উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে সেই 'কাঙ্ক্ষিত স্বাদগন্ধের' অভাব বোধ করি, যা টেনে নিয়ে যাবে নিজেরই অজান্তে!
Published : 01 Jun 2024, 03:30 PM
২০১৮ সালে সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী প্রয়াত হওয়ার অব্যবহিত পর বিশ্বজিৎ রায় আনন্দবাজার পত্রিকায় 'স্মার্ট মুদির দোকান' শিরোনামে একটি উল্লেখযোগ্য নিবন্ধ লেখেন, যার মূল প্রতিপাদ্য ছিল, সকলেই লেখক কিন্তু সকলেই সাহিত্যিক নন। লিখলেই লেখক হওয়া যায়, কিন্তু 'সাহিত্যিক' পদবাচ্য হতে গেলে আরও কিছু মহিমার প্রয়োজন, যা অনেকেরই নেই। অথচ বাজারে জনপ্রিয় অনেক লেখককেই আমরা 'সাহিত্যিক' হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছি। শ্রী রায়ের এই বিশ্লেষণের সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। তাঁর বক্তব্য কেবল গদ্য লেখকদের সম্পর্কেই প্রযোজ্য নয়, কবিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর কে না জানে জীবনানন্দের সেই বিখ্যাত উক্তি, 'সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।' কালে কালে বহু কূট প্রশ্ন জড়ো হয়েছে এই মর্মে যে, 'সাহিত্যিক' আমরা কাকে বলব? তিনি কি আদর্শবাদী হবেন, সংস্কারক হবেন, দ্রোহবাদী হবেন ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ওঠে। দেখা যায়, সাহিত্যিকদের মধ্যেও এ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে। কিন্তু, যে কেন্দ্রীয় বিষয়টি নিয়ে সম্ভবত কোনও মতভেদ নেই সেটি হ'ল, সাহিত্যিক হচ্ছেন জীবনবাদী এক শিল্পী। জীবনের ধূসরতা, জীর্ণতা, পাঁক তিনি শব্দে শব্দে গাঁথলেও তার গহন অভিপ্রায়টি প্রচ্ছন্ন হয়ে থাকে সুন্দর জীবনের গভীর অন্বেষায়! 'আরও কিছু মহিমা'র গূঢ়ার্থটি হাতে নগদ প্রাপ্ত জীবন থেকে আকাঙ্ক্ষিত মহাজীবনের অন্বেষায় নিহিত! 'মহাজীবন' মানে কিন্তু মহাপুরুষের অলীক মহিমাঘন জীবন নয়!
যেকোনও সৃজনশীল কর্মের সার্থকতা কোথায় নিহিত? সাহিত্য, সঙ্গীত, অঙ্কন, চলচ্চিত্র---সৃষ্টিপ্রবাহের বহুবিধ ধারা কোন খাতে বইলে তা নান্দনিক ও অর্থপূর্ণ হতে পারে? এককথায় বলতে গেলে, যা মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত, রোমাঞ্চিত ও অনুপ্রাণিত করে তোলে, সেই সৃষ্টিই নান্দনিক, অর্থপূর্ণ ও সার্থক। কবি-সাহিত্যিক বা শিল্পী তো আর তাদের সৃষ্টিকর্মকে একান্ত গোপনীয়তায় মুড়ে রাখেন না, তাকে সর্বসমক্ষে প্রকাশ করেন, মৃত্যুর পর প্রকাশিত হলেও সৃষ্টির নেপথ্যে প্রচ্ছন্ন থাকেই মানুষের সানন্দ-সমাদর প্রত্যাশা! অতএব, যিনি তাঁর মেধা ও প্রতিভার আলোয় একান্ত আত্মগত অনুভূতি ও ভাবনা বিচ্ছুরিত করছেন, তা মানুষের মনে প্রভূত আনন্দ দেয় ও হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, যখন সৃষ্টির সাথে মানুষ নিবিড় একাত্মতা অনুভব করে। 'আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে'--ভারতচন্দ্র লিখিত অমর এই পংক্তিটি আপাত-সারল্যে সিরিয়াস গবেষকের চিত্তকে হয়তো তৃপ্ত করবে না, কিন্তু আপামর মানুষের চোখ দুটি অশ্রুসজল হয়ে ওঠে এর অমলিন ও শাশ্বত আবেদনে। এখানেই সার্থক স্রষ্টার সৃষ্টিসাধনা। মধুসূদন দত্ত মহাকাব্যের সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার বিপরীত মেরু থেকে রাবণ, মেঘনাদ প্রভৃতি চরিত্রকে যেভাবে চিত্রিত করলেন, তারপরও তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত হ'ল কেন? তবে কি প্রতিষ্ঠিত সর্বজনগ্রাহ্যতাকে অতিক্রম করে মাটির পৃথিবী আরও কিছুর প্রত্যাশায় প্রতীক্ষিত ছিল, যা গভীর অন্তর্দৃষ্টির আলোয় একজন কবিই দেখতে পান? হ্যাঁ, ঠিক তাই।
আজ এতগুলো বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও আর একটিও 'পথের পাঁচালী' রচিত হ'ল না কেন? ছোটগল্প, কাব্য--সবক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। বরং তুলনায় প্রবন্ধের ধারাটা তার গৌরব বজায় রাখতে পেরেছে। অথচ, উপন্যাস-ছোটগল্প-কবিতা কম লেখা হচ্ছে না; কিন্তু, পাঠকচিত্তকে সেসব কতটা মুগ্ধ-অভিভূত ও আন্দোলিত করতে পারছে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম, তা সাহিত্য-সঙ্গীত-চলচ্চিত্র যা-ই হোক, মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করতে না পারলে নিরর্থক তার সৃজন-প্রয়াস; তা হয়তো বৌদ্ধিক পরিমণ্ডলের উচ্চমার্গে অবস্থিত মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কৃপাধন্য হতে পারে, কিন্তু জননন্দিত না-হওয়ায় সেইসব তথাকথিত সৃষ্টিসম্ভার মহাকালের নির্মম হস্তে একদিন যে মহাশূন্যে বিলীন হতে বাধ্য--এর মধ্যে একবিন্দুও ভুল নেই!
প্রয়াত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ-এর জন্মদিনে ( ১৯৪৮ ) বিষণ্ণমধুর একটি স্বাদু, অপরূপ লেখার মাধ্যমে তাঁকে গত বছর স্মরণ করেছিলেন প্রাবন্ধিক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। দুই বছর পরে, ২০২৫ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার নিতে গিয়ে সম্মানিত অতিথিবর্গের সামনে হুমায়ূন আহমেদ ঠিক কি কি বলতে পারতেন, সেই বক্তৃতাটি কল্পনার মেদুর বিচ্ছুরণে তিনি যেভাবে লিখেছিলেন তা আমাদের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠেছিল এজন্যেই যে, তাঁর আত্মার ভিতরে অবগাহন করে যেন উঠে এসেছিল কথাগুলি! কেবল তাঁর নয়, জগতের তাবৎ 'সাহিত্যিক'-এরই বোধহয় মনের কথা! যুদ্ধহীন পৃথিবীতে সব মানুষের সুখ ও শান্তির কামনায় দীপিত এক সাহিত্যিকের, না কি সব সাহিত্যিকেরই জীবনসাধনার মূল সুরটি বেজে উঠেছিল সেই কল্পিত বক্তৃতায়?
আজকাল এখানে-ওখানে অনেক 'সাহিত্যসভা' হয়। অনেকেই স্বরচিত কবিতা, গল্প ইত্যাদি পড়ে থাকেন। 'সাহিত্য' নিয়ে বক্তৃতা হয়। হাততালি পড়ে। সেইসব 'সাহিত্যসভায়' কিছু 'বিনোদনের' ব্যবস্থাও থাকে। হয়তো সাহিত্যে বিনোদনের যথেষ্ট অভাব আছে সেই কল্পনায় এই 'অতিরিক্ত' আয়োজন। আমি বুঝতে অপারগ যে, হয়তো কম বোঝার কারণেই, এইসব আয়োজনে সাহিত্যের ঠিক কতটা 'উপকার' বা 'কল্যাণ' হয়ে থাকে। যারা 'হাততালির' প্রত্যাশায় থাকেন তাদের দ্বারা আর যাই হোক 'সাহিত্য' হওয়া সম্ভব নয়। কারণ, যারা 'হাততালি' দেয় তারা যতটা 'হাত' আর 'তালি' বোঝে, ঠিক ততটাই 'সাহিত্য' বোঝে কি না সে-নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। 'সাহিত্য' গভীর নিভৃতির সাধনা। 'নির্জনতা', 'নৈঃশব্দ্য' সাহিত্যিকের পরম কামনার ধন। আর আয়োজকদের কথা? মনে পড়ছে, 'অগ্নীশ্বর' নিতান্ত অনীহা সত্ত্বেও একটি 'সাহিত্যসভায়' শেষপর্যন্ত উপস্থিত হয়ে মাত্র দুটি বাক্য বলেছিলেন। 'অনিবার্য কারণে' উপস্থিত হতে বিলম্ব হওয়ায় মার্জনা চেয়ে নেওয়া। আর, 'বিনোদনের প্রতি' অত্যধিক ঝোঁককে চিহ্নিত করা। 'সাহিত্যবোধ' বা 'সাহিত্যমনস্কতা' মূলত 'ভিন্ন কিছু' প্রত্যাশা করে; সাহিত্যের বিশুদ্ধ পাঠক ও সাহিত্যিক দুই তরফেই।
বহুবার বলেছি বা লিখেছি। শিল্পে ও সাহিত্যে চাই নতুন কথা, নতুনের নির্মাণ। গতানুগতিকতা নয়। মৌলিক ও নতুন আলো সৃজনশীলতার গহন 'মনের কথা'। ''এক গড়পড়তা সাহিত্য-শিল্পের নিশ্চিত আরামে কেন আজ আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সৃজনশীলতা?'' অত্যন্ত জরুরি এই সমীক্ষাটি উন্মোচন করতে গিয়ে 'দেশ' পত্রিকায় ( ২ এপ্রিল, ২০২২ ) কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য একই লয়ে তান বিস্তার করেছিলেন। 'সময় যখন সম্পাদক' শীর্ষক লেখায় তিনি লিখছেন: ''এর সঙ্গে আসছে তাৎক্ষণিক মন্তব্য ও প্রশংসার মোহ। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে হাজারো অন্তঃসারশূন্য মন্তব্যে আত্মপ্রসাদ লাভ করে কেউ তৃপ্ত হচ্ছেন। তিনি প্রশ্ন করছেন না নিজের সৃষ্টিকেই। নির্মেদ করছেন না কিছু। মানুষও হাততালি দিচ্ছে এই সমকালীন ইভেন্ট-সম সাহিত্যিক প্রক্রিয়াগুলিকে। এর ফলে ক্ষতি হচ্ছে সেই ব্যক্তিরই। নিজেকে আক্রমণ না-করে তিনি বন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছেন।'' সোশ্যাল মিডিয়ার লঘু আনন্দের দুর্মর আকর্ষণে বিশেষত নতুন লেখকদের নিজেকে নিঃশেষিত করার এই বীক্ষণ যথার্থ। শেষ অনুচ্ছেদে তিনি যা লিখছেন তা-ও একেবারে অমোঘ: ''সৃজনশীলতা হল মৃত্যুর সামনে বসে স্বীকারোক্তি করার মতো। ঝুঁকি আপনাকে নিতেই হবে। নিজেকেও বারবার ভেঙে নিজের ধ্বজা নিজে হাতেই ধ্বংস করার সৃষ্টি ও ধ্বংসের খেলাই সৃজনশীলতার ডি এন এ।''
একজন লেখক ঠিক কখন 'ফুরিয়ে' যান? যখন তিনি কথিত ওই 'আত্মপ্রসাদ' লাভ করেন। একজন সৃষ্টিশীল লেখক সবসময় একটি 'অতৃপ্তি' নিয়ে ঘোরেন। কিন্তু, যখন তিনি 'তৃপ্তি' পান তখন বুঝতে হবে, তিনি নিজেই নিজের লেখকসত্তার সমাধি খুঁড়তে শুরু করেছেন। ক্রমাগত ও উচ্চকিত 'আত্মপ্রদর্শনী' সৃজনশীল সৃষ্টির পথে বাধা। হিন্দোল ভট্টাচার্যের নিবন্ধটি লেখকদের 'দিশা' দেখাতে সক্ষম। কিন্তু, প্রশ্ন হ'ল, দেখার ইচ্ছে বা আগ্রহ আছে তো?
উপন্যাস ও ছোটগল্পের প্রতি 'টান' অনেকদিন থেকেই ম্লান, ধূসর। অথচ, একসময় 'প্রথম আকর্ষণ' ছিল উপন্যাস ও ছোটগল্পই। নবীন বয়সের চপল আনন্দ সাহিত্যের এই দুটি শাখার সঙ্গে সহজ মিতালি গড়ে নেয়। এই প্রধান কারণটি 'অনুকূল জলহাওয়ায়' স্বচ্ছন্দে পরিপুষ্ট হতে পেরেছে একথা অনস্বীকার্য। তারপর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়েছে সিরিয়াস প্ৰবন্ধ বা প্রবন্ধের বই। সাহিত্য, দর্শন, ইতিহাস। তা ছড়িয়ে গেছে গভীর চিন্তার নানা দিগন্তে। আগ্রহ ক্রমে তুমুল আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। এর নেপথ্যেও জীবনের বহতা সময় হয়তো একটা প্রধান অনুঘটক। সকালের সূর্য বিকেলে অন্য রঙ ধারণ করবেই। কিন্তু, সেজন্য উপন্যাস বা ছোটগল্পের প্রতি আগের সেই টান ম্লান বা ফিকে হতে শুরু করাটা ঠিক যৌক্তিক নয়। কিন্তু, তবুও সেটাই যখন হয়েছে তখন ভেবেছি যে, এর কারণটা কী। অনেক ভেবে মনে হয়েছে, ওই 'অনুকূল জলহাওয়া'র ক্রমবিলুপ্তি। অথচ, লেখা হচ্ছে প্রচুর। আগেই বরং কম হ'ত। আসলে রান্না হলেই তো কেবল হয় না, তার স্বাদগন্ধের ব্যাপারটাই মুখ্য। উপন্যাস ও ছোটগল্পের মধ্যে সেই 'কাঙ্ক্ষিত স্বাদগন্ধের' অভাব বোধ করি, যা টেনে নিয়ে যাবে নিজেরই অজান্তে!
শেষ করি প্রাবন্ধিক আহমাদ মাযহার-এর এই যথার্থ পর্যবেক্ষণটি দিয়ে:
"হ্যাঁ, একথা ঠিক যে সাহিত্যে কল্পনাপ্রতিভার গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। কিন্তু, সাহিত্যচর্চা গজদন্ত মিনারে বাস করে হয় না। সৃষ্টিশীল সাহিত্যিকের যে কল্পনাপ্রতিভা থাকতে হয়, তিনি যে কল্পনা করেন, তা তাকে করতে হয় জীবনের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। সাহিত্যিক যে মত প্রকাশ করেন তাকে উঠে আসতে হয় তার অন্তর থেকে স্বতোৎসারিত ঝর্নাধারার মতো। কয়েকজন মানুষ একজোট হয়ে কিছু একটা করে এক ধরনের রাজনীতি করা যেতে পারে। খুব জনসমর্থন পাওয়ায় এক ধরনের সাফল্যও আসতে পারে তা থেকে, কিন্তু সাহিত্যে তার স্থান নেই। সাহিত্যিকের সত্তা কোনো কূপিত অন্তর থেকে উৎসারিত হতে পারে না! শেষবিচারে সাহিত্যিককে প্রতিনিধিত্ব করতে হয় সৎ অন্তঃকরণের!"