আমরা লক্ষ করি, বাংলা বিভাগসমূহে ভাষাবিজ্ঞান কিংবা ভাষা-গবেষণা বিষয়ক কোর্সের সংখ্যা কমে এসেছে । অথচ ভাষার অনুপুঙ্খ অধ্যয়ন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ভাষাবিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই।
Published : 21 Feb 2025, 01:30 PM
ভাষা বদলায় এ কথা নতুন নয়; বাংলাও বদলেছে, বদলাবে। হাজার বছর আগের বাংলা ভাষা এবং আজকের বাংলা ভাষা দূর-সম্পর্কের আত্মীয়। নানা কারণেই ভাষা বদলায়। প্রভাব ফেলে অর্থনীতি, রাজনীতি, ক্ষমতা, ভাবাদর্শ। একালের বাংলাও বদলাচ্ছে। অনেক দ্রুতই বদলে যাচ্ছে। বিশেষ করে নতুন প্রযুক্তি এসে বাংলা ভাষাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নতুন দুনিয়ায়। সেখানে ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, নিউজপোর্টাল অশরীরী গন্ধ ছোটায়। এই ভাষাকে পাঠ করা দরকার গবেষকের মন দিয়ে। প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা কি সেই পাঠ করছি?
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট বাংলা বিভাগ নানা ধরনের গবেষণা করেছে। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলা বিভাগ সংশ্লিষ্ট গবেষকরাই ছিলেন গবেষণার মৌল শক্তি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এনামুল হক, মুহম্মদ আবদুল হাই, মুনীর চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ, মনসুর মুসা, মহাম্মদ দানীউল হক প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানীর হাত ধরে সম্পাদিত হয়েছে ভাষাবিষয়ক গবেষণা।
গত দুই দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাবৃদ্ধির পাশাপাশি বাংলা বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে। সংগত কারণেই অনেকের মনে আশার সঞ্চার ঘটেছে যে, এর ফলে বোধ হয় বাংলা ভাষা বিষয়ক গবেষণা সংখ্যায় বেড়েছে। সত্যিই কি তেমন ঘটেছে? ব্যক্তিক অভিজ্ঞতার ওপর ভরসা করে বলতে পারি, সে রকম কিছু ঘটে নি। মনোযোগের আলোকসম্পাত যতোটা সাহিত্যের ওপর পড়েছে ততোটা পড়ে নি বাংলা ভাষার ওপর। রূপান্তরশীল বাংলা ভাষার নতুন অভিব্যক্তি, সংকট ও সম্ভাবনাগুলোর সঙ্গে গবেষকদের সাক্ষাৎ খুব কমই ঘটেছে।
অন্য দিকে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগের শিক্ষক ও গবেষকরা গবেষণায় নতুন বিষয় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন। চমৎকার কিছু কাজ সম্পন্ন হয়েছে সৌরভ সিকদার, হাকিম আরিফ, গুলশান আরা বেগম, সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান, মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, মনিরা বেগম, নাদিয়া নন্দিতা ইসলাম, মাশরুর ইমতিয়াজ প্রমুখের মাধ্যমে। বাংলা ভাষার ইতিহাস, লিপির মতো সাধারণ বিষয়গুলোর পাশাপাশি সম্পাদিত হয়েছে বাংলা ভাষার ওপর অন্য ভাষার প্রভাব, অন্য ভাষার ওপর বাংলার প্রভাব, অভিধান, রূপমূলতত্ত্ব, শৈলীবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা। কারো কারো গবেষণায় স্থান পেয়েছে সেমিওটিকস, ডিসকোর্স অ্যানালাইসিস। কারো কারো আগ্রহের ক্ষেত্রে ভাষা-বৈকল্য।
বহুভাষিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে আদিবাসী ভাষাসমূহের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়েছেন কোনো কোনো গবেষক। প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞানের আলোকে শিশুর ভাষা-অর্জন ও ভাষাশিক্ষার সমস্যা নিয়ে কাজে মগ্ন হতে দেখা গেছে কোনো কোনো ভাষাবিজ্ঞানীকে। এসব আমাদের আশাবাদী করে তোলো। কিন্তু যে ভাষাচেতনার বীজসূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে বাংলা বিভাগের উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠা সেই ভাষা নিয়ে বাংলা বিভাগসমূহের কাজ এখন কেমন?
আমরা লক্ষ করব, অধিকাংশ বাংলা বিভাগের গবেষণাক্ষেত্র সাহিত্যনির্ভর; কখনো কখনো প্রাসঙ্গিকভাবে বিশ্লেষিত হয় সাহিত্যের ভাষা। ভাষার মতো বিরাট ও ব্যাপ্ত জগতের বড় অংশই অস্পর্শিত থেকে যায়। বিগত দুই-তিন দশকের বাংলা বিভাগের খতিয়ান যদি আমরা গ্রহণ করি, তাহলে দেখতে পাবো ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক বিশেষজ্ঞতার ক্ষেত্র তৈরি হয় নি, ভাষা-আশ্রয়ী গবেষণার হার কমেছে। অবশ্য এই দাবি আমি করছি না যে, ৫০ বছর আগের বাংলা বিভাগগুলোতে ভাষাবিষয়ক গবেষণার ছড়াছড়ি ছিল। কিন্তু একথা বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলা বিভাগের সংখ্যা অল্প হলেও, প্রযুক্তির অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সেই বিভাগগুলোতে ভাষা-গবেষণার একটি বিদ্যায়তনিক পরিবেশ ছিল। অর্থাৎ শিক্ষক ও গবেষকবৃন্দ ভাষা-গবেষণায় আগ্রহী ছিলেন। তার প্রকাশ দেখা যেত গবেষণা-সাময়িকী ও গবেষণা-পুস্তকে।
বাংলা বিভাগ সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ও গবেষকরাই গড়ে তুলেছিলেন ভাষা গবেষণা বিষয়ক সংগঠন। বাংলাদেশে প্রায়োগিক ভাষা-বিজ্ঞান ও ভাষা-পরিকল্পনা বিষয়ক গবেষণায় প্রায় পথিকৃতের মতো কাজ করেছেন মনসুর মুসা। হুমায়ুন আজাদের সম্পাদনায় সংকলিত হয়েছিল বাংলা ভাষা নামক বিরাট দুই সংকলন। বাক্যতত্ত্বের মতো বড় মাপের গ্রন্থের প্রণেতাও হুমায়ুন আজাদ। ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক সাধারণ তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনার পাশাপাশি মহাম্মদ দানীউল হক লিখেছেন ভাষা-আর্জন ও আয়ত্তীকরণ প্রসঙ্গে। উপভাষা নিয়ে কাজ করেছেন মনিরুজ্জামান। সমাজভাষাবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন রাজীব হুমায়ুন। এদের সবাই বাংলা বিভাগের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের প্রায় সবাই ভাষাবিজ্ঞান নিয়ে উচ্চতর পড়ালেখা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন এবং সেই বিদ্যা ও অভিজ্ঞতাকে গবেষণার কাজে ব্যয় করেছেন। দেখা যাচ্ছে যে, ভাষা ও সাহিত্যনির্ভর একটি বিভাগে ভাষা প্রায় সমান আগ্রহের সঙ্গে অনুশীলিত হয়েছে। কিন্তু এ কালে সেই বিভাগসমূহের কার্যপরিসর কেমন?
সাম্প্রতিক বাংলাদেশের বাংলা বিভাগসমূহের গবেষণা প্রধানত সাহিত্য-ঘেঁষা। গবেষণার ক্ষেত্রও একই আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। তবু কিছু কাজের নজির পাওয়া যায়। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম কাজ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষাচিন্তাকে বিষয় করে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে ভাষাবিষয়ক জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চায় তাঁর রবীন্দ্র-গবেষণার প্রভাব পড়েছে। এছাড়া বাংলা ভাষার প্রমিতায়ন নিয়ে তাঁর কাজ আছে। মূলত ভাষার আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পাঠ তিনি করতে চেয়েছেন। একই বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক তারিক মনজুর কাজ করেছেন বাংলা বানান নিয়ে। বাংলাদেশে বাংলা বানান নিয়ে এটিই প্রথম পিএইচডি স্তরের গবেষণা। শব্দ, বানান, ব্যাকরণ তাঁর আলোচনায় প্রায়শই কেন্দ্রীয় বিষয়ের মর্যাদা পায়। তিনি যেতে চান সাহিত্যের বাইরের ভাষায়। তাঁর ভাষাবিষয়ক কাজগুলো থেকে সাধারণ পাঠক ভাষা-সমস্যার চটজলদি সমাধানও পেয়ে যেতে পারেন।
প্রায় দুই দশক আগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবু দায়েন প্রচলিত নতুন শব্দের আর্থব্যঞ্জনা নিয়ে গবেষণা-প্রবন্ধ লিখেছিলেন। আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্ক নিয়েও কিছু কাজ সম্পন্ন করেছেন। সোহানা বিলকিস গবেষণা করেছেন সাহিত্যে নারীভাষা প্রসঙ্গে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসান তালুকদার কাজ করেন প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক বাংলা ভাষা নিয়ে। নবীন গবেষক হিসেবে ভাষাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক চিন্তাপ্রবাহে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মামুন আর রশীদ। আন্তর্জাতিক ধ্বনিমূলক বর্ণমালা নিয়ে পূর্ণাঙ্গ একটি পুস্তক রচনা করেছেন তিনি। সংকলন করেছেন চলতি শব্দের অভিধান। কম্পিউটার প্রযুক্তি ও বাংলা ভাষার সুচারু সম্পর্ক স্থাপনে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ কারণে মামুনের কাজের বিষয় কম্পিটারের জন্য ভাষা প্রক্রিয়াকরণ। অলনাইনে ব্যবহৃত টক্সিক শব্দের তালিকাও তিনি প্রণয়ন করেছেন। তাঁর কাজে তালিকায় আছে বাংলা কম্পিউটেশনাল গ্রামার। এদের সমবেত প্রয়াসে ভাষা-প্রযুক্তি, সমাজভাষাবিজ্ঞান, প্রায়োগিক ভাষাবিজ্ঞান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাঠক্রমে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগও ভাষা-গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। সাঁওতালি ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিএম সফিকুল ইসলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে চাকমা, চট্টগ্রামী বাংলা ভাষা নিয়ে গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ক কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন জফির সেতু। তাঁর আগ্রহ ও কাজের ক্ষেত্র লোকভাষাবিজ্ঞান, সমাজভাষাবিজ্ঞান, আদিবাসী ভাষা। তাঁর পিএইচডি গবেষণা সম্পাদিত হয়েছে সমাজভাষাবিজ্ঞানকে আশ্রয় করে। নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে কেউ কেউ ভাষা-গবেষণায় আগ্রহ ও পরাঙ্গমতা দেখিয়েছেন।
এই ফিরিস্তির ভেতর আমরা শিক্ষকদের গবেষণা-পরিসর তুলে ধরেছি মাত্র। তাঁদের তত্ত্ববধানে শিক্ষার্থীরাও কিছু গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। তাবে সাম্প্রতিক কালে তার হার খুব কম। এই তথ্যগুলো দিয়ে আমরা মোটা দাগে বাংলা বিভাগসমূহে ভাষা-গবেষণার একটি সাধারণ খতিয়ান তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। কাজের ক্ষেত্রে ও বিষয়গুলো নিঃসন্দেহে অভিনব, চিন্তা-উদ্দীপক। কিন্তু তালিকা তো আরও লম্বা হওয়ার কথা।
আমরা দেখতে পাই বাংলা ভাষার প্রমিতায়নের ইতিহাস ও প্রক্রিয়া নিয়ে এদেশে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো কাজ সম্পন্ন হয় নি। অথচ মান ভাষা, প্রমিত ভাষা ও আঞ্চলিক ভাষা বিষয়ক তর্ক প্রতি বছর সংঘটিত হয়। মুদ্রণযন্ত্র-পূর্ব বাংলা বনাম মুদ্রণযন্ত্র-পরবর্তী বাংলার তুলনামূলক পাঠ সম্পন্ন হয় নি। প্রেস, টাইপ, মুদ্রণ, অক্ষরবিন্যাস, লিপি -- এই সবের ভাষা-প্রযুক্তিভিত্তিক ইতিহাসও আমাদের অজানা; ইতিহাস থাকলেও বিশদ গবেষণা সম্পন্ন হয় নি বলেই জানি। অন্তত পূর্ববাংলার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে এ জাতীয় গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
পূর্ববাংলার ভাষার স্বাতন্ত্র্য এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাষা-আধিপত্য নিয়ে প্রায়শই তর্ক বাঁধে; কিন্তু এ বিষয়ক ভাষাবিজ্ঞানভিত্তিক সূক্ষ্মতর পর্যালোচনায় আমরা অবতীর্ণ হই নি। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ-বিরোধী একটি উষ্মা আমাদের মনে কাজ করে। সেই বিরাগের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যাখ্যা সম্পাদিত হলেও বাংলা ভাষার মান্যায়নের ভাষাতাত্ত্বিক ইতিহাস আমরা গড়ে তুলি নি। বাংলাদেশে অভিধানচর্চা প্রবণতা ও ইতিহাস নিয়ে আমাদের কাজের ঘাটতি আছে। শব্দার্থবিজ্ঞানের কাজ প্রসারিত হয় নি। হুমায়ুন আজাদ অর্থবিজ্ঞান নামে ছোট্ট একটি বই লিখেছিলেন, তার পর সে দিকে আর কারো পদচ্ছাপ পড়ে নি। ভাষা ও দর্শনের সম্পর্ক বিষয়ক কোনো কাজের হদিস আমরা দেখতে পাই না।
বাংলাদেশি বাংলা ভাষার স্বাতন্ত্র্য কোথায়? তার কালকেন্দ্রিক কিংবা কালানুক্রমিক পাঠ আমরা সম্পন্ন করি নি। বহু বছর আগে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান প্রণয়ন করেছেন। তারপর কেমন আছে আঞ্চলিক বাংলা? অর্থনীতি ও সংস্কৃতি কি ভাষাগুলোকে প্রভাবিত করে নি? আমাদের জানা দরকার ভাষাগুলোর সর্বশেষ চেহারা কী। আর তাই এ বিষয়ক গবেষণা দরকার।
বাংলা স্ল্যাং নিয়ে এখনও আমাদের অনেক ট্যাবু। অথচ এই ভাষা ঘোরতারভাবে শক্তিশালী। বাংলাদেশের স্ল্যাং নিয়ে ভালো একটি কাজের প্রত্যাশা আমরা করতে পারি। বাংলা ভাষায় প্রচুর ইংরেজি শব্দ ঢুকেছে। সেসব শব্দের বঙ্গীয়করণ এবং আঞ্চলিকীকরণও ঘটেছে। সেসব নিয়ে অগ্রগণ্য কোনো গবেষণামূলক কাজ আছে কি? আমার নজরে পড়ে নি।
প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতির উত্থান, নতুন গণমাধ্যমের বিস্তৃতির ফলে বাংলা ভাষায় কী কী পরিবর্তন এলো? তার হদিস কি আমরা নিয়েছি? পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বায়ন ও বাংলা ভাষার সম্পর্কের একটি রূপরেখা আমরা তৈরি করতেই পারি। দৃশ্যশ্রুতিনির্ভর মাধ্যমগুলোতে বাংলা লিখন, সম্প্রচারের বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিগত দুইশো বছরে বাংলা বিজ্ঞাপনের ভাষার রূপান্তর সম্পর্কেও আমাদের জানাশোনা দরকার। এখন তো বিজ্ঞাপন ঝুলে থাকে বিলবোর্ডে, ওয়েবসাইটের ব্যানারে, সংবাদের খোপে, অডিও-ভিডিওর অন্দরে। এসব ভাষা বিষয়ে আলাপ তোলা দরকার।
সবচেয়ে জরুরি এখন বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল প্রযুক্তি মাধ্যমের উপযোগী করে তোলা। নির্ভুলভাবে বাংলা উপস্থাপনের উদ্যোগ কেমন হতে পারে? কোথায় আমাদের ঘাটতি? নিউজপোর্টালগুলো কেন প্রতিনিয়ত ভুল বানান উৎপাদন করছে? কী সেই ভুলের রকমফের? প্রমিত বাংলা বানান সংস্কারের ভিত্তি কী হতে পারে? এসব প্রশ্নের সুরাহা করা দরকার। কারা করবে? নিশ্চিতভাবে, ভাষা-গবেষকরাই এক্ষেত্রে প্রধান অবলম্বন। এই কাজ কেবল ভাষাবিজ্ঞান চর্চাকারীদের নয়। একচ্ছত্রভাবে বাংলা বিভাগগুলোও তা পারবে না। কারণ বাংলা বিভাগসমূহের ধ্রুপদী চেহারা আর নেই -- যেখানে একজন ভাষা-গবেষক নিবিড়ভাবে গবেষণার অন্দরমহলে প্রবেশ করতেন।
পশ্চিমে ভাষাতাত্ত্বিক চিন্তার যে বড় বড় পরিবর্তন ঘটে গেছে, তার ছাপ কতটুকু আমরা দেখতে পাচ্ছি সাম্প্রতিক কালের বাংলা বিভাগগুলোতে? তার ঢেউ কি তাহলে বাংলা বিভাগের দেয়ালে আঘাত করে নি? আদতে দেখতে পাই, সেমিওটিকস, সেমিওলজি, ডিসকোর্স অ্যানালাইসিসের মতো বিষয়গুলোই এখনও বাংলা বিভাগসমূহের চিন্তার পালে কোনো হাওয়া দিতে পারে নি। বাংলা বিভাগে এখনও দুষ্পাঠ্য ভাষাদর্শন। তাহলে বাংলা ভাষা-গবেষণা এখনও কি পড়ে থাকবে ধ্বনিমূল, রূপমূল বিশ্লেষণের ধূলিময় অববাহিকায়?
আমরা লক্ষ করি, বাংলা বিভাগসমূহে ভাষাবিজ্ঞান কিংবা ভাষা-গবেষণা বিষয়ক কোর্সের সংখ্যা কমে এসেছে । অথচ ভাষার অনুপুঙ্খ অধ্যয়ন সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে ভাষাবিজ্ঞানের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের বাংলা বিভাগগুলো ধ্বনিবিজ্ঞান ও সাধারণ ভাষাবিজ্ঞানের ঘাটে তরী ভিড়িয়েছে। অথচ পুরনো বন্দর ভেঙে তৈরি হয়েছে ভাষাবিজ্ঞানের নতুন নতুন বন্দর। সত্তরের দশকে হুমায়ুন আজাদরা নওম চমস্কির জাহাজে চেপে বসেছিলেন। চমস্কির তরী অনেক অনেক আগেই অচল হয়েছে। অথচ বাংলা বিভাগগুলো বিশদভাবে খবর নিলো না রোমান ইয়াকবসন, অ্যাডওয়ার্ড সাপির, উইলিয়াম লেবভ, জর্জ লাকভ, ইভ ক্লার্কের মতো ভাষাবিজ্ঞানীর। সতিকার অর্থে, সাম্প্রতিক কালের ভাষাবিজ্ঞান ও ভাষা-গবেষণার ধারাকে ধারণ করে -- এমন একটি অবশ্যপাঠ্য বাংলা বই বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এ লেখার ভেতর দিয়ে এটুকুই বলতে চাই যে, বাংলা ভাষাকে যদি একটি ডিজিটাল ক্ষমতাসম্পন্ন ভাষা হিসেবে ভবিষ্যতে দেখতে চাই, তাহলে বাংলা বিভাগকে অবশ্যই এ কালের উপযোগী ভাষা-অধ্যয়ন ও তত্ত্বচিন্তার দিকে মনোযোগী হতে হবে। পাঠ্যবিষয়, গবেষণার তত্ত্বদৃষ্টি ও বিষয়ে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। ভাষা বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের ক্লাসিক পাটাতনে নিশ্চয়ই পা রাখবো, কিন্তু সেসব ঘিরে আচলায়তন করে তুললে বাংলাদেশে ভাষাবিষয়ক গবেষণা খুব বেশি দূর এগুতে পারবে না, অন্য কোনো ডিজিটাল ক্ষমতাসম্পন্ন ভাষার সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়বে; সেক্ষেত্রে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ভাষার তালিকায় বাংলার নাম ওঠাতে বাংলাভাষীকে কয়েক জন্ম পাড়ি দিতে হবে।