ক্ষমতাশালী হয়।’ অর্থাৎ, পারেসিয়া ঘটে অসম ক্ষমতা-কাঠামোর প্রেক্ষাপটে, ফলে এটি করার জন্য দরকার হয় প্রচুর সাহস। স্বভাবতই, ক্ষমতাহীন মানুষটি নিরন্তর থাকেন ঝুঁকির মধ্যে। সত্য বলাটা জীবন-মৃত্যুর খেলায় রূপ নেয়। শেহেরজাদের ক্ষেত্রেও কিন্তু তা-ই। তিনিও দুলছেন জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে। ফুকো বলেছেন, পারেসিয়রা সমষ্টিস্বার্থের যূপকাষ্ঠে নিজের স্বার্থকে বলি দেয়। শাহরিয়ারকে বিয়ে করতে রাজি হওয়ার মাধ্যমে শেহেরজাদও জীবন নিয়ে জুয়া খেলেছে। ঘৃণার আগুনে জ্বলতে থাকা এক রাজন্যের রোষ থেকে তার মতো অসংখ্য তরুণীর জীবন বাঁচানোর জন্য নিজের নিরাপত্তাকে জলাঞ্জলি দিয়েছে।
তবে পারেসিয়া সংক্রান্ত ফুকোর বয়ানের সাথে শেহেরজাদের কৌশলের পার্থক্যও স্পষ্ট। ক্ষমতাবানদের সাথে বোঝাপড়ার সময় ফুকোর পারেসিয়রা যেখানে স্তাবকতার পরিবর্তে সমালোচনাকে প্রাধান্য দেয়, শেহেরজাদ এই কাজ করেন দারুণ কৌশলে, চাটুবাক্য আর বশ্যতাস্বীকারের মাধ্যমে। সুলতান যা বলেন বিনা বাক্যব্যয়ে তা-ই মানেন তিনি। সুলতানের নির্দেশমতো পূর্ববর্তী রাতের গল্পটাকে শেষ করেন। সুলতানের আত্মগর্বকে আহত না করে কাজ উদ্ধার করতে হবে, এটা ভালোভাবেই জানেন তিনি। সুলতান যখন ভাবেন শেহেরজাদ একান্ত বাধ্যগত ভৃত্যের মতো তার নির্দেশ প্রতিপালন করছেন, শেহেরজাদ আসলে গল্পের জাদুতে সুলতানকে পরিণত করছেন এমন এক শ্রোতায় যে কিনা শেষমেষ নিজের বিশ্বাস ও প্রতিজ্ঞাকে পাল্টাতে বাধ্য হবে। ক্ষমতাকাঠামোয় শেহেরজাদের অবস্থান একবারেই নড়বড়ে, তাই ফুকোর তত্ত্ব মেনে অকপট ও সাহসী হওয়ার কোনো উপায় নেই তাঁর। নিজের উদ্দেশ্যকে তাই তিনি ঢেকে রাখেন পর্দার আড়ালে। যেহেতু অকপট ও প্রত্যক্ষ হওয়ার সুযোগ নেই, তাই তাঁকে বলা যায় ‘তীর্যক পারেসিয়’। মৌখিক ইতিহাস আর কাল্পনিক গল্পগাথার জাল দিয়ে তৈরি করতে হয় আত্মরক্ষার বর্ম, যে বর্ম একদিন তাকেসহ অসংখ্য নারীর প্রাণ রক্ষা করবে। উত্তরাধুনিক ফেমিনিস্ট পণ্ডিত ও চলচ্চিত্রনির্মাতা ট্রিন টি মিন-হা অসম ক্ষমতাসম্পর্কে বন্দি প্রান্তিক মানুষের যুদ্ধ নিয়ে বলেছিলেন, ‘শাসকের মুখোমুখি হয়ে নিজের কথাগুলো বলা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাকে এগোতে হয় পরোক্ষভাবে, কৌশলে।’ তাঁর কথিত এই প্রান্তজনের মধ্যে যেন শেহেরজাদকেই চোখে পড়ে আমাদের--পরোক্ষ কৌশলের শক্তি ও সম্ভাবনা সম্বন্ধে যে পুরোপুরি ওয়াকেবহাল।
জীবন আর মৃত্যু নিয়ে জুয়া খেলছেন শেহেরজাদ। প্রাণভয়ে ভীত শেহেরজাদের মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে কোনো হুমকি দেখতে পাননি শাহরিয়ার। অধিকাংশ সময়, এমনকি সরাসরি তাঁকে সম্বোধনও করেন না শেহেরজাদ। দুনিয়াজাদ আর শাহরিয়ারকে নিয়ে তিনি তৈরি করেন এক অদৃশ্য ত্রিভুজ। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর শাসকটি হয়ে যায় সে ত্রিভুজের নিরীহ এক ফলা। শেহেরজাদ আর দুনিয়াজাদের গোপন আঁতাত চোখে পড়ে না তার। চোখে পড়ে না তাদের সাহসিকতাও। ক্ষমতার স্থানান্তর এখানে এক বিন্দু থেকে আরেক বিন্দুতে প্রকাশ্যে ঘটে না, এটি ঘটে আলগোছে, গল্পের ছলে, যে গল্প কেবল শাহরিয়ার নয়, শতাব্দী ধরে অজস্র মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে।
সূত্র:
• Lessons from Scheherazade on the art of indirection, Amelia Groom.
• Enthralling Legacy: The Timeless Allure of Scheherazade and the Arabian Nights. Indrajit Roy Choudhury