আসলে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী, বসতি স্থাপনকারী, আদালত এবং সরকার— এরা সকলে একটাই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করছিল।
Published : 18 Nov 2023, 05:21 PM
আহেদ তামিমি ফিলিস্তিনি মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর বাবা ফিলিস্তিন মুক্তি আন্দোলনের শরিক। বিশ অক্টোবর থেকে তিনি নিখোঁজ আছেন। এদিকে, মাত্র ১৬ বছর বয়সে ইজরায়েলের আগ্রাসনের প্রতিবাদের শাস্তি হিসেবে তামিমিকে তুলে নিয়ে যায় ইসরাইলি সেনা। তামিমিকে অবশ্য বিশ্ব চিনেছে অনেক আগেই। ভাইয়ের গ্রেফতারির সময় তর্জনি তুলে ইজরায়েলি মিলিটারির সঙ্গে বাহাসে জড়িয়ে পড়লে সেই ছবি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। তখন তার বয়স এগারো। এর তিন বছর বাদে পাথর ছোড়ার অপরাধে ইজরায়েলি বাহিনী তাঁর ভাইকে ফের বাড়ি থেকে তুলে নিতে গেলে তাকে এক সেনাকর্তার সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়তে দেখা যায়। জ্ঞান হওয়া ইস্তক প্রিয়জনদের অত্যাচারিত হতে দেখা মেয়েটির সশস্ত্র সেনাকর্তাকে চড় কষাতে হাত কাঁপেনি। দীর্ঘসময় জিজ্ঞাসাবাদের সেলে বসে যখন মূত্রথলি ফেটে যাওয়ার জোগাড়, অথচ তাক করে রাখা ক্যামেরার ভয়ে বাথরুমে যাওয়া যাচ্ছে না, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্বকে সব জানিয়ে দেবে সে। গত ৫ নভেম্বর ইসরাইলি সেনারা তামিমিকে আবারও গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে। এই লেখা তামিমির মতো কয়েক লক্ষ ফিলিস্তিনির সঙ্গে হওয়া চরম অন্যায় আর তামিমিদের দেশপ্রেমের দলিল।
দেনা তাকরুরি এই লেখায় তামিমির সই। দেনা ফিলিস্তানি শরণার্থীর সন্তান। বড় হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বারবার ফিরে গেছেন বাপ মায়ের ভিটেয়। বর্তমানে তিনি AJ+ এ কর্মরত। লিঙ্গনিরপেক্ষতার কারণে They Called me Lioness (২০২২) শিরোনামের সিংহ শব্দটি বেছে নেয়া হয়েছে। বইটি মূলত আহেদ তামিমির বয়ানে রচিত। দেনা তাকরুরি বইটি সম্পাদনায় সহায়তা করেছেন। মূল লেখকের অনুমতি নিয়ে ইংরেজি থেকে পুরো বইটি অনুবাদ করছেন সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক এবং অনুবাদক অর্ক দেব। আজকে বইটির তৃতীয় পর্ব প্রকাশিত হলো। বি. স
যে খেলাই খেলি না কেন, আমার প্রিয় খেলা ছিল (এবং এখনও আছে) ফুটবল। ফুটবল ব্যাপারটা একটা ক্লিশে শৌখিনতার চেয়ে অনেক বড় আমার কাছে। স্বপ্ন ছিল বার্সেলোনার হয়ে পেশাদার ফুটবল খেলা। সত্যিই এটুকু অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম আমি। প্রতিদিন প্র্যাকটিস করতাম, ছুটিছাটায়, টিফিনের বিরতিতেও ফুটবল সঙ্গেই থাকত। ফুটবলের সব খুঁটিনাটি ঠোঁটস্থ ছিল। এমন একজন খেলোয়াড়ও নেই যাঁকে আমি চিনতাম না, এমন একটি ম্যাচও হয়নি যা দেখিনি, এর জন্যে সারারাত জেগে থাকতেও আমার কোনো আপত্তি ছিল না। প্রথম দিকে, মেসি আমার পছন্দের খেলোয়াড় ছিল। কিন্তু নেইমার যখন বার্সেলোনায় যোগ দিলেন, আমার বয়স তখন বারো বছর, আমি অন্যের জন্যে বাজি ধরা বন্ধ করে তাঁকেই জীবনের বিগ্রহ করলাম। আমি ওঁর সবটা ভালবাসতাম— ওঁর দক্ষতা, ওঁর লাবণ্যময় চেহারা, ভুবনভোলানো হাসি ওঁর ব্যাপারে এক ধরনের ভাললাগা অনুভব করতে লাগলাম। 'ক্রাশ' শব্দটা এক্ষেত্রে সম্ভত একটু কমিয়ে বলাই হবে। বলা চলে আমি মোহাবিষ্ট হয়ে গিয়েছিলাম। আমার কম্পিউটার নেইমারের ছবিতে ভরা ছিল। আমার বিছানা লাগোয়া দেওয়ালে মেসির ছবির পাশে আমি তারও একটা ছবি লাগিয়ে দিলাম। ক্রমে, আমি আমার খুড়তুতো বোন জান্নাকেও নেইমারের পাগল ভক্ত বানিয়ে ফেলেছিলাম। নেইমারের জন্মদিনে আমরা ওঁর সম্মানে কেক বেক করেছি, কেকের উপর আলগোছে গোলাপি রঙে ওঁর নাম লিখেছি। আমি ওঁর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম। ওঁর মতো একজন ভাল খেলোয়াড় হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ফিলিস্তিনি শিশু হিসেবে অধীনতার মধ্যে বেঁচে থাকার বাস্তবতা আমার স্বপ্নগুলো কেড়ে নিয়েছিল।
প্রথম শৈশবে আমার মনের উপর ঠাকুমা ফারহা-র প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। তার সাথে আমার বড় হওয়ার দিনগুলিতে বিছানা ভাগ করেছি। কয়েদখানায় ঢোকার আগে পর্যন্ত, ঠাকুমাই ছিল আমার প্রথম এবং একমাত্র কামরাদারির সই। ঠাম্মার বিছানা আমারটার তুলনায় অনেক বেশি নরম আর উষ্ণ থাকত। আমি প্রায়শই দুঃস্বপ্ন দেখার ভান করতাম, কেবল ওর পাশে শুয়ে, ওর ওম গায়ে মেখে ঘুমোব বলেই। টাটা ফারহা, আমার প্রিয়তমা, একজন দানশীলা এবং যত্নশীলা মহিলা। ফারহা সর্বদা নিজের আগে অন্যের চাহিদার কথা ভাবতেন। আমরা যখন বাইরে খেলতাম, তিনি একটা বড় জলের বোতল নিয়ে আমাদের পেছন পেছন ঘুরতেন। প্লাস্টিকের কাপে জল ভরে আমাদের দিকে এগিয়ে দিতেন বারবার যাতে ডিহাইড্রেটেড বা জলশূন্য না হয়ে যাই।
এ যাবৎকালে আমার দেখা সেরা গল্পবলিয়ে ছিলেন তিনিই। ওর সঙ্গে আছি মানে আমি আর আমার ভাইয়েরা রাতে শুতে যাওয়ার সময় গল্প শুনতে পাব। কিন্তু সেসব রূপকথা বা সূদুরের অত্যাশ্চর্য নয়, বা কোনো শ্রুতিমধুর আখ্যান নয়, ঠকুমা আমাদের পরিবারের, আমাদের গাঁয়ের, আমাদের দেশ প্যালেস্টাইনের গল্প বলতেন। বহ গল্পে উঠে আসত নরকযন্ত্রনা আর হৃদয়ভাঙার কাহিনি, যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে আমারই পরিজনদের। প্রতিটা গল্পে শিক্ষার বীজ থাকত। সেসব শুনে আমাদের কল্পনাশক্তিই শুধু বাড়ত না, আমি বুঝতে পারতাম প্রজন্মের পর প্রজন্ম আমাদের ডিএনএ-তে কোন যন্ত্রনা জাঁকিয়ে বসেছে।
টাটা ফারাহ, ঠাকুমার এই নামের আক্ষকির অর্থ ছিল আনন্দ। কিন্তু এইটাই ছিল সবচেয়ে বড় পরিহাস। কারণ জীবন তার থেকে আনন্দ ছিনিয়ে নিয়েছে বারবার। দু'টি সন্তান ছিল তাঁর। আমার বাবা বাশিম আর আমার পিসি, বাবার বড় বোন, বাশিমা। ইজরায়েলের সামরিক আদালতের কক্ষে আমার পিসি বাশিমার মৃত্যু হয়। এই মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৯৩ সাল, আমার বা আমার ভাইয়েদের সবার জন্মের আগে। কিন্তু ঠাম্মা বারংবার এই গল্পটা আমাদের এমন ভাবে বলত, আমার মনে হতে থাকে, আমিও সেখানে ছিলাম। আমার পিসি বাশিমার ছেলেকে ইজরায়েলি সেনা বন্দি করেছিল। তারই বিচারে অংশ নিতে যায় পিসি। এক মহিলা সামরিক অফিসার তাকে আচমকা জোরে ধাক্কা দেয়। সিঁড়ি থেকে নীচে পড়ে যায় পিসি। তার মাথায় গভীর আঘাত লাগে। বেশ কয়েকদিন টানা মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণের পর পিসির মৃত্যু হয়। আমতো বাশিমা, পাঁচ সন্তানের মা, তার দুই মেয়ে, তিন ছেলে-কে মায়ের স্নেহাশিস ছাড়াই বড় হতে হয়েছে। এই সময়টাতে আমার বাবাও জেলেই ছিলেন। ইজরায়েল গোয়েন্দা বিভাগের কর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে এমন অত্যাচার করে, তিনি এক সপ্তাহের বেশি সময় কোমায় ছিলেন।
টাটা ফারাহ-র দুঃখ কতটা ভয়াবহ ভাবুন, তার একমাত্র মেয়ের আকস্মিক মৃত্যু হয়েছে। তার ছেলেও মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে বাধ্য হয়েছে। দুটো ঘটনাই ঘটেছে ইজরায়েলি সেনার সৌজন্যে। আমার বাবার বেঁচে যাওয়াটা একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা। ডাক্তাররাও আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তার বোন আর নেই, এই খবরটাই সম্ভবত তাকে জাগিয়েছিল। কোমা থেকে উঠে সরাসরি তাকে যোগ দিতে যেতে হয়েছিল বোনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়। এই শোক আমার বাবা, আমার ঠাম্মা কেউই কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, ওরা হেরেও যায়নি। ব্যক্তিগত শোক থাকা সত্ত্বেও আমার ঠাম্মা এসব কথা উঠলেই হালকা চালে গল্পের মতো করেই বলত সবটা। আমার বাবা যখন মাথায় ৩৬ টা সেলাই নিয়ে বাড়ি ফিরল, ঠাম্মার নাকি দেখে মনে হয়েছিল ওর দুটো মাথা। একটা মাথা এদিকে, আরেকটা ওদিকে। ঠাম্মা পরেও দু'হাত বেলুনের মতো পাকিয়ে মাথার আকৃতিটা দেখিয়ে আমাদের এই বাবার মাথায় সেলাইয়ের গল্পটা বলত। সঙ্গে সঙ্গে আমি দুই মস্তক-বিশিষ্ট বাবার মুখটা কল্পনা করার চেষ্টা করতাম। ২০১১ সালে ঠাম্মার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার এই সব হাস্যরসাত্মক পরিবেশনা জারি ছিল, কিন্তু তা দিয়ে আজীবন বয়ে আসা দুঃখটা তিনি ঢাকতে পারেননি। ঘুমের মধ্যে আমি তার কান্না শুনেছি। বহুদিন আগে চলে যাওয়া মেয়ে বাশিমার নাম নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছে ঠাকুমা, আমি শুনেছি।
অবশ্য আনন্দময় গল্পও ছিল আমাদের জীবনে। আমার প্রিয় জায়গা ছিল আমাদের গ্রামের ঝরণাটা। এই ঝরণার নাম- আইন আল কোয়াস বা বো স্প্রিং। পাহাড়ের সানুতলে আমাদের মূল রাস্তার ধারে এই ঝরণাটা ছিল। এই ঝরণাই আমাদের আর হালামিশদের আলাদা করেছিল। টাটা ফারহা আমাদের গল্পের ছলে বলতেন, কী ভাবে তার বড় হওয়ার দিনগুলিতে গ্রামের অন্যান্যদের সঙ্গে সে এই ঝরণা থেকে জল ভরে, ভেড়া আর মুরগি নিয়ে পাহাড়ে যেত। ফেরার পথে ফাঁকা জলের পাত্র ফের ভরে নিত। তখন বাড়িগুলিতে জলের আলাদা কুয়ো ছিল না যে। মাটির পাত্রে ভরা ঝরণার জলই ছিল তাদের একমাত্র ভরসা।
আমার ঠাম্মার বর্ণনায়, গ্রামজীবন সে সময় ছিল সরল কিন্তু বর্ণময়। অবশ্য আমার বড় হওয়ার সময়েও ছবিটা এমনই ছিল, অতিরিক্ত বলতে ছিল পরিকাঠামো আর তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি। বেড়ে ওঠার দিনগুলিতে ঝরণার ধারে খেলতে যেতাম আমি। আমি আর আমার তুতো ভাইবোনেরা একে অন্যেকে ঝরণার জলে ভিজিয়ে দিতাম, আমরা খেলে বেড়াতাম জলপাই, ডুমুর আর লেবু গাছের ছায়ায়। এই গোটা জমিটা, এমনকী ঝরণাটাও এক ব্যক্তির মালিকানা ছিল। সেই ব্যক্তির নাম বশির তামিমি। বাবার থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে উনি এই জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু এই উত্তরাধিকারের কোনো মূল্য ছিল না ইজরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের কাছে। পথের কাঁটা উপড়ে ফেলে যত বেশি সম্ভব জমি দখল করাই ছিল ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
২০০৮ সালের মধ্য আমাদের জমির আরও অনেকটা অংশ দখল করে ওরা নিজেদের বসতির চারপাশে ঘিরে ফেলেছিল । ফিলিস্তিনি কৃষকদের তাদের ফসল এবং চারণভূমি থেকে ছিন্নমূল করা হয়েছিল। তাদের জীবিকা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি ইজরায়েল সরকার নয়া বসতিস্থাপনকারীদের সুরক্ষা সুনিশ্চিত করে। এমন আচরণ করে যেন চুরি করে পাওয়া জমিটা যেন ইজরায়েলেরই অংশ। এই সময়ে একটি ইজরায়েলি আদালত এই জায়গা ঘেরার দেওয়াল ভাঙার নির্দেশও দেয়। নির্দেশ এল কিন্তু বসতিস্থাপনকারীদের থামানোর জন্যে কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হলো না। আমাদের প্রিয় আইন আল কোয়াস দখল করে ওরা তার সংস্কার করল। ঝোরার পাশে ছায়াঘেরা জায়গায় বেঞ্চ বসাল। দোলনা লাগাল। এলাকার চারপাশ সাইনবোর্ড বসিয়ে দিল যাতে লেখা- মেয়ার স্প্রিং (হিব্রু শব্দ মেয়ারের অর্থ রক্ষাকারী), আমাদের শতাব্দী-প্রাচীন জলের উৎসের নাম রাতারাতি বদলে গেল। স্পষ্ট বলে রাখা জরুরি, ওরা এই দখলদারি করতে পেরেছিল কারণ ইহুদি সামরিক বাহিনী প্রতিটি পদক্ষেপে ওদের সুরক্ষা দিয়েছিল। আসলে ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী, বসতি স্থাপনকারী, আদালত এবং সরকার— এরা সকলে একটাই ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করছিল।
তারপর থেকে আমাদের এই প্রিয় ঝরণায় যাওয়াটা অ্যাডভেঞ্চারের মতো হয়ে দাঁড়াল। ওখানে প্রবেশ করা মানেই ধরপাকড়, হেনস্থা, শারীরিক নিগ্রহ। এই কাজে অংশ নিত বসতিস্থাপনকারীরা, আর তাদের সুরক্ষা দেওয়ার জন্যে মোতায়েন করা হয় সেনা। কখনও কখনও এই বসতিস্থাপনকারীরা আমাদের দিকে কুকুর ছেড়ে দিত। কখনও আবার অস্ত্র নিয়ে ধেয়ে আসত। আমাদেরই জমি, আমরা পা রাখতে চাইলে বন্দুক তাক করা হচ্ছে আমাদের দিকে! পরিস্থিতিটা আরও প্রতিকূল হয়ে উঠল ক্রমে। দেখা গেল অনেক বসতিস্থাপনকারী উদোম গায়ে স্নান করছে ওই ঝরণায়। আমাদের সংস্কৃতি এই আচরণকে মান্যতা দেয় না। শেষমেশ আমাদের বাবামায়েরা আমাদের আর ওদিকটায় যেতে দিত না। আমাদের গ্রামের সকলে ঝরণাটার জন্য মন খারাপ করত। আমরা চূড়ান্ত হয়রান হয়ে গিয়েছিলাম।
একের পর এক ঘটনা নিরস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনের বীজতলা তৈরি করেছিল। এই আন্দোলনের জন্যেই আমাদের গ্রাম পরে খ্যাতিলাভ করে। আমার বাবা আমার কাকা নাজি (মারাহ-র বাবা) এবং গ্রামের আরও কয়েকজন মানুষ যারা অতীতে সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিল, সকলে মিলে একটা প্রতিরোধ কমিটি গড়ে তুলল। কী ভাবে আমাদের সম্পদ-সম্পত্তির উপর বসতিস্থাপনকারীদের এই গা-জোয়ারি দখলদারি আটকানো যায় তা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল। আলোচনা শুধু আমাদের গ্রামের সম্পদ রক্ষাতেই আটকে থাকল না, ক্রমে কথা হতে লাগল চাপিয়ে দেওয়া আগ্রাসন আর অগণিত অন্যায়ের প্রতিবাদের ধরনধারণ নিয়ে। ওরা সিদ্ধান্ত নিল ওরা টানা পদযাত্রা আয়োজন করবে। পরিকল্পনা হলো জমির অধিকার এবং নিজেদের অস্তিত্বের ব্যাপারে দৃঢ় মনোভাব বোঝাতে ঝরণার চারধারে পুরুষ, মহিল এবং শিশুরা শান্তিপূর্ণ ভাবে মিছিল করবে। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসের একটা শুক্রবার বেছে নেওয়া হলো প্রথম প্রতিবাদের দিন হিসেবে। শুক্রবার আমাদের সপ্তাহের শেষ দিন, ওই দিন মসজিদগুলিতে বিকেলে প্রার্থনা হয়। প্রার্থনা শেষ হতেই সেদিন সবাই মসজিদ থেকে বেরিয়ে জমায়েত করল ওই ঝরণার কাছে, ঝরণাটাকে প্রদক্ষিণ করল।
ন'বছর হতে তখন আমার কয়েক মাস মাত্র বাকি। একদম প্রথম দিনগুলিতেই আমাদের নিরস্ত্র মিছিলগুলিকে ঘিরে যে ভাবে অশান্তি দানা বাঁধছিল, তাতে আমি খানিকটা ভয় পেয়েই বাড়িতে সেঁধিয়ে ছিলাম। খানিকটা যেন স্বস্তিতেই ছিলাম। একদিন সশস্ত্র বসতিস্থাপনকারী আর সামরিক বাহিনী আমাদের গ্রামবাসীরা ঝরণা পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই তাদের দিকে আক্রমণ শানায়। বসতিস্থাপনকারীরা আমাদের পরিজনদের লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়ে মারে। সামরিক বাহিনী টিয়ার গ্যাস ছুঁড়তে থাকে। রবারে মোড়া ইস্পাতের বুলেট ছোড়ে নির্বিচারে। অন্তত পঁচিশজন আহত হয় এই বুলেটের ঘায়ে। বাড়িতে বসে আমি যখন গোলার শব্দ শুনছি, আমার মনে কু ডাক শুরু হয়। আমার বাবা-মা, ওয়ায়েদ, আবু ইয়াজানের সঙ্গেই ঘটছে না তো এই ঘটনাটা! আমি বাড়িতে ছিলাম সালামের সঙ্গে, সালাম তখন মাত্র তিন, কী হচ্ছে কিছুই বোঝার বয়স হয়নি ওর। আমি টাটা ফারাহ-র গায়ে আঠার মতো সেঁটে থাকি। আমাকে শান্ত করে টাটা। সূর্যাস্তের সময় মা-বাবা, ওয়ায়েদ-আবু বাড়িতে ফিরলে দেখতে পাই মা-র দিকে তাক করে ওরা ওই রবারে মোড়া ধাতব বুলেট ছুঁড়েছে। মায়ের আঘাতটা দেখে আমার বিধ্বস্ত লাগছিল। আমি ওদের কাছে হাতজোড় করে বলতে থাকি, আর এই পদযাত্রায় শামিল হওয়ার দরকার নেই। কিন্তু ঠিক তার পরের শুক্রবার, তার পরে প্রত্যেকটি শুক্রবার নবি সালেহর সাধারণ মানুষ, সমব্যথী আন্দোলনকারী, সাংবাদিক, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই প্রতিবাদ মিছিলে জমা হলো। ওরা সবাই মিলে ওই ঝোরাটার দিকে রওনা হলো। আসলে তারা দখলদারদের বুঝিয়ে দিতে চাইছিল, এই দখলদারি তারা মুখ বুজে মেনে নেবে না কিছুতেই। গোটা বিশ্বকে তারা বলতে চাইছিল: ফিলিস্তানিরা ইজয়ায়েলি আগ্রাসনের অধীনস্ত জীবন আর কিছুতেই মেনে নেবে না। ফিলিস্তানের মানুষকে ওরা বোঝাতে চাইছিল— সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা দায়িত্ব, অন্যের আওতাধীন জীবনে প্রতিবাদটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। ক্রমে ইজরায়েলি সামরিকবাহিনীর দমনপীড়নের মাত্রা বাড়তে লাগল। কিন্তু তৃণমূলস্তরে আন্দোলনটার ততদিনে জন্ম হয়ে গিয়েছে। আমরা এটাকে 'লোকপ্রিয় আন্দোলন' বলতাম কারণ জনতা এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিল।
আমার বাবা, গ্রামের অন্যান্যরা লোকজন রাতারাতি এই প্রতিরোধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেনি। বলতে পারি, বছরের পর বছর লড়াইয়ের মধ্যে থাকা, বারংবার পরিকল্পনা করা, বারবার চেষ্টা এবং ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে এই প্রতিরোধের জন্ম হয়েছিল। ওরা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং গান্ধীর জীবনী পাঠ করেছিল। প্যালেস্টাইনের তামাম ইতিহাস ছানবিন করে ওরা দু'টি স্বতন্ত্র মুহূর্ত চিহ্নিত করেছিল যে সময়ে স্বেচ্ছায় জনতা এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে একদম তৃণমূল স্তরে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। প্রথমটি ছিল ১৯৩৬ সালের আরব সাধারণ ধর্মঘট। দীর্ঘকাল ধরে ফিলিস্তিনি শাসন করে আসছে যে ব্রিটিশ অধ্যাদেশ, তার প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা দেশব্যাপী ধর্মঘট শুরু করে। বহু ব্রিটিশ নীতি— বিশেষত ইউরোপ থেকে প্যালেস্টাইনে সীমাহীন ইহুদি অভিবাসন নীতির বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ সংঘটিত হয়। উল্লেখ্য প্যালেস্টাইন ইহুদিদের স্থায়ী বসতিস্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ব্রিটেন। স্বাভাবিক ভাবেই অভিবাসীদের সংখ্যাধিক্য দেখে বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা করেছিল ফিলিস্তিনিরা। প্যালেস্টাইনকে যে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা চলছে, তা আর গোপন থাকেনি। তিন বছর এই ধর্মঘট চলেছিল। তবে শেষমেষ ব্রিটিশ সমরশক্তি আর রাজনৈতিক ক্ষমতার মোকাবিলা করতে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়।
ব্রিটিশ বাহিনীর আক্রমণে শয়ে শয়ে ফিলিস্তানি মারা যায়।
আমাদের জোট বাঁধার দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটেছিল ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম অভ্যুত্থান বা প্রথম ইন্তিফাদার সময়ে, যার জন্ম ১৯৮৭ সালে। গাজার শরণার্থী শিবিরে একটা ইজরায়েলি সামরিক ট্রাক চার ফিলিস্তিনি শ্রমিককে হত্যা করার পর ইন্তিফাদা শুরু হয়। সেই স্ফুলিঙ্গই ইজরায়েলের এই দশকের পর দশকব্যাপী নৃশংসতার বিরুদ্ধে, লাগাতার ফিলিস্তিনি ভূমি দখল আর উপনিবেশ বিস্তারের বিপক্ষে সব ফিলিস্তিনিদের সর্বত্রগামী প্রতিবাদ। এই অভ্যুত্থান ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। বয়কট, ধর্মঘট, ইজরায়েলিদের ট্যাক্স দেওয়া বন্ধ করা, মিছিল করা, পাথর ছোড়া—সবই ঘটছিল। ইজরায়েলি বাহিনী প্রত্যুত্তরে প্রতিবাদকারীদের মারধর করে, হত্যা করে, এক বছরের জন্য স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেয়। সপ্তাহের পর সপ্তাহব্যাপী কারফিউ চলতে থাকে। অবদমিত ফিলিস্তিনিরা একত্রিত হয়েছিল সৈন্যের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে। কারফিউ চলাকালীন ওরা পরস্পরকে খাবার দিত, কার্ফুর মধ্যেও সন্তানদের আন্ডারগ্রাউন্ড স্কুলে পড়াত। ইজরায়েলিদের প্রবল সামরিক শক্তি ছিল কিন্তু তারা এই বিদ্রোহ দমন করতে পারেনি।
১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ইন্তিফাদা শেষ হয়। ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের নেতৃত্বর মধ্যে এই শান্তি চুক্তি সাক্ষরের ব্যাপারে (প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন, বা PLO) মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় ছিল আমেরিকা। অসলো— চুক্তি হিসাবে এর ব্যাপারে সংক্ষেপে বলা যায়, ইজরায়েল আনুষ্ঠানিকভাবে পিএলও-কে ফিলিস্তানি জনতার প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। বিনিময়ে পিএলও ইজরায়েলের অস্তিত্বরক্ষার অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়। একটি দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান খোঁজাই ছিল এই চুক্তির মূল কথা। কিন্তু ফল যা দাঁড়াল তাতে ফিলিস্তিনিদের জমি আর অধিকার— দুইই নাগাড়ে কেড়ে নেওয়া হতে লাগল।
অসলো একই সঙ্গে প্যালেস্টাইন অথরিটি বা পিএ-এর জন্ম দিয়েছিল। স্থির হয় একটা অন্তর্বতীকালীন প্রশাসন কাজ করবে ঠিক ততদিন যতদিন না একটা পাকাপাকি সমঝোতা হয়। কিন্তু এই সমঝোতা কখনও হয়নি। পিএ ক্রমে ইজরায়েলের ঠিকাদারে পরিণত হয়েছিল। তার কাজ ছিল নিরাপত্তা সমন্বয়ের দায়িত্বপালন, জবরদখলের হিসেব রাখা, যে দায় আন্তর্জাতির আইন অনুসারে ইজরায়েলের নেওয়া উচিত। আমার বাবা বহু ফিলিস্তিনির মতোই পিএ-তে কাজ করেছেন কিন্তু সবসময় এই অসলোকে একটা সচেতন সর্বনাশ (নাকবা) বলেছেন।
আমার জন্মের কয়েক মাস আগে, ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে কয়েক মাস ধরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদা শুরু হয়। তবে প্রথম বিদ্রোহের উল্টোপথে হেঁটে, এই আন্দোলনে শামিল মানুষ শেষ পর্যন্ত অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। এরিয়েল শ্যারন, ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কিছুদিন আগে, অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমে আল-আকসা মসজিদ কম্পাউন্ডের হাজার হাজার সশস্ত্র পুলিশ অফিসার পাঠালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল। ইসলাম অনুযায়ী, আল-আকসা তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। শ্যারনের এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উস্কানিমূলক পদক্ষেপ বুঝিয়ে দিচ্ছিল, জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনি রাজধানী ঘোষণা করার ব্যাপারে আলাপ চলছে জেনেও গায়ের জোরে পুরো জেরুজালেমের ওপর ইজরায়েলি দখলদারি এক মুহূর্তে সুনিশ্চিত করতে চায় ওরা।
এই উস্কানির আগেই অবশ্য, যে ভাবে ইজরায়েল বারবার অসলো চুক্তি লঙ্ঘন করেছে তাতে সাধারণ ফিলিস্তিনির, সে মুসলিম হোক বা খ্রিস্টান, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল। কোনো ভাবেই প্যালেস্টাইনের অস্তিত্ব এই চুক্তি অক্ষুণ্ন রাখবে না, বোঝা হয়ে গিয়েছিল ততদিনে। অসলো চুক্তি স্বাধীন প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের বাস্তবায়ন ঘটাবে না, এ কথাও বোঝা হয়ে গিয়েছিল। বরং, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৯৯৩ থেকে ২০০০-এর মধ্যে ইজরায়েলি বসতিস্থাপনকারীদের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছিল। বলা চলে, সর্বোচ্চ জবরদখল এই সময়খণ্ডেই হয়েছে।
প্রথম দিনগুলিতে বিক্ষোভ ছিল নিরস্ত্র। কিন্তু দেখা গেল, ইজরায়েল সামরিক বাহিনী প্রচুর সংখ্যক সেনা, রবার বুলেট, গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের বিক্ষোভ ভেস্তে দিতে প্রস্তুত। একই সঙ্গে ঘনজনবসতিপূর্ণ এলাকায় হেলিকপ্টার, ট্যাঙ্ক-সহ মিলিটারি অনুপ্রবেশও ঘটতে লাগল। ফলে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ ক্রমেই সশস্ত্র বিদ্রোহের আকার নিল। ইজরায়েলি সেনা আর সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যেতে লাগল আত্মঘাতী বোমা গায়ে জড়ানো মানুষ। আমার বাবা মা-সহ বহু ফিলিস্তিনি-ই প্রতিবাদের এই ধারাটা মেনে নিতে পারেনি।
কিন্তু দ্বিতীয় ইন্তিফাদার দিনগুলিতে এই প্রতিরোধের সমান্তরাল, একটা নিরস্ত্র ধারাও দেখা গিয়েছিল। এই ধারার ফল হিসেবেই কয়েক বছর পরেই নবী সালেহতে লাগাতার জনসমাবেশ দেখা যাবে। ২০২২ সালে ইজরায়েল নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে একটা বিরাট দেওয়াল তুলতে লাগল যা দখলদার ইজরায়েলি আর ফিলিস্তিনিদের বিচ্ছিন্ন করবে। ফিলিস্তিনিরা এটাকে বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত হিসেবেই দেখেছিল কারণ স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল এই দেওয়াল দখলদারদের কবলে থাকা ওয়েস্টব্যাঙ্কের বাসিন্দা সাধারণ ফিলিস্তানি এবং ইজরায়েলিদের তো আলাদা করবেই, এমনকী পূর্ব জেরুজালেম আর ওয়েস্টব্যাঙ্কে বসবাসকারী ইজরায়েলি বসতির মধ্যেও প্রাচীর হিসেবে কাজ করবে। কয়েকশো মাইল লম্বা ছিল এই দেওয়াল। ১৫ ফুট লম্বা কংক্রিটের চাই জুড়ে জুড়ে এই দেওয়াল বানানো হয়েছিল। এই পর্যন্ত পড়ে কারও যদি মনে হয় অভিযোগ তত গুরুতর নয়, তবে তাদের জন্যে এই তথ্যও রাখা থাক যে, ১৯৬৭ সালে আন্তর্জাতিক ভাবে যে সীমানাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল সেই সীমানা বরাবর এই দেওয়াল তোলা হয়নি। বরং দেওয়াল তোলা হয় ফিলিস্তিনিদের জমিতে, ওয়েস্টব্যাঙ্কের ভিতরে। তার মানে খুব বুঝেশুনে আমাদের আরও বেশি জমি কেড়ে নিতেই, আমাদের গ্রামটাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাই ছিল উদ্দেশ্য।
বুদ্রাসের মতো বেশ কয়েকটি ছোট গ্রামের ক্ষেত্রে ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল, দেওয়ালের যে পরিকল্পনা তার ফলে ওয়েস্ট ল্যান্ডের থেকে বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছিল। ফলে সেখানকার বাসিন্দারা এর বিরুদ্ধে সংগঠিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ইজরায়েল যখন পথ পরিস্কার করতে বুলডোজার দিয়ে তাদের মূল্যবান জলপাই গাছ উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন তারা নিজেদের শরীর ব্যবহার করা শুরু করে। বুলডোজারের সামনে বুক পেতে দেয়। তাদের সঙ্গে সাপ্তাহিক অহিংস বিক্ষোভে বহু ইজরায়েলি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংহতি-কর্মীরা যোগ দিয়েছিল। গ্রামবাসীরা পুরোপুরি অহিংস প্রতিবাদের কৌশল অবলম্বন করে। কিন্তু ইজরায়েলি সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া যেমন হওয়ার তেমনই হলো। সেনাকর্মীরা নিয়মিত বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে রাবার বুলেট, কাঁদানে গ্যাস এমনকী গুলিগোলাও ছুঁড়তে লাগল। বহু বিক্ষোভকারী আহত হলেন। বহু বিক্ষোভকারীকে মারধর ও গ্রেফতার করা হলো। কিন্তু এতদসত্ত্বেও বুদ্রাসের লোকেরা সফল হয়েছিল। ইজরায়েলি সরকার তাদের দেওয়ালটির জন্য পরিকল্পনা করল। জমিহাঙর ইজরায়েলের থেকে বুদ্রাসের লোকেরা সেদিন নিজেদের জলপাইগাছ আর প্রায় সমস্ত জমি রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল। এই জয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। অন্যান্য গ্রাম এই পথ অবলম্বন করতে লাগল। কোথাও কোথাও মামলায় তাদের জয়ও হলো। আমার বাবা ও অন্যান্য আত্মীয়রা এই অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই প্রতিরোধে অংশ নেন। তৃণমূল স্তরের প্রচেষ্টায় ততদিনে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে, সশস্ত্র সংগ্রামের তুলনায় জনবিক্ষোভে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেশি। আর এই ঘরানাই বিশ্বের সামনে প্যালেস্টাইন দেশটার এবং ফিলিস্তিনিদের সঠিক প্রতিচ্ছবি তুলে ধরতে পারে। পশ্চিমে আমাদের ভয়াবহ জঙ্গি হিসেবে যে ভাবে তুলে ধরা হয়, সেই গতবাঁধা চিন্তাকে ঠিক উল্টোমেরুতে ছিল এই আন্দোলন।
সেই কারণেই ক্রমেই তারা নবী সালেহ-র ক্ষেত্রে জনপ্রতিরোধ মডেলে জোর দিতে লাগলেন। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে নিয়মকানুনে তারা বদল আনলেন নিজেদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করেই। তার মধ্যে প্রথমটাই হলো আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো। এই ঘটনা আসলে আমাদের ফিলিস্তিনি সংস্কৃতিতে মহিলাদের চিরাচরিত গুরুত্বের দিকটাই প্রতিফলিত করে। আগে, দেওয়াল তোলার বিরুদ্ধে গ্রাম্য প্রতিবাদগুলিতে মেয়েদের তেমন দেখা যেত না, অন্তত যতজন থাকা উচিত ততজনকে দেখা যেত না। প্রথম ইন্তিফাদার সময়ে বিরাট মহিলা সমাগম চোখে পড়েনি কোথাও। সৌভাগ্যবশত আমাদে নবী সালেহ লিঙ্গসাম্যে বিশ্বাসী ছিল প্রথম থেকেই। আমরা ছোটরা একসঙ্গে খেলাধুলো করেছি। কোথাও কোনো লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য চোখে পড়েনি। আমরা যত বড় হয়েছি ততই পারস্পরিক সহযোগিতার গুরুত্ব বুঝেছি। এর ফলে আমাদের লক্ষ্যের দিকে এগোতে আরও সুবিধেই হয়েছে। মহিলারা (আমার মা, আমার কাকিমা আমতো মানাল-সহ) আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠেছে।
আরেকটি ব্যাপার নিয়ে আমার বাবা-মা ও আমার গ্রামের অন্যান্য বড়রা মাথা ঘামিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, দেওয়াল তোলা বন্ধ করার থেকেও আধিপত্যের গোড়াটা উপড়ে ফেলতে কৌশল নেওয়া জরুরি। সমস্ত ফিলিস্তিনি অনুসরণ করবে এমন একটা পরিকল্পনার খোঁজ জরুরি। তারা অচিরেই বুঝেছিল, দেওয়ালটা মূল সমস্যা না, অলিভ গাছ কেটে ফেলাটা মূল সমস্যা না, হঠাৎ করে বসতি স্থাপন, এমনকী ঝোরা দখলটাও মূল সমস্যা নয়। এগুলি সবই উপসর্গ। মূল সমস্যাটা ছিল ইজরায়েলের বসতি প্রকল্প, যার মধ্যে ছিল— আমাদের জমি চুরি, আমাদের জমিতে গায়ের জোরে দখলদারি, আমাদের নিয়ন্ত্রণ, আমাদের সমূলে নিকেশ করা (এথনিক ক্লেনজিং)। মূল রোগটা ছিল সাম্রাজ্যবাদ। ফলে এই আধিপত্যের অবিচারটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরাটা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য হয়ে ওঠে।
আমরা মোটের উপর এই অভিমুখে রওনা হতে চাইছিলাম। আামাদের আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল মানবিক সাম্য, ন্যায়বিচার আর অন্তর্ভুক্তি। আমার বাবা-মা তো বটেই, এই প্রতিরোধের সব নেতারাই বুঝতে পেরেছিলেন এই আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যেতে হলে আমাদের গ্রামের প্রত্যেকের মধ্যে সচেতনতার বীজ বুনতে হব। যারা দলে যোগ দিতে চায় তাদের বোঝাতে হবে নিবিড় ভাবে। ওরা বিশ্বাস করত বিপ্লবের প্রথম নিয়মটাই হলো সচেতনতা। শুধু মাত্র লড়াই বা প্রতিবাদের প্রস্তুতি নিলেই হবে না। নানারকম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং ক্লাসের আয়োজন করে ওরা আসলে মানুষের মধ্যে বোঝাপড়াটা বাড়াতে লাগল। ইজরায়েল দ্বারা বাজেয়াপ্ত হওয়া জমিতে আমরা জলপাই গাছ লাগালাম। ওই ঝোরাটার চারধারে জলপাই গাছ লাগিয়ে দেওয়া হল। আমরা ইজরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক দিলাম। কাজের অভাব বলে যারা ইজরায়েলি বসতিতে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে যেত, তাদেরও আমরা না যাওয়ার জন্যে অনুরোধ করতে লাগলাম। আমরা গর্বিত ছিলাম কারণ আমাদের গ্রাম নবী সালেহ-র কেউ ওই জবরদখলি জমিতে কাজের খোঁজে যেত না।
বিক্ষোভ প্রদর্শনের শর্তাবলী কী হবে, তা নিয়ে একমত হওয়াটা আমাদের জন্যে অত্যন্ত জরুরি ছিল। আমাদের প্রতিরোধের মূল কথাই ছিল, আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নেব না। আমরা কাউকে আঘাত না করে, হত্যা না করে সংগ্রাম চালিয়ে নিয়ে যাব। আমাদের বিরোধীরা বলবে, কই তোমাদের তরুণতরুণীরা তো পাথর ছুঁড়েছে, তোমরা তো তোমাদের বানানো শর্তই লঙ্ঘন করেছ। আমাদের মত ছিল, পাথর কোনো অস্ত্র নয়। আমাদের পুরাণ এবং মিথ অনুযায়ী, পাথর প্রতিরক্ষার প্রতীক। একজন ফিলিস্তিনি যদি নিজের জমিতে কোনো বনশূকর বা সাপের মুখোমুখি পড়ে, সে তখনই নিজেকে রক্ষা করার জন্যে আশেপাশে পাথরের অনুসন্ধান করবে। প্রাথমিক ভাবে প্রাণীটিকে মারার কথা সে ভাববে না।
আমাদের জমিতে অনুপ্রবেশকারী সশস্ত্র ইজরায়েলি সেনার চরিত্রটাও ভাবতে হবে। তাদের পোশাক বুলেটপ্রুফ, যে সাঁজোয়া গাড়িতে সে চড়ছে, একটা পাথর তার কোনো ক্ষতিই আপাত ভাবে করবে না। ফলে পাথরটা আমাদের প্রতীক ছিল, একথায় যুক্তির অভাব নেই। যে শত্রুপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাচ্ছে, আমরা তাকে প্রত্যাখান করছি, আমাদের এই চিন্তাই আমরা প্রতিফলিত করতে চেয়েছি। অহিংসা মানে কিন্তু ভাগ্যে সমর্পিত হয়ে ভূপতিত হওয়া নয়। আমাদের জমি রক্ষায় আমাদের প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিতে হবে, আমরা বুঝেছিলাম। একজন ভাগ্যহত নয়, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে লড়ার ব্যাপারে পাথরের টুকরো আমাদের সাহায্য করেছিল।
এই সব আদর্শে সওয়ার হয়ে নবী সালেহর প্রতিরোধ-যাত্রা শুরু হলো। আমার বাবার স্বপ্ন ছিল আমাদের প্রতিরোধের মডেল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের অন্যান্য গ্রাম-নগরেও অনুসরণ করা হবে। যদি তৃতীয় ইন্তিফাদার কথা বলি, মানতেই হবে তার জন্মভূমি আমাদের গ্রাম, নবী সালেহ।
(চলবে)