তখন আমি ছিলাম এক ছাব্বিশ বছরের যুবক। যে যুবক হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়-র পংক্তিমালার মতো ভাবতে পারতো: 'এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,/এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়'। কিন্তু আজ সেই মিছিলের, সেই যুদ্ধের, সেই বিজয়ের একান্ন বছর পর যে ফিরে দেখা, তা সত্যি বলতে কি এতো রোমাঞ্চকর, এতোই ঘটনাবহুল, এতোই উত্তেজনাকর যে সেই মিছিলে, সেই যুদ্ধে আপন ভূমিকাকে নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় বোধহয়। যুক্তি আবেগকে হার মানাতে পারবে না কোনক্রমে--আমি নিশ্চিত।
আজ যখন শুনি কোনো সাক্ষাৎকারে এক বীরাঙ্গনা বলছেন তাকে জনৈক তরুণ ব্যাঙ্গ করে বলেছে, ‘খালা, কোন কালে কী এক যুদ্ধ করছিলেন সেটা জানতে আপনার কাছে ঢাকা থেকে এখনও সাংবাদিকরা আসে!’ তখন ভাবি এই তরুণও তো যুবক এখন, তার কি যোগ দেবার মতো কোনও মিছিল, কোনও যুদ্ধ নেই? সে কি সেই মিছিলে যোগ দিতে পারে না যে মিছিল মানুষকে মানুষ হবার শিক্ষা দিতে পারে, জাগতিক স্বার্থপরতাকে বিসর্জন দিয়ে একটি স্বাধীন দেশের সৎ-সাহসী নাগরিক হবার স্লোগান দিতে পারে? সে কি একজন হ্যামলেটের মতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বে সময় নষ্ট না করে সেই যুদ্ধে যেতে পারে না যে যুদ্ধ ন্যায় ও সততার পক্ষে জেহাদ ঘোষণা করতে পারে?
আমরা যারা ষাটের দশকের প্রজন্ম আমাদের অন্তরের গভীরে যে প্রতিবাদের প্রবণতা প্রস্তুত হয়েছিল তার পেছনে আসলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের পরগাছাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা কাজ করেছে। সত্যি বলতে কি এজন্য পরোক্ষভাবে তাদের ধন্যবাদ পাবার অধিকার আছে! তারা যদি আমাদের সাথে ওভাবে আচরণ না করতো আমাদের কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যেত উপলব্ধি করতে। তারা আমাদেরকে যে পাকিস্তানি ইসলামি জাতীয়তাবাদের অলীক স্বপ্ন দেখিয়েছে সেটা ছিল মূলত এদেশটাকে পরিকল্পিতভাবে শোষণ করার একটা প্রতিক্রিয়াশীল নীলনকশা। আমরা যেসব তরুণ তরুণীরা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতাম তারা কিন্তু অজান্তেই ওই হেলাল হাফিজের নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়-র পঙক্তিমালার জীবনচেতনাতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলাম আর তাই যেমন মার্কিন পুঁজিবাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলাম তেমনি তাদের কোরিয়া, ভিয়েতনামের যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিলে সামিল হয়েছিলাম। আমরা যেমন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষাতে স্লোগান দিয়ে প্রাণ দিতে দ্বিধা করিনি, তেমনি বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যে যুদ্ধ করতেও পিছপা হইনি। চার্লস ডিকেন্স-এর মতো করে বলতেই পারি "It was the best of times, it was the worst of times.” এবং আমরা "the best of times”-এর খোঁজে পথ হাঁটতে বিন্দুমাত্র ভয় পাইনি।
উনিশ শ' একাত্তুরে আমরা মিছিলে মিছিলে ভরিয়ে দিয়েছিলাম সারা দেশের অলিগলি। তখন কারো সাথে কারো দ্বিমত ছিল না আমাদের চাওয়া পাওয়ার। সবারই এক মিছিল, এক স্লোগান, এক সংগ্রাম। আর সত্যি বলতে কি এই বিজয়ের মূল চালিকাশক্তিই ছিল ওই ঐক্যমত। কিছু রাজনৈতিক চরমপন্থি এই আন্দোলনের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছিল মনে পড়ে, কিন্ত সে দুর্বল ব্যাখ্যা আমাদের মিছিলে, স্লোগানে, সংগ্রামে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল আপনাআপনি। তারাই পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুফল ভোগ করেছে, এবং করেছে সবচাইতে বেশি।
আজ যখন এই বিজয়ের দিনে ফিরে তাকাই তখন স্পষ্ট, স্বচ্ছ হয়, আমরা মিছিলে গিয়ে, স্লোগান দিয়ে, যুদ্ধ করে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে, শ্রেষ্ঠ কাজটিই করেছি, শ্রেষ্ঠ অর্জনটিই করেছি। আজ একথা স্পষ্ট হয়েছে পাকিস্তানের অর্থনীতির সিংহভাগ আমাদের উপরই নির্ভরশীল ছিল। নইলে আজ তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এত নাজুক কেন? আজ আমরা, সেই আমরা, যাদের সংজ্ঞায়িত করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার 'বটমলেস বাস্কেট' বলে, যে কিসিঞ্জার ছিল অখন্ড পাকিস্তানের ধ্বজাধারী, তার সকল অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশ পাকিস্তান এবং এমন কি ভারতের চাইতে এক শক্ত, নির্ভরযোগ্য উচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশ রূপে যখন স্বীকৃত, তখন তো ভাবতেই পারি আমরা মিছিলে সামিল হয়ে, যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি করে সঠিক কাজটাই করেছি। আজ এই বিজয়ের দিনে বাংলার সব যুবককে উদাত্ত আহবান: এখন যৌবন যার দেশকে অনেক দেবার তার শ্রেষ্ঠ সময়,/এখন যৌবন যার অন্যায়ের প্রতিবাদ করারা তার শ্রেষ্ঠ সময়'।